বিল্বমঙ্গল এর কাহিনী
কোন এক গ্রামে এক গরীব ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তিনি ছিলেন খুবই ধর্মপারায়ণ। তার একটি পুত্র সন্তান ছিল, তার নাম ছিল বিল্বমঙ্গল। বিল্বমঙ্গল খুবই অল্প বয়সে তার মাকে হারায়। ব্রাহ্মণটি বিল্বমঙ্গলকে সুশিক্ষিত করার জন্য গুরুকুলে এক পন্ডিতের অধীনে রেখে আসে।
বিল্বমঙ্গল সেখানে কিছু খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পরে পড়াশোনা না করে সারাদিন শুধু খেলাধূলা করে বেড়াত। আর এই কথা ব্রাহ্মণের কানে গেলে ব্রাহ্মণ খুব কষ্ট পেল।
তিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট খুব কান্না -কাটি করতে লাগলেন আর বললেন, "হে কৃষ্ণ!! তুমি তো অন্তর্যামী,তুমি সবই জানো গোবিন্দ তুমি একটু কৃপা কর বিল্বমঙ্গলকে। তোমার চরনে ঠাঁই দাও গোবিন্দ ।
এইভাবে দেখতে দেখতে বিল্বমঙ্গল কৈশোর পাড় করে যৌবনে পা দিল। এখন সে পিতৃ গৃহে থাকে। ব্রাহ্মণ কৃষ্ণভক্ত হলেও বিল্বমঙ্গল মোটেই কৃষ্ণভক্ত ছিল না। এমন কি সে কোনদিন কৃষ্ণনাম পর্যন্ত নিত না।
সে বন্ধুদের সাথে সব সময় আড্ডা দিয়ে বেড়াত। আর এদিকে ব্রাহ্মণ সারাদিন শুধু কৃষ্ণের কাছে কাঁদতে থাকতো আর বলতেন,হে গোবিন্দ!!! তুমি বিল্বমঙ্গলকে সুমতি দান করো।"
একদিন,বিল্বমঙ্গল নদীর পাড়ে বসে ছিল। এমন সময় এক অপূর্ব সুন্দরী নারী নদীতে জল নিতে আসে। যাকে দেখে বিল্বমঙ্গল এর খুব ভালো লাগে। বিল্বমঙ্গল প্রতিদিন ঠিক ঐ সময়ে নদীর পাড়ে এসে বসত ঐ সুন্দরী রমনীকে দেখার জন্য সে আস্তে আস্তে তাকে ভালবাসতে শুরু করল।
একদিন নারীটির কাছে জানতে চায় তার নাম কি ? আর সে কোথায় থাকে ? নারীটি জানায় তার নাম চিন্তামনি এবং সে নদীর ওপারে বাস করে। আসলে চিন্তামনি ছিলো পতিতালয়ের একজন ব্যেশ্যা।
তবুও বিল্বমঙ্গলকে তার ভালো লাগত তাই বিল্বমঙ্গল প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে চিন্তামনির সাথে দেখা করার জন্য নদী পাড় হয়ে তার বাড়ি যেত। এভাবে দিন যায়,মাস যায়। এখন বিল্বমঙ্গল এর শয়নে স্বপনে শুধু চিন্তামনি আর চিন্তামনি।
এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে সারাদিন রাত বিল্বমঙ্গল শুধু চিন্তামনির নাম জপ করতে থাকে। আর এদিকে ব্রাহ্মণ তার সন্তানের চিন্তায় কৃষ্ণকে ডাকতে ডাকতে মারা যায়।
বাবার মৃত্যুতে এতটুকু দুঃখ পেল না বিল্বমঙ্গল। বাবার মৃতদেহ শশ্মানে দাহ করেই সে ছুটলো চিন্তামনির সাথে দেখা করতে। চিন্তামনি,বিল্বমঙ্গলকে ঐ গুরুদশা অবস্থায় তাকে দেখে খুব বকাবকি করল আর বলল, " তুমি কি গো ঠাকুর ?
