ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ ।
অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্ব্বকারণকারণম্।।
ভগবানের সংজ্ঞা:- ভগবানের একটি
সরল সংজ্ঞা হচ্ছে : 'জন্মাদাস্য য্তঃ' - "যাঁর থেকে সমস্ত প্রকাশিত
হয়" (ভা: 1/1/1)৷ 'ভগবান' শব্দটি সংস্কৃত, এবং এর অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন
ব্যাসদেবের পিতা পরাশর মুনি- "(১) সমগ্র ঐশ্বর্য (ধনসম্পদ), (২) সমগ্র বীর্য (শক্তিমত্তা), (৩) সমগ্র য্শ, (৪) সমগ্র শ্রী (সৌন্দর্য, রূপবত্তা), (৫) সমগ্র জ্ঞান ও (৬) সমগ্র
বৈরাগ্য যাঁর মধ্যে পূর্ণ-রূপে বর্তমান, সেই
পরম পুরুষ হচ্ছেন ভগবান ৷" 'ভগ' শব্দের অর্থ ছয়টি ঐশ্বর্য
(ষড়ৈশ্বর্য ) এবং 'বান' শব্দের অর্থ যুক্ত বা সমন্বিত৷
যেমন জ্ঞানবান অর্থ জ্ঞান-সমন্বিত, ধনবান
শব্দের অর্থ ধন-সমন্বিত, তেমনি ভগবান শব্দের অর্থ
যিনি সম্পূর্ণভাবে ৬টি ঐশ্বর্য সমন্বিত৷ ঐ সমস্ত ঐশ্বর্য অন্যকে আকর্ষণ করে-
আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হবার এটিই রহস্য৷ কারও যে-পরিমাণে এই ঐশ্বর্য থাকে, তিনি ততটাই আকর্ষণীয় হন৷ এজগতে
সকলেরই ঐসব ঐশ্বর্য কিছু কিছু পরিমাণে রয়েছে- কিন্তু কেউই সমগ্র ঐশ্বর্য-সম্পন্ন
নয়৷ অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যাঁরা অত্যন্ত ধনবান, খুব
বলবান, খুব রূপবান, অত্যন্ত য্শস্বী, খুব জ্ঞানী এবং অত্যন্ত
বৈরাগ্যবান, কিন্তু কেউই দাবী করতে পারে না
যে তাঁর সমগ্র ধনৈশ্বর্য , সমগ্র বলবত্তা, সমগ্র সৌন্দর্য ইত্যাদি রয়েছে-
একমাত্র ভগবানেরই এগুলি পূর্ণমাত্রায় রয়েছে৷ উপরোক্ত ছয়টি ঐশ্বর্য যাঁর পূর্ণ
মাত্রায় আছে, তিনি নিশ্চয়ই 'সর্বাকর্ষক'৷ সংস্কৃত ভাষায় সর্বাকর্ষক
শব্দের সমতুল শব্দ হচ্ছে 'কৃষ্ণ'৷
এইভাবে আমরা দেখতে পাই যে, শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ, যিনি শাশ্বত কাল ধরে, সম্পূর্ণভাবে সমস্ত ঐশ্বর্যের
অধিকারী ৷ শ্রীকৃষ্ণই পূর্ণ ঐশ্বর্যসম্পন্ন পরমপুরুষ, পরমেশ্বর ভগবান৷ পূর্ণ মাত্রায়
ঐশ্বর্য সমূহের অধিকারী হওয়ায় শ্রীকৃষ্ণ পরম আকর্ষক, তিনি সর্বাকর্ষক পরম পুরুষ, সেজন্যই তাঁর নাম 'কৃষ্ণ', যিনি সকলকে আকর্ষণ-পূর্বক আনন্দ
প্রদান করেন৷
শ্রীকৃষ্ণ : পরম সম্পদশালী
ভগবদ্ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন (১০/৮),
"আমি জড় ও চেতন জগতের সব
কিছুর উৎস৷ সব কিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়৷ সেই তত্ত্ব অবগত হয়ে পণ্ডিতগণ
শুদ্ধ ভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন৷"
শ্রীকৃষ্ণ সব কিছুর পরম উৎস
হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তিনি জড় ও চিন্ময় জগতের সব কিছুর উৎস৷
এই জগতে সকলেই লক্ষ্মীদেবীর
সামান্য কৃপাদৃষ্টি লাভের জন্য চেষ্টা করছে, কিন্তু
চিন্ময় জগতে শতসহস্র লক্ষ্মীদেবী শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার জন্য সর্বদা তৎপর, ব্রহ্মসংহিতায় যেমন তা বলা
হয়েছে (৫/২৯),
"লক্ষ্মী সহস্র শতসম্ভ্রম
সেব্যমানম্"৷
ব্রহ্মসংহিতার ঐ শ্লোকেই
শ্রীকৃষ্ণের আবাস গোলোকের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে যে তার ভূমি চিন্তামণিময় এবং
সমস্ত ব্রহ্মগুলিই কল্পবৃক্ষ, সমস্ত গাভীই সুরভী গাভী
:
চিন্তামণি প্রকরসদ্মসু
কল্পবৃক্ষ/ লক্ষাবৃতেষু সুরভিরভি পালয়্ন্তম্৷
এই পৃথিবীতে লীলাবিলাসকালে
শ্রীকৃষ্ণ য্খন দুরাচারী নরকাসুরকে বধ করেন, তখন
তার কারাগৃহে বন্দী ১৬০০০ রাজকন্যা তাদেরকে গ্রহণ করার জন্য তাঁর কাছে পার্থনা
করে৷ শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের পার্থনা পূর্ণ করে তাদের সকলকে দ্বারকায় নিয়ে যান এবং
প্রত্যেকের জন্য একটি করে অত্যন্ত সুরম্য বিশাল অট্টালিকার ব্যবস্থা করেন, এইরকম প্রত্যেক প্রাসাদে ছিল
শোভাময় মোজেইক-রাস্তা, সুন্দর উদ্যান, হাজার হাজার দাস-দাসী, মণি-রত্নখচিত অনন্যসুন্দর
আসবাবপত্র৷
বৈকুণ্ঠ জগতের গ্রহলোকগুলিতে
ঐরকম কোটি কোটি অতিসুরম্য অট্টালিকা ও মহা-ঐশ্বর্য বিদ্যমান, এবং শ্রীকৃষ্ণই সকল ঐশ্বর্যের
অধীশ্বর৷
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ : পরম শক্তিমান
এজগতে যারা খুব বলশালী, মানুষ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়৷
ওয়েট-লিফ্ টার- যারা সারা জীবন ধরে ওজন তোলার জন্য মর্মন্ত্তদ পরিশ্রম করে, তারপর বহু বছরের নিদারুণ কসরতের
শেষে বিশ্ব-ক্রীড়াঙ্গনে য্খন তারা অল্প কিছু ওজন কয়েক মুহূর্তের জন্য উপরে তুলে
ধরে রাখতে সক্ষম হয়, তখন লক্ষ লক্ষ মানুষের
কাছে সে একজন বীর তারকায় পরিণত হয়৷ কিন্তু তাদের শক্তির সংগে যদি গোবর্দ্ধনধারী
কৃষ্ণের শক্তি তুলনা করা হয়? শ্রীকৃষ্ণের বয়্স য্খন
মাত্র সাত বছর, তখন তিনি তাঁর বাঁহাতের কনিষ্ঠ
আঙুলটির সাহায্যে একটা গোটা পর্বত তুলে ধরেছিলেন-- ইন্দ্রের সৃষ্ট অবিশ্রান্ত
বর্ষণ থেকে ব্রজবাসীদের রক্ষা করার জন্য৷ সেই গোবর্দ্ধন পর্বতটি এখনো বৃন্দাবনে
রয়েছে, ২২ কিলোমিটার যার পরিধি, আর পাঁচ হাজার বছর আগে এটি আরো
বড় ছিল৷ কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সহজেই পর্বতটি ধরে রেখেছিলেন-- কয়েক মুহূর্তের জন্য
নয়-- সাতদিন সাত রাত্রি ধরে৷ শ্রীকৃষ্ণের অলোকসামান্য বীর্যবত্তার এটি একটি
দৃষ্টান্ত৷**
এক বার শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর
শিষ্যা য্দুরাণীকে (জ্যাড, অস্ট্রেলিয়া)
গোবর্দ্ধন-ধারী কৃষ্ণের একটি ছবি আঁকতে বলেছিলেন৷ য্দুরাণী কৃষ্ণকে একজন বলশালী এক
যুবক-রূপে আঁকল, তাঁর পেশীবহুল দেহের বাইসেপ্
গুলো ভালভাবেই দেখা যাচ্ছিল৷ শ্রীল প্রভুপাদ তাঁকে বললেন যে গোবর্দ্ধন উত্তোলন
করার জন্য শ্রীকৃষ্ণের এইরকম বড় বড় পেশীর প্রয়োজন হয় না; তাঁর দেহটি চিন্ময়, আর তিনি অচিন্ত্য অনন্ত শক্তির
অধিকারী৷ একটি হাতি যেমন বিনা আয়াসে একটি ব্যাঙের ছাতা বা ছ্ত্রাক তুলে ধরতে পারে, শ্রীকৃষ্ণ ঠিক তেমনই অনায়াসে
গোবর্দ্ধন পর্বত তুলেছিলেন, ধরে
রেখেছিলেন সাতদিন৷
------------------------------------------------
** তাহলে, বড় পৃথিবী গ্রহটি কিংবা
দৈত্যাকার বৃহস্পতি-গ্রহ- যার খোলের মধ্যে ধরে যাবে ১৩০০ পৃথিবী, কিংবা মহাদ্যুতিশালী সূর্য
-এদের মহাশূন্যে ভাসিয়ে রাখার জন্য যে মহাকর্ষ-শক্তির প্রয়োজন, সেটি কত প্রচণ্ড হতে পারে ? সেটি আসছে কোথা থেকে, কার কাছ থেকে ? শ্রীকৃষ্ণ বলেন, 'গামাবিশ্য চ ভূতানি ধারয়ামি
অহম্ ওজসা' (ভ. গী. ১৫/১৩), তাঁর শক্তিতেই গ্রহ, জীবসমূহ রয়েছে নির্ভর করে৷
শুধু একটি সৌরজগৎ নয়, কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড
তিনি ধারণ করেন- সূত্রে গ্রথিত মণি-সমূহের মতো, তিনিই
সবকিছুকে ধারণকারী সূত্র (ময়ি সর্বম্ ইদং প্রোতঃ সূত্রে মণিগণা ইব (ভ. গী. ৭/৭)৷
গ্রহসমূহ যে ভগবানের পরিকল্পনায়, ভগবানের শক্তিতে স্থিত, সেকথা বলেছেন মাধ্যাকর্ষণের
আবিষ্কর্তা নিউটনও; তিনি তাঁর 'প্রিন্সিপিয়া' গ্রন্থে লিখেছেন : " The motions which the planets now have, could not spring from any
natural cause alone, but were impressed by an Intelligent Agent."
