আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম - শ্রীমৎ ভক্তিপুরুষোত্তম স্বামী মহারাজ


আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম - শ্রীমৎ ভক্তিপুরুষোত্তম স্বামী মহারাজ


১৯৫৭ সালে ২২শে সেপ্টেম্বর শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পবিত্র লীলাস্থলী পুরুষোত্তম ক্ষেত্র শ্রীজগন্নাথ পুরীতেই আবির্ভূত হয়েছিলেন শ্রীমৎ ভক্তিপুরুষোত্তম স্বামী মহারাজ। বাবা ছিলেন পুরীর কলামাটি হাইস্কুলের হেডমাস্টার। নিয়মিত চতুর্ভুজ নারায়ণ বিগ্রহের সেবা করতেন।‌ আর মা ছিলেন পরম রামভক্ত। তবে নারায়ণ ভক্ত হলেও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃত শিক্ষাষ্টকাদি শ্লোকের সঙ্গে তাঁর পিতা পরিচিত ছিলেন এবং নিয়মিত তা পাঠও করতেন। আর মহারাজের বিশেষ আকর্ষণ ছিল শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রতি। যখনই মনে কোন অতৃপ্ত জাগতো, গীতা পড়তেন। মুটামুটি একটা আধ্যাত্মিক পরিবেশেই মানুষ হচ্ছিলেন তিনি। তবে ভগবত্তত্ত্ব সম্বন্ধে খুব একটা গভীর জ্ঞান তখন ছিল না।

"আমি তখন ভক্তিসিদ্ধান্ত জানতাম না। এখন যেমন শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ পড়ে সিদ্ধান্ত জানতে পেরেছি, তখন সেরকম জানতাম না। তবে বরাবরই ভগবানে বিশ্বাসী ছিলাম। বিজ্ঞান বিভাগে পড়েও নাস্তিক হয়নি।"

বাড়ী যদিও পুরীধামে, বাবার শিক্ষকতার সূত্র ধরে কলামাটি হাইস্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করতেন। যথাসময়ে ভাল রেজাল্ট করে প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করলেন। তারপর ভর্তি হলেন পুরীর এস.সি.এস কলেজে। এবারও বিজ্ঞান নিয়ে।

মাঝে মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে পুরীর সমুদ্রতীরে ঘুরে বেড়াতেন। বিদেশী দেখলেই তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার ইচ্ছা হত। যখনই কোন প্রাশ্চাত্য দেশীয় কাউকে দেখতেন, ইংরেজিতে গল্প জুড়ে দিতেন। একদিন উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে দুজন বিদেশী ভক্ত ঘোরাফেরা করছিল। দুজন বিদেশীকে এভাবে বৈষ্ণব সাজে দেখে মহারাজ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হলেন।

"নিছক শখের বশে তাঁদের সঙ্গে গল্প শুরু করলাম। ভক্ত হবার থোরই ইচ্ছা ছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদেরকে অসংখ্য প্রশ্ন করলাম। তাঁরা খুব যুক্তিপূর্ণ উত্তর দিচ্ছিলেন। এঁদের প্রাঞ্জল এবং অকাট্য যুক্তি শুনে সত্যিই খুব ভাল লেগেছিল। তাই তাঁদের সঙ্গে স্থায়ী বন্ধুত্ব পাতানোর উদ্দেশ্যে তাঁদের নাম‌ ঠিকানা রেখে দিলাম। এঁরা দুজন কানাডার টরেন্টো ইসকন মন্দিরের ভক্ত। একজনের নাম তমোহর দাস, অপর জন পদ্মপাণি। তাঁরা আমাকে 'পারফেকশন অব যোগ' নামে শ্রীল প্রভুপাদের একটি ইংরেজি বই দিলেন। আমি তা বাড়িতে গিয়ে পড়তে লাগলাম। এত চমৎকার। এত গভীর অথচ সুস্পষ্ট, যুক্তিপূর্ণ! সত্যিই মুগ্ধ হলাম।"

