বিবিধ গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু শ্লোক
শ্লোক: 19
দ্বাপরীয়ৈর্জনৈর্বিষ্ণুঃ পঞ্চরাত্রৈস্ত্ত কেবলৈঃ ।
কলৌ তু নামমাত্রেণ পূজ্যতে ভগবান্ হরিঃ ।।
(নারায়ণ-সংহিতা)
অনুবাদঃ- দ্বাপরযুগে বৈষ্ণব তথা কৃষ্ণভক্তেরা পাঞ্চরাত্রিক বিধি অনুসারে ভক্তিমূলক সেবা সম্পাদন করতেন। এই কলিযুগে শুধুমাত্র হরিনাম জপকীর্তনের দ্বারাই পরমেশ্বর শ্রীহরি পূজিত হন।
শ্লোক: 20
বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্ ।
(হিতোপদেশ)
অনুবাদঃ- বিদ্যা বিনয় দান করে।
শ্লোক: 21
ওঁ জন্মাদাস্য যতঃ
(বেদান্তসূত্র ১/১/২)
অনুবাদঃ- সেই ব্রহ্ম হচ্ছেন তিনি, যাঁর থেকে প্রকাশিত ব্রহ্মাণ্ডসমূহের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সাধিত হয়।
শ্লোক: 22
ভাবগ্রাহী জনার্দনঃ
(চৈতন্য-ভাগবত আদি ১১/১০৮)
অনুবাদঃ- ভগবান জনার্দন শুধু ভক্তের ভাবটুকুই গ্রহণ করেন।
শ্লোক: 23
শরীর অবিদ্যা-জাল, জড়েন্দ্রিয় তাহে কাল,
জীবে ফেলে বিষয়-সাগরে।
তা'র মধ্যে জিহ্বা অতি, লোভময় সুদুর্মতি,
তা'কে জেতা কঠিন সংসারে ।।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, প্রসাদ-সেবায় ১)
অনুবাদঃ- শরীর একটি অবিদ্যার জাল, ইন্দ্রিয়গুলি যেন কালশত্রু, কেন না সেগুলি জীবকে বিষয় ভোগের সাগরে নিক্ষেপ করে। ওই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্যে জিহ্বা হচ্ছে সবচেয়ে লোলুপ, অসংযত ও দুর্মতিবিশিষ্ট। এই সংসারে জিহ্বাকে জয় করা খুবই কঠিন।
শ্লোক: 24
কৃষ্ণ-বহির্মুখ হঞা ভোগ-বাঞ্ছা করে।
নিকটস্থ মায়া তারে জাপটিয়া ধরে।।
(জগদানন্দ পণ্ডিত, প্রেমবিবর্ত)
অনুবাদঃ- যেই মুহূর্তে কেউ কৃষ্ণের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়ে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা করে, সেই মুহুর্তেই ভগবানের মায়াশক্তি তাকে জড় বন্ধনে আবদ্ধ করে।
শ্লোক: 25
বিষয় ছাড়িয়া কবে শুদ্ধ হবে মন ।
কবে হাম হেরব শ্রীবৃন্দাবন ।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর, গৌরাঙ্গ বলিতে)
অনুবাদঃ- সেদিন আমার কবে হবে যখন আমার মন বিষয় বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ হবে, আমি শ্রীবৃন্দাবন ধামে শ্রীশ্রীরাধা-কৃষ্ণের মাধুর্যপ্রেম উপলব্ধি করতে সক্ষম হব এবং আমার পারমার্থিক জীবন পূর্ণরূপে সাফল্যমণ্ডিত হবে।
শ্লোক: 26
'কাম' কৃষ্ণ-কর্মার্পণে, 'ক্রোধ' ভক্তদ্বেষি-জনে,
'লোভ' ইষ্টলাভ বিনে, 'মদ' কৃষ্ণগুণগানে,
নিযুক্ত করিব যথা তথা ।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর, অন্য অভিলাষ ছাড়ি)
অনুবাদঃ- আমার কর্মফল কৃষ্ণকে নিবেদন করার মাধ্যমে আমি কামকে নিযুক্ত করব। ভক্তবিদ্বেষীদের প্রতি আমার ক্রোধ প্রদর্শন করব। সাধুসঙ্গে হরিকথা শ্রবণ করার জন্য আমি আমার লোভকে নিযুক্ত করব। এই মুহূর্তে আমি আমার আরাধ্য ভগবানক লাভ করতে পারলাম না- এই চিন্তায় আমি মোহগ্রস্ত হব । শ্রীকৃষ্ণের গুণকীর্তনের মধ্যেই আমার মত্ততা প্রকাশিত হবে। এভাবেই এদের আমি কৃষ্ণসেবায় নিযুক্ত করব।
শ্লোক: 27
পিশাচী পাইলে যেন মতিচ্ছন্ন হয়।
মায়াগ্রস্ত জীবের হয় সে-ভাব উদয় ।।
অনুবাদঃ- জীব যখন মায়াগ্রস্ত হয়, তখন তার অবস্থা ঠিক যেন পিশাচীর আক্রমণগ্রস্ত একজন ব্যক্তির মতো ।
শ্লোক: 28
জীব জাগ, জীব জাগ, গোরাচাঁদ বলে ।
কত নিদ্রা যাও মায়া-পিশাচীর কোলে ।।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, অরুণোদয় কীর্তন ২)
অনুবাদঃ- গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ডেকে বলছেন। "হে ঘুমন্ত জীবসকল! উঠ, জেগে উঠ। মায়া পিশাচীর কোলে অনেক ঘুমিয়েছ। আর কত ঘুমাবে?"
শ্লোক: 29
মানস, দেহ, গেহ, যো কিছু মোর ।
অর্পিলুঁ তুয়া পদে, নন্দকিশোর ।।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, শরণাগতি)
অনুবাদঃ- আমার মন, দেহ, গৃহ, যা কিছু রয়েছে, সবই আমি তোমার চরণে অর্পণ করলাম, হে নন্দকিশোর !