--------------------------------------------
শ্রীকৃষ্ণ কংসের আমন্ত্রণে
মথুরায় গিয়ে বিশাল হরধনুটি নিমেষেই ভেঙে ফেলেছিলেন; বিশাল ও ক্রোধোন্মত্ত কুবলয়
হস্তীকে বধ করেছিলেন, চাণুর, মুষ্টিকের মতো বিশালদেহী
মুষ্টিযোদ্ধাদের বধ করেছিলেন৷ অথচ তখন তাঁর 'বয়স' ছিল মাত্র ১১ বছর ৬ মাস৷ ভগবান
সবসময়ই ভগবান, শিশু বা তরুণ- তিনি সবসময়ই
সমান শক্তিশালী, সমান অচিন্ত্য শক্তির অধিকারী৷
শ্রীকৃষ্ণের বয়্স য্খন মাত্র সাত দিন, তখন
তিনি কংসের পাঠানো বিশালদেহী পুতনা রাক্ষসীকে বধ করেছিলেন৷ পরবর্তীতে, অর্জুনকে তিনি বিশ্বরূপ
দেখিয়েছিলেন, যা দর্শন করে অর্জুনের মতো বীরও
ভয়ে কাঁপছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন যে ভীষ্ম-দ্রোণ-দুর্যোধন-সহ সমস্ত যোদ্ধাদের তিনি
নিহত করেই রেখেছেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ইতিহাস তাঁর উক্তির সত্যতা বহু করেছেন৷
ভীষ্ম-দ্রোণ ছিলেন প্রায় অজেয়৷ অথচ তাঁদের মৃত্যুবরণ করতে হয়, কেননা সেটাই ছিল শ্রীকৃষ্ণের
ইচ্ছা৷ শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মদেব স্বীকার করেন যে অনন্ত শক্তিধর সর্বাধীশ্বর
শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাই চূড়ান্ত৷ শুধু তাই নয়, আমাদের
যা বল, শক্তি, শৌর্য আছে, তা শ্রীকৃষ্ণের থেকেই আসছে৷
ভগবদ্ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তা বলেছেন :
বলং বলবতা চ অহম্, "আমি বলবানদের বল৷"
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ : সর্বাপেক্ষা
য্শস্বী
শ্রীকৃষ্ণের অপর নাম 'উত্তমশ্লোক'৷ এই পৃথিবীতে, ব্রহ্মাণ্ডের নানা লোকে, অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডে এবং
চিন্ময় জগতের বৈকুণ্ঠ গ্রহলোকে সবচেয়ে বিদগ্ধ মহাত্মাগণ সবচেয়ে সুন্দর সুন্দর
শ্লোকে নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণের যশোমহিমা গান করে থাকেন৷
ভগবান গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর
শয্যা-স্বরূপ অনন্ত শেষ তার সহস্র বদনে স্মরণাতীত কাল ধরে শ্রীকৃষ্ণের যশোমহিমা
গান করছেন, কিন্তু এখনো তিনি ভগবানের
মহিমার অন্ত পান নি৷
শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধে
ভগবান বলেন, "একজন বিজ্ঞানী ব্রহ্মাণ্ডের
সমস্ত পরমাণুও গণনা করতে সক্ষম হতে পারেন, আমার
মহিমা বর্ণনা করতে কেউই সমর্থ নয়৷"
একজন কবি গেয়েছেন যে আমরা যদি
আকাশকে কাগজ হিসাবে ব্যবহার করি, বিশ্বের সমস্ত
বৃক্ষগুলিকে লেখনী আর সমস্ত মহাসমূদ্রগুলিকে কালি হিসাবে ব্যবহার করি, তবুও সেগুলি ভগবানের গুণগাথার
বর্ণনা এমনকি শুরু করার পক্ষেও যথেষ্ট হবে না৷
মহাভারতে, শ্রীকৃষ্ণের মহিমা বর্ণনার সময়
বিষ্ণু সহস্র নাম (শ্রীকৃষ্ণের এক হাজার নাম) স্তোত্র কীর্তন করেন৷ এই নামগুলির
প্রতিটিই ভগবানের অচিন্ত্য অপ্রাকৃত গুণ-মহিমা ব্যক্ত করছে৷**
------------------------------------------------
** পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এমন কেউ
জন্মগ্রহণ করেনি, যে শ্রীকৃষ্ণের মতো
য্শখ্যাতি লাভ করতে পেরেছে৷ সারা ভারতে শ্রীকৃষ্ণের যশমহিমা প্রচারের জন্য
লক্ষাধিক মন্দির রয়েছে৷ শুধু বৃন্দাবনেই রয়েছে পাঁচ হাজার মন্দির৷ পৃথিবীর এমন
কোনো দেশ, কোনো শহর নেই, যেখানে শ্রীকৃষ্ণের দিব্য
শ্রীমন্দির নেই৷ পৃথিবীর প্রাচীনতম সাহিত্য বেদ, ১০৮
উপনিষদ, ১৮ টি পুরাণ বা পৌরাণিক
ইতিবৃত্ত, প্রাচীনতম মহাকাব্য রামায়্ণম্
ও মহাভারতম্, শ্রীমদ্ভাগবত সহ শতশত গ্রন্থ
শ্রীকৃষ্ণের মহিমা প্রচার করছে৷ বেদে পরম পুরুষ ও তাঁর শক্তিরাজি ধারণকারী
দেবদেবীর মহিমা বর্ণিত হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে শ্রীকৃষ্ণই ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম
জীব ব্রহ্মাকে বেদ-জ্ঞান প্রদান করেন, অতীতে
বেদ শিক্ষা দেন
(যো ব্রহ্মানং বিদধাতি পুর্বম্
যে ধব বেদাংশ্চ গাপয়তিচন্দ্রস্ম কৃষ্ণঃ-
অথর্ববেদ)৷ শ্রীরাম শ্রীকৃষ্ণের
অবতার, উভয়ে অভিন্ন, (ভগবান দুইজন নন-
একমেবাদ্বিতীয়্ম্- বেদ), সেজন্য রামায়্ণও
শ্রীকৃষ্ণের মহিমা বর্ণনা করছে৷ ------------------------------------------------
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ : পরম সুন্দর
ভগবদ্ গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং
তাঁর রূপের দ্বিভূজ নরাকার রূপকে দুর্লভ দর্শন বলেছেন
(সুদুর্দর্শম্ ইদং রূপং-১১/৫২)৷
ব্রহ্মসংহিতায় তাঁর রূপের
অনবদ্য বর্ণনা রয়েছে- তিনি ত্রিভঙ্গললিত, গোপবেশ
তাঁর মস্তক ময়ূর-পুচ্ছ যুক্ত উষ্ণীষ-শোভিত, তাঁর
নয়্নদ্বয় পদ্মের পাপড়ির মতো আয়্তাকার ও সুকোমল, তাঁর
গলদেশে শোভমান বৈজয়ন্তীমালা, তাঁর সুন্দর অধরে শোভিত
মোহন মুরলী; তাঁর গাত্র বর্ণ ঘন মেঘের মতো
নীলাভ, তিনি দিব্য আভরণ ভূষিত
সুন্দরাঙ্গ, তিনি নিত্য-নব-নবায়্মান যৌবন
সম্পন্ন৷ বস্তুতঃ, যুগ-যুগান্ত ধরে
শিল্পে-সাহিত্যে, ভাস্কর্যে, চিত্র-কলায়, নাট্যে-সঙ্গীতে পৃথিবীর মানুষ
শ্রীকৃষ্ণের অনুপম রূপ-মহিমার গুণ-গান করে আসছে৷
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ : সর্বজ্ঞ:-
জড় দেহধারী কেউই তার অতীতের
লক্ষ লক্ষ জন্মের কথা স্মরণ করতে পারে না, সে
তার ভবিষ্যত জীবন সম্বন্ধেও কিছু বলতে পারে না৷ কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "হে অর্জুন! পরমেশ্বর ভগবানরূপে
আমি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে
সম্পূর্ণরূপে অবগত৷ আমি সমস্ত জীব সম্বন্ধে জানি, কিন্তু
আমাকে কেউ জানে না৷"
(ভ.গী.৭/২৬) কেবল শ্রীকৃষ্ণই
জানেন সমস্ত জীবসত্তার অতীত ইতিহাস, তিনিই
জানেন কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত জীবের বর্তমান এবং কেবল তিনিই জানেন সকলের
ভবিষ্যত৷ আমরা কেউ এমনকি গতকাল ও আগামী কালের কথাও ঠিকভাবে বলতে পারি না৷
ভগবদ্ গীতার চতুর্থ-অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ
অর্জুনকে জানান যে তিনি কোটি কোটি বছর পূর্বে সূর্যদেব বিবস্বানকে জ্ঞান প্রদান
করেছিলেন৷কিন্তু অর্জুন তখন জানতে চান, শ্রীকৃষ্ণের
জন্মের এত পূর্বে জন্মানো বিবস্বানকে কিভাবে তিনি জ্ঞান দান করতে পারেন৷ উত্তরে
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন-
" হে পরন্তপ অর্জুন ! আমার
ও তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে ৷ আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পার না "
(ভ.গী. ৪/৫)৷
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ : পরম
বৈরাগ্যবান
কেউ য্খন উপরোক্ত ঐশ্বর্যগুলির
একটিরও অধিকারী হয়, তখন স্বভাবতই সে ঐগুলির
প্রতি অত্যন্ত আসক্ত ও গর্বিত হয়ে পড়ে৷ কিন্তু ঐ সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিপতি হওয়া
সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণ বিন্দু মাত্রও ঐসবের প্রতি আসক্ত নন৷ এইভাবে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ
ঐশ্বর্যটিরও অধিকারী হন : বৈরাগ্য৷ কয়েকটি দৃষ্টান্ত :
শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় পাণ্ডবদের জন্য
