যার যতই ঐশ্বর্য্য (ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা) থাকুক না কেন, তা যদি তিনি কাউকে দেখাতে না পারেন, কাউকে দান করতে না পারেন, সে ঐশ্বর্য্য যদি কারো কাজে না লাগে, কেউ যদি সে সম্পর্কে তাঁকে প্রশংসা না করেন, তাহলে কি তিনি প্রকৃত তৃপ্তি পাবেন? অবশ্যই না। কেউ যতই শক্তিশালী হোন না কেন, তা যদি তিনি কাউকে দেখাতে না পারেন, কেউ যদি সে শক্তিমত্তার পরিচয় না পায়, সে শক্তি যদি কারও কাজে না লাগে এবং সে সম্পর্কে তাঁকে প্রশংসা না করেন , তাহলে কি তিনি সত্যিই আনন্দিত হবেন? অবশ্যই না। এমনিভাবে কেউ যতই সুন্দর - সুশ্রী বা সুন্দরী দেখতে হোন না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য কেউ তাঁর রূপের প্রশংসা না করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি প্রকৃত আনন্দ পাবেন না। অর্থাৎ কেউ যতই গুণবান হোন না কেন, যখন অন্য কেউ সেই গুণের প্রশংসা করবেন তখনই তিনি প্রকৃত আনন্দ পাবেন। ঠিক এই কারণেই সচ্চিদানন্দময় সর্বশক্তিমান ভগবান নিজেই প্রথমে নিজেকে শ্রীমতি রাধারাণীরূপে সৃষ্টি করলেন এবং উভয়ে এক অপ্রাকৃত আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন। পরবর্তীতে উভয়ে মিলে সৃষ্টির নব নব আনন্দ আস্বাদনের জন্য একে একে অন্যান্য সকল প্রাণী তথা সমগ্র সৃষ্টিজগৎ রচনা করেন।
গীতায় ভগবান বলেছেন, "সপ্ত মহর্ষি, তাঁদের পূর্বজাত সনকাদি চার কুমার ও চতুর্দশ মনু, সকলেই আমার মন থেকে উৎপন্ন হয়ে আমা হতে জন্মগ্রহণ করেছে এবং এই জগতের স্থাবর-জঙ্গম আদি সমস্ত প্রজা তাঁরাই সৃষ্টি করেছেন" (গীতা-১০/৭)। সৃষ্টির আদিতে একজনই আছেন বিধায় সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড একটি সুনির্দিস্ট নিয়মেই চলছে। এক্ষেত্রে একাধিক ভগবান থাকার বা হওয়ার কোন সুযোগই নেই। পিতা যেমন একাধিক হতে পারে না, তেমনি পরমপিতাও একাধিক হতে পারে না । ব্রহ্মা, বিষ্ণু , মহেশ্বর (শিব) সকলেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই বিভিন্ন প্রকাশ এবং যত অবতার তাঁরই অংশপ্রকাশ। এছাড়া বিভিন্ন দেব-দেবী, মহাত্মা-ঋষি, এমনকি মানুষ, (আপনি- আমি),পশু, পাখি, কীট-পতঙ্গ সকলেই তাঁরই অনন্ত গুণ বা শক্তির অংশ মাত্র। প্রত্যেকেই তাঁদের নিজ নিজ কর্তব্য কর্মে নিয়োজিত থাকার মাধ্যমে তাঁরই ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছেন মাত্র !!! শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান। সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর দেহে ধারণ করে আছেন। তাইতো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন-
" হে অর্জুন ! আমার এই বিরাট শরীরে একত্রে অবস্থিত সমগ্র স্থাবর-জঙ্গমাত্মক বিশ্ব এবং অন্য যা কিছু দেখতে ইচ্ছা কর, তা এক্ষণে দর্শন কর।" (গীতা-১১/৭) অর্জুন বললেন- " হে দেব ! তোমার দেহে দেবতাদের, বিবিধ প্রাণীদের, কমলাসনে স্থিত ব্রহ্মা, শিব, ঋষিদের ও দিব্য সর্পদেরকে দেখছি।" (গীতা-১১/১৫) অর্জুন বললেন- "আমি দেখছি তোমার আদি, মধ্য ও অন্ত নেই৷ তুমি অনন্ত বীর্যশালী ও অসংখ্য বাহুবিশিষ্ট এবং চন্দ্র ও সূর্য তোমার চক্ষুদ্বয়৷ তোমার মুখমণ্ডলে প্রদীপ্ত অগ্নির জ্যোতি এবং তুমি স্বীয় তেজে সমস্ত জগৎ সন্তপ্ত করছ।" (গীতা-১১/১৯)