শ্লোক: 30
আরাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্।
নারাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্।।
(নারদ-পঞ্চরাত্র)
অনুবাদঃ- যদি শ্রীহরির আরাধনা করা হয়, তা হলে কঠোর তপস্যার কি প্রয়োজন, কেন না তপস্যার লক্ষ্যবস্তু তো লাভ হয়েই গেছে। আর সমস্ত রকমের তপস্যা করেও যদি শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করা না যায়, তা হলে তপস্যার কোনও মূল্য নেই, কেন না শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া সকল তপস্যাই বৃথা শ্রম মাত্র।
শ্লোক: 31
অন্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্ ।
নান্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্ ।।
(নারদ-পঞ্চরাত্র)
অনুবাদঃ- শ্রীহরি যে সর্বব্যাপক, তিনি যে অন্তরে ও বাইরে সর্বত্রই আছেন, এই উপলব্ধি যার হয়েছে, তপস্যায় তার কি প্রয়োজন। আর শ্রীহরি যে সর্বব্যাপক, এই উপলব্ধিই যদি না হল, তা হলে সব তপস্যাই বৃথা ।
শ্লোক: 32
আনুকূল্যস্য সঙ্কল্পঃ প্রাতিকূল্যস্য বর্জনম্ ।
রক্ষিষ্যতীতি বিশ্বাসো গোপ্তৃত্বে বরণং তথা ।
আত্মনিক্ষেপকার্পণ্যে ষড়বিধা শরণাগতিঃ ।।
(হরিভক্তি-বিলাস ১১/৪১৭)
অনুবাদঃ- শরণাগতির ছয় প্রকার লক্ষণ- কৃষ্ণভক্তির অনুকূল যা গ্রহণ করা, কৃষ্ণভক্তির প্রতিকূল বিষয় বর্জন করা, কৃষ্ণ সব সময়ই রক্ষা করবেন এই বিশ্বাস, শ্রীকৃষ্ণকে প্রভুরূপে গ্রহণ করা, সর্বতোভাবে শরণাগত হওয়া এবং দৈন্য ।
শ্লোক: 33
হরিসেবায় যাহা হয় অনুকূল ।
বিষয় বলিয়া তাহার ত্যাগে হয় ভুল ।।
(ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী)
অনুবাদঃ- হরিসেবার অনুকূল বস্তুকে যিনি জড় বিষয় জ্ঞানে পরিত্যাগ করেন, তিনি মহাভুল করছেন ।
শ্লোক: 34
গোলোকের প্রেমধন, হরিনাম সংকীর্তন,
রতি না জন্মিলে কেনে তায় ।
সংসার-বিষানলে দিবানিশি হিয়ে জ্বলে,
জুড়াইতে না কৈনু উপায় ।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর-ইষ্টদেবে বিজ্ঞপ্তি-২, প্রার্থনা থেকে)
অনুবাদঃ- হরিনাম সংকীর্তনরূপে ভগবৎপ্রেম গোলোক বৃন্দাবন থেকে এই জগতে অবতরণ করেছে। কেন আমার তাতে রতি হল না? দিন ও রাত ধরে সংসার বিষের অনলে আমার হৃদয় জ্বলছে। কিন্তু তবুও তাকে প্রশমিত করার কোন উপায় আমি গ্রহণ করছি না।
শ্লোক: 35
যদি বৈষ্ণব-অপরাধ উঠে হাতী মাতা ।
উপাড়ে বা ছিণ্ডে, তার শুখি যায় পাতা ।।
অনুবাদঃ- ভগবদ্ভক্ত যদি এই জড় জগতে ভক্তিলতার সেবা করার সময় কোন বৈষ্ণবের চরণে অপরাধ করেন, তা হলে ভক্তিলতার পাতা শুকিয়ে যায়। এই প্রকার বৈষ্ণব অপরাধকে মত্ত হস্তীর আচরণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।শ্লোক: 36
নারীস্তনা ভারং নাভিদেশং
দৃষ্ট্বা মা গা মোহ বেশ্যাম্ ।
এতাং মাংস বাসাদি বিকারা
মনসি বিচিন্তায় ভারং ভারম্ ।
(শঙ্করাচার্য)
অনুবাদঃ- নারীদের স্তনভার ও সরু নাভিদেশের তথাকথিত সৌন্দর্য দর্শন করে মোহগ্রস্ত বা উত্তেজিত হয়ো না। কারণ, এই আকর্ষণীয় অঙ্গগুলি শুধু চর্বি, মাংস আদি জঘন্য বস্তুর সমন্বয় মাত্র। এই কথা মনে মনে গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করা উচিত।
শ্লোক: 37
শ্রুতিমপরে স্মৃতিমিতরে ভারতমন্যে ভজন্তু ভবভীতাঃ ।
অহমিহ নন্দং বন্দে যস্যালিন্দে পরং ব্রহ্ম ।।
(পদ্যাবলী ১২৬)
অনুবাদঃ- সংসার ভয়ে ভীত মানুষেরা কেউ শ্রুতিকে, কেউ স্মৃতিকে, কেউ বা মহাভারতকে ভজনা করুন; আমি কিন্তু কেবল শ্রীনন্দেরই বন্দনা করি – যাঁর অলিন্দে শ্রীকৃষ্ণ খেলা করেন। (রঘুপতি উপাধ্যায়/ রূপ গোস্বামী)
শ্লোক: 38
তুমি ত ঠাকুর, তোমার কুক্কুর,
বলিয়া জানহ মোরে।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, শরণাগতি)
অনুবাদঃ- তুমি তো পরমেশ্বর ভগবান, অনুগ্রহ করে আমাকে তোমার পোষা কুকুর বলে গণ্য করবে।
শ্লোক: 39
কীটজন্ম হউ যথা তুয়া দাস ।
বহির্মুখ ব্রহ্মজন্মে নাহি আশ ।।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, মানস দেহ গেহ ৫)
অনুবাদঃ- তোমার ভক্ত হয়ে, যেখানে তোমার ভক্তদের বাস, সেখানে কীটরূপে জন্ম নিতেও আমি প্রস্তুত। তবে তোমার প্রতি ভক্তিহীন হয়ে ব্রহ্মার জন্ম লাভ করার ইচ্ছাও আমার নেই।
শ্লোক: 40
হা হা প্রভু নন্দসুত, বৃষভানুসুতাযুত,
করুণা করহ এইবার ।
নরোত্তমদাস কয়, না ঠেলিহ রাঙ্গা পায়,
তোমা বিনা কে আছে আমার।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর)
অনুবাদঃ- হে শ্রীকৃষ্ণ! হে নন্দসুত! হে বৃষভানুর কন্যা শ্রীমতি রাধার সঙ্গী! আমাকে এবার করুণা কর। অবশেষে আমি তোমার রাঙ্গাচরণ পেলাম। কৃপা করে আমাকে সেখান থেকে ঠেলে দিও না। তুমি ছাড়া আমার আশ্রয় আর কে আছে?