সামান্য দূত হিসাবে দুর্যোধনের কাছে যান৷ যিনি লক্ষ্মীপতি, মাধব, সেই শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের
যুদ্ধে তাঁর সখা অর্জুনের রথের সারথ্য বরণ করে অর্জুনের কথামত রথ চালনা করতে থাকেন৷
মহৈশ্বর্য-শালী শ্রীকৃষ্ণ এতই সুন্দর যে, যে
তাঁকে ভালবাসে, তিনি নিজেকে পর্যন্ত তার কাছে
বিকিয়ে দেন৷
মহাভারতে, য্খন
রাজসূর্য যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির
ব্যাসদেবের সংগে পরামর্শ করার পর তার বিভিন্ন আত্মীয়্স্বজনদের বিভিন্ন সেবা করার ভার
দেন৷ ভীষ্ম-দ্রোণের উপর যজ্ঞ তত্ত্বাবধানের ভার পড়ে, দুঃসাশনের উপর খাদ্য বিতরণের
ভার ন্যস্ত হয়, অশ্বথামাকে অনুরোধ করা হ্য়
অভ্যাগত ব্রাহ্মণদের দেখাশুনা করার জন্য, দুর্যোধনের
উপর ভার ছিল যুধিষ্ঠিরের জন্য আনীত সমস্ত উপহারগুলি গ্রহণ করার৷ বিদূর হয়েছিলেন কোষাধ্যক্ষ৷
সমস্ত অভ্যাগত অতিথিবর্গ ও ব্রাহ্মণদের আশীর্বাদ লাভের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
ব্যক্তিগত ভাবে তাদের পদ ধৌত করার ভার নেন ও গভীর যত্ন সহকারে সেই দায়িত্ব
সম্পাদন করেন৷ এইভাবে পরম ঐশ্বর্যশালী পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরম বৈরাগ্য
প্রদর্শন করেন৷
শ্রীকৃষ্ণ যখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রূপে
অবতীর্ণ হন, তখন সুন্দরী সুবিনীতা স্ত্রী ও
পরম স্নেহশীলা মাতৃদেবীকে পরিত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন৷
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরতার
প্রমাণ:-
ব্রহ্মসংহিতায় প্রথম শ্লোকে
বলা হয়েছে :
ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ
সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ৷
অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ
সর্বকারণকারণম্ ৷৷
"শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম
পুরুষোত্তম পরমেশ্বর ভগবান৷ তাঁর শ্রীবিগ্রহ অর্থাৎ শ্রীদেহ সৎ-চিৎ-আনন্দ-ঘন, অর্থাৎ নিত্য শাশ্বত, চিন্ময় বা জ্ঞানময় এবং
চিদানন্দময়৷ তাঁর কোনও আদি নেই৷ কারণ তিনিই অনাদির আদি , সব কিছুর উৎস৷ তিনিই সর্বকারণের
আদি কারণ, সকল অস্তিত্বের পরম উৎস৷"
'বিগ্রহ
শব্দটির অর্থ দেহাবয়ব, শরীর৷ এছাড়াও ব্রহ্মসংহিতায়
বলা হয়েছে (৫/৩১) :
আলোলচন্দ্রক লসদ্ বনমাল্যবংশী
রত্নাঙ্গদং
প্রণয়কেলিকলাবিলাসম্৷
শ্যামং ত্রিভঙ্গললিতং
নিয়্তপ্রকাশং
গোবিন্দং আদিপুরুষং তমহং ভজামি
৷৷
"দোলিত চন্দ্রক-শোভিত
বনমালা যাঁর গলদেশে, বংশী ও রত্নাঙ্গদ যাঁর
করদ্বয়ে, যিনি সর্বদা প্রণয়কেলিবিলাস
যুক্ত, ললিত-ত্রিভঙ্গ শ্যামসুন্দর রূপই
যাঁর নিত্য প্রকাশ সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি ৷৷"
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ : সমস্ত
গুণ-বৈশিষ্ট্যের উৎস
বুদ্ধির্জ্ঞানমসংমোহঃ ক্ষমা
সত্যং দমঃ শমঃ ।
সুখং দুঃখং ভবোহভাবো ভয়ং
চাভয়মেব চ ॥
অহিংসা সমতা তুষ্টিস্তপো দানং
যশোহযশোঃ ।
ভবন্তি ভাবা ভূতানাং মত্ত এব
পৃথগ্ বিধাঃ ॥ (ভ.গী-১০/৪-৫)
"বুদ্ধি, জ্ঞান, সংশয় ও মোহ থেকে মুক্তি, ক্ষমা, সত্যবাদিতা, ইন্দ্রিয়-সংয্ম, মনসংযম, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, অভয়, অহিংসা, সমতা, সন্তোষ, তপস্যা, দান, য্শ ও অয্শ- প্রাণিদের এই সমস্ত
নানা প্রকার ভাব আমার থেকেই উৎপন্ন হয়। "
ভীষ্মদেব (দ্বাদশ মহাজনের একজন)
'বিষ্ণু সহস্রনাম স্তোত্রে'
শ্রীকৃষ্ণকে বন্দনা করেছেন
এইভাবে :
ন ক্রোধ ন চ মাৎসর্য ন লোভো
নাশুভ মতিম্ ৷
ভবন্তি কৃতপুণ্যানাং ভক্তানাং
পুরুষোত্তমে ৷৷
ধ্যায়ুঃ সচন্দ্রক নক্ষত্রকং
দিশো ভূর্মহোদধিঃ৷
বাসুদেবস্য বীর্যেন বিধ্রুতানি
মহাত্মনঃ ৷৷
সসুরাসুর গন্ধর্বং স যক্ষোরগ
রাক্ষসম্৷
জগদ্বশে বর্ততেদং কৃষ্ণস্য
সচরাচরম্ ৷৷
(বিষ্ণু সহস্রনাম-১৩/১৫)
"ভগবান শ্রীকৃষ্ণের
পুণ্যকীর্তি ভক্তবৃন্দের কোনো প্রকার ক্রোধ নেই, মাৎসর্য
(পরশ্রীকাতরতা) নেই; তাদের লোভ নেই, এবং অপরের অমঙ্গল উৎপন্ন করার
কোনো দুর্মতিও নেই৷ সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, আকাশ, দিকসমূহ, পৃথিবী, মহাসাগর সবই কৃষ্ণের শক্তিতে
স্থিত৷ সুরগণ (দেবদেবী), অসুর, গন্ধর্ব, য্ক্ষ, নাগ, রাক্ষস এবং অন্য সকল সচর ও অচর
অর্থাৎ স্থাবর ও জঙ্গম জীব-সমাকুল এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড সম্পূর্ণভাবে শ্রীকৃষ্ণের
নিয়্ন্ত্রণাধীন৷"
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরতার
প্রমাণ:-
শ্রীকৃষ্ণ : সকল জীবের পিতা
চলমান ও স্থির গ্রহ-নক্ষত্র-জীব
সমাকুল এই সমগ্র মহাবিশ্ব শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন শক্তিরাজির কার্যের দ্বারা প্রকাশিত
বা অভিব্যক্ত হয়৷ জড় জগতে আমরা বিভিন্ন জীবের সংগে বিভিন্ন সম্পর্ক গড়ে তুলি
যেমন- পিতা, মাতা, পিতামহ, পিতামহী, মাতামহ, মাতামহী- ইত্যাদি, সকলেই স্বরূপতঃ শ্রীকৃষ্ণের
অংশ৷ শ্রীকৃষ্ণ বলেনঃ
"পিতাহমস্য জগতো মাতা ধাতা
পিতামহঃ ।"
(ভ.গী. ৯/১৭)-
আমিই এই জগতের পিতা, মাতা, বিধাতা (ধারণকর্তা) ও পিতামহ৷
এই ব্রহ্মাণ্ডের জীব সৃষ্টির
সংক্ষিপ্ত বংশতত্ত্বগত ইতিহাস শ্রীকৃষ্ণ প্রদান করেছেন ভগবদ্ গীতার নিম্নোক্ত
শ্লোকেঃ
মহর্ষয়ঃ সপ্ত পূর্বে চত্বারো
মনবস্তথা ।
মদ্ ভাবা মানসা জাতা যেসাং লোক
ইমাঃ প্রজাঃ ॥ (ভ.গী. ১০/৬)
সপ্ত মহর্ষি, তাঁদের পূর্বজাত সনকাদি চার
কুমার ও চতুর্দশ মনু, সকলেই আমার মন থেকে
উৎপন্ন হয়ে আমা হতে জন্মগ্রহণ করেছে এবং এই জগতের স্থাবর-জঙ্গম আদি সমস্ত প্রজা
তাঁরাই সৃষ্টি করেছেন।
সর্বযোনিষু কৌন্তেয় মূর্তয়ঃ
সম্ভবন্তি যাঃ ।
তাসাং ব্রহ্ম মহদ্ যোনিরহং
বীজপ্রদঃ পিতা ॥ (ভ.গী. ১৪/৪)
হে কৌন্তেয় ! সকল যোনিতে যে
সমস্ত মূর্তি প্রকাশিত হয়, ব্রহ্মরূপী যোনিই তাদের
জননী-স্বরূপা এবং আমি তাদের বীজ প্রদানকারী পিতা।
--------------------------------------------------------
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ : সমস্ত
অবতারগণের উৎস
ভগবান আমাদের মধ্যে অবতার-রূপে
অবতীর্ণ হন৷ আর, তিনি অব তীর্ণ হবার পূর্বেই
শাস্ত্রে সেই অবতারের উল্লেখ থাকে৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের পূর্বে বিভিন্ন
শাস্ত্রে তার উল্লেখ ছিল৷ ঋগ্বেদে শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে উল্লেখ রয়েছে৷ ছান্দোগ্য
উপনিষদে দেবকীনন্দন কৃষ্ণের উল্লেখ রয়েছে এবং এমন আরো বহু শাস্ত্রে রয়েছে৷
বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের আড়াই হাজার বছর পূর্বেই ঐ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছিল (ভাঃ
১/৩/২৪)৷ অথর্ববেদের চৈতন্য উপনিষদ অংশে তাঁর আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী করা
হয়েছিল৷
শ্রীমদ্ভাগবতে
পরমেশ্বর ভগবানের ২২ জন অবতারের
একটি তালিকা রয়েছে, কিন্তু সেখানে বলা
হয়েছে যে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন আদিপুরুষ, যাঁর থেকে অন্য সকল অবতার
প্রকাশিত হয় :
