মহারাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি যক্ষের প্রশ্ন??



মহাভারতের বনপর্বে বর্ণিত আছে, বনবাসকালে একদিন পঞ্চপান্ডব তৃষ্ণার্ত হলে যুধিষ্ঠির মহারাজ প্রথমে নকুলকে নিকটস্থ কুণ্ডে জল আনতে পাঠালেন। নকুল জল আনতে গেলে এক যক্ষের আকাশবাণী হলো যে, তাঁর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে যেন এই কুণ্ডের জল পান না করে। যক্ষের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই জল পান করায় নকুলের মৃত্যু হলো, তাকে খুঁজতে এসে সহদেব এবং পরপর অর্জুন ও ভীমেরেও মৃত্যু হলো। পরিশেষে, যুধিষ্ঠির কুণ্ডের তীরে এলে যক্ষের বাণী শুনে তার উত্তর দিতে সম্মত হলেন। তখন বকরূপী যক্ষ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস শুরু করিলেন।

যক্ষ বললেন,  "ব্রাহ্মণগণের দেবত্ব কী ও তাঁদের কোন ধর্ম সাধুধর্ম, তাঁদের মনুষ্যভাব কী এবং কী প্রকার ভাবই বা অসাধু ভাব?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "বেদপাঠ তাঁদের দেবভাব, তপস্যা সাধুধর্ম, মৃত্য মনুষ্যভাব এবং পরীবাদ অসাধুভাব"

যক্ষ বললেন, "ক্ষত্রিয়গণের দেবভাব, সাধুভাব, মনুষ্যভাব এবং অসাধুভাবই বা কী?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "ক্ষত্রিয়গণের অস্ত্রশস্ত্র দেবভাব, যজ্ঞ সাধুভাব, ভয় মনুষ্যভাব এবং পরিত্যাগ অসাধুভাব।"

যক্ষ বললেন, "আবপনকারী, নিবপনকারী, প্রতিষ্ঠমান এবং প্রসবকারী তাদের কী কী শ্রেষ্ঠ?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "আবপনকারীদের বৃষ্টি, নিবপনকারীদের বীজ, প্রতিষ্ঠামানদের ধেনু এবং প্রসূতিদের পুত্রই শ্রেষ্ঠ।"

যক্ষ বললেন, "কোন ব্যক্তি ইন্দ্রিয়সুখানুভবে সমর্থ, বুদ্ধিমান, লোকপূজিত ও সর্বপ্রাণীর সম্মত হয়ে জীবন থাকতেও জীবিত না?
যুধিষ্ঠির বললেন, " যে ব্যক্তি দেবতা, অতিথি, ভৃত্য, পিতৃলোক ও আত্মা তাদের নিমিত্ত নির্বপণ না করে, সেই ব্যক্তিই জীবন থাকতেও জীবিত না।

যক্ষ বললেন, "পৃথিবী অপেক্ষাও গুরুতর কে, আকাশ অপেক্ষাও উচ্চতর কে, বায়ু অপেক্ষা শীঘ্রগামী কে, আর কাদের সংখ্যা তৃণ অপেক্ষাও বহুতর?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "মাতা পৃথিবী অপেক্ষা গুরুতর, পিতা আকাশ অপেক্ষা উচ্চতর, মন বায়ু অপেক্ষা শ্রীঘ্রগামী এবং চিন্তা তৃণ অপেক্ষা বহুতর।"

যক্ষ বললেন, "কে নিদ্রিত হলে নয়ন মুদিত করে না, কে জন্মিয়া স্পন্দিত হয় না, কাদের হৃদয় নাই এবং কে বেগে বর্ধিত হয়?""
যুধিষ্ঠির বললেন, "মৎস্য নিদ্রিত হলে নয়ন মুদিত করে না, অণ্ড জন্মিয়া স্পন্দিত হয় না, পাষাণের হৃদয় নাই এবং নদী বেগে বর্ধিত হয়।"

যক্ষ বললেন, "প্রবাসীর মিত্র কে, গৃহবাসীর মিত্র কে, আতুরের মিত্র কে এবং মুমূর্ষ ব্যক্তির মিত্র কে?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "প্রবাসীর সঙ্গী, গৃহবাসীর ভার্যা, আতুরের চিকিৎসক এবং মুমূর্ষ ব্যক্তির দানই মিত্র।"

যক্ষ বললেন, "কে সর্বভূতের অতিথি, সনাতন ধর্ম কী, অমৃত কী এবং সমুদয় জগৎ কী পদার্থ?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "অগ্নি সর্বভূতের অতিথি, সলিল ও যজ্ঞশেষ অমৃত, জ্ঞানযোগ সনাতন ধর্ম এবং বায়ু সমুদয় জগৎ।"

যক্ষ বললেন, "ধর্মের একমাত্র আশ্রয় কী, যশের একমাত্র আশ্রয় কী, স্বর্গের একমাত্র আশ্রয় কী এবং সুখের একমাত্র আশ্রয় কী?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "দাক্ষ্য ধর্মের, দান যশের, সত্য স্বর্গের এবং শীল সুখের একমাত্র আশ্রয়।"