শ্লোক: 41
বিষ্ণু অস্য দেবতা ইতি বৈষ্ণবঃ ।
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- যিনি ভগবান বিষ্ণুকে তাঁর আরাধ্যদেব রূপে গ্রহণ করেছেন, তিনিই বৈষ্ণব ।
শ্লোক: 42
নানাশাস্ত্র-বিচারণৈক-নিপুণৌ সদ্ধর্ম-সংস্থাপকৌ
লোকানাং হিতকারিণৌ ত্রিভুবনে মানৌ শরণ্যাকরৌ ।
রাধাকৃষ্ণ-পদারবিন্দভজনানন্দেন মত্তালিকৌ
বন্দে রূপ-সনাতনৌ রঘুযুগৌ শ্রীজীব-গোপালকৌ ।।
(শ্রীশ্রীষড়্ গোস্বামী-অষ্টক-২)
অনুবাদঃ- যাঁরা বিবিধ শাস্ত্র-বিচারে পরম নিপুণ, সৎ-ধর্মের স্থাপনকর্তা, মানবগণের পরম মঙ্গলকারী, ত্রিভুবন-পূজ্য, আশ্রয়দাতা ও শ্রীরাধা-গোবিন্দের পদারবিন্দ ভজনানন্দে প্রমত্ত মধুকর-সদৃশ আমি বারবার সেই শ্রীরূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ দাস ও শ্রীজীব গোস্বামীপাদগণের বন্দনা করি। (শ্রীনিবাস আচার্য)
শ্লোক: 43
ত্যক্ত্বা তূর্ণমশেষ-মণ্ডলপতিশ্রেণীং সদা তুচ্ছবৎ
ভূত্বা দীনগণেশকৌ করুণয়া কৌপীন-কন্থাশ্রিতৌ ।
গোপীভাব-রসামৃতাব্ধিলহরী-কল্লোল-মগ্নৌমুহু-
র্বন্দে রূপ-সনাতনৌ রঘুযুগৌ শ্রীজীব-গোপালকৌ ।।
(শ্রীশ্রীষড়্ গোস্বামী-অষ্টক-৪)
অনুবাদঃ- যাঁরা অসংখ্য মণ্ডলপতিদের সহবাস ঝটিতি তুচ্ছবৎ পরিত্যাগ করে কৃপাপূর্বক দীনহীনগণের পতি হয়ে কৌপীনকন্থা অবলম্বন করেছিলেন এবং যাঁরা গোপীপ্রেম-রসামৃত-সিন্ধু-তরঙ্গে সদাই নিমগ্ন ছিলেন, আমি বারবার সেই শ্রীরূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ দাস ও শ্রীজীব গোস্বামীপাদগণের বন্দনা করি। (শ্রীনিবাস আচার্য)
শ্লোক: 44
সংখ্যাপূর্বক-নাম-গান-নতিভিঃ কালাবসানীকৃতৌ
নিদ্রাহার-বিহারকাদি-বিজিতৌ চাতন্ত্যদীনৌ চ যৌ ।
রাধাকৃষ্ণ-গুণ-স্মৃতের্মধুরিমানন্দেন সম্মোহিতৌ
বন্দে রূপ-সনাতনৌ রঘুযুগৌ শ্রীজীব-গোপালকৌ ।।
(শ্রীশ্রীষড়্ গোস্বামী-অষ্টক-৬)
অনুবাদঃ- যাঁরা সংখ্যাপূর্বক নাম-জপ, কীর্তন ও প্রণাম করে সময় অতিবাহিত করতেন, যাঁরা আহার-বিহার-নিদ্রা আদি জয় করেছিলেন, যাঁরা অত্যন্ত দীন-হীনের মতো বিচরণ করতেন এবং যাঁরা শ্রীশ্রীরাধা-গোবিন্দের গুণ-মাধুর্য স্মরণ করে পরমানন্দে বিভোর হতেন, আমি বারবার সেই শ্রীরূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, গোপালভট্ট, রঘুনাথ দাস ও শ্রীজীব গোস্বামীপাদগণের বন্দনা করি। (শ্রীনিবাস আচার্য)
শ্লোক: 45
হে রাধে ব্রজদেবিকে চ ললিতে হে নন্দসূনো কুতঃ
শ্রীগোবর্ধন-কল্পপাদপ-তলে কালিন্দী-বন্যে কুতঃ ।
ঘোষন্তাবিতি সর্বতো ব্রজপুরে খেদৈর্মহাবিহ্বলৌ
বন্দে রূপ-সনাতনৌ রঘুযুগৌ শ্রীজীব-গোপালকৌ ।।
(শ্রীশ্রীষড়্ গোস্বামী-অষ্টক-৮)
অনুবাদঃ- “হে ব্রজদেবী রাধে! তুমি কোথায়? হে ললিতে! তুমি কোথায়? হে কৃষ্ণ! তুমি কোথায়? তোমরা কি শ্রীগোবর্ধনের কল্পতরুতলে, না কালিন্দী-কূলস্থ বনমধ্যে,”- এভাবেই বলতে বলতে যাঁরা নিরতিশয় শোকাতুর হয়ে ব্রজভূমির সর্বত্র ব্যাকুলভাবে পরিভ্রমণ করতেন, আমি বার-বার সেই শ্রীরূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ দাস ও শ্রীজীব গোস্বামীপাদগণের বন্দনা করি। (শ্রীনিবাস আচার্য)
শ্লোক: 46
নাহং বিপ্রো ন চ নরপতির্নাপি বৈশ্যো ন শূদ্রো
নাহং বর্ণী ন চ গৃহপতির্নো বনস্থো যতির্বা ।
কিন্তু প্রোদ্যন্নিখিলপরমানন্দপূর্ণামৃতাব্ধে-
র্গোপীভর্তুঃ পদকমলয়োর্দাসদাসানুদাসঃ ।।
(পদ্যাবলী ৭৪)
অনুবাদঃ- আমি ব্রাহ্মণ নই, ক্ষত্রিয় রাজা নই, বৈশ্য বা শূদ্র নই, ব্রহ্মচারী নই, গৃহস্থ নই, বাণপ্রস্থ নই, সন্ন্যাসীও নই। কিন্তু আমি নিত্য স্বতঃ প্রকাশমান নিখিল পরমানন্দপূর্ণ অমৃত-সমুদ্ররূপ শ্রীকৃষ্ণের পদকমলের দাসের অনুদাসের দাস। (রূপ গোস্বামী)
শ্লোক: 47
চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠো হরিভক্তিপরায়ণঃ ।
হরিভক্তিবিহীনশ্চ দ্বিজোহপি শ্বপচাধমঃ ।।
(অজ্ঞাত উৎস, শাস্ত্র নির্দেশ)