এতে চাংশুকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু
ভগবান্ স্বয়্ম্৷
ইন্দ্রারিব্যাকুলং লোকং
মৃড়য়ন্তি যুগে যুগে ৷৷
(ভাঃ ১/৩/২৮)
"পূর্বোল্লিখিত এই সমস্ত
অবতারেরা হচ্ছেন ভগবানের অংশ অথবা কলা অবতার, কিন্তু
শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং৷ য্খন নাস্তিকদের অত্যাচার বেড়ে যায়, তখন আস্তিকদের রক্ষা করার জন্য
ভগবান এই ধরাধামে অবতীর্ণ হন৷"
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ : সমস্ত
অবতারগণের উৎস
শ্রীকৃষ্ণ: সকল দেবদেবীর উৎস
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকল দেবদেবী-
শিব-ব্রহ্মা আদি সকলের উৎস৷ ভগবদ্ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ এই তথ্য সমর্থন করেছেন যে তিনিই
সকল দেবদেবীর আদি উৎস :
ন মে বিদুঃ সুরগণাঃ প্রভবং ন
মহর্ষয়ঃ ।
অহমাদির্হি দেবানাং মহর্ষীনাং চ
সর্বশঃ ॥
(ভ.গী. ১০/২)
"দেবতারা বা মহর্ষিরাও
আমার উৎপত্তি অবগত হতে পারে না, কেন না, সর্বতোভাবে আমিই দেবতা ও
মহর্ষিদের আদি কারণ।"
সকল বৈদিক শাস্ত্রে এই তথ্য
সমর্থিত হয়েছে যে শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ব্রহ্মা, শিব-আদি
সকল দেবগণের উৎস৷ অথর্ব-বেদে বলা হয়েছে,
যো ব্রাহ্মণং বিদধাতিঃ পূর্বং
যো বৈ
বেদংশ্চ গাপয়তি স্ম কৃষ্ণঃ
"যিনি সৃষ্টির আদিতে
ব্রহ্মাকে বৈদিক জ্ঞান উপদেশ করেছিলেন এবং পূর্বে বৈদিক জ্ঞান বিস্তার করেন, তিনি শ্রীকৃষ্ণই৷"
তারপর পুনরায় বলা হয়েছে,
অথ-পুরুষোঃ বৈ নারায়ণোঃ
অকাম্যতা
প্রজাঃ সৃজেয়ৈতি উপক্রম্য৷
"তখন পরমপুরুষ
শ্রীনারায়্ণ প্রজা সৃষ্টির ইচ্ছা করিলেন৷"
নারায়ণাদ্ ব্রহ্মা জায়তে, নারায়ণাদ্ প্রজাপতিঃ প্রজায়তে,
নারায়ণাদ্ ইন্দ্রো জায়তে, নারায়ণাদ্ অস্তৌ বাসবো
জায়ন্তে,
নারায়ণাদ্ একাদশ রুদ্র
জায়ন্তে, নারায়ণাদ্ দ্বাদশাদিত্যঃ৷৷
নারায়ণ থেকে ব্রহ্মার জন্ম হয়, নারায়ণ থেকে সমস্ত
প্রজা-সৃষ্টা প্রজাপতিগণেরও জন্ম হয়৷ নারায়ণ থেকে ইন্দ্রের জন্ম হয়, নারায়ণ হতে অষ্ট বসুর জন্ম হয়৷
নারায়ণ হতে একাদশ রুদ্রের জন্ম হয়, নারায়ণ
থেকে দ্বাদশ আদিত্যের জন্ম হয়৷"
'ব্রহ্মণ্যো দেবকী-পুত্রঃ৷'
দেবকীর পুত্র শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন
পরমেশ্বর ভগবান৷
একো বৈ নারায়্ণ আসীন্ ন
ব্রহ্মা না ঈশানো নাপো নাগ্নি
সমৌ নেমে দ্যবা পৃথিবী ন
নক্ষত্রাণি ন সূর্যঃ স একাকী
ন রমতে তস্য ধ্যানন্তঃ স্থাস্য
য্ত্র ছন্দোগৈঃ
ক্রিয়্মানাষ্টকাদি-সংজ্ঞক
স্তুতি-স্তোমঃ স্তোমম্ উচ্যতে৷
"সৃষ্টির আদিতে কেবল পরম
পুরুষ নারায়্ণ ছিলেন৷ ব্রহ্মা ছিলেন না শিব ছিলেন না, অগ্নি ছিলেন না, আকাশে চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র ছিল না৷ কেবল শ্রীকৃষ্ণ
ছিলেন, যিনি সব কিছু সৃজন করেন এবং রমণ
করেন৷"
(মহা উপনিষদ-১)
বরাহপুরাণে বলা হয়েছে,
নারায়্ণঃ পরো দেবস্তস্মাজ্জাতশ্চতুর্মুখঃ৷
তস্মাদ্ রুদ্রোহভবদ্ দেবঃ স চ
সর্বজ্ঞতাং গতঃ৷৷
'নারায়্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম
ভগবান এবং তাঁর থেকে ব্রহ্মার জন্ম হয়, তাঁর
থেকে শিবের জন্ম হয়৷'
শ্রীকৃষ্ণ ও জীবসত্তার মধ্যে
পার্থক্য:-
জীবসত্তা অণু-সদৃশ ক্ষুদ্র, কিন্তু কৃষ্ণ অসীমঃ
বৈদিক শাস্ত্রে, যেমন কঠোপনিষদে ও শ্বেতাশ্বতর
উপনিষদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে বদ্ধ ও মুক্ত সকল জীবসত্তার মধ্যে একজন পরম
চেতন ব্যক্তি রয়েছেন, পরম পুরুষোত্তম ভগবান, যিনি সকল জীবকে পালন করেন এবং
তিনি একাকী সেই অনন্ত-সংখ্যক জীবসত্তার ভিন্ন ভিন্ন বাসনা পুরণ করার সুযোগ প্রদান
ক্রেনঃ “নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাং একো বহুনাং যো বিদধাতি কামান্”।
শ্রীকৃষ্ণ নিত্য, এবং জীবসত্তা সমূহও
নিত্য। শ্রীকৃষ্ণের যেমন একটি সচ্চিদানন্দময় দেহ রয়েছে, তেমনি সমস্ত জীবসত্তার
প্রত্যেকেরই এক একটি সচ্চিদানন্দময় দেহ রয়েছে। কিন্তু জীব ও শ্রীকৃষ্ণের
পার্থক্য হচ্ছে, কৃষ্ণ হচ্ছেন ভগবান, প্রভু ও সকল জীবসত্তার পরম
নিয়ন্তা ঈশ্বর। আর জীব নিত্যকালের জন্য শ্রীকৃষ্ণের দাস, সেবক।
অতএব সিদ্ধান্ত এই যে, জীব শ্রীকৃষ্ণের সংগে এক কেবল
গুণগতভাবে (উভয়ই সৎ-চিৎ-আনন্দময়), কিন্তু
পরিমাণগতভাবে জীব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চিদ্ অণু, আর
শ্রীকৃষ্ণ অসীম, বিভু। একে বলা হয়
‘অচিন্ত্য-ভেদাভেদ-তত্ত্ব’, যার অর্থ জীব ও
শ্রীকৃষ্ণ ‘যুগপৎ ভিন্ন আবার অভিন্ন, যা
অচিন্তনীয়’। এই অভিন্নতা বা অভেদত্ব হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ ও জীবসত্তার গুণগত একত্ব, আর ভিন্নতা, ভেদত্ব হচ্ছে পরিমাণগত (যেমন
সূর্য ও তার কিরণ কণা – উভয়ের গুণগত ধর্ম এক, কিন্তু
পরিমাণগতভাবে অসীম প্রভেদ)।
জীবসত্তা তার নিজ দেহটির জ্ঞাতা
কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ দেহ সমূহের জ্ঞাতা
দেহ ও দেহের জ্ঞাতা- বিষয়টি
আলোচনা করতে গিয়ে আমরা ভিন্ন ভিন্ন তিনটি মুখ্য বিষয় পাইঃ ভগবান, জীব-সত্তা, এবং জড় পদার্থ। প্রত্যেক
জীব-শরীরে দুটি আত্মা রয়েছেঃ জীবাত্মা এবং পরমাত্মা। আর পরমাত্মা যেহেতু পরম
পুরুষ ভগবানেরই অংশপ্রকাশ, সেজন্য শ্রীকৃষ্ণ বলেন, আমিও জ্ঞাতা, আমি পরমাত্মারূপে প্রত্যেক
জীবদেহে অবস্থান করি” (ভ. গী.- ১৩/২-৩, ১৫/১৫)।
আত্মার জড় শরীরকে বলা হয় ‘ক্ষেত্র’, আর ঐ শরীরটিকে যিনি জানেন, সেই আত্মাকে বলা হয়
‘ক্ষেত্রজ্ঞ’। একজন জীবাত্মা হিসাবে আমি আমার শরীরটি সম্বন্ধে, জ্ঞাত, অবগত। ঠিক তেমনি আপনি
(জীবাত্মা) আপনার শরীরটির জ্ঞাতা, আপনি আপনার শরীরের
সংবেদনশীলতা অনুভব করেন। কিন্তু আপনার যদি মাথা যন্ত্রণা হয়, আর আপনি যদি আমাকে না বলেন, তাহলে আমি সে বিষয়ে কিছুই
জানতে পারি না। তেমনি আমি যদি কোন বিষয়ে চিন্তা করতে থাকি, আপনি জানতে পারেন না কোন
বিষয়টি নিয়ে আমি ভাবছি। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সকল জীব শরীরে পরমাত্মারূপে বিরাজিত
থাকায় তিনি সকল জীব শরীরের সবকিছুই জ্ঞাত, অবগত।
তিনি সকল ধরণের প্রজাতির সবরকমের শরীরের জ্ঞাতা। সেই জন্য প্রত্যেক শরীরে বিরাজিত
পরমাত্মাকে বলা হয় ‘পরম ক্ষেত্রজ্ঞ’।
ঠিক যেমন আত্মা তার চেতনাকে পরিব্যপ্ত
করার মাধ্যমে সমগ্র শরীরটিতে বিরাজিত, তেমনি
পরমাত্মা তাঁর পরমচৈতন্যকে সারা সৃষ্টি জুড়ে বিরাজমান। সীমিত-চেতন জীবাত্মা কখনোই
এই অসীমরূপে সর্বব্যাপ্ত পরমচৈতন্যের অনুকরণ করতে পারে না। আমার সীমিত শরীরটিতে কি
চলছে, আমার অনুভবের পরিধি কেবল
সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ; অন্যের শরীরে কি ঘটছে তা
আমার উপলব্ধির অতীত। আমার চেতনার মাধ্যমে সারা শরীরটিতে উপস্থিত, কিন্তু আমি আমার চেতনার দ্বারা
অন্যের শরীরে উপস্থিত নই। পক্ষান্তরে পরমাত্মা সকল জীব শরীরে ও সকল পরমাণুতে –
সর্বত্র বিরাজ করায় তিনি অস্তিত্বশীল সবকিছু সম্বন্ধে সচেতন তিনি পরম চেতন, পরম ক্ষেত্রজ্ঞ।
জীবাত্মা তার দেহটির গৌণ মালিক, পরমেশ্বর ভগবানই সকল দেহের
মুখ্য মালিক। একজন রাজা হচ্ছেন তার রাজ্যের মূল মালিক, অধিকর্তা, আর প্রজারা হচ্ছে গৌণ অধিকর্তা।
আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, কোন মালিকের একটি বাড়ী
যদি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনো ভাড়াটিয়ার কাছে ভাড়া দেওয়া থাকে, তাহলে ঐ মালিককে বলা হয় মুখ্য
অধিকর্তা, আর ঐ ভাড়াটিয়াকে বলা যেতে
পারে গৌণ অধিকর্তা।
ঠিক তেমনি শ্রীকৃষ্ণই সমস্ত শরীরের মালিক, আর আমরা হচ্ছি এই শরীর-রূপ
নানা-আকারের গৃহগুলির ভাড়াটিয়া। ভাড়াটিয়ারা যেমন তাদের মূল্য দানের ক্ষমতা
অনুসারে নানা রকম মেয়াদে থাকার অধিকার পায়, তেমনি
আমরাও (জীবাত্মা) নানা কর্ম-রূপ মূল্যদানের মাধ্যমে নানা মেয়াদকালের জন্য এই সব
দেহ-রূপ ঘরগুলিতে বাস করতে পারি। সুতরাং প্রত্যেক দেহে আত্মা হচ্ছে গৌণ মালিক। আর
জীবাত্মা যদিও তার শরীরটির জ্ঞাতা ও মালিক, পরমেশ্বর
ভগবান ঐ শরীর ও শরীরটির মালিক- উভয়েরই জ্ঞাতা এবং উভয়েরই মুখ্য মালিক।
জীবাত্মাকে বিস্মৃতির মধ্যে
ফেলা যায়, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে কখনই
বিস্মৃতি অধিকার করতে পারে না।
ভগবদগীতার চতুর্থ অধ্যায়ে
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন যে তিনি ভগবদগীতার এই জ্ঞান কোটি কোটি বছর পূর্বে
সূর্যদেব বিবস্বানকে দান করেছিলেন। অর্জুন তখন জিজ্ঞাসা করেন, সূর্যদেব বিবস্বানের জন্ম
হয়েছিল আপনার অনেক পূর্বে। আপনি সৃষ্টির প্রারম্ভে তাঁকে এই জ্ঞান উপদেশ করেছিলেন, তা আমি কেমন করে বুঝব? (ভ. গী. ৪/৪)। শ্রীকৃষ্ণ
এই প্রশ্নটির উত্তর দিলেন, হে
পরন্তপ অর্জুন, আমার এবং তোমার বহু জন্ম অতীত
হয়েছে। আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু
তুমি পার না।” (ভ. গী.- ৪/৫)।
বেদে বলা হয়েছে যে পরমেশ্বর ভগবান এক ও
অদ্বিতীয় হলেও নিজেকে বহু রূপে প্রকাশ করেন। তিনি ঠিক বৈদুর্যমণির মতো, যা রঙ পরিবর্তন করে বহু বর্ণে
প্রতিভাত হলেও সর্বদাই একই থাকে। অর্জুনের মতো ভক্তগণ ভগবানের সর্বক্ষণের সঙ্গী, আর যখনই ভগবান অবতীর্ণ হন, তখন বিভিন্ন ভাবে তাঁর সেবা
করার জন্য তাঁর নিত্য পার্ষদ ভক্তগণও অবতীর্ণ হন। অর্জুন সেইরকম নিত্য ভগবৎ-পার্ষদ
গণের একজন, এবং যখন কোটি কোটি বছর পূর্বে
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সূর্যদেব বিবস্বানকে ভগবদগীতা বলেছিলেন, তখন ভিন্ন কোনো উপযোগী রূপে
অর্জুনও সেখানে ছিলেন। কিন্তু ভগবানের সংগে পার্থক্য এই যে ভগবান সেই ঘটনা স্মরণ
করেছিলেন, কিন্তু অর্জুন বিস্মৃত
হয়েছিলেন, ভুলে গিয়েছিলেন। জীবাত্মা এবং
পরমাত্মার (ভগবান শ্রীকৃষ্ণ) মধ্যে এই হচ্ছে প্রভেদ। ভগবানের নিত্য পরিকর এমন
যেকোনো ব্যক্তি নিশ্চিতভাবেই একজন মুক্ত পুরুষ, কিন্তু
তিনি ভগবানের সমকক্ষ হতে পারেন না। ব্রহ্মসংহিতায় ভগবানকে অচ্যুত বলে বর্ণনা করা
হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে এই যে তিনি কখনো
নিজেকে বিস্মৃত হন না। সেইজন্য জীবসত্তা কখনোই ভগবানের সম পর্যায়ভুক্ত নয়, এমনকি সেই জীবসত্তা যদি
অর্জুনের মতো মুক্তাত্মাও হন, তবুও নয়।
জীবসত্তার এই বিস্মৃতির প্রবণতা যুক্তিসংগত; কেননা, জীবসত্তা হচ্ছে অণু-আয়তন
বিশিষ্ট এবং সে মায়া শক্তির দ্বারা পরাভূত হতে পারে, যদিও গুণগতভাবে সে ভগবানেরি
মতো। এইভাবে মায়াগ্রস্ত হয়ে পড়লে জীবসত্তা পরমেশ্বর ভগবানের সান্নিধ্য থেকে
ভ্রষ্ট হয় এবং সে জড়া প্রকৃ্তির কবলে পতিত হয়ে নশ্বর জড় আবরণময় দেহ-ধারণে
বাধ্য হয়, তাঁর আলোকজ্জ্বল চিৎ-প্রভা
আবরিত হয়ে পড়ে; ঠিক যেমন বৃহৎ
অগ্নিকুণ্ডের থেকে ছিটকে আসা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ-গুলি অগ্নির মতো সমগুণবিশিষ্ট হলেও
অচিরেই স্তিমিত, প্রভাহীন হয়ে যায়। অর্জুনের
প্রতি প্রদত্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা অনুসারে এমনকি মুক্তিলাভের পরও জীবের
ব্যক্তিগত সত্তা বিলুপ্ত হয়ে যায় না, সে
‘পরমচৈতন্য’র সাথে ‘লীন’ হয়ে যায় না, কেননা
আত্মা মানেই এক জন অপরিবর্তনীয় (অবিকার্যঃ ২/২৫) নিত্য, শাশ্বত, সনাতন ব্যক্তি।
সেইজন্য ভিত্তিহীন মায়াবাদী
দর্শনের গোড়াতেই এক গভীর গলদ রয়েছে, যেখানে
বলা হচ্ছে যে সেই পরম তত্ত্ববস্তু এই সমস্ত ৮৪ লক্ষ প্রজাতির জীব শরীর ধারণ
করেছেন। যদি পরম তত্ত্ববস্তু মায়াগ্রাসে পতিত হয়ে এভাবে জরা-ব্যাধির-মৃত্যু-র
মতো অতি ভীষণ দুর্দশা-ভোগে বাধ্য হন, তাহলে
কি মায়া ভগবানের থেকে শক্তিশালী? ভগবান কখনই মায়াগ্রস্ত
হতে পারেন না। যদি তিনি তা হতেন, তাহলে তাঁকে ভগবান বলা
যেতে পারে না। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এই প্রশ্নগুলি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা, যারা নিরাকারবাদ বা অদ্বৈতবাদ
প্রচার করছে, অথবা যারা নিজেদেরকেই ভগবান বলে
দাবী করছে। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবদগীতায় (৭/৪) বলেছেন যে তিনি কখনই মায়ার অধীন হন
না। পক্ষান্তরে মায়াই বিনীতভাবে তাঁর সেবা করে চলেছেঃ ‘দৈবি হ্যেষা গুণময়ী মম
মায়া দূরত্যয়া। মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।। (ভ. গী.- ৭/১৪)’
“আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমনীয়া। কিন্তু যারা আমাতে
প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে
পারেন।” এই শ্লোকের “মম মায়া”-র অর্থ হচ্ছে “আমার মায়াশক্তি”। অতএব শ্রীকৃষ্ণ
এখানে দাবী করছেন যে মায়া শক্তি তাঁর অধীন এবং তাঁর আজ্ঞানুসারে তা কার্য করে।
সুতরাং এই মায়াশক্তি ভগবানকে পরাভূত করবে, এমন
কোনো সম্ভাবনাই নেই।
জীবসত্তার কেবল প্রত্যক্ষ
সচেতনতা রয়েছে, শ্রীকৃষ্ণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ
উভয় প্রকার সচেতনতা রয়েছে
আমরা এমন কত বিষয় নিয়ে
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকি যা আমাদের প্রত্যক্ষণ বা ইন্দ্রিয়ানুভূতির পরিধির
মধ্যে। কিছু বিষয় সম্বন্ধে আমাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সচেতনতা বা জ্ঞান রয়েছে।
কিন্তু আমরা এমনকি এটাও জানতে পারি না- এক টুকরো খাদ্য গলাধঃকরণ করার পর কি ঘটে, কিভাবে খাদ্য বিভিন্ন
প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদানে ও রক্তে পরিণত হয়, কিভাবে
তা শরীরের পুষ্টিসাধন করে, কিভাবে দেহের বিভিন্ন
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুষ্ট হয়, কিভাবে সেগুলি কার করছে।
আমাদের পরোক্ষ-অনুভবের বা প্রত্যক্ষণের ক্ষমতা নেই।
কিন্তু শ্রীমদভাগবতের প্রথম
শ্লোকে (১/১/১) বলা হয়েছে, জন্মাদস্য
যতহন্বয়াদিতরতশ্চার্থেস্বভিজ্ঞঃ স্বরাট।’ ‘অন্বয়াৎ’ শব্দের অর্থ ‘প্রত্যক্ষভাবে’
এবং ‘ইতরতঃ’ শব্দের অর্থ- ‘পরোক্ষভাবে’। সুতরাং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মাণ্ডে
প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে সর্বকাল ধরে ঘটমান সবকিছু সম্বন্ধে পূর্ণরূপে সচেতন।
আর ‘স্বরাট’ শব্দের অর্থ হচ্ছে “পরম স্বাধীন”। শক্তি বা জ্ঞানের জন্য তিনি কারো
উপর নির্ভরশীল নন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর শক্তিসমূহের মাধ্যমে সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে
থাকেন।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা
হয়েছেঃ ‘পরাস্য শক্তির্বিবিধৈব সূয়তে, স্বাভাবিকী
জ্ঞান বল ক্রিয়া চ’ যার অর্থ ‘শ্রীকৃষ্ণের অসীম শতিরাজি রয়েছে, এবং তিনি তাঁর শক্তিরাজির
মাধ্যমে ক্রিয়া করেন।’ শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মাণ্ডের যে কোনো অংশের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা
স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োগ করতে পারেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আপনার শরীরে যদি কোথাও চুলকানি
থাকে, তাহলে সেখানে চুলকানোর জন্য
কোনো পরিকল্পনা রচনার প্রয়োজন হয় না। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই (‘স্বাভাবিকী’) আপনার
হাত সেখানে চুলকাতে শুরু করে। ঠিক সেইরকম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন জড় জগৎ সৃষ্টির
ইচ্ছা করেন, তখন এজন্য তাঁর কোনো নক্শা বা
মডেল রচনা করার দরকার হয় না, তাঁকে ভাবতে হয় না কোথা
থেকে উপাদানগুলি সংগ্রহ করতে হবে, কিভাবে সেগুলিকে একত্রে
মিশ্রিত করতে হবে- ইত্যাদি, এবং পরে কিভাবে ঐ
সৃষ্ট-জগতকে পালন করতে হবে। এসব কোন কিছু সম্বন্ধে তাঁর কোনো উৎকণ্ঠিত হওয়ার কোনো
প্রয়োজনই হয় না- ‘স্বাভাবিকী’। সব কিছু স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে। সবকিছুই তিনি
সম্পন্ন করেন তাঁর শক্তিরাজির মাধ্যমে। তাঁর শক্তি স্বয়ংক্রিয়, স্বয়ংসিদ্ধ ও স্বতঃস্ফূর্ত। এই
হচ্ছে পরমচৈতন্যের স্বরূপ।
শ্রীকৃষ্ণের সংগে দেবদেবীগণের
সম্পর্ক:-
জড়জগতের কার্যাবলী পরিচালনার
জন্য পরমেশ্বর ভগবানের পরিচালনাধীন যে প্রশাসন-ব্যবস্থা বা ‘সরকার’ রয়েছে, দেবদেবীগণ হচ্ছেন সেই সরকারের
বিভিন্ন পদস্থ কর্মাধ্যক্ষ (অফিসার) ও নির্দেশক বা তত্ত্বাবধায়ক (ডিরেক্টর)। এই
সব দেবদেবীগণ প্রকৃতির বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার জন্য ভগবানের দ্বারা
শক্তিপ্রাপ্ত হন। ইন্দ্র, বরুণ, বায়ু, ব্রহ্মা ইত্যাদি দেবদেবীগণ
সকলেই পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটা সর্বজনবিদিত যে যখনই কোন মহাজাগতিক
বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, ব্রহ্মাণ্ডে কোন এমন
আকারের বিঘ্ন-বিপর্যয় ঘটে যা দেবদেবীগণের নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতার বাইরে, তখন ব্রহ্মার নেতৃত্বে সকল
দেবদেবীগণ বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন (যেমন দ্বাপরে ব্রহ্মা-শিব-ইন্দ্র-সহ সকল দেবগণ
ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণুর নিকটে গিয়ে পুরুষসূক্তে মন্ত্রে তাঁর আবাহন করেন, এবং তাঁরপর শ্রীকৃষ্ণ অবতীর্ণ
হন)।
সুতরাং, দেবদেবীগণকে একটি বৃক্ষের
পত্র-পল্লব-শাখার সংগে তুলনা করা যায়, আর
শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ঐ বৃক্ষটির মূল কাণ্ড। যদি কোনো গাছকে পুষ্ট করতে হয়, তাহলে ঐ গাছের গোড়ায়, মূলে জল ঢালতে হয়, তখন পত্র-পল্লব শাখা সমন্বিত
সমস্ত গাছটিই পরিপুষ্ট হয়। প্রতিটি পাতায়, পল্লবে
পৃথকভাবে জল দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, আর
সেটা বাস্তবসম্মতও নয়। শ্রীমদ্ভাগবতে নারদমুনি প্রচেতাগণকে বলেন (৪/৩১/১৪)ঃ
যথা তরোর্মূলনিষেচনেন
তৃপ্যন্তি তৎস্কন্ধভুজোপশাখাঃ।
প্রাণাপোহারাচ্চ
যথেন্দ্রিয়ানাং
তথৈব সর্বার্হণমুচ্যতেজ্যা।।
“গাছের মূলে জল সেচন করলে যেমন
সেই গাছের কাণ্ড, ডাল, উপশাখা প্রভৃতি সকলেই তৃপ্তি
লাভ করে এবং উদরকে খাদ্যদ্রব্য দিলে যেমন শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-ইন্দ্রিয়
পরিপুষ্ট হয়, তেমনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের
পূজা করলে সকলেরই পূজা হয়, সকলেই তৃপ্ত (পুষ্ট)
হয়।”
----
-----
জীবসত্তাসমূহ ও দেবদাবীগণ –
সকলেই পরমেশ্বর ভগবানের ইচ্ছাধীন। সাধারণতঃ এই জড়জগতে যেসব ব্যক্তি বিভিন্নভাবে
দুর্দশাগ্রস্ত হয় বা নানা কামনা-পূরণে আকুল হয়, তাঁরা
দেবদেবীর শরণাপন্ন হয়। বিশেষ কামনা পূরণের জন্য বিশেষ বিশেষ দেবতার নিকটে যেতে
হয়। যেমন রোগাক্রান্ত ব্যক্তির ‘সূর্য পূজা’ করার বিধান রয়েছে, যিনি জড়বিদ্যা লাভ করতে চান, তাঁকে বিদ্যাদেবী সরস্বতীর
আরাধনা করতে হয়; কেউ যদি ধনৈশ্বর্য চান, তাহলে তাঁকে লক্ষ্মীদেবীর পূজা
করতে হয়। কেউ যদি সুন্দর স্বামী চান, তিনি
শিবের আরাধনা করেন, সুন্দরী স্ত্রী চাইলে
শিবের স্ত্রী উমাদেবীর আরাধনা করতে হয়। এইভাবে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জন্য
বিভিন্ন রকমের পূজার বিধান শাস্ত্রে নির্দেশিত হয়েছে।
কিন্তু দেব-পূজার এই
সুযোগ-সুবিধাগুলি তাঁদের প্রদত্ত হয়েছে, যারা
স্বল্প মেধা-সম্পন্ন, এবং জড় কামনা-বাসনা
যাঁদের চিত্ত অধিকার করেছে, প্রকৃত জ্ঞান হরণ করেছে।
ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন, যাদের
মন জড় কামনা বাসনার দ্বারা বিকৃ্ত, তারা
অন্য দেবদেবীর শরণাগত হয়” (৭/২০); অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদের
(অল্পমেধসাম্) আরাধনা-লব্ধ সেই ফল ক্ষণস্থায়ী। দেবতাদের উপাসকেরা তাঁদের আরাধ্য
দেবতাদের লোক প্রাপ্ত হন (যা জড়, প্রাকৃত’), কিন্তু আমার ভক্তরা আমার পরম
ধর্মপ্রাপ্ত হন (চিন্ময়, অপ্রাকৃ্ত) (ভগী-৭/২৩)।”
কিন্তু দেব-পূজার এই
সুযোগ-সুবিধাগুলি তাঁদের প্রদত্ত হয়েছে, যারা
স্বল্প মেধা-সম্পন্ন, এবং জড় কামনা-বাসনা
যাঁদের চিত্ত অধিকার করেছে, প্রকৃত জ্ঞান হরণ করেছে।
ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন, যাদের
মন জড় কামনা বাসনার দ্বারা বিকৃ্ত, তারা
অন্য দেবদেবীর শরণাগত হয়” (৭/২০); অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদের
(অল্পমেধসাম্) আরাধনা-লব্ধ সেই ফল ক্ষণস্থায়ী। দেবতাদের উপাসকেরা তাঁদের আরাধ্য
দেবতাদের লোক প্রাপ্ত হন (যা জড়, প্রাকৃত’), কিন্তু আমার ভক্তরা আমার পরম
ধর্মপ্রাপ্ত হন (চিন্ময়, অপ্রাকৃ্ত) (ভগী-৭/২৩)।”
শ্রীকৃষ্ণ কেন দেবপূজকদের
স্বল্প-মেধা বা স্বল্পবুদ্ধি (অল্পমেধসাম্)বলেছেন? (১)
তারা গাছের পাতায় জল দেওয়ার মতোই দেবদেবীদের আরাধনা করে, যা কখনো হৃদয়কে পূর্ণ
পরিতৃপ্তি দেয় না, এমনকি দেবতারাও তাতে
প্রকৃত সন্তুষ্ট হন না, ঠিক যেমন পাতায় জল দিলে
পাতা পুষ্ট হয় না, অথবা হাতকে খাদ্য দিলে
হাতের পুষ্টিবিধান হয় না। শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পুষ্ট করতে হলে খাদ্য
দিতে হবে উদরকে।
দেবদেবীদের বলা যেতে পারে
পরমেশ্বর ভগবানের পরিচালনাধীন সরকারের বিভিন্ন অফিসার বা ডিরেক্টর। রাষ্ট্রপতিকে
সন্তুষ্ট করলে যেমন কিছুই অলভ্য থাকেনা, তেমনি
ভগবানকে পরিতৃপ্ত করলে সবকিছু আপনা থেকেই সাধিত হয়। পক্ষান্তরে, অফিসার বা ডিরেক্টরদের ঘুষ
দিয়ে কিছু লাভ করা যেমন শোভনীয় নয়, তেমনি
দেবদেবীগণকে কিছু উপহার দিয়ে অস্থায়ী ফল লাভ করে মূল্যবান মানব-জীবনটি সমাপ্ত
করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়।
----
-----
কিভাবে দেব দেবীগণকে সম্মান জানাতে হয়?