আজ তোমার বাবা মারা গেছে, তবুও তুমি আমাকে দেখতে চল এসছো ?" বিল্বমঙ্গল বলল, "আমি যে তোমাকে একদিন না দেখে থাকতে পারি না। আমি যে তোমাকে খুব ভালোবাসি।" তবুও চিন্তামনি দরজা খুলল না।
এভাবে বিল্বমঙ্গল প্রতিদিন রাতে চিন্তামনিকে একটিবার দেখার জন্য আসতো। আর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চিন্তামনিকে একটু দেখে চলে যেত।
দেখতে দেখতে বিল্বমঙ্গল এর বাবার শ্রাদ্ধের কাজ এগিয়ে আসল। বাবার শ্রাদ্ধের কাজের আগের রাতে চিন্তামনির সাথে বিল্বমঙ্গল দেখা করতে গেলে চিন্তামনি তাকে বলল, "দেখ ঠাকুর!!!
কাল তোমার বাবার শ্রাদ্ধ কাজ,কাল তুমি আসবে না।" বিল্বমঙ্গল বলল,"আমি তোমাকে না দেখে থাকতে পারব না।" চিন্তামনি বলল, "না না,তুমি এলে আমি জানলাটাও খুলবো না। তুমি এখন চলে যাও।"
পরদিন,বিল্বমঙ্গল কোন রকম বাবার শ্রাদ্ধের কাজটি শেরে চলল চিন্তা মনির সাথে দেখা করতে। রাতটি ছিল অমাবশ্যার রাত সাথে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তার মধ্যে বিল্বমঙ্গল চিন্তামনির সাথে দেখা করতে যাচ্ছে।
কখনো কাঁদায় পড়ে যাচ্ছে আবার কখনো কাঁটায় পা আটকে যাচ্ছে। কোনদিকেই বিল্বমঙ্গল এর লক্ষ্য নেই। সে কোন ভাবে নদীর ঘাটে এসে দেখল ঘাটে কোন নৌকা নেই। মানুষ বিপদে পড়লে পরমেশ্বর ভগবানকে স্মরণ করা আর বিল্বমঙ্গল বিপদে চিন্তামনিকে স্মরণ করছে।
সে জোড়ে জোড়ে "চিন্তা" "চিন্তা" বলে চিৎকার করতে লাগল আর কাঁদতে লাগল। বিল্বমঙ্গল বলল, "ওগো চিন্তা,তুমি আমাকে নদী পাড় করে নেও। আমি তোমার একটু দেখব।" সে এই কথা বার বার বলছে আর কাঁদছে। হঠাৎ করে সে দেখতে পেল নদীতে একটি মরা কাঠ ভেসে আসছে।
এই দেখে বিল্বমঙ্গল মনে মনে ভাবল, "চিন্তামনি,বুঝি তার জন্য এই মরা গাছটি পাঠিয়েছে।" সে কোন মতে ঐ মরা গাছটি ধরে সাঁতার কেটে নদী পাড় হলো। চিন্তামনির বাড়ির সামনে একটা উঁচু প্রাচীর ছিলো। বিল্বমঙ্গল এর পক্ষে সম্ভব না প্রাচীরটি পাড় করে চিন্তামনির সাথে দেখা করা।
তখন সে আবার চিন্তার নাম স্মরণ করতে থাকল। আর বলল, "ওগো চিন্তা,আমি পারছি না প্রাচীর পাড় করতে। তুমি আমাকে পাড় করে নেও।"
ঠিক তখনই বিল্বমঙ্গল দেখতে পেল প্রাচীরের ওপর থেকে একটি দড়ি ঝুলছে। সে মনে মনে ভাবল, "চিন্তামনি বুঝি তার জন্য এই দড়ি রেখেছে প্রাচীরটি পাড় হবার জন্য।" বিল্বমঙ্গল কোন ভাবে সেই দড়িটি ধরে প্রাচীরটি পাড় করে চিন্তামনির বাড়িতে পৌছাল। "চিন্তা,চিন্তা!!!"