যক্ষ বললেন, "ধন্যের মধ্যে উত্তম কী, ধনের মধ্যে উত্তম কী, লাভের মধ্যে উত্তম কী এবং সুখের মধ্যে উত্তম কী?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "ধন্যের মধ্যে দাক্ষ্য, ধনের মধ্যে শাস্ত্র, লাভের মধ্যে আরোগ্য এবং সুখের মধ্যে সন্তোষই উত্তম।"

যক্ষ বললেন, "প্রধান ধর্ম কী, কোন ধর্ম সর্বদা ফলবান, কাকে সংযত করলে শোক থাকে না এবং কাদের সাথে সন্ধি করলে সে সন্ধি ভঙ্গ হয় না?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "অনৃশংস্য প্রধান ধর্ম, বৈদিক ধর্ম সর্বদা ফলবান, মনকে সংযত করলে শোক থাকে না এবং সাধুর সাথে সন্ধি হলে ভঙ্গ হয় না।"

যক্ষ বললেন, "কী ত্যাগ করলে প্রিয় হয়, কী ত্যাগ করলে শোক হয় না, কী ত্যাগ করলে অর্থবান হয় এবং কী ত্যাগ করলে সুখী হয়?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "অভিমান ত্যাগ করলে প্রিয় হয়, ক্রোধ ত্যাগ করলে শোক থাকে না, কামনা ত্যাগ করলে অর্থবান হয় এবং লোভ ত্যাগ করলে সুখী হয়।"

যক্ষ বললেন, "লোকসকল কীসের দ্বারা আবৃত ও কীসের দ্বারা অপ্রকাশিত থাকে, কী জন্য মিত্রগণকে পরিত্যাগ করে এবং কী জন্যই বা স্বর্গগমনে অসমর্থ হয়?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "লোকসকল অজ্ঞানে আবৃত থাকে, তমোদ্বারা অপ্রকাশিত থাকে, লোভহেতু মিত্রগণকে পরিত্যাগ করে এবং সঙ্গহেতু স্বর্গগমনে অসমর্থ হয়।"

যক্ষ বললেন, "মৃত পুরুষ কে, মৃত রাষ্ট্র কী, মৃত শ্রাদ্ধ কী এবং মৃত যজ্ঞই বা কী?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "দরিদ্র পুরুষই মৃত, অরাজক রাষ্ট্রই মৃত রাষ্ট্র, আশ্রোত্রিয় শ্রাদ্ধই মৃত শ্রাদ্ধ এবং অদক্ষিণ যজ্ঞই মৃত যজ্ঞ।"

যক্ষ বললেন, "তপ, দম, ক্ষমা ও লজ্জার লক্ষণ কী?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "স্বধর্মানুবর্তিত্বই তপ, মনের নিগ্রহই দম, দ্বন্দ্বসহিষ্ণুতাই ক্ষমা, অকার্য হতে নিবৃত্তিই লজ্জা।"

যক্ষ বললেন, "জ্ঞান, শম, দয়া এবং আর্জব কাকে বলে?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "তত্ত্বার্থোপলব্ধিই জ্ঞান, চিত্তের প্রশান্ততাই শম, সকলের সুখ ইচ্ছা করাই দয়া এবং সমচিত্ততাই আর্জব।"

যক্ষ বললেন, "পুরুষের কোন শত্রু দুর্জয়, কোন ব্যাধি অনন্ত, কীদৃশ লোক সাধু, কীদৃশ লোকই বা অসাধু?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "ক্রোধ দুর্জয় শত্রু, লোভ অনন্ত ব্যাধি, সকল প্রাণীর হিতকারী ব্যক্তি সাধু এবং নির্দয় ব্যক্তিই অসাধু।"

যক্ষ বললেন, "ঋষিগণ স্থৈর্য, ধৈর্য, স্নান ও দানের কী লক্ষণ করেছেন?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "স্বধর্মে স্থিরতাই স্থৈর্য, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ ধৈর্য, মনোমালিন্য-পরিত্যাগই স্নান এবং প্রাণীগণকে রক্ষা করাই দান - এই লক্ষণ নির্দিষ্ট আছে।"

যক্ষ বললেন, "পন্ডিত কে, নাস্তিক কে, মূর্খ কে, কাম কী এবং মৎসরই বা কী?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "ধর্মজ্ঞ ব্যক্তি পন্ডিত, মূর্খই নাস্তিক, নাস্তিকই মূর্খ, সংসারহেতুই কাম ও হৃদয়ের তাপই মৎসর (ঈর্ষা)।"

যক্ষ বললেন, "অহঙ্কার, দম্ভ, দৈব এবং পৈশুন্য কী?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "অজ্ঞানরাশিই অহঙ্কার, ধর্মধ্বজের উন্নমনই দম্ভ, দানের ফলই দৈব এবং পরের প্রতি দোষারোপ করাই পৈশুন্য।"