একজন কৃষ্ণভক্ত জানেন যে
দেবদেবীগণ সকলেই শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা শক্তিপ্রাপ্ত শ্রীকৃষ্ণের আজ্ঞানুবর্তী
সেবক-সেবিকা। এঁদের প্রত্যেককেই বিশেষ বিশেষ সেবাভার বা কার্যভার দেওয়া হয়েছে।
কৃষ্ণভক্ত দেবদেবীগণকে কখনই
অসম্মান করেন না, তিনি সকল দেবদেবীগণকে
শ্রীকৃষ্ণর বিরাট-রূপের বা বিশ্বরূপের অবিচ্ছেদ্য অংশ রূপে দর্শন করেন এবং
তাঁদেরকে সম্মান করেন, প্রণাম করেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন
করেন। অবশ্য, কৃষ্ণভক্ত তাঁদের কাছ থেকে কোন
জড়-লাভ, প্রতিষ্ঠা কামনা করেন না। যখন
একজন কৃষ্ণভক্ত শ্রীগণেশকে প্রণাম ও প্রার্থনা করেন, তিনি
বলেন, হে প্রভু! কৃষ্ণের কাছে ফিরে
যাওয়ার পথে যে সব বাধা-বিঘ্ন রয়েছে, কৃপাপূর্বক
আপনি সেগুলি দূর করুন।” যখন তিনি শিবের নিকট প্রার্থনা করেন, তিনি বলেন, আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব। কৃপা
করে আমাকেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একজন প্রেমানুরক্ত ভক্ত হবার আশীর্বাদ করুন, যাতে আমি নিত্যকাল তাঁর সেবায়
নিয়োজিত হতে পারি।” তিনি সরস্বতীর নিকট প্রার্থনা করেন, হে মাতা সরস্বতী। আমাকে কৃপাশীষ
প্রদান করুন, যাতে আমি এই শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ
করে উপলদ্ধি করতে পারি এবং শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত হতে পারি।”
এই হচ্ছে দেবদেবীদের প্রতি
ভক্তের মনোভাব। ভগবদ্ভক্ত সকল জড়-অভিপ্রায়-শূন্য হয়ে নিরন্তর কেবল শ্রীকৃষ্ণের
সেবা করতে আগ্রহী। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁর অনন্য ভক্তের সকল প্রয়োজন পূরণ করেন
(যোগক্ষেম বহামি অহম্ – ভ.গী.-৯/২২)।
একজন কৃষ্ণভক্ত কোন জড় বাসনা
পূরণের জন্য কোন দেব-দেবীর নিকটে যাবার কথা এমনকি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না।
বৃন্দাবনের গোপিকাগণ যখন কাত্যায়ণী ব্রত করে কাত্যায়ণী দেবীর (যোগমায়া) নিকট
প্রার্থনা করতেন, তাদের প্রার্থনা ছিল এই
যে কৃষ্ণকে যেন তাঁরা স্বামীরূপে লাভ করতে পারেন। সুতরাং শ্রীকৃষ্ণের একজন
অনন্যচিত্ত শুদ্ধ ভক্ত হওয়ার জন্যই আমাদের আকাঙ্ক্ষিত হওয়া উচিত।
কিভাবে দেব দেবীগণকে সম্মান
জানাতে হয়?
একজন কৃষ্ণভক্ত জানেন যে
দেবদেবীগণ সকলেই শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা শক্তিপ্রাপ্ত শ্রীকৃষ্ণের আজ্ঞানুবর্তী
সেবক-সেবিকা। এঁদের প্রত্যেককেই বিশেষ বিশেষ সেবাভার বা কার্যভার দেওয়া হয়েছে।
কৃষ্ণভক্ত দেবদেবীগণকে কখনই
অসম্মান করেন না, তিনি সকল দেবদেবীগণকে
শ্রীকৃষ্ণর বিরাট-রূপের বা বিশ্বরূপের অবিচ্ছেদ্য অংশ রূপে দর্শন করেন এবং
তাঁদেরকে সম্মান করেন, প্রণাম করেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন
করেন। অবশ্য, কৃষ্ণভক্ত তাঁদের কাছ থেকে কোন
জড়-লাভ, প্রতিষ্ঠা কামনা করেন না। যখন
একজন কৃষ্ণভক্ত শ্রীগণেশকে প্রণাম ও প্রার্থনা করেন, তিনি
বলেন, হে প্রভু! কৃষ্ণের কাছে ফিরে
যাওয়ার পথে যে সব বাধা-বিঘ্ন রয়েছে, কৃপাপূর্বক
আপনি সেগুলি দূর করুন।” যখন তিনি শিবের নিকট প্রার্থনা করেন, তিনি বলেন, আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব। কৃপা
করে আমাকেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একজন প্রেমানুরক্ত ভক্ত হবার আশীর্বাদ করুন, যাতে আমি নিত্যকাল তাঁর সেবায়
নিয়োজিত হতে পারি।” তিনি সরস্বতীর নিকট প্রার্থনা করেন, হে মাতা সরস্বতী। আমাকে কৃপাশীষ
প্রদান করুন, যাতে আমি এই শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ
করে উপলদ্ধি করতে পারি এবং শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত হতে পারি।”
এই হচ্ছে দেবদেবীদের প্রতি
ভক্তের মনোভাব। ভগবদ্ভক্ত সকল জড়-অভিপ্রায়-শূন্য হয়ে নিরন্তর কেবল শ্রীকৃষ্ণের
সেবা করতে আগ্রহী। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁর অনন্য ভক্তের সকল প্রয়োজন পূরণ করেন
(যোগক্ষেম বহামি অহম্ – ভ.গী.-৯/২২)। একজন কৃষ্ণভক্ত কোন জড় বাসনা পূরণের জন্য
কোন দেব-দেবীর নিকটে যাবার কথা এমনকি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। বৃন্দাবনের
গোপিকাগণ যখন কাত্যায়ণী ব্রত করে কাত্যায়ণী দেবীর (যোগমায়া) নিকট প্রার্থনা
করতেন, তাদের প্রার্থনা ছিল এই যে
কৃষ্ণকে যেন তাঁরা স্বামীরূপে লাভ করতে পারেন। সুতরাং শ্রীকৃষ্ণের একজন অনন্যচিত্ত
শুদ্ধ ভক্ত হওয়ার জন্যই আমাদের আকাঙ্ক্ষিত হওয়া উচিত। “জয় শ্রীকৃষ্ণ”।।
সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয়
পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তরশত নাম
জয় জয় গোবিন্দ গোপাল গধাধর।
কৃষ্ণচন্দ্র কর কৃপা
করুণাসাগর।।
জয় জয় গোবিন্দ গোপাল বনমালী।
শ্রীরাধার প্রাণধন মুকুন্দ
মুরারি।।
হরিনাম বিনে রে গোবিন্দনাম
বিনে।
বিফলে মনুষ্য জন্ম যায় দিনে
দিনে।।
দিন গেল মিছা কাজে রাত্রি গেল
নিদ্রে।
না ভজিনু
রাধাকৃষ্ণ-চরণারবিন্দে।।
কৃষ্ণ ভজিবার তরে সংসারে আইনু।
মিছা-মায়ায় বদ্ধ হ’য়ে
বৃক্ষসম হইনু।।
ফলরূপে পুত্র-কন্যা ডালভাঙ্গি’
পড়ে।
কালরূপে সংসারেতে পক্ষী বাসা
করে।।
যখন কৃষ্ণ জন্ম নিল দৈবকী উদরে।
মথুরাতে দেবগণ পুষ্পবৃষ্টি
করে।।
বসুদেব রাখি’ আইল নন্দের
মন্দিরে।
নন্দের আলয়ে কৃষ্ণ দিনে দিনে
বাড়ে।।
শ্রীনন্দ রাখিল নাম ‘নন্দের
নন্দন’।
যশোদা রাখিল নাম ‘যাদু
বাছাধন’।।