অনুবাদঃ- চণ্ডালকুলে জন্ম হলেও, কোন ব্যক্তি যদি হরিভক্তি-পরায়ণ হন, তা হলে তিনিও শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণে পরিণত হন। কিন্তু হরিভক্তি-বিহীন ব্যক্তি যদি ব্রাহ্মণও হন, তিনি কুকুরভোজী চণ্ডাল থেকেও অধম।
শ্লোক: 48
মুক্তিপ্রদাতা সর্বেষাং বিষ্ণুরেব ন সংশয়ঃ ।
(শিব)
অনুবাদঃ- ভগবান শ্রীবিষ্ণুই যে সকলের মুক্তি-প্রদাতা, এতে কোন সংশয় নেই।
শ্লোক: 49
ভক্তিস্ত্বয়ি স্থিরতরা ভগবন্ যদি স্যাদ্
দৈবেন নঃ ফলতি দিব্যকিশোরমূর্তিঃ ।
মুক্তি স্বয়ং মুকুলিতাঞ্জলি সেবতেহস্মান্
ধর্মার্থকামগতয়ঃ সময়প্রতীক্ষাঃ ।।
(কৃষ্ণকর্ণমৃত)
অনুবাদঃ- হে ভগবান! কেউ যদি স্থিরভাবে তোমার প্রতি শুদ্ধ ভক্তমূলক সেবা সম্পাদনে নিযুক্ত হন, তা হলে তুমি তাঁর কাছে তোমার দিব্য কিশোররূপে প্রকটিত হও। মুক্তিদেবী স্বয়ং অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে শুদ্ধ ভক্তের সেবা করার জন্য অপেক্ষা করেন। ধর্ম, অর্থ ও কাম তখন পৃথক চেষ্টা ছাড়াই স্বতস্ফূর্তভাবে লাভ করা যায়। (বিল্বমঙ্গল ঠাকুর)
শ্লোক: 50
স্থানাভিলাষী তপসি স্থিতোহহং
ত্বাং প্রাপ্তবান্ দেবমুনীন্দ্রগুহ্যম্ ।
কাচং বিচিন্বন্নপি দিব্যরত্নং
স্বামিন্ কৃতার্থোহস্মি বরং ন যাচে ।।
(হরিভক্তিসুধোদয় ৭/২৮)
অনুবাদঃ- (ভগবান যখন ধ্রুব মহারাজকে বর দিচ্ছিলেন, তখন ধ্রুব মহারাজ বলেছিলেন--) “হে ভগবান, জড়-জাগতিক ঐশ্বর্য এবং পদের কামনা নিয়ে আমি কঠোর তপস্যায় স্থিত হয়েছিলাম। এখন আমি শ্রেষ্ঠ দেবতা এবং মুনিদেরও দুর্লভ আপনাকে লাভ করেছি। আমি এক টুকরো ভাঙ্গা কাঁচের অনুসন্ধান করছিলাম। আমি দিব্যরত্ন লাভ করেছি। তাই আমি এতই কৃতার্থ বোধ করছি যে, আপনার কাছে কোন বর আমি চাই না। ”শ্লোক: 51
অত্যাহারঃ প্রয়াসশ্চ প্রজল্পো নিয়মাগ্রহঃ ।
জনসঙ্গশ্চ লৌল্যঞ্চ ষড়্ ভির্ভক্তির্বিনশ্যতি ।।
(উপদেশামৃত ২)
অনুবাদঃ- প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার গ্রহণ বা প্রয়োজনের অধিক অর্থ সঞ্চয়, পার্থিব সম্পদ লাভের জন্য অত্যধিক প্রচেষ্টা করা, কৃষ্ণবিহীন অনাবশ্যক গ্রাম্য-কথন, পারমার্থিক জীবনে উন্নতি লাভের জন্য প্রয়াস না করে শুধুমাত্র শাস্ত্রের নিয়ম-নীতিগুলি অনুসরণ করার জন্যই তাদের অনুশীলন করার প্রচেষ্টা, বা শাস্ত্রের নির্দেশ অমান্যপূর্বক ব্যক্তিগত খেয়াল বা ইচ্ছা অনুসারে কার্য সম্পাদন করার প্রচেষ্টা, কৃষ্ণ ভাবনাবিমুখ জড় বিষয়ী লোকের সঙ্গ করা, পার্থিব বিষয় লাভ করার বাসনায় ব্যাকুল হওয়া—কোন ব্যক্তি যখন উপরোক্ত ছয়টি দোষের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন তার পারমার্থিক জীবন বিনাশপ্রাপ্ত হয়।
(শ্রীল রূপ গোস্বামী)
শ্লোক: 52
উৎসাহান্নিশ্চয়াদ্ধৈর্যাৎ তত্তৎকর্মপ্রবর্তনাৎ ।
সঙ্গত্যাগাৎ সতোবৃত্তেঃ ষড়্ ভির্ভক্তিঃ প্রসিধ্যতি ।।
(উপদেশামৃত ৩)
অনুবাদঃ- ভক্তিযোগে ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে সেবাকার্য সম্পাদন করার সময় অনুকূলে ছয়টি প্রধান নিয়ম বা বিধি বর্তমান আছে। যথা, সেবাকার্যে উৎসাহ, দৃঢ় বিশ্বাস বা সংকল্প, ধৈর্য ধারণ, নববিধা ভক্তির বিধি অনুসারে সেবাকার্য সম্পাদন, আসক্তি ও অসৎসঙ্গ ত্যাগ, পূর্বতন আচার্যবর্গের পদাঙ্ক অনুসরণ। এই ছয়টি বিধি অনুসারে পারমার্থিক জীবন যাপন করলে ভক্তিযোগে অবশ্যই সিদ্ধিলাভ করা যাবে।
(শ্রীল রুপ গোস্বামী)
শ্লোক: 53
কৃষ্ণভক্তিরসভাবিতা মতিঃ
ক্রীয়তাং যদি কুতোহপি লভ্যতে ।
তত্র লৌল্যমপি মূল্যমেকলং
জন্মকোটিসুকৃতৈর্ন লভ্যতে ।।
(রূপগোস্বামী, পদ্যাবলী-১৪)
অনুবাদঃ- কোটি কোটি জন্ম-জন্মান্তরের সুকৃতির দ্বারাও যা পাওয়া যায় না, অথচ লোভরূপ একটি মূল্য দিয়ে যা পাওয়া যায়, সেই কৃষ্ণভক্তি রসভাবিতা মতি যেখানেই পাও, অবিলম্বে তা ক্রয় করে নাও।
শ্লোক: 54
সর্বোপাধিবিনির্মুক্তং তৎপরত্বেন নির্মলম্ ।
হৃষীকেণ হৃষীকেশ-সেবনং ভক্তিরুচ্যতে ।।
(নারদ পঞ্চরাত্র)
