ধারাবাহিক শ্রী জগন্নাথ লীলা মহিমা। ♥ পর্ব - ২১ ♥ আজকের লীলাঃ জগন্নাথের রান্নাঘর

ধারাবাহিক শ্রী জগন্নাথ লীলা মহিমা।
 পর্ব - ২১
আজকের লীলাঃ জগন্নাথের রান্নাঘর


পুরুষোত্তম জগন্নাথ। জগতের প্রভু মানা হয় তাঁকে। রথযাত্রার সময় সারা পৃথিবীর নজর থাকে ওড়িশার পুরীর দিকে। প্রভু জগন্নাথের মন্দির যেমন বিখ্যাত,  তেমনি বিখ্যাত মন্দিরের হেঁশেল।

পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রান্নাঘরকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রান্না বলে দাবী করা হয়। বলা হয় যে, দেবী মহালক্ষ্মী স্বয়ং প্রভুর জন্য রন্ধন করেন ও দক্ষিণাকালী এই স্থানকে রক্ষা করেন |

পুরাণ থেকে শুরু করে লোককথা, হাজার এক গল্প আছে এই হেঁশেল নিয়ে। তেত্রিশ কোটি দেবতার দেশে জগন্নাথের রান্নাঘর আলাদা সম্ভ্রম জাগায় মানুষের মধ্যে। বাইরের দুনিয়ার কাছে এ এক আশ্চর্য আগ্রহের জায়গা। জগন্নাথের মহাপ্রসাদের জন্য আকুল হয় মানুষ। কথিত আছে, ভগবান ভোজন করেন এই নীলাচলে | আর রাজ্য শাসন করেন দ্বারকায় ও বদ্রীনাথে শয়ন করেন |

জগন্নাথদেবের প্রসাদ রান্না হয় মন্দিরের হেঁশেলে। এমন আশ্চর্য হেঁশেল দেশ তো বটেই বিশ্বেও আর কোথাও নেই। প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার লোক জগন্নাথের প্রসাদ পায়। উৎসবের সময় সংখ্যাটা লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে কয়েক হাজার মানুষের রান্না। দু’হাজার বছর ধরে চলে আসা প্রথা ও কঠোর নিয়ম মেনে সবটা করা হয়। কোথাও এতটুকু বিচ্যুতি নেই।

জগন্নাথের শ্রীমন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পাকশালার অবস্থান। দৈর্ঘে ১৫০ ফুট, প্রস্থে ১০০ ফুট। উচ্চতা ২০ ফুট। ৯টি ভাগে বিভক্ত। যাদের দুটি ভাগ ২৫০০ বর্গফুট করে এবং বাকি ৭টি ভাগ তার চেয়ে একটু ছোট। ৩২ টি প্রকোষ্ঠ মানে ঘর আছে।

আগের রান্নাঘর ছিল সত্যনারায়ণ মন্দিরের পিছন দিকে। ১৬৮০-১৭১৩ সালের মধ্যে তৈরি হয় নতুন রান্নাঘর।
জগন্নাথের ছাপান্ন ভোগ জগৎ বিখ্যাত। দিনে মোট ৬ বার ভোগ দেওয়া হয়। প্রথম ভোগকে বলা হয় গোপাল বল্লভ ভোগ। দ্বিতীয় প্রসাদ সকাল ১০ টায়।  তৃতীয় প্রসাদ সকাল ১১ টায়। দুপুর সাড়ে ১২ টায় মধ্যণ ধূপ। সন্ধে ৭ টার সময় সান্ধ্য ধূপ। রাত ১১ টায় বড় সিঙ্গার।

২৫০ টি উনুনে রান্না হয় জগন্নাথ স্বামীর ভোগ। আয়তাকার উনুন। মাটির তৈরি। উনুনের নামগুলোও আলাদা আলাদা। অন্ন চুলি, আহিয়া চুলি, পিথা চুলি। অন্ন চুলি অন্ন গোত্রের পদ রান্না করা হয়। জগন্নাথের ভোগে যত রকম ডাল পরিবেশন করা হয় সেই সব ধরনের ডাল আর তৈরি হয় ‘আহিয়া চুলি’তে। আর পিঠে বানানো হয় পিথা চুলি’তে। এরকম ১০ টি পিথা চুলি আছে। পিথাচুলি কেবলমাত্র কংক্রিটের তৈরি। কাঠের আগুনে রান্না হয়। কোথাও কোনওরকম বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয় না। তেলের বাতি জ্বেলে রান্না সম্পন্ন হয়। ভোগ রান্নার সঙ্গে যুক্ত সকলেই প্রভু জগন্নাথের সেবক।  ৬০০ জন রাঁধুনি হেঁশেল সামলান। তাঁদের সাহায্য করে আরও ৪০০ জন।  একদিনে প্রায় ১০- ১৫ হাজার লোক এই প্রসাদ পায়।

রান্নার পদ্ধতিও ভারী অদ্ভুত। চুলিতে একটির উপর আর একটি পাত্র বসানো হয়। এভাবে প্রায় নয়টি পাত্র থাকে । একদম তলার পাত্রটিই কেবল আগুনের তাপ পায়। সেই পাত্র থেকে বাকি পাত্রে তাপ ছড়িয়ে পড়ে।