উপানন্দ নাম রাখে ‘সুন্দর
গোপাল’।
ব্রজবালক নাম রাখে ‘ঠাকুর
রাখাল’।।
সুবল রাখিল নাম ‘ঠাকুর কানাই’।
শ্রীদাম রাখিল নাম
‘রাখালরাজা-ভাই’।।
‘ননীচোরা’ নাম রাখে যতেক
গোপিনী।
‘কালোসোনা’ নাম রাখে
রাধাবিনোদিনী।।
চন্দ্রাবলী নাম রাখে
‘মোহন-বংশীধারী’।
কুব্জা রাখিল নাম ‘পতিতপাবন
হরি’।।
‘অনন্ত’ রাখিল নাম অন্ত না
পাইয়া।
‘কৃষ্ণ’ নাম রাখে গর্গ ধ্যানেতে
জানিয়া।।
কন্বমুনি রাখে নাম ‘দেব
চক্রপাণি’।
‘বনমালী’ নাম রাখে বনের হরিণী।।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তরশত
নাম
জয় জয় গোবিন্দ গোপাল গধাধর।
কৃষ্ণচন্দ্র কর কৃপা
করুণাসাগর।।
জয় জয় গোবিন্দ গোপাল বনমালী।
শ্রীরাধার প্রাণধন মুকুন্দ
মুরারি।।
হরিনাম বিনে রে গোবিন্দনাম
বিনে।
বিফলে মনুষ্য জন্ম যায় দিনে
দিনে।।
দিন গেল মিছা কাজে রাত্রি গেল
নিদ্রে।
না ভজিনু
রাধাকৃষ্ণ-চরণারবিন্দে।।
কৃষ্ণ ভজিবার তরে সংসারে আইনু।
মিছা-মায়ায় বদ্ধ হ’য়ে
বৃক্ষসম হইনু।।
ফলরূপে পুত্র-কন্যা ডালভাঙ্গি’
পড়ে।
কালরূপে সংসারেতে পক্ষী বাসা
করে।।
যখন কৃষ্ণ জন্ম নিল দৈবকী উদরে।
মথুরাতে দেবগণ পুষ্পবৃষ্টি
করে।।
বসুদেব রাখি’ আইল নন্দের
মন্দিরে।
নন্দের আলয়ে কৃষ্ণ দিনে দিনে
বাড়ে।।
শ্রীনন্দ রাখিল নাম ‘নন্দের
নন্দন’।
যশোদা রাখিল নাম ‘যাদু
বাছাধন’।।
উপানন্দ নাম রাখে ‘সুন্দর
গোপাল’।
ব্রজবালক নাম রাখে ‘ঠাকুর
রাখাল’।।
সুবল রাখিল নাম ‘ঠাকুর কানাই’।
শ্রীদাম রাখিল নাম
‘রাখালরাজা-ভাই’।।
‘ননীচোরা’ নাম রাখে যতেক
গোপিনী।
‘কালোসোনা’ নাম রাখে
রাধাবিনোদিনী।।
চন্দ্রাবলী নাম রাখে
‘মোহন-বংশীধারী’।
কুব্জা রাখিল নাম ‘পতিতপাবন
হরি’।।
‘অনন্ত’ রাখিল নাম অন্ত না
পাইয়া।
‘কৃষ্ণ’ নাম রাখে গর্গ ধ্যানেতে
জানিয়া।।
কন্বমুনি রাখে নাম ‘দেব
চক্রপাণি’।
‘বনমালী’ নাম রাখে বনের হরিণী।।
গজরাজ নাম রাখে ‘শ্রীমধুসূদন’।
অজামিল নাম রাখে ‘দেব
নারায়ণ’।।
পুরন্দর নাম রাখে ‘দেব
শ্রীগোবিন্দ’।
দ্রৌপদী রাখিল নাম ‘দেব
দীনবন্ধু’।।
সুদামা রাখিল নাম
‘দারিদ্র্যভঞ্জন’।
ব্রজবাসী নাম রাখে ‘ব্রজের
জীবন’।।
‘দর্পহারী’ নাম রাখে ‘অর্জুন
সুধীর।
‘পশুপতি’ নাম রাখে গরুড়
মহাবীর।।
যুধিষ্ঠির নাম রাখে ‘দেব
যদুবর’।
বিদূর রাখিল নাম ‘কাঙ্গালের
ঠাকুর’।।
বাসুকী রাখিল নাম ‘দেব
সৃষ্টি-স্থিতি’।
ধ্রুবলোকে নাম রাখে ‘ধ্রুবের
সারথী’।।
নারদ রাখিল নাম ‘ভক্তপ্রাণধন’।
ভীষ্মদেব নাম রাখে
‘লক্ষ্মীনারায়ণ’।।
সত্যভামা নাম রাখে ‘সত্যের
সারথী’।
জাম্ববতী নাম রাখে ‘সংসারের
সার’।
অহল্যা রাখিল নাম
‘পাষাণ-উদ্ধার’।।
ভৃগুমুনি নাম রাখে ‘জগতের হরি’।
পঞ্চমুখে ‘রাম’-নাম গান
ত্রিপুরারি।।
কুঞ্জকেশী নাম রাখে ‘বলী
সদাচারী’।
প্রহ্লাদ রাখিল নাম ‘নৃ্সিংহ
মুরারী’।।
দৈত্যারি দ্বারকানাথ
দারিদ্রভঞ্জন।
দয়াময় দ্রৌপদীর
লজ্জা-নিবারণ।।
স্বরূপে সবার হয় গোলোকেতে
স্থিতি।
বৈকুন্ঠে বৈকুন্ঠনাথ কমলার
পতি।।
বাসুদেব-প্রদ্যুম্নাদি-চতুর্বূহ-সহ।
মহৈশ্বর্যপূর্ণ হ’য়ে বিহার
করহ।।
অনিরুদ্ধ সঙ্কর্শণ নৃসিংহ বামন।
মৎস-কূর্ম-বরাহাদি অবতারগণ।।
ক্ষীরোদকশায়ী হরি
গর্ভোদবিহারী।
কারণসাগরে শক্তি মায়াতে
সঞ্চারী।।
বৃন্দাবনে কর লীলা ধরি গোপবেশ।
সে লীলার অন্ত প্রভু নাহি পায়
‘শেষ’।।
পূতনাবিনাশকারী শকটভঞ্জন।
তৃণাবর্ত-বক-কেশী-ধেনুক-মর্দন।।
অঘারি গোবৎসহারী ব্রহ্মার মোহন।
গিরিগোবর্ধনধারী অর্জুনভঞ্জন।।
কালীয়দমনকারী যমুনাবিহারী।
গোপীকুলবস্ত্রহারী
শ্রীরাসবিহারী।।
ইন্দ্রদর্পনাশকারী
কুব্জামনোহারী।
ইন্দ্রদর্পনাশকারী
কুব্জামনোহারী।
চাণুর-কংসাদি-নাশী
অক্রূরনিস্তারী।।
নবীন-নীরদ-কান্তি শিশুগোপবেশ।
শিখিপুচ্ছবিভূষিত ব্রহ্ম-পরবেশ।।
পীতাম্বর-বেণুধর শ্রীবৎসলাঞ্ছন।
গোপগোপীপরিবৃত কমল-নয়ন।।
বৃন্দাবন-বনচারী মদনমোহন।
মথুরামণ্ডলচারী শ্রীযদুনন্দন।।
সত্যভামাপ্রাণপতি রুক্মিণীরমণ।
প্রদ্যুম্নজনক
শিশুপাল্যাদি-দমন।।
উদ্ধবের গতিদাতা দ্বারকার পতি।
ত্রিভুবনপরিত্রাতা অখিলের গতি।।
শাল্ব-দন্তবক্র নাশী
মহিষীবিলাসী।
সাধুজন-ত্রাণকর্তা
ভূভার-বিনাশী।।
পাণ্ডবের সখা কৃষ্ণ বিদুরের
প্রভু।
ভীষ্মের উপাস্যদেব ভুবনের
বিভু।।
দেবের আরাধ্যদেব মুনিজনগতি।
যোগিধ্যেয়-পাদপদ্ম রাধিকার
পতি।।
রসময় রসিক নাগর অনুপম।
নিকুঞ্জবিহারী হরি নবঘনশ্যাম।।
শালগ্রাম দামোদর শ্রীপতি
শ্রীধর।
তারক-ব্রহ্ম সনাতন পরম ঈশ্বর।।
কল্পতরু কমললোচন হৃষিকেশ।
পতিতপাবন গুরু জ্ঞান-উপদেশ।।
চিন্তামণি চতুর্ভূজ দেব
চক্রপাণি।
দীনবন্ধু দেবকীনন্দন যদুমণি।।
অনন্ত কৃষ্ণের নাম অনন্ত মহিমা।
নারদাদি ব্যাসদেব দিতে নারে
সীমা।।
নাম ভজ নাম চিন্ত নাম কর সার।
অনন্ত কৃষ্ণের নাম মহিমা অপার।।
শতভার-সুবর্ণ-গো-কোটি-কন্যাদান।
তথাপি না হয় কৃষ্ণনামের সমান।।
যেই নাম সেই কৃষ্ণ ভজ নিষ্ঠা
করি।
নামের সহিত আছেন আপনি শ্রীহরি।।
শুন শুন ওরে ভাই নাম-সংকীর্তন।
যে নাম শ্রবণে হয় পাপ-বিমোচন।।
কৃষ্ণনাম ভজ জীব আর সব মিছে।
পলাইতে পথ নাই যম আছে পিছে।।
কৃষ্ণনাম হরিনাম বড়ই মধুর।
যেই জন কৃষ্ণ ভজে সে বড় চতুর।।
ব্রহ্মা-আদি দেব যাঁরে ধ্যানে
নাহি পায়।
সে-হরি-বঞ্চিত হ’লে কি হবে
উপায়।।
হিরণ্যকশিপুর করি উদর বিদারণ।
প্রহ্লাদে করিলা রক্ষা দেব
নারায়ণ।।
বলিরে ছলিতে প্রভু রইলা বামন।
দ্রৌপদীর লজ্জা হরি কৈলা
নিবারণ।।
অষ্টোত্ত্রশত নাম যে করে পঠন।
অনায়াসে পায় রাধাকৃষ্ণের
চরণ।।
ভক্তবাঞ্ছা পূর্ণ করে নন্দের
নন্দন।
মথুরায় কংসধ্বংস, লঙ্কায় রাবণ।।
বকাসুরবধ আদি কালীয়দমন।
দ্বিজ হরিদাস কহে
নাম-সংকীর্তন।।
0 Comments