অনুবাদঃ- সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ইন্দ্রিয়ের অধীশ্বর হৃষীকেশের সেবা করার নাম ভক্তি। এই সেবার দুটি ‘তটস্থ’ লক্ষণ—যথা, এই শুদ্ধ ভক্তি সমস্ত উপাধি থেকে মুক্ত এবং কেবল শ্রীকৃষ্ণের সেবায় যুক্ত হবার ফলে নির্মল ।
শ্লোক: 55
অন্যাভিলাষিতাশূন্যং জ্ঞানকর্মাদ্যনাবৃতম্ ।
আনুকূল্যেন কৃষ্ণানুশীলনং ভক্তিরুত্তমা ।।
(ভঃ রঃ সিঃ ১/১/১১)
অনুবাদঃ- যখন উত্তমা ভক্তি জাগ্রত হয়, তখন ভক্তকে অবশ্যই সমস্ত জড় অভিলাষ, অদ্বৈত মায়াবাদ দর্শন এবং সকাম কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হবে। শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছার অনুকূলে ভক্তকে নিরন্তর সেবা অনুষ্ঠান করতে হবে।
শ্লোক: 56
নাচতে উঠে ঘোমটা টানা
(বাংলা প্রবাদ)
অনুবাদঃ- নাচার উদ্দেশ্যে মঞ্চে উঠে কোন মেয়ে যদি আত্মীয়স্বজনদের দেখে লজ্জায় ঘোমটা টানে, তা হাস্যকর।
শ্লোক: 57
ন হি সুপ্তস্য সিংহস্য প্রবিশন্তি মুখে মৃগাঃ ।
(হিতোপদেশ)
অনুবাদঃ- প্রত্যেকেকেই কাজ করতে হবে। এমন কি একটি সিংহও যদি এই প্রত্যাশা নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে যে, তার মুখে হরিণ বা কোন পশু আপনা থেকেই প্রবেশ করবে, তা হলে তার খাদ্য জুটবে না।
শ্লোক: 58
যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- ভগবান শ্রীবিষ্ণু আর যজ্ঞ হচ্ছে অভিন্ন ।
শ্লোক: 59
গুরুমুখপদ্মবাক্য, চিত্তেতে করিয়া ঐক্য,
আর না করিহ মনে আশা ।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর, প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা)
অনুবাদঃ- শ্রীগুরুদেবের মুখপদ্ম-নিঃসৃত উপদেশকে তোমার চিত্তের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ কর এবং অন্য আর কোন কিছুই আশা করো না ।
শ্লোক: 60
ন মেহভক্তশ্চতুর্বেদী মদ্ভক্তঃ শ্বপচঃ প্রিয়ঃ ।
তস্মৈ দেয়ং ততো গ্রাহ্যং স চ পূজ্যো যথা হ্যহম্ ।।
(হরিভক্তিবিলাস ১০/১২৭)
অনুবাদঃ- যে ব্যক্তি আমার শুদ্ধ ভক্ত নয়, তিনি যদি চতুর্বেদীও হন, তিনি আমার প্রিয় নন। অপরপক্ষে জ্ঞান ও কর্মবাসনা থেকে মুক্ত একজন শুদ্ধ ভক্ত যদি চণ্ডাল কুলেও জাত হন, তিনি আমার প্রিয়। প্রকৃতপক্ষে তাঁকেই দান করতে হবে, তাঁর থেকেই উচ্ছিষ্ট প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে এবং তাঁকে আমার মতোই পূজা করতে হবে।
শ্লোক: 61
চক্ষুদান দিল যেই, জন্মে জন্মে প্রভু সেই,
দিব্যজ্ঞান হৃদে প্রকাশিত ।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর, প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা)
অনুবাদঃ- যিনি চক্ষুদান করলেন, তিনিই জন্মে জন্মে আমার প্রভু। তাঁরই কৃপার প্রভাবে দিব্যজ্ঞান হৃদয়ে প্রকাশিত হয়।
শ্লোক: 62
সাক্ষাদ্ধরিত্বেন সমস্তশাস্ত্রৈ-
রুক্তস্তথা ভাব্যত এব সদ্ভিঃ ।
কিন্তু প্রভোর্যঃ প্রিয় এব তস্য
বন্দে শুরোঃ শ্রীচরণারবিন্দম্ ।।
(শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর, গুর্বষ্টক-৭ )
অনুবাদঃ- নিখিলশাস্ত্র যাঁকে সাক্ষাৎ শ্রীহরির অভিন্ন-বিগ্রহরূপে কীর্তন করেছেন এবং সাধুগণও যাঁকে সেইরূপেই চিন্তা করে থাকেন, কিন্তু যিনি ভগবানের একান্ত প্রেষ্ঠ, সেই (ভগবানের অচিন্ত্য-ভেদাভেদ-প্রকাশ-বিগ্রহ) শ্রীগুরুদেবের পাদপদ্ম আমি বন্দনা করি।
শ্লোক: 63
গোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া
(বাংলা প্রবাদ)
অনুবাদঃ- ঘোড়া বা গরু যখন গোড়া বা বেষ্টনী ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার চেষ্টা করে, তখন তাদের পা ভাঙার সম্ভাবনা থাকে। দ্রঃ শ্রীল প্রভুপাদ এই প্রবাদের মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছেন যে, গুরুকে ডিঙিয়ে কেউ কৃষ্ণকে লাভ করতে পারে না।
শ্লোক: 64
যস্য প্রসাদাদ্ভগবদৎপ্রসাদো
যস্যাপ্রসাদান্ন গতিঃ কুতোহপি ।