"সেই গ্রন্থ থেকে আমার মনোমত বহু উদ্ধৃতি দিয়ে তের-চোদ্দ পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে পাঠালাম তমোহর প্রভু আর পদ্মপাণি প্রভুর কাছে। চিঠি পেয়ে তাঁরাও প্রচুর পরিমাণে বই পাঠাতে লাগলেন একের পর এক। ভক্ত হবার দেড় বছর আগে ধরে শুধু গ্রন্থই পড়তে লাগলাম নেশাখোরের মতো। পুরীতে তখন ইসকনের কোন মন্দির ছিল না। তবে মাঝে মধ্যে গৌড়িয় মঠে যেতাম। কারণ সিদ্ধান্তগতভাবে তাঁদের সঙ্গে মিল খুঁজে পেতাম।" এইভাবে যখন দিন কাটছিল, হঠাৎ তাঁর বাবা একদিন দেহত্যাগ করলেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মনে হয়েছিল, এই জগৎ অনিত্য। এইভাবে একটা প্রচ্ছন্ন বৈরাগ্য ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছিল। পাশাপাশি কলেজের পড়াশুনাও চলছিল। দেখতে দেখতে ফাইনাল পরীক্ষা এসে গেল। পরীক্ষা যদিও দিচ্ছিলেন, মন ছিল শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ আস্বাদনে। আর একটা মাত্র পরীক্ষা বাকী আছে। সাবজেক্ট বোটানী। পরের দিন হবে। ঠিক সেই সময় ডাকপিয়ন একগাদা বই নিয়ে আসলেন। তমোহর আর পদ্মপাণি পাঠিয়েছেন কানাডা থেকে। বোটানী পড়া তখন গোল্লায় গেল। একে তো শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ। তাতে আবার বিদেশে ছাপা অপূর্ব সুন্দর গ্রন্থ। বহু চিত্রে শোভিত বই পড়ে তাঁর খিদে যেন আর মিটে না।

ইতিমধ্যে চিঠির মাধ্যমে শ্রীধাম মায়াপুরের তৎকালীন অন্যতম কর্ণধার শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজের সঙ্গেও তার যোগাযোগ হয়ে যায়। একদিন তিনি খবর পেলেন যে, শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজ পুরীতে আসছেন। পুরীর একটি হোটেলে থাকবেন। ঠিকানা পেয়ে যথাসময়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। মনে মনে একটু খুঁৎ ছিল। শত হলেও বিদেশী সন্ন্যাসী শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজ, কেমন সাধু কে জানে!

"কিন্তু যখন হোটেলে গিয়ে তাঁকে দর্শন করলাম, তখনই আকৃষ্ট হলাম। যেটা আমার সবচেয়ে ভাল লাগল, তাহলে এই যে শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজ হোটেলের যে খাটে বসে আসেন, সেখান থেকে হোটেলের বিছানাপত্রগুলি সম্পূর্ণ সরানো আছে। বিছানা ছাড়াই খাটের উপর বসে আছেন তিনি। আমাকে দেখে স্নেহভরে বললেন, "তুমি এখনই আমার সঙ্গে আমাদের গাড়ীতে করে মায়াপুরে চল।" শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজের এই আহ্বান ছিল এক দিব্য চুম্বকের মতো। এই চুম্বক যেন এক অতিজাগতিক ঔষধের মতো তাঁর চিত্তের গভীরে তৎক্ষণাৎ সক্রিয় হয়ে উঠল। তবুও তৎক্ষণাৎ রাজী হতে পারলেন না তিনি। এক অদৃশ্য পিছুটান। মুহূর্তের মধ্যে কি দীর্ঘ একুশ বছর জীবনের সংস্কারকে ছুড়ে ফেলা যায়! বড়ই কঠিন! ফিরে গেলেন শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজ। তাঁর ‌ নিক্ষিপ্ত দিব্য ঔষধের চুম্বকীয় ক্রিয়া ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলল। জল থেকে আনা মাছের মতো তিনি ছটফট করতে লাগলেন। প্রচণ্ড অস্থিরতার মধ্যে তাঁর দিন কাটতে লাগলো। ঘরের বদ্ধ যেন অসহ্য মনে হতে লাগল। জন্ম-জন্মান্তরের পারমার্থিক পিতা শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজের আহ্বান তাঁর হৃদয়ে বিস্ফোরিত হতে লাগল বার বার।

বহু কষ্টে একটি মাস কেটে গেল! না, আর থাকা যায় না! কিন্তু যাবেন কেমন করে? প্রথমত টাকার প্রশ্ন। হ্যা পোষ্ট অফিসে এক সময় তিনি কিছু টাকা জমিয়েছিলেন। সেখান থেকে তক্ষুনি ১০০ টাকা তুলে নিলেন। বাড়ীতে বললেন, 'আমি খুব অসুস্থ, কলকাতায় বড় ডাক্তার দেখাতে হবে।' এই অজুহাতে ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে চম্পট দিলেন শ্রীধাম মায়াপুরে-- যেখানে ভবরোগের চিকিৎসার জন্য খুব বড় বড় ডাক্তাররা হামেশাই যাতায়াত করে।

শ্রীমায়াপুরের ইসকন ভক্তরা তাঁকে সাদরে দলভুক্ত করলেন। ভক্তরা খুব শীঘ্রই তাঁকে মস্তক মুণ্ডন করতে অনুরোধ করলেন। চুলের মায়া কি অত সহজে কাটানো যায়? এছাড়া মনে কি তখনও পিছুটান-- কি জানি, যদি বা ফিরে যাই!

