সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ (ভাগবতের আলোকে)

সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ (ভাগবতের আলোকে)





ভাগবতে সূর্য ও চন্দ্র গহণের ব্যাখ্যা অনেকটা বিজ্ঞানের মত । তবে ভাগবতের সাথে কিছুটা পার্থক্য আছে ।

আলোর সামনে কোন পদার্থ থাকলে তার ঠিক বিপরীত দিকে ছায়া পড়ে । সূর্যের আলোর সামনে অবস্থিত পৃথিবীর একটি ছায়া প্রতিনিয়ত মহাশূন্যে পড়ছে । সে ছায়া যখন চন্দ্রের উপর পড়ে তখন চন্দ্র গ্রহণ হয় । চন্দ্র, পৃথিবী ও সূর্য একই সরল রেখার হলে চন্দ্র গ্রহন হয় সকল পূর্ণিমা তিথিতেই চন্দ্র সূর্যের বিপরীত দিকে ও পৃথিবীর পশ্চাতে এক সরল রেখায় থাকে । তবে বছরে প্রত্যেক মাসে পূর্ণিমা তিথিতে চন্দ্র গ্রহন হয় না কেন?

সৌরজগৎ সহ সূর্যের সঞ্চার বৃত্তের দুই স্থানের সঙ্গে সূর্যের আকর্ষন দ্বারা পরিচালিত পৃথিবীর সূর্য প্রদক্ষিন কক্ষের দুই স্থান স্পর্শিত হয়ে যেমন শারদ বিষুব ও বাসন্তী বিষুব সৃষ্টি হয়েছে । ঠিক তেমনি উপবৃত্ত পৃথিবী কক্ষের দুই স্থান ও চন্দ্রের উপবৃত্ত কক্ষ পরিধির প্রান্তদ্বয়ে সম্পাত সংগঠিত হয়েছে । এই সম্পাতকে ভাগবতে রাহু নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে । রাহুতে উপস্থিতির সময় যদি চন্দ্রের পূর্ণিমা হয়, তবে পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রের উপর পড়ে গ্রহণ ঘটায় । রাহু দ্বারা আড়ষ্ট না হলে পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রকে আচ্ছাদিত করতে পারে না । তাই বছরে সকল পূর্ণিমা তিথিতে চন্দ্রগ্রহন হয় না । বছরে চন্দ্র গ্রহন নাও হতে পারে আবার তিনটি পর্যন্ত হতে পারে, তবে পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ বছরে একাধিক হয় না ।

পৃথিবীর ছায়ার মধ্যে চন্দ্রের যত অংশ প্রবিষ্ট হয় তত অংশই গ্রস্ত হয় একে আংশিক গ্রহন বলা হয় । ভাগবতে রাহুকে ছায়া গ্রহ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । সূর্য গ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণে রাহুর যথেষ্ট প্রভাব আছে । সূর্য গ্রহণের ক্ষেত্রে রাহু আড়ষ্ট চন্দ্র সূর্যকে আচ্ছাদিত করে এবং চন্দ্র নিক্ষিপ্ত ছায়াটি পৃথিবীর কোনো অংশের উপর দিয়ে যায় । চন্দ্র গ্রহণের ক্ষেত্রে রাহু আড়ষ্ট চন্দ্র পৃথিবী নিক্ষিপ্ত ছায়াতে প্রবেশ করে ।

সূর্য গ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণ সংক্ষিপ্তকালের বিষয় হইলেও ভাগবতে সূর্যের স্বল্পস্থায়ী পূর্ণগ্রাস গ্রহণকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছে । অমাবস্যা হলেই সূর্য গ্রহণ বা পূর্ণিমা হলেই চন্দ্র গ্রহণ ঘটে না । গ্রহণ ঘটানোর জন্য চন্দ্রের রাহু আড়ষ্ট হওয়া চাই । এটি ভাগবতে বর্ণনা করা আছে ।

সূর্য গ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন

১। চন্দ্র পৃথিবীর চারেদিকে ঘূর্ণায়মান
২। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণায়মান
৩। চন্দ্র ও পৃথিবীর কক্ষ পথে উপবৃত্তকার ।
৪। পূর্ণিমাতে চন্দ্র সূর্যের বিপরীতে অবস্থান করতে হবে

উপরোক্ত বিষগুলো ভাগবতের আলোকে প্রমাণ করা আছে ।

রাহুর মস্তককে ছায়া গ্রহে রূপান্তর
শিরস্ত্বমরতাং নীতমজো গ্রহমচীক্লপৎ ।
যস্ত্ত পর্বণি চন্দ্রার্কাবভিধাবতি বৈরধীঃ ।। (ভাগবত ৮/৯/২৬)