ধ্যায়ংস্তুবংস্তস্য যশস্ত্রিসন্ধ্যং
বন্দে গুরোঃ শ্রীচরণারবিন্দম্ ।।
(শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর, গুর্বষ্টক-৮)
অনুবাদঃ- একমাত্র যাঁর কৃপাতেই ভগবদ্-অনুগ্রহ লাভ হয় এবং যিনি অপ্রসন্ন হলে জীবের আর কোথাও গতি থাকে নাম, আমি ত্রিসন্ধ্যা সেই শ্রীগুরুদেবের কীর্তিসমূহ স্তব ও ধ্যান করতে করতে তাঁর পাদপদ্ম বন্দনা করি।
শ্লোক: 65
সাধু-শাস্ত্র-গুরু-বাক্য, চিত্তেতে করিয়া ঐক্য,
(নরোত্তম দাস ঠাকুর, প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা-২) (আমরা যদি সাধু হতে চাই, তা হলে) আমাদের সাধু, শাস্ত্র ও গুরুর অনুসরণ করা উচিত।
অনুবাদঃ- (আমরা যদি সাধু হতে চাই, তা হলে) আমাদের সাধু, শাস্ত্র ও গুরুর অনুসরণ করা উচিত।শ্লোক: 66
জন্মে জন্মে সবে পিতামাতা পায় ।
কৃষ্ণ-গুরু নাহি মিলে ভজহ হিয়ায় ।।
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- জন্মে জন্মে সকলেই পিতা-মাতা লাভ করে। কিন্তু প্রতি জন্মে কৃষ্ণ বা গুরু লাভ হয় না। সুতরাং, এই দুর্লভ গুরু বা শ্রীকৃষ্ণ সেবার সুযোগ লাভ হলে হৃদয় দিয়ে তাঁদের ভজনা করা উচিত।
শ্লোক: 67
মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্ ।
যৎকৃপা তমহং বন্দে শ্রীগুরুং দীন তারিণম্ ।।
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- যাঁর কৃপা বোবাকে বাচাল করতে পারে এবং পঙ্গুকে গিরি লঙ্ঘন করাতে পারে, সেই পতিত জীবদের উদ্ধারকারী শ্রীগুরুদেবকে আমি বন্দনা করি।
শ্লোক: 68
যথা কাঞ্চনতাং যাতি কাংস্যং রসবিধানতঃ ।
তথা দীক্ষাবিধানেন দ্বিজত্বং জায়তে নৃণাম্ ।।
(হরিভক্তিবিলাস ২/১২)
অনুবাদঃ- ঠিক যেমন কাঁসার সঙ্গে পারদের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে কাঁসাকে সোনায় রূপান্তরিত করা যায়, তেমনই সদগুরুর দ্বারা যিনি যথাযথভাবে দীক্ষা ও শিক্ষা লাভ করেছেন, তিনি তৎক্ষণাৎ ব্রাহ্মণরূপে রূপান্তরিত হন।
শ্লোক: 69
চতুর্বিধ-শ্রীভগবৎপ্রসাদ-
স্বাদন্নতৃপ্তান্ হরিভক্তসঙ্ঘান্ ।
কৃত্বৈব তৃপ্তিং ভজতঃ সদৈব
বন্দে গুরোঃ শ্রীচরণারবিন্দম্ ।।
(শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর, গুর্বষ্টক-৪)
অনুবাদঃ- যিনি শ্রীকৃষ্ণভক্তবৃন্দকে চর্ব্য, দূষ্য, লেহ্য ও পেয়- এ চতুর্বিধ রসসমন্বিত সুস্বাদু প্রসাদান্ন দ্বারা পরিতৃপ্ত করে (অর্থাৎ প্রসাদ-সেবন জনিত প্রপঞ্চ-নাশ ও প্রেমানন্দের উদয় করিয়ে) স্বয়ং তৃপ্তি লাভ করেন, সেই শ্রীগুরুদেবের পাদপদ্ম আমি বন্দনা করি।
শ্লোক: 70
ওঁ অজ্ঞান-তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন-শলাকয়া
চক্ষুরুন্মীলিয়তং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।
(গৌতমীয় তন্ত্র, শ্রীগুরু প্রণাম)
অনুবাদঃ- অজ্ঞানের অন্ধকারের দ্বারা আমার চক্ষুদ্বয় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যিনি জ্ঞানের আলোকের দ্বারা তা উন্মীলিত করেছেন, সেই আমার গুরুদেবকে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।
শ্লোক: 71
হরি হরি ! বিফলে জনম গোঙাইনু ।
মনুষ্য-জনম পাইয়া, রাধাকৃষ্ণ না ভজিয়া,
জানিয়া শুনিয়া বিষ খাইনু ।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর, প্রার্থনা)
অনুবাদঃ- হে শ্রীহরি ! হে শ্রীহরি ! বৃথাই এই জন্ম কাটালাম। এই দুর্লভ মনুষ্যজন্ম পেয়েও শ্রীশ্রীরাধা-কৃষ্ণের ভজনা না করে আমি শুধু জেনে শুনে বিষ পান করলাম।
শ্লোক: 72
প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং নিবৃত্তিস্তু মহাফলম্ ।
(মনু সংহিতা)
অনুবাদঃ- এই জড় জগতে সকলেই প্রবৃত্তি মার্গের প্রতি আসক্ত হয়, কিন্তু নিবৃত্তি মার্গের অনুগমন করেই মহত্তম সম্পদ লাভ করা যায়।
শ্লোক: 73
ওঁ অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা
(বেদান্তসূত্র ১/১/১)
