শ্রী শ্রী রাধারমনের আর্বিভাব তিথি

শ্রী শ্রী রাধারমনের আর্বিভাব তিথি


 

রাধারমণ হলেন  রাধা ও কৃষ্ণের একটি সম্মিলিত বিগ্রহ। এই বিগ্রহটি বৃন্দাবনের রাধারমণ মন্দিরে পূজিত হয়।

গোপাল ভট্ট গোস্বামীর জীবনীকার নরহরি মাত্র চারটি শ্লোকে ( ভক্তিরত্নাকর ৪। ৩১৫-১৯) রাধারমণের আবির্ভাব বর্ণনা করেছেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে গোপাল ভট্ট গোস্বামীর উল্লেখ অত্যন্ত কম দেখে নরহরি চক্রবর্তী বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, গোপাল ভট্ট গোস্বামী বিনয়ের সঙ্গে তার বয়ঃকনিষ্ঠ গ্রন্থকার কৃষ্ণদাস কবিরাজকে অনুরোধ করেছিলেন উক্ত গ্রন্থ থেকে তার নাম বাদ দিতে (১। ২২২-৩)। চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্যান্য জীবনীগ্রন্থে তার দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়নি। কিন্তু চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে সেই বিবরণ, তার শ্রীরঙ্গম গমন এবং মন্দিরের পুরোহিত বেঙ্কট ভট্টের গৃহে অবস্থানের বর্ণনা রয়েছে (চৈতন্য চরিতামৃত ২। ৯। ৮২-১৬৫)। 

১৫১১ খ্রিষ্টাব্দে চৈতন্য মহাপ্রভু রঙ্গক্ষেত্রে এসে বেঙ্কট ভট্টের গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেন। বেঙ্কট ভট্টের দুই ভাই তিরুমল্ল ভট্ট ও প্রবোধানন্দ সরস্বতী ছিলেন রামানুজ সম্প্রদায়-ভুক্ত এবং প্রবোধানন্দ সরস্বতী ছিলেন সেই সম্প্রদায়ের ‘ত্রিদণ্ডী’ সন্ন্যাসী। গোপাল ভট্ট গোস্বামী ছিলেন বেঙ্কট ভট্টের পুত্র। মহাপ্রভুর আগমনের সময় গোপাল ভট্ট গোস্বামী ছিলেন নিতান্তই বালক।

শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ের রীতি অনুসারে, বেঙ্কট ভট্ট, তিরুমল্ল ভট্ট ও প্রবোধানন্দ সরস্বতীর আরাধ্য দেবতা ছিলেন লক্ষ্মী-নারায়ণ । পরে তারা রাধাকৃষ্ণ-কেন্দ্রিক মতবাদে বিশ্বাসী হন এবং কৃষ্ণকে স্বয়ং ভগবান রূপে মেনে নেন। 

গোপাল ভট্ট গোস্বামীর সেবা ও ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে চৈতন্য মহাপ্রভু তাকে দীক্ষা দেন। তিনি গোপাল ভট্ট গোস্বামীকে নির্দেশ দেন যে, তার পিতামাতার মৃত্যুর পর তিনি যেন বৃন্দাবনে চলে যান এবং সেখানেই ভজন ও রচনাকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। গোপাল ভট্ট গোস্বামী ৩০ বছর বয়সে বৃন্দাবনে আসেন।

চৈতন্য মহাপ্রভুর মৃতুর পর গোপাল ভট্ট গোস্বামী অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছিলেন। এই সময় তিনি স্বপ্ন দেখেন, কৃষ্ণ তাকে বলছেন, “আমার দর্শন পেতে হলে নেপালে যাও।” নেপালে গোপাল ভট্ট গোস্বামী বিখ্যাত কালী-গণ্ডকী নদীতে স্নান করেন। তিনি যখন নদীতে জলপাত্র ডোবান তখন তার পাত্রে বেশ কয়েকটি শালগ্রাম শিলা উঠে আসে। তিনি শিলাগুলি জলে ফেলে দিয়ে আবার পাত্র ডোবান। সেবারেও পাত্রে শালগ্রাম শিলা ওঠে।