বলে ডাকতে থাকল বিল্বমঙ্গল,চিন্তামনির বাড়ির সামনে গিয়ে। চিন্তামনি বিল্বমঙ্গল এর কন্ঠস্বর শুনে দরজা খুলে বলল, "তুমি কি মানুষ ঠাকুর ? এই ঝড় জলের রাতে তুমি চলে আসছ আমাকে দেখতে!!! তুমি কি করে প্রাচীরটি পাড় করলে ?"
বিল্বমঙ্গল বলল,"কেন ? তুমিই তো প্রাচীরের ওপরে আমার জন্য দড়ি ঝুলিয়ে রেখেছ, আমি তা ধরে পাড় হয়েছি।"চিন্তামনি বলল,"কই না তো ? আমি তো কোথাও দড়ি রাখিনি। চলতো দেখি!!!
তুমি কি ধরে প্রাচীর পাড় হয়েছ ?" তখন বিল্বমঙ্গল চিন্তামনিকে প্রাচীরের নিকট নিয়ে গেল। চিন্তামনিকে দড়িটি দেখিয়ে বলল বিল্বমঙ্গল বলল, "ঐ তো দড়ি।" চিন্তামনি চোখ বড় বড় করে বলল,"ওগো ঠাকুর তুমি একি ধরে পাড় হয়েছ ? এতো একটি অজগর সাপের লেজ। তুমি কি চোখের মাথা খেয়েছ ?"
এরপর চিন্তামনি বিল্বমঙ্গলকে বলল,"তুমি কি করে নদী পাড় হলে ?" বিল্বমঙ্গল বলল, "কেন!! তুমি তো আমার জন্য একটি মরা গাছ পাঠিয়ে দিয়েছ। আমি তা ধরে সাঁতরে নদী পাড় হয়েছি।"
চিন্তামনি বলল, "কই আমি তো কিছু পাঠাইনি তোমার নদী পাড় হবার জন্য। চলতো নদীর পাড়ে,দেখি তুমি কি ধরে নদী পাড় হয়েছ ?"
এরপর তারা নদীর পাড়ে গেল আর দেখতে পেল, বিল্বমঙ্গল যেটিকে ধরে নদী পাড় হল ওটি কোন মরা গাছ ছিল না, ওটি ছিলো একটি মানুষের মৃতদেহ। চিন্তামনি এই দেখে ভয়ে আঁতকে উঠলো। সে গোপালকে বলল, "তুমি কি পাগল ঠাকুর ?
মরা গাছ আর মৃতদেহের মধ্যে তফাত দেখছো না ?" আরও বলল, "ঠাকুর!!! তুমি আমাকে যতটা ভালবাস তা যদি গোবিন্দকে ভালবাসতে তাহলে তুমি এতো দিনে তাঁকে পেয়ে যেতে। আমি জানি তুমি গোবিন্দকে আমার মতো করে ভালবাসলে তুমি নিশ্চিত গোবিন্দের দর্শন পাবেই।
আর ঠাকুর!!! কাল থেকে তুমি আর তোমার মুখ আমাকে দেখাবে না। আর যদি তুমি আমাকে দেখতে আস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবে।"
এই বলে চিন্তামনি বিল্বমঙ্গলকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল।আর তাকে একটা গোবিন্দর মূর্তি দিয়ে বলল, "তুমি যতদিন গোবিন্দ দর্শন না পাবে ততদিন তুমি বৃন্দাবনে থাকবে আর আমাকে দেখতে আসবে না।"
এরপর বিল্বমঙ্গল, গোবিন্দর মূর্তিটি সাথে করে বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ছে আর "হে গোবিন্দ, প্রাণ গোবিন্দ " বলে কাঁদছে,,
আর রাস্তায় যাকে পায় তাকেই বলে, "কি করে আমি বৃন্দাবন যেতে পারি ? কোন রাস্তায় গেলে বৃন্দাবনে যেতে পারি ?" বিল্বমঙ্গল রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দেখতে পেল এক সাধুকে।
ঋষিকে বিল্বমঙ্গল বলল,ঋষি কি করে আমি গোবিন্দের দর্শন পাব ? আমাকে আপনি দীক্ষা দান করুণ।" তখন সাধু বলল,"তোমার দীক্ষা তো হয়ে গেছে। চিন্তামনি তোমাকে দীক্ষা দিয়ে দিয়েছে।"