অনুবাদঃ- অতএব, এখনই ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসা (পরমেশ্বর সম্পর্কে) কর্তব্য ।
শ্লোক: 74
যস্য প্রভা প্রভবতো জগদণ্ডকোটি-
কোটিষ্বশেষবসুধাদিবিভূতিভিন্নম্ ।
তদ্ ব্রহ্ম নিষ্কলমনন্তমশেষভূতং
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৪০)
অনুবাদঃ- অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ডে অনন্ত বসুধাদি বিভূতির দ্বারা যিনি ভেদপ্রাপ্ত হয়েছেন, সেই পূর্ণ, নিরবচ্ছিন্ন এবং অশেষভূত ব্রহ্ম যাঁর প্রভা, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।
শ্লোক: 75
বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্
(হিতোপদেশ)
অনুবাদঃ- বিদ্যা বিনয় দান করে।
শ্লোক: 76
বুদ্ধিঃ যস্য বলং তস্য
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- বুদ্ধি যার বল তার ।
শ্লোক: 77
তর্কাপ্রতিষ্ঠানাৎ
(বেদান্তসূত্র ২/১/১১)
অনুবাদঃ- চিন্ময় তত্ত্ব যুক্তি তর্কের দ্বারা উপলব্ধি বা প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
শ্লোক: 78
কর্মকাণ্ড, জ্ঞানকাণ্ড, কেবল বিষের ভাণ্ড,
‘অমৃত’ বলিয়া যেবা খায় ।
নানা যোনি সদা ফিরে, কদর্থ ভক্ষণ করে,
তা’র জন্ম অধঃপাতে যায় ।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর, প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা)
অনুবাদঃ-
শ্লোক: 79
জড়বিদ্যা যত মায়ার বৈভব,
তোমার ভজনে বাধা।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, বিদ্যার বিলাসে-৩)
অনুবাদঃ- সমস্ত জাগতিক জ্ঞান ভগবানের মায়াশক্তির বৈভব এবং তা ভগবৎ-সেবার বিঘ্নস্বরূপ ।
শ্লোক: 80
অসমোর্ধ্ব
(অজ্ঞাত উৎস) অসম—যাঁর সমান কেউ নেই; ঊর্ধ্ব—কিংবা যাঁর ঊর্ধ্বে কেউ নেই।
অনুবাদঃ- কেউ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সমান বা তাঁর থেকে বড় নয়।
শ্লোক: 81
একং ব্রহ্ম দ্বিতীয়ং নাস্তি
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- ভগবান একজনই, দুজন নন।
শ্লোক: 82
সঃ ভগবান্ স্বয়ং কৃষ্ণ
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- সেই শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান।
শ্লোক: 83
সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- জড় ও চেতন – সব কিছুই পরমেশ্বর ভগবান তথা পরব্রহ্ম থেকে অভিন্ন ।
শ্লোক: 84
নারায়ণ পরোহব্যক্তাৎ
(শঙ্করাচার্য/গীতা-ভাষ্য)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ হচ্ছেন ব্যক্ত ও অব্যক্ত জড় সৃষ্টির অতীত।
শ্লোক: 85
ওঁ আনন্দময়োহভ্যাসাৎ
(বেদান্তসূত্র ১/১/১২)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান স্বভাবতই আনন্দময় ।শ্লোক: 86
নিত্য নবনবায়মান
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- নিত্যকাল নব নব বৈশিষ্ট্য সমন্বিত।
শ্লোক: 87
কেশব তুয়া জগৎ বিচিত্র
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)
অনুবাদঃ- হে কেশব! তোমার সৃষ্ট জগৎ বড়ই বিচিত্র ।
শ্লোক: 88
ভগবান্ ভক্তহৃদিস্থিতঃ
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সর্বদাই তাঁর চরণকমল তাঁর ভক্তদের হৃদয়ে স্থাপন করেন।
শ্লোক: 89
মারবি রাখবি—যো ইচ্ছা তোহারা ।
নিত্যদাস-প্রতি তুয়া অধিকারা ।।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, মানস, দেহ, গেহ ৩)
অনুবাদঃ- হে কৃষ্ণ! আমাকে মার কিংবা রক্ষা কর তা তোমার ইচ্ছা, কেন না আমি তোমার নিত্যদাস। এই দাসের প্রতি তোমার পূর্ণ অধিকার রয়েছে।
শ্লোক: 90
বৃদ্ধকাল আওল সব সুখ ভাগল ।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)
অনুবাদঃ- বৃদ্ধকাল সমুপস্থিত হলে জড় সুখভোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
শ্লোক: 91
তাতল সৈকতে, বারিবিন্দু সম,
সুত-মিত-রমণী সমাজে
(শ্রীল বিদ্যাপতি ঠাকুর)