যাই হোক, অবশেষে মস্তক মুণ্ডন করলেন তিনি। আর গৃহে ফিরে যাওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। বিশেষ করে উড়িষ্যার লোক-লজ্জা বড়ই প্রবল। একবার গৃহ ত্যাগ করে গৃহে ফিরে গেলে জনগণ তাকে গলিত কুষ্ঠরোগীর মতোই ঘৃণা করে। সুতরাং কোমর বেঁধে পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের সেবায় জীবন উৎসর্গ করলেন তিনি। দেখতে দেখতে বৈষ্ণব সমাজে সবাকার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন মহারাজ।

১৯৭৯ সালে দোল পূর্ণিমায়, মার্চ মাসে, শ্রীধাম মায়াপুরে শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজের কাছ থেকে হরিনাম দীক্ষা লাভ করলেন। মাস দুয়েক পরে ব্রাহ্মণদীক্ষাও লাভ করলেন। তারপর থেকেই মনোনিবেশ করলেন শ্রীল প্রভুপাদের দিব্য গ্রন্থাবলী বিতরণে। এক নাগাড়ে পাঁচ বৎসর সংকীর্তন ডাইরেক্টর থাকার পর তিনি ভুবনেশ্বর ইসকন মন্দিরের প্রেসিডেন্ট রূপে নিযুক্ত হলেন। প্রায় পাঁচ বছর মন্দির পরিচালনার পর ১৯৮৫ সালের জন্মাষ্টমী উৎসবে কলকাতা মন্দিরে, শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজের কাজ থেকে সন্ন্যাস দীক্ষা লাভ করলেন শ্রীমৎ ভক্তিপুরুষোত্তম স্বামী মহারাজ।

১৯৮৭ সালে তিনি শ্রীধাম মায়াপুরে জেনারেল ম্যানেজারের পদে ব্রতী হন। বর্তমানে মহারাজ মায়াপুরের কো-ডাইরেক্টর এবং একজন জি.বি.সি মেম্বার হিসাবে সেবারত।

মহারাজের তত্ত্বাবধানে গীতা করেস্‌পণ্ডেস্ কোর্স প্রোগ্রাম, স্কুল প্রিচিং এবং গ্রন্থ বিতরণ কার্যক্রমের সূচনা হয়। বিশেষত নামহট্ট প্রচারে তাঁর অক্লান্ত সেবা অতুলনীয়। ভারতের সর্বত্রই প্রচারে ব্যাপৃত রয়েছেন তিনি। গ্রন্থ বিতরণে তাঁর ত্যাগ স্বীকার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

প্রচারকার্যে প্রতিবছরই বিশ্বভ্রমণে যাচ্ছেন মহারাজ। ইউরোপ, ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী, সুইজারল্যাণ্ড, অস্টিয়া, টোকিয়ো, হংকং, ব্যাংকক, আমেরিকা-- এসব দেশে প্রতি বছরই চলছে তাঁর দিগ্বিজয়ী যাত্রা।

তিনি শ্রীমতী রাধারাণীর লীলামহিমা, শ্রীজগন্নাথ, শ্রীক্ষেত্র পরিক্রমা ইত্যাদি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যও তাঁর কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

তাঁর অপূর্ব সুন্দর ভাগবত পাঠ ইসকনের ভক্তদের কাছে এক বহু আকাঙ্ক্ষিত বিষয়। যদিও তিনি বর্ণাশ্রমের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত তবু তাঁর বিনয় বিস্ময়কর। তাঁর শুদ্ধতা সন্দেহাতীত। এমন একজন দুর্লভ ভক্তের জয়গান সমস্ত জগতে মুখরিত হোক, দীর্ঘ জীবন লাভ করে সমস্ত বিশ্বকে শ্রীকৃষ্ণ-প্রেমের বন্যায় আলোড়িত করুন তিনি--এটাই সমস্ত ভক্তদের একান্ত প্রার্থনা।

Post a Comment

0 Comments