যক্ষ বললেন, "ধর্ম, অর্থ ও কাম তারা পরস্পরবিরোধী, তবে কী প্রকারে তাদের একত্র সমাবেশ হয়?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "যখন ধর্ম ও ভার্যা এই উভয়ে পরস্পর বশানুগ হয়, তখনই ধর্ম, অর্থ ও কাম এই তিনের একত্র সমাবেশ হয়ে থাকে।"

যক্ষ বললেন, "হে রাজন, তুমি শীঘ্র বল, কোন কর্ম করলে অক্ষয় নরকে গমন করতে হয়?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "যে ব্যক্তি যাচমান অকিঞ্চন ব্রাহ্মণকে স্বয়ং আহবান করে পরিশেষে 'নাই' বলে বিদায় করে, যে ব্যক্তি বেদ, ধর্মশাস্ত্র, দ্বিজাতি, দেবতা ও পৈতৃক ধর্ম মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করে এবং যে ব্যক্তি ধন বিদ্যমান থাকতেও 'নাই' বলে দান ও ভোগে পরাঙ্মুখ হয়ে থাকে, তাদেরই অক্ষয় নরকে গমন করতে হয়।"

যক্ষ বললেন, "হে রাজন, কুল, বৃত্ত, স্বাধ্যায় এবং শ্রুত এর মধ্যে কোনটি ব্রাহ্মণত্বের কারণ, তুমি নিশ্চয় করে বল।"
যুধিষ্ঠির বললেন, "ব্রাহ্মণের কেবল অধ্যায়ন, অধ্যাপনা, শাস্ত্রচিন্তা করলেই হবে না, তিনি ক্রিয়াবান যোগনিষ্ঠ হলে হবে তবে যথার্থ পন্ডিত হবেন। চতুর্বেদবেত্তা ব্যক্তিও দুর্বৃত্ত হলে কখনো ব্রাহ্মণ বলে পরিগণিত হন না; কেবল শূদ্র হতে ভিন্ন,  এইমাত্র বিশেষ ; কিন্তু যিনি অগ্নিহোত্রপরায়ণ, তিনি যথার্থ ব্রাহ্মণ।"

যক্ষ বললেন, "প্রিয়বাক্য বললে কি লাভ হয়, বিবেচনাপূর্বক কার্য করলে কী লাভ হয়, বহুমিত্র হলে কি লাভ হয় এবং ধর্মে অনুরক্ত থাকলেই বা কী লাভ হয়ে থাকে?"
যুধিষ্ঠির বললেন, "প্রিয়বাদী সকলের প্রিয় হয়, বিমৃষ্যকারী ব্যক্তি অধিকতর জয়লাভ করে, বহুমিত্রশালী ব্যক্তি সতত সুখে বাস করে এবং ধর্মানুগত ব্যক্তি সদ্ গতি লাভ করে থাকে।"

যক্ষ বললেন, "সুখী কে, আশ্চর্য কী, পথ বা বার্তাই বা কী? এই চার প্রশ্নের উত্তর প্রদান করলে তোমরা ভ্রাতৃগণ জীবিত হবেন।"
যুধিষ্ঠির বলিলেন, "যিনি ঋণশূন্য ও অপ্রবাসী হয়ে দিবসের পঞ্চম বা ষষ্ঠ ভাগে আপন গৃহে শাক পাক করেন, তিনিই সুখী।
প্রাণীগণ প্রতিদিন মৃত্যুমুখে গমন করছে দেখেও অবশিষ্ট লোকে যে চিরজীবন ইচ্ছা করে, তা অপেক্ষা আশ্চর্যের বিষয় আর কী আছে?
তর্কের স্থিরতা নাই, বেদসকল ও স্মৃতিসমূহ ভিন্ন ভিন্ন প্রকার, মুনিও একজন নয়, তাঁদের মতও বিভিন্ন (অথবা) মুনিও একজন নয় যে, তাঁর মতই একমাত্র প্রামাণ্য। আর ধর্মের তত্ত্ব জ্ঞানগুহায় বিলীন হয়েছে; অতএব,  মহাজন যে পথে গমন করেছেন, সেই পথই পথ।
কাল সূর্যরূপ অনলে রাত্রিদিনস্বরূপ ইন্ধন প্রজ্বলিত করে মহামোহরূপ কড়ায় ঋতু ও মাসস্বরূপ দর্বী পরিঘট্টনদ্বারা প্রাণীগণকে যে পাক করতেছে, তাই বার্তা।

যক্ষ বললেন, "হে রাজন, তুমি যথার্থরূপে আমার সমুদয় প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেছ, সকলের মধ্যে ধনী কে তা নিরূপণ করো।"
যুধিষ্ঠির বললেন, "যে ব্যক্তি অতীত বা অনাগত সুখ-দুঃখ ও প্রিয় অপ্রিয় তুল্য জ্ঞান করেন, তিনি সকলের মধ্যে ধনী।"
তথ সূত্র - মহাভারত/অমৃতের সন্ধানে

Post a Comment

0 Comments