অনুবাদঃ- স্ত্রী, বন্ধুবান্ধব ও সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যে সুখ পাওয়া যায়, তা মরুভূমিতে একবিন্দু জলের মতো।
শ্লোক: 92
মাংস খাদতি ইতি মাংসঃ
(মনু সংহিতা)
অনুবাদঃ- আমি এখন তোমাকে খাচ্ছি কিন্তু ভবিষ্যতে তুমি আমাকে হত্যা করে খেতে পারবে।
শ্লোক: 93
ঘুটে পোড়ে গোবর হাসে
(বাংলা প্রবাদ)
অনুবাদঃ- গোবরের শুকনো ঘুটে যখন আগুনে পোড়ে, কাঁচা নরম গোবর তখন হাসে।
শ্লোক: 94
কমলদলজল, জীবন টলমল,
(ভজহুঁ রে মন, শ্রীনন্দনন্দন ৩)
অনুবাদঃ- কমলদলের উপর এক বিন্দু জলের ন্যায় জীবন টলমল ।
(গোবিন্দ দাস কবিরাজ গোস্বামী)
শ্লোক: 95
অনাদি করম-ফলে, পড়ি’ ভবার্ণব-জলে,
তরিবারে না দেখি উপায়।
এ বিষয়-হলাহলে, দিবানিশি হিয়া জ্বলে,
মন কভু সুখ নাহি পায় ।।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, গীতাবলী)
অনুবাদঃ- আমার অতীত কর্মের ফলে আমি এখন অজ্ঞানতার সমুদে পতিত হয়েছি। এই সমুদ্র থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার কোন উপায় দেখছি না। এই সমুদ্রটি বাস্তবিকই একটি বিষের সমুদ্রের মতো। আমরা ইন্দ্রিয়ভোগের মাধ্যমে সুখী হওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ইন্দ্রিয়ভোগ হচ্ছে উত্তপ্ত খাদ্যের মতো যা হৃদয়ে জ্বালার সৃষ্টি করে।
শ্লোক: 96
সংসার-দাবানল-লীঢ় লোক
ত্রাণায় কারুণ্যঘনাঘনত্বম্ ।
প্রাপ্তস্য কল্যাণ-গুণার্ণবস্য
বন্দে গুরোঃ শ্রীচরণারবিন্দম্ ।।
(বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর, শ্রীশ্রীগুর্বষ্টক ১)
অনুবাদঃ- সংসার-দাবানল-সন্তপ্ত লোক সকলের পরিত্রাণের জন্য যিনি কারুণ্য-বারিবাহ তরলত্ব প্রাপ্ত হয়ে কৃপাবারি বর্ষণ করেন, আমি সেই কল্যাণ গুণনিধি শ্রীগুরুদেবের পাদপদ্ম বন্দনা করি।
শ্লোক: 97
হয় ‘মায়াদাস’ করে নানা অভিলাষ ।
(বাংলা গান)
অনুবাদঃ- মায়ার দাস হয়ে জীব নানা রকমের জড় অভিলাষে অভিভূত হয়ে পড়ে।
শ্লোক: 98
আত্মবৎ মন্যতে জগৎ
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- জড়-জাগতিক জীবনে প্রত্যেকেই মনে করে যে, অন্যদের অবস্থাও তার মতোই। (মানুষ মনে করে সকলেই বুঝি তার মতো চিন্তা করে। )
শ্লোক: 99
ভগবদ্ভক্তিহীনস্য জাতিঃ শাস্ত্রং জপস্তপঃ ।
অপ্রাণস্যেব দেহস্য মণ্ডনং লোকরঞ্জনম্ ।।
(হরিভক্তিসুধোদয় ৩/১১/১২)
অনুবাদঃ- ভগবদ্ভক্তিহীন ব্যক্তির উচ্চকুলে জন্ম, শাস্ত্রজ্ঞান, জপ ও তপ, মৃতদেহের অলঙ্কারের মতো কোন কাজেরই নয়, কেবল লোকরঞ্জন মাত্র।
শ্লোক: 100
এ-ও ত’ এক কলির চেলা ।
মাথা নেড়া, কপ্নি পরা, তিলক নাকে, গলায় মালা ।
সহজ-ভজন করছেন মামু, সঙ্গে ল’য়ে পরের বালা ।।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)
অনুবাদঃ- এ-ও তো একজন কলির প্রতিনিধি। সে মাথা নেড়া করেছে (এবং বৈষ্ণব ত্যাগীর মতো বেশ ধারণ করেছে)। কৌপীন পরিহিত হয়ে, নাকে তিলক ধারণ করে এবং গলায় কণ্ঠিমালা পরে সে খুব সহজভাবে কৃষ্ণভজন করছে। কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য শুধু পরস্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অবৈধ জীবন যাপন করা।
শ্লোক: 101
সৎসঙ্গ ছাড়ি কৈনু অসতে বিলাস ।
তে কারণে লাগিল যে কর্মবন্ধ ফাঁস ।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর, প্রার্থনা)
অনুবাদঃ- সৎসঙ্গ ছেড়ে আমি ক্ষণস্থায়ী বিলাসিতায় মগ্ন হয়েছি। তাই আমি আমার কর্মফলের ফাঁসিতে আবদ্ধ হয়ে গেছি।
শ্লোক: 102
দিনকা ডাকিনী রাতকা বাঘিনী
পলক পলক লহু চুষে ।
দুনিয়া সব বউর হোয়ে
ঘর ঘর বাঘিনী পূজে ।।
(হিন্দী কবি তুলসী দাস)
অনুবাদঃ- ভোগাসক্ত পত্নী দিনের বেলায় একটি ডাকিনীর মতো এবং রাত্রিতে একটি বাঘিনীর মতো—প্রতিমুহূর্তে তার কাজই হচ্ছে কারও না কারও রক্ত শোষণ করা। সমগ্র জগৎ উন্মত্ত হয়ে ঘরে ঘরে এই বাঘিনীর পূজা করছে।
0 Comments