এভাবে,বিল্বমঙ্গল নৃত্য করছে আর গোবিন্দর নাম করছে। সে একটি নদীর পাড় দিয়ে যাচ্ছিল কীর্ত্তন করতে করতে। হঠাৎ এক সুন্দরী রমনীকে দেখে থমকে দাঁড়াল। তাকে ঠিক চিন্তামনির মতো দেখতে। তাই সে তার পিছন পিছন তার বাড়ি পর্যন্ত চলে গেল।
ঐ রমনী ছিল এক বণিকের স্ত্রী। বণিক বিল্বমঙ্গল দেখে বলল, "প্রভু!!! আমি ধন্য আপনার মতো একজন পরম বৈষ্ণব আমার বাড়িতে পদধূলি দেওয়ার জন্য। বলুন আমি কি করলে আপনি খুশি হবেন ? "তখন বিল্বমঙ্গল বলল,"তোমাকে বৈষ্ণব সেবা দিতে হবে।
তুমি তো জান বৈষ্ণবকে ভজন করালে গৃহস্থ্যের কল্যাণ হয়। তাই আজ আমি তোমার গৃহে সেবা করব।" বণিক তো মহা খুশি। সে ঘরে ভিতরে গিয়ে তার স্ত্রীকে বলল, "শোন!!!
গৃহস্থে বৈষ্ণব এসছে,তাহার সেবার ব্যবস্থা করো। তুমি তার জন্য ভোজনের ব্যবস্থা করো। "বণিকের স্ত্রী তার জন্য ভোজনের ব্যবস্থা করলেন। আর বিল্বমঙ্গলকে খুব আদর যত্ন করে ভজন করালেন। বিল্বমঙ্গল পেট ভরে খেয়ে খুব খুশি হলেন।
তখন সে বণিককে ডাকলো আর বলল, "ওহে বণিক!!! তুমি তো বৈষ্ণব সেবা করালে তা এবার ভোজন দক্ষিণা দাও।" বণিক বলল,"বলেন প্রভু!!! আপনাকে কি দক্ষিণা দিলে খুশি হবেন ?"
তখন বিল্বমঙ্গল বলল,"বণিক!!! তুমি আমাকে কথা দাও আমি যা চাইবো তাই তুমি দেবে ?" বণিক বলল, "কথা দিলাম বাবা। আপনি যা চাইবেন আমি তাই দেব।
" তখন বিল্বমঙ্গল বলল " আজ মধ্যরাতে তোমার স্ত্রীকে সুসজ্জিত করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবে।" এই কথা শুনে বণিক বলল,"একি আপনি চাইছেন প্রভু ?
আপনি এছাড়া আর যা চাইবেন আমি তাই দেব। আমার স্ত্রীকে আপনার নিকট পাঠাতে পারবো না। আমাকে ক্ষমা করুন প্রভু" বিল্বমঙ্গল সব শুনে বলল,"বণিক!! তুমি আমাকে কথা দিয়েছ।
তুমি যদি তোমার কথা তুমি না রাখ তাহলে কিন্তু তোমার ধর্ম নষ্ট হবে।"বণিক খুব চিন্তিত হয়ে তার স্ত্রীর নিকট গিয়ে সব খুলে বলল। বণিকের স্ত্রী বলল,"স্বামী!! আমি এটা পারব না। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।"
তখন বণিক বলল,"দেখ!! তুমি না গেলে আমাদের ধর্ম নষ্ট হবে। আমাদের সারা জীবনের সঞ্চিত পূর্ণ্য নষ্ট হয়ে যাবে।
আমি তোমাকে আদেশ করছি তুমি তার কাছে আজ মধ্যরাতে যাবে। আমি তোমায় নিজ হাতে সাজিয়ে দেব।" বণিকের স্ত্রী ছিলেন পতিব্রতা । স্বামী যা বলেন তাই মানিয়া চলেন। তারপর বণিক তার স্ত্রীকে নিজ হাতে সুসজ্জিত করে মধ্যরাতে বিল্বমঙ্গল নিকট দিয়ে আসে।
বণিকের স্ত্রীকে দেখে বিল্বমঙ্গলের অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে। তার বিবেক তাকে ধিক্কার দিয়ে বলে,"ঐ তুই কি করছিস ? তুই আবার কামে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিস। পরমেশ্বর ভগবানের দর্শনের জন্য তুই আবার পরস্ত্রীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিস ?"