" তুমি আদি দেব, পুরাণ পুরুষ এবং এই বিশ্বের পরম আশ্রয়। তুমি সবকিছুর জ্ঞাতা, তুমিই জ্ঞেয় এবং তুমিই গুণাতীত পরম ধামস্বরূপ৷ হে অনন্তরূপ ! এই জগৎ তোমার দ্বারা পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে।" (গীতা-১১/৩৮) সেই সৃষ্টির আনন্দ আস্বাদনের সাথে সাথে এক অতি সূক্ষ্ম এবং নিখুঁত বিধান রচনা করে আমাদের ইচ্ছা পূরণের নিমিত্তে আমাদেরকে কর্মের স্বাধীনতা দিয়ে এবিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কর্মচক্রে পাঠিয়ে দিলেন। এবং তাঁর সৃষ্টির শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মায়া সৃষ্টি করলেন ( যাতে আমরা তাঁকে ভুলে না যাই) ।
" দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া । মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।। (গীতা-৭/১৪) অর্থাৎ- আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন। যদিও "কৃষ্ণ ভুলি' সেই জীব অনাদি- বহির্মুখ। অতএব মায়া তারে দেয় সংসার-দুঃখ ।(চৈ.চঃ মধ্য ২০/১১৭)।। অতএব এ থেকে একটা কথা স্পস্ট যে, আমাদের কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম হল- নিত্য ভগবানের স্মরণ করা, তাঁর গুণগান করা, ( তাঁর মহিমা কীর্তন করা), তাঁর নিকটেই সব কিছু প্রার্থনা করা। এবং সমস্ত প্রকার কর্ম তাঁকে সমর্পণ করে ( কর্মবন্ধন-শূন্য হয়ে কর্ম করে) জীবন পথে এগিয়ে চলা । জয় শ্রীকৃষ্ণ।।
মানুষের কর্মচক্র একনজরে দর্শন করতে দয়াকরে মানুষের অবস্থান অর্থাৎ মনুষ্যলোক থেকে শুরু করুন (এখানে ক্লিক করুন) এরপর একে একে উপরে-নীচে দেখে বোঝার চেস্টা করুন।
এই অংশটুকু ভগবানের ধাম ! গোলক বৃন্দাবন (Our Real Home) যেখানে যেতে পারলে আর পুনঃ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হবে না এবং প্রত্যেকের সাধন-ভজন অনুযায়ী উপরোক্ত পাঁচটি ভাবে ভগবানের নিত্য সেবা করার মাধ্যমে অফুরন্ত চিন্ময় সুখের তথা অফুরন্ত চিন্ময় আনন্দের সুযোগ মিলবে ! কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন চেতনার পূর্ণ বিকাশ সাধনের মাধ্যমে যথাযথ যোগ্যতা অর্জন (অর্থাৎ উপরোক্ত পাঁচটির মধ্যে কোনটি আমি চাই সেটা ঠিক করা এবং সে অনুযায়ী সেবায় ভগবানকে সন্তুষ্ট করা এবং ভগবানের কাছ থেকে নিয়োগপত্র /ছাড়পত্র পাওয়া ) ! ! !
ভগবানের ধাম ( গোলক বৃন্দাবন )
ব্রহ্মলোকএই স্তরটি ভগবানের ধামের ঠিক নীচে অবস্থিত ব্রহ্মলোক। এখানেও কর্ম এবং সাধনার মাধ্যমে পৌঁছান যায়, তবে পূণ্যফল ভোগ শেষ হলে পুনঃরায় পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে অতপরঃ কর্ম এবং বাসনা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রাণীকুলে জন্মগ্রহণ করতে হবে। ভগবান বলেছেন , " আব্রহ্মভুবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোহর্জুন। মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে ॥১৬॥ " অর্থাৎ " হে অর্জুন ! এই ভুবন থেকে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সমস্ত লোকই পুনরাবর্তনশীল অর্থাৎ পুনর্জন্ম হয়৷ কিন্তু হে কৌন্তেয় ! আমাকে প্রাপ্ত হলে আর পুনর্জন্ম হয় না। " গীতা: ৮ম অধ্যায় / শ্লোক: ॥১৬॥ |
স্বর্গঃ থেকেও উচ্চতর বিভিন্ন গ্রহলোকএই অংশটুকু স্বর্গঃ থেকেও উচ্চতর যত গ্রহলোক আছে সেটিকে বোঝানো হয়েছে । এই স্তরে অর্থাৎ কর্ম এবং সাধনা অনুযায়ী বিভিন্ন উচ্চতর গ্রহলোকে যাওয়া যায়। তবে এখানেও পূণ্যফল শেষ হলে পুনঃরায় ফিরে এসে কর্ম এবং বাসনা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রাণীকুলে জন্মগ্রহণ করতে হবে। |
