আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম - শ্রীপাদ প্রভাবিষ্ণু দাস

আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম শ্রীপাদ প্রভাবিষ্ণু দাস


ছেলেবেলায় মা আমাকে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন, কিন্তু আমি ওসব কিছুই শুনতাম না। তখনকার সময়টাতে উত্তর আমেরিকার খুব বেশি ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিল না সমাজে। অনবরত দ্বন্দ্ব-লড়াই লেগে থাকত রোম্যান আর ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের মধ্যে। আমার বন্ধুবান্ধবেরাও ওসব মোটেই পছন্দ করত না। তাই আমাদের দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে যেতে হয়েছিল সপরিবারে, কারণ চারিদিকে বিষম মারপিট দাঙ্গা চলছিল।
ইংল্যান্ডে এসেই আমি হরেকৃষ্ণ ভক্তদের সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম। 'ব্যাক টু গডহেড' নামে একখানি ইংরেজি সুদৃশ্য ম্যাগাজিন পেয়েছিলাম এবং একজন ভক্ত আমাকে একখানি কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রন্থ পড়তে দিয়েছিল কিছুদিনের জন্য।
এছাড়া লন্ডন শহরে প্রায়ই আমি হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রের কীর্তন গান বাজনা শোনবার জন্য সুযোগ পেতাম। এইভাবে পত্রিকা আর গ্রন্থের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণভাবনার সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল এবং ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় হরেকৃষ্ণ সংকীর্তন দলের কীর্তন গানবাজনা শুনে আমার বড় ভালো লাগত।
এর আগে অবশ্য কানাডায় থাকাকালীন আমি আমার এক আত্মীয়ের কাছে কৃষ্ণভাবনামৃত সম্পর্কিত কিছু পত্র-পত্রিকা এবং গ্রন্থাদি দেখেছিলাম', এবং সেই সব থেকে হরেকৃষ্ণ আন্দোলন সম্পর্কে বেশ কৌতূহল জেগে উঠেছিল মনের মধ্যে।
ঐ আত্মীয় বন্ধুটি আমাকে একখানি ভগবদ্গীতা দিয়েছিল। সেটি মাঝে মাঝে পড়তাম এবং নতুন চিন্তাধারার পরিচয় পেতাম।
পরে নিউ ইয়র্কে আবার আমরা ফিরে আসি। তখন ইসকনের সংকীর্তন গোষ্ঠীতে যোগ দিতে শুরু করে দিই। সংকীর্তন গোষ্ঠীর সাথে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম আর সমস্বরে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করে সকলকে শোনাতাম। ভক্তদের প্রাণচাঞ্চল্য দেখে আমার ভারি ভাল লাগত এবং বিশেষ মনোযোগ সহকারে তাদের সমস্ত কার্যকলাপ লক্ষ্য করতাম।
'ব্যাক টু গডহেড' পত্রিকার আরও কিছু সংখ্যা ক্রমে আমার হাতে আসে এবং মন্দিরের বাইরে শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ শুরু করে দিই।
লন্ডনে যখন শ্রীল প্রভুপাদ এসেছিলেন, তখন আমি তাঁর সান্নিধ্য লাভের দুর্লভ সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার পরম সৌভাগ্য যে, তিনি আমাকে জীবনের সার্থক পথ প্রদর্শন করেছিলেন।
ইংল্যান্ডে শ্রীল প্রভুপাদ বহুবার আসতেন এবং সংকীর্তন প্রচার অনুষ্ঠানে তিনি প্রত্যক্ষভাবে আমাদের আকৃষ্ট করতেন। শ্রীল প্রভুপাদ স্বয়ং আমাকে সংকীর্তন প্রচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
সেখান থেকে শ্রীল প্রভুপাদের আদেশে আমি ভারতে আসি এবং মুম্বাই শহরের ইসকন মন্দিরে সহকারী অধ্যক্ষরূপে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বভার পেয়েছিলাম। সেই সাথে কলেজে এবং ইউনিভার্সিটিতে কৃষ্ণভাবনাময় গ্রন্থাবলী ও পত্রপত্রিকা পরিবেশন করতে শুরু করেছিলেন।
তারপরে শ্রীল প্রভুপাদের নির্দেশে আসামে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে গিয়েছিলাম এবং ক্রমে সারা ভারতে ঘুরেছিলাম প্রচার পর্যটনের দায়িত্ব পেয়ে। নানা শহরে গিয়েছি-- শ্রীল প্রভুপাদের সান্নিধ্য লাভ করেছি এবং তাঁর কাছ থেকে প্রচুর উৎসাহ উদ্দীপনা পেয়েছি। নেপালে আমি কৃষ্ণগ্রন্থ বিতরণ করেছি। কয়েকমাস বাংলাদেশেও কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করেছি। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সে দেশে দ্বন্দ্বভাব থাকা সত্ত্বেও সেখানে আমরা মন্দির গড়েতে পেরেছিলাম।
আমি ১৯৫০ সালের ৪ অক্টোবর উত্তর আমেরিকায় জন্মেছিলাম এবং ২০ বছর বয়সে ইসকনে যোগদানের সুযোগ লাভ করেছি। প্রথম হরিনাম দীক্ষা পাই ১৯৭১ সালে ফ্রান্সে, দ্বিতীয় ব্রাহ্মণ দীক্ষা গ্রহণ করি ১৯৭২ সালে লন্ডনে এবং শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজের কৃপায় সন্ন্যাস দীক্ষা পেয়েছি ১৯৭৯ সালে শ্রীধাম মায়াপুরে।
আমি আমেরিকায় পাবলিক স্কুলে পড়াশুনা করবার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করি।
অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, লাতভিয়া, বিহার, উড়িষ্যা- বহু জায়গায় আমি কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করবার সুযোগ পেয়েছি। আয়ার্ল্যান্ডে প্রথম পর্যায়ে শ্রীল প্রভুপাদের নির্দেশে ইসকনের মন্দির নির্মাণ এবং প্যারিসে মন্দির নির্মাণে সহযোগিতার সুযোগ পেয়েছিলাম। শ্রীল প্রভুপাদ এই মহানব্রত সাধনে আমাকে সদাসর্বদা আলোকবর্তিকা প্রদর্শন করেছেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী সার্থক করে সারা বিশ্বে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র প্রচার এবং বৈদিক সাম্যবাদ প্রসারের গুরুদায়িত্ব পালনে শ্রীল প্রভুপাদই আমাদের অসামান্য সাহস জুগিয়েছেন। তিনিই যথার্থ যোগ্য ব্যক্তি, আর আমরা কেবল তাঁর পথ নির্দেশ মেনে চলেছি মাত্র।
এই বিশ্বব্যাপী হরেকৃষ্ণ আন্দোলন প্রচারের উদ্দেশ্যে আমি ইংরেজি ভাষা ছাড়াও, জার্মান ও ফরাসী ভাষা শিখেছি। বাংলা শিখেছি, এখন হিন্দি শিখছি।
আমি মনে করি, শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থাবলী নিয়মিত সকলেরই পাঠ করা একান্ত উচিত। তাহলে বর্তমান বিভ্রান্ত কলিযুগে মানুষের যথার্থ কর্তব্যবোধ সম্বন্ধে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া সম্ভব হবে।
বিঃদ্রঃ মহারাজ স্ব-ইচ্ছায় তিনি তাঁর সন্ন্যাসী পদ ত্যাগ করেছেন। একারণেই তার নামের শেষে এখন দাস যুক্ত। 'শ্রীপাদ প্রভাবিষ্ণু দাস'

Post a Comment

0 Comments