অনুবাদ
 
রাহুর মস্তক অমৃতের স্পর্শ লাভ করিবার ফলে অমর হইয়াছিল । তাই ব্রহ্মা রাহুর মস্তককে একটি ছায়া গ্রহরূপে স্বীকৃত দিয়াছিলেন । রাহু যেহেতু চন্দ্র ও সূর্যের চিরশত্রু, তাই সে অমাবস্যা এবং পূর্ণিমা তিথিতে চন্দ্র এবং সূর্যের প্রতি ধাবিত হয় ।

এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে ব্রহ্মা রাহুকে একটি ছায়া গ্রহে পরিণত করেছেন । রাহু নামক এই ছায়া গ্রহটি অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে চন্দ্র ও সূর্যের প্রতি ধাবিত হয় কিন্তু প্রত্যেক সময়ে তাদের আচ্ছাদিত বা আড়িষ্ট করতে পারে না । ফলে গ্রহণ হয় না ।

রাহু দ্বারা চন্দ্র ও সূর্য আচ্ছাদনের চেষ্টা

যদদস্তরণের্মন্ডলং প্রতপতস্তদ্বিস্তরতো যোজনাযুতমাচক্ষতে দ্বাদশসহস্রং সোমস্য
ত্রয়োদশসহস্রং রাহোর্যঃ পর্বণি তদ্ব্যবধানকৃদ্‌বৈরানুবন্ধ সূর্যাচন্দ্রসাবভিধাবতি ।। (ভাগবত ৫/২৪/২)

অনুবাদ
 
তাপের উৎস সূর্যমন্ডল ১০,০০০ যোজন এবং রাহুমণ্ডলের বিস্তার ৩০,০০০ যোজন । পূর্বে অমৃত বিতরনের সময়, রাহু সূর্য এবং চন্দ্রের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করিয়া শত্রুতা সৃষ্টি  করিতে চেষ্টা করিয়াছিল । রাহু সূর্য এবং চন্দ্র উভয়েরই প্রতি বৈরীভাবাপন্ন এবং তাই সে প্রত্যেক অমাবস্য ও পূর্ণিমাতে তাহাদের আচ্ছদিত করিতে চেষ্টা করে ।

এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে প্রত্যেক অমাবস্য বা পূর্ণিমাতে রাহু নামক ছায়া গ্রহ সূর্য ও চন্দ্রকে আচ্ছাদিত করার চেষ্টা করে ।

রাহুর আক্রমনের ফলে গ্রহণ হয়

তন্নিশম্যোভয়ত্রাপি ভগবতা রক্ষণায় প্রযুক্তং সুদর্শনং নাম ভাগবতং দয়িতমস্ত্রং
তত্তেজসা দুর্বিষহং মুহুঃ পরিবর্তমানমভ্যবস্থিতো মূহুর্তমদ্বিজমানশ্চকিতহৃদয় আরাদেব বিবর্তিতে তদুপরাগমিতি বদন্তি লোকাঃ ।। (ভাগবত ৫/২৪/৩)

অনুবাদ
 
চন্দ্র ও সূর্যের কাছে রাহু আক্রমনের কথা অবগত হইয়া ভগবান শ্রীবিষ্ণু চন্দ্র ও সূর্যকে রক্ষা করিবার জন্য তাঁহার শক্তিযুক্ত পরম প্রিয় সুদর্শন নামক অস্ত্র প্রয়োগ করেন । অবৈষ্ণবদের সংহার করিবার জন্য প্রচন্ড তাপ এবং জ্যোতি সমন্বিত সুদর্শন রাহুর কাছে অসহ্য হইয়াছিল এবং তাহার ফলে সে পলায়ন করিয়াছিলেন । রাহু যখন সূর্য এবং চন্দ্রকে আড়ষ্ট করে, লোকে তাহাকে গ্রহণ বলে ।

এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে রাহু যখন সূর্য বা চন্দ্রকে আড়ষ্ট বা আক্রমন করে তখন তাকে গ্রহন বলে । এটা থেকে উপলব্ধি করা যায়, গ্রহন সম্বন্ধে ভাগবতের আলোচনা বিজ্ঞানীদের আলোচনা থেকেও গঠনমূলক ।
সূর্য গ্রহণ সর্ম্পকে পবিত্র বেদ
"যত্ ত্ব সূর্য স্বর্ভানু
স্তমসাবিধ্যদাসুরঃ।
অক্ষেত্রবিদ্ যথা মুগ্ধো
ভুবনান্যদীধয়ু।। (ঋগ্বেদ ৫/৪০/৫)

অনুবাদ

হে সূর্য যাকে তুমি তোমার নিজ আলো উপহার স্বরুপ প্রদানকরেছ,(চাঁদ)তাঁর দ্বারা যখন তুমি আচ্ছাদিত হয়ে যাও ,তখন আকস্কিক অন্ধকারেপৃথিবী ভীত হয়ে যায়।

Post a Comment

0 Comments