গোপাল ভট্ট গোস্বামী ১২টি শালগ্রাম শিলা পান। মনে করা হয়, একবার এক ধনী ব্যক্তি বৃন্দাবনে এসে গোপাল ভট্ট গোস্বামীকে তার শালগ্রাম শিলাগুলির জন্য বস্ত্র ও অলংকার দান করতে এসেছিলেন। কিন্তু গোপাল ভট্ট গোস্বামী সেগুলি নিতে চাননি। কারণ, গোলাকার শালগ্রাম শিলায় সেগুলি ব্যবহার করা যায় না। তিনি দাতাকে অন্য কোথাও সেগুলি দান করতে বলেন। কিন্তু দাতা তা করতে অস্বীকার করেন এবং গোপাল ভট্ট গোস্বামীকেই সেগুলি দান করে যান।

পূর্ণিমার সন্ধ্যায় শালগ্রাম শিলার শীতল দানের পর গোপাল ভট্ট গোস্বামী শিলাগুলিকে একটি বাঁশের ঝুড়ি ঢাকা দিয়ে শয়ান দেন। পরদিন সকালে তিনি যমুনায় স্নান করতে যান। ফিরে এসে পূজার জন্য শিলাগুলি বের করতে গিয়ে তিনি দেখেন সেগুলির মধ্যে একটি বংশীবাদনরত কৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে। মোট এগারোটি শিলা রয়েছে এবং দ্বাদশ শিলাটি বিগ্রহে পরিণত হয়েছে। দামোদর শিলাটি ‘ত্রিভঙ্গানন্দ কৃষ্ণে’র রূপ ধারণ করেছে। মনে করা হয়, এই ভাবেই “কৃষ্ণ তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করেন এবং শিলা থেকে মূর্তিতে রূপান্তরিত হন।” রাধারমন নাম কৃষ্ণের  একটি বিশেষ অর্থ বহন করে। ‘রাধারমণ’ শব্দটির অর্থ রাধার প্রেমিক (‘রমণ’)।

রাধারমণের আবির্ভাব সংক্রান্ত এই কিংবদন্তিটি দেবতা-মানব প্রেম সম্পর্কের দিকে আলোকপাত করে। তাই এটি তাত্ত্বিক দিক থেকে সর্বোচ্চ সত্যের কেন্দ্রীয় স্থান অধিকার করে আছে বলে মনে করা হয়। মন্দির রাধারমণ বিগ্রহটি বৃন্দাবনের বিখ্যাত

রাধারমণ মন্দিরে পূজিত হয়। এই মন্দিরটি প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো। বৃন্দাবনের এই একটি মন্দিরেই বিগ্রহ একাদিক্রমে দীর্ঘতম সময় মন্দিরে পূজিত হয়েছে। উল্লেখ্য, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনী ১৭শ শতাব্দীতে বৃন্দাবনে মূর্তিধ্বংসকারী অভিযান চালালে, বৃন্দাবনের সকল বিগ্রহ শহরের বাইরে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল।

বর্তমান কালে এই মন্দিরে রাতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। দেশবিদেশ থেকে বহু ভক্ত এই মন্দিরে প্রতি বছর তীর্থযাত্রায় আসেন।
ভক্তেরা এই বিগ্রহটিকে জীবন্ত মনে করেন। তারা মনে করেন যে, দেবতা দৈনিক একটি পরিবারকে তার সেবার সুযোগ দেন। 


মূর্তির সাজসজ্জা


রাধারমণ বিগ্রহটিকে ময়ূরপুচ্ছ, মুকুট, হলুদ কাপড় ও বক্ষস্থলে উজ্জ্বল বৈজয়ন্তী মালা দিয়ে সাজানো হয়। কানেও অলংকার থাকে এবং কপালে থাকে একটি সুন্দর তিলক।

Post a Comment

0 Comments