স্বর্গলোকঃমনুষ্যলোকের উপরেই স্বর্গলোক। যেকোন প্রকার পূণ্যফলের বিনিময়ে স্বর্গসুখ ভোগকরা যায় অর্থাৎ স্বর্গে যাওয়া যায়। (কোন কাজ নেই,নামকরা শহরে ১৫দিনের অবকাশ যাপন; ফাইভ স্টার হোটেলে থাকা, ভালো ভালো খাওয়া, ইচ্ছেমত ঘোরাঘুরি- ট্যুর এর মত; সময় শেষ হলে পুনঃরায় কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসতে হয়।) এখানেও অনুরূপ- পূণ্যফল শেষ হলে পুনঃরায় ফিরে এসে কর্ম এবং বাসনা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রাণীকুলে জন্মগ্রহণ করতে হবে। |
মনুষ্য লোকঃ / ভূলোক / পৃথিবী / পরীক্ষাগার / মায়ার কারাগার স্বরূপ:
জীবসমূহ ভগবানের মায়া ত্রিগুণের দ্বারা মোহিত। শুধুমাত্র যাঁরা তাঁর অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণে প্রপত্তি করে অর্থাৎ আত্মসমর্পণ করে, তাঁরাই গুণাতীত স্তরে অধিষ্ঠিত হয়ে কর্ম করতে পারে এবং তাঁদের চেতনার পূর্ণ বিকাশ সাধনের মাধ্যমে ভগবদ ধামে ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টা করে।
বস্তুতঃ কারো বর্তমান অবস্থা নির্ভর করে শুধুমাত্র তাঁর পূর্ব পূর্ব জন্মের পূণ্যকর্মের সঞ্চিত ফলের সাথে বর্তমানের সৎকর্ম, সৎসঙ্গ বা সাধুসঙ্গের প্রভাবের মাত্রার উপর ! ! ! দুর্লভ মানব জনম- সুবর্ণ সুযোগ ; - হতে পারে এটাই শেষ সুযোগ ! ! !
স্থাবর ত্রিংশলক্ষশ্চ জলজোনবলক্ষকঃ, কৃমিয়োদশলক্ষশ্চ রুদ্রলক্ষশ্চ পক্ষিনৌ। পাশোবো বিংশলক্ষশ্চ চতুর্লক্ষশ্চ মানবাঃ এতেশু ভ্রমনং কৃত্বা ভ্রদ্ধিজত্ব মৃপজায়তে, মনুষ্য দুর্লভং জন্ম যদিস্যাৎ কৃষ্ণসাধকঃ ।। (পদ্ম পুরাণ) অর্থাৎঃ- স্থাবর-জঙ্গম অর্থাৎ বৃক্ষ-লতারূপে ত্রিশ লক্ষ জনম, নয় লক্ষ জনম জলজ প্রাণীরূপে, কৃমিকীট আদি যোনিতে দশ লক্ষ জনম, পক্ষী যোনিতে একাদশ লক্ষ জনম, কুড়ি লক্ষ জনম পশু রূপে এবং মানব রূপে চার লক্ষ জনম এভাবে ৮৪ লক্ষ যোনি ভ্রমণ করতে হয় জীবের। ৮০ লক্ষ বিভিন্ন যোনি ভ্রমণ শেষে মাত্র চার লক্ষ বার দুর্লভ মনুষ্য জন্ম পাওয়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সাধনা করার জন্য ।
মাত্র চার লক্ষবার মানব জন্মের সুযোগ আছে ! কে জানে ইতোমধ্যে কার কত জন্ম পার হয়ে গেছে ! চেতনার পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে যদি ভগবানের ধামে ফিরে যাওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জিত না হয়, তবে পুনরায় আশি লক্ষ বিভিন্ন যোনি ভ্রমণ করতে হবে মানব শরীর লাভ করার জন্য এবং পুনরায় পরীক্ষা দেওয়ার জন্য !!! |
পশু রূপে ২০ লক্ষ জনম ভ্রমণ করতে হয় জীবের । (পদ্ম পুরাণ) |
পক্ষী রূপে ১১ লক্ষ জনম ভ্রমণ করতে হয় জীবের । (পদ্ম পুরাণ) |
স্থাবর জঙ্গম-আদি রূপে ৩০ লক্ষ জনম ভ্রমণ করতে হয় জীবের । (পদ্ম পুরাণ) |
জলজ প্রাণী রূপে ৯ লক্ষ জনম ভ্রমণ করতে হয় জীবের । (পদ্ম পুরাণ) |
কৃমি-কীট, সরিসৃপ রূপে ১০ লক্ষ জনম ভ্রমণ করতে হয় জীবের । (পদ্ম পুরাণ) |
শুধুমাত্র মানবের কর্ম অনুযায়ী বিভিন্ন নিম্ন থেকে নিম্নতর নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। কর্মফল ভোগ শেষ হলে পুনঃরায় কর্ম এবং বাসনা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রাণীকুলে জন্ম হয়। |
0 Comments