এবার বিল্বমঙ্গল বণিকের স্ত্রীকে বলল," আমি যা চাইব তুমি কি তাই আমাকে দিতে পারবে ?" বণিকের স্ত্রী বলল,প্রভু!! আমি আজ আপনাকে সবকিছু দেওয়ার জন্যই এখানে এসছি। বলুন আপনার কী চাই ?"
বিল্বমঙ্গল বলল,"তোমার চুলের কাঁটা দুটো আমাকে দিতে পারবে ?" বণিকের স্ত্রী তাড়াতাড়ি করে চুলের কাঁটা দুটি খুলে বিল্বমঙ্গল এর হাতে দিয়ে দেয়। আর তখনই বিল্বমঙ্গল কাঁটা দুটো নিয়ে নিজ চোখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।
তাই দেখে বণিকের স্ত্রী বলল, "একি করছেন প্রভু ? আপনার নয়ন দুটি দিয়ে তো অঝোরে রক্ত ঝরছে।" বিল্বমঙ্গল বলল, "মা, মাগো!! আমি এই চক্ষু রাখব না যা দিয়ে আমি পরমেশ্বর ভগবানের দর্শনে বেরিয়ে অন্য কিছু দর্শন করছি।
মা,মাগো তুমি আমাায় ক্ষমা করে দাও,আমি তোমার দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছি। আমাকে একটি লাঠি দিতে পারবে মা?"
তখন বণিকের স্ত্রী বিল্বমঙ্গলকে একটি লাঠি দিয়ে বলল, প্রভু!!! আমার কোন সন্তান নেই,আজ থেকে তুমি আমার সন্তান। আমি তোমাকে আশির্বাদ করছি তুমি যেন তোমার পরমেশ্বর ভগবানের দর্শন পাও।"
এরপর বিল্বমঙ্গল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, "আমি যত দিন পরমেশ্বর ভগবানের দর্শন না পাই ততদিন আমি অন্ন গ্রহণ করবো না।"
এরপর বিল্বমঙ্গল আবার বৃন্দাবন যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। এবার সে অন্ধ,,,, চোখে কিছু দেখতে পায় না। "হায় গোবিন্দ,প্রাণ গোবিন্দ!! তুমি কোথায় ? কৃপা করো মোরে,একটু দর্শন দাও ভগবান।
আমি যে বড়ই পাপী।" এই বলছে আর কাঁদছে আর রাস্তা দিয়ে চলছে। তার একি কান্না,,,,সারাক্ষণ কাঁদছে আর বলছে, "হায় গোবিন্দ!! আমাকে একটু বৃন্দাবনের পথ বলে দাও,,, আমি বৃন্দাবনে যাব ?"
রাস্তায় দিয়ে চলতে চলতে কখনো কাঁদায় পড়ে যাচ্ছে আবার কখনো কাঁটায় পড়ে যাচ্ছে।
কখনো ধূলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। সে কি করুণ দৃশ্য তা কেউ চোখে না দেখলে বলতে পারবে না। বিল্বমঙ্গল এর সারা অঙ্গ থেকে রক্ত ঝরছে তবুও তার কোন চেতনা নাই। সে শুধু "গোবিন্দ,গোবিন্দ " বলছে আর কাঁদছে।
ভক্তের এতো কষ্ট ভগবান সহ্য না করতে পেরে এক ছোট্ট দইওয়ালা বালকের রূপ ধারন করে তার কাছে এলো। বিল্বমঙ্গল তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "বাবা!! আমাকে একটু বৃন্দাবনে যাওয়ার পথ বলে দাও। আমি কোন পথে গেলে বৃন্দাবনে যেতে পারব ?"