এভাবেই নীচের থেকে  উপরের পাত্রে রান্না সম্পন্ন হয় । রান্নাঘরের পুর দায়িত্ব সামলানোর জন্য এক হাজার সেবক । তার মধ্যে ৫০০ সেবক রয়েছে কেবলমাত্র চুলিতে রান্নায় সাহায্য করার জন্য। রান্নাঘরে যে সেবকরা থাকে তাদের বয়স যখন ১২ বছর হয় তখন থেকে তারা ট্রেনিং এ নেমে পড়ে এভাবে তারা বংশানুক্রমে প্রাপ্ত নির্দিষ্ট সেবা সারাজীবন ধরে অর্থাত্‍ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করে থাকে ।

রান্নাঘরে আগুনকে বলা হয় ‘বিষ্ণু অগ্নি’। ‘বিষ্ণু অগ্নি’ জগন্নাথেরই আর এক রূপ মানা হয়। যে কারনে এই আগুন কোনও সময় নেভে না। প্রচলিত বিশ্বাস দেবী মহালক্ষ্মী নিজেই রান্না করেন পাকশালায়। রান্নাঘরের কাজে যুক্ত সকলেই তাই সেবক।  রথযাত্রার আগে প্রভু জগন্নাথ যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন  দেবী মহালক্ষ্মী নিজে রান্নায় তেমন নজর দিতে পারেন না। তাই বছরের ওই কটা দিন পাকশালার পদে তেমন স্বাদ থাকে না। জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা মাসির বাড়ি চলে যাওয়ার পর তেমনই ঝিমিয়ে থাকে রান্না ঘরের কাজ। দেবীর মন বসে না রান্নাবান্নায়।

রান্নার সময় হেঁশেল চত্বরে যদি কোনও সারমেয় দেখা যায় তাহলে রান্না করা সমস্ত পদ ফেলে দেওয়া হয়। আবার নতুন করে রান্না করতে হয় সব। 
চার ধরনের রান্না হয়। ভীমপাকা, নালপাকা, সৌরপাকা, গৌরিপাকা। ১০০টির উপর পদ। এখানে আরেকটি অদ্ভুত বিষয় হল রান্না করার জন্য এখানে গঙ্গা আর যমুনা নদী এই দুই নদীর নামে দুটি নলকূপ আছে। রান্নাঘরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাইরে থেকে দেখা যায় না। এখানে কোন পুরাতন পাত্রে রান্না করা হয় না। প্রত্যেকদিন রান্নার জন্য নতুন পাত্রে রান্না করা হয়।  তাই মাটির পাত্র।

প্রতিদিন যা  রান্না হয় তার দুটি ভাগ। পাক্কা এবং সুক্কা । যেমন ডাল , চাল , খিচুরী এবং যেগুলো সিদ্ধ করা সবজি তা হল ‘পাক্কা’ । অপরদিকে ‘সুক্কা’ বলা হয় বিস্কিট , মিষ্টান্ন আর বিভিন্ন ধরনের পিঠা। জগন্নাথের জন্য যেসমস্ত ফল ও সবজি ব্যবহার করা হয় সেগুলো দু হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শুধুমাত্র স্থানীয়ভাবে উত্‍পাদিত সবজি ও ফলই জগন্নাথের জন্য ব্যবহৃত হয় । অন্য কোন অঞ্চল থেকে উত্‍পাদিত দ্রব্য জগন্নাথের জন্য ব্যবহার করা হয় না ।

জগন্নাথ দেবের ভোগে কিছু দ্রব্য ও বস্তুকে নিষিদ্ধ করা আছে , যেমন, সিদ্ধ চাল , গোল আলু , পেঁয়াজ , রসুন , সাদা লবন , কলে পেষা আটা , ঢ্যাঁড়স , চিনি , ডাঁটা , লাউ , কপি।

রান্নাঘরের মশলাপাতি আসে মহালক্ষ্মী ভান্ডার থেকে। সুয়ারা নিজোগা কো-অপারেটিভ সোসাইটি পরিচালনা করে। রান্না করতে যেসব মাটির পাত্র ব্যবহার করা হয় তাও আসে নিজোগা সোসাইটির মৃৎশিল্পীদের থেকে। আগে উড়িষ্যার বিভিন্ন জঙ্গল থেকে উনুনের জ্বালানি আসত। কিন্তু জঙ্গল জাতীয়করণের পর কাঠ আসে স্টেট ফরেস্ট কর্পোরেশন থেকে।
সারা বছর ধরেই সমপরিমান প্রসাদ রান্না করা হয়। কিন্তু ওই একই পরিমান প্রসাদ দিয়ে কয়েক হাজার মানুষ হোক বা ২০ লক্ষ মানুষকে খাওয়ানো হোক তবু প্রসাদ কখনও নষ্ট হয় না বা কখনও কম পড়ে না।

প্রথমে জগন্নাথকে ভোগ নিবেদন করার পর তা বিমলাকে দেবীকে দেওয়া হয়। তারপর সেই মহাভোগ বিতরণ করা হয় ভক্তদের মধ্যে। বলা হয় মাটির পাত্রে রান্না করা ভোগ যখন জগ্ননাথকে নিবেদন করা হয় তখন তাতে কোনও গন্ধ থাকে না। পরে তা থেকে সুগন্ধ আসে। তার অর্থ এই প্রসাদ জগন্নাথের আশীর্বাদপ্রাপ্ত।

জগন্নাথের ভোগের পরে সেই প্রসাদ পীঠদেবী বিমলাকে নিবেদিত হয় | এরপরেই তা মহাপ্রসাদ আখ্যা পায় | উল্লেখ্য যে,এই মহাপ্রসাদে স্পর্শদোষ, উচ্ছিষ্টদোষ বা জাতিবিচার নেই |

Post a Comment

0 Comments