তখন বালক রূপী পরমেশ্বর ভগবান বলল, "তোমায় দেখে তো ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে। তুমি আগে একটু দধি খাও। তার জন্য তোমায় কোন পয়সা দিতে হবে না।" তখন বিল্বমঙ্গল বলল, "না গো বাবা!!!
আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যত দিন পরমেশ্বর ভগবান আমাকে নিজ হস্তে না খাইয়ে দেবে ততদিন আমি কিছু গ্রহণ করবো না।
তুমি আমাকে এ অনুরোধ করো না। আমি রাখতে পারবো না। তুমি শুধু আমাকে বৃন্দাবনে নিয়ে চলো। আমি বৃন্দাবনে যাব,আর পরমেশ্বর ভগবানকে দর্শন করবো।" বালক রূপী ভগবান বললেন, "আগে তুমি আমাকে ছাড়,তুমি আমাকে ধরবে না।
পরে যদি তুমি আমায় না ছাড়ো। তাই আমি আগে আগে যাবো আর তুমি আমার নূপুরের শব্দ অনুসারণ করে পিছে পিছে আসবে।" বিল্বমঙ্গল বলল,"ঠিক আছে বাবা, তাই হবে। আমি তোমার পিছে পিছে যাব।"
এই ভাবে বালক রূপী পরমেশ্বর ভগবান বিল্বমঙ্গলকে নিয়ে বৃন্দাবনে গেল। বৃন্দাবনে বালক,বিল্বমঙ্গলকে এক গাছ তলায় বসিয়ে দিয়ে বললেন,"তুমি এখানে বসে ভগবানকে ডাকতে থাকো। আমি আবার আসব।" এই বলে বালকটি সেখান থেকে চলে গেল।
আর বিল্বমঙ্গল ওখানেই বসে পরমেশ্বর ভগবানকে ডাকছে আর অঝোর ধারায় কাঁদছে। তার কান্না দেখে বনে পশু পাখি পর্যন্ত দাড়িয়ে পড়ছে,আশেপাশের সবকিছু স্তব্ধ হয়ে পড়ছে। বিল্বমঙ্গল এক মনে পরমেশ্বর ভগবানকে ডাকছে।
বিল্বমঙ্গল এর এই আর্তনাদ শুনে ভগবান ঠিক থাকতে না পেরে স্বমহিমায় শঙ্খ,চক্র,গদা পদ্ম ধারন করে বিল্বমঙ্গল এর সামনে আবির্ভূত হলেন। তারপর বিল্বমঙ্গল বুকে জড়িয়ে বললেন, "আর কাঁদিস না বিল্বমঙ্গল।"
নিজ হাতে ভগবান বিল্বমঙ্গল এর চোখের জল মুছে দিল। আর তার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন। বিল্বমঙ্গল তো পরমেশ্বর ভগবানের দর্শন পেয়ে মহা খুশি। বিল্বমঙ্গল ভগবানকে প্রণাম করলেন। ভগবান নিজ হস্তে বিল্বমঙ্গলকে খাইয়ে দিলো।
এই ভাবে আমরা যদি মনপ্রাণ দিয়ে পরমেশ্বর ভগবানকে ডাকতে পারি তাহলে ভগবান অবশ্যই আমাদের দর্শন দেবেন। আজ আমরা কতো কিছুই না করি ভালবাসার মানুষটি খুশি করার জন্য।
একটু ভেবে বলুন তো পরমেশ্বর ভগবানকে খুশি করার জন্য আমরা কি কিছু করি ? পরমেশ্বর ভগবান আমাদের এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছন একটি স্বতন্ত্র ইচ্ছা শক্তি দিয়ে। ছলনায় পরে আমরা পরমেশ্বর ভগবানকেই ভুলে যাই। কৃ্ষ্ণ ভুলি যেই জীব ভোগবাঞ্চা করে নিকতস্ত মায়া তারা জাপটিয়া ধরে। তাই আসুন আপনারা আমরা কৃ্ষ্ণকে ভালোবাসি।
0 Comments