মীরাবাঈঃ


মীরাবাঈ (রাজস্থানি: मीराबाई) (১৪৯৮-১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন একজন অভিজাতবংশীয়  হিন্দু  অতিন্দ্রীয়বাদী সংগীতশিল্পী ও সহজিয়া (অসাম্প্রদায়িক) কৃষ্ণ-ভক্ত। তিনি রাজস্থান অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। মীরাবাঈ বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের সন্ত ধারার প্রধান ব্যক্তিত্বদের অন্যতম। মনে করা হয়, তিনি বারোশো থেকে তেরোশো ভজন রচনা করেছিলেন। এই গানগুলি সারা ভারতে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ভক্তিবাদী ধারায় রচিত এই গানগুলির মাধ্যমে তিনি কৃষ্ণের প্রতি তাঁর প্রেম ব্যক্ত করেছিলেন।


মীরাবাঈয়ের গান ও তাঁর সম্প্রদায়ে তাঁর সম্পর্কে যে গল্প প্রচলিত আছে তার ভিত্তিতে তাঁর জীবনবৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়। এই জীবনবৃত্তান্ত অবলম্বনে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তবে এই সব গল্পের ঐতিহাসিক ভিত্তি অবিতর্কিত নয়। বিশেষত, যে সব গল্পে তানসেনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক প্রদর্শিত হয়েছে সেগুলি যথেষ্টই বিতর্কিত। আবার মীরা রবিদাস না রূপ গোস্বামীর শিষ্যা ছিলেন, তা নিয়েও বিতর্ক আছে।


জীবনী


মীরা ছিলেন একজন রাজপুত রাজকুমারী।[১] তিনি অধুনা ভারতের রাজস্থান রাজ্যের নাগৌর জেলার অন্তঃপাতী মেরতার নিকটবর্তী কুদকি (কুরকি) নামে একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন যোধপুর শহরের প্রতিষ্ঠাতা মান্দোরের রাও যোধার (১৪১৬-১৪৮৯) পুত্র তথা রাঠোর বংশীয় যোদ্ধা রতন সিংহ রাঠোর।


বাল্যকালে মীরা এক পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর দ্বারা আরাধিত একটি কৃষ্ণমূর্তির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। মূর্তিটি পাওয়ার জন্য তিনি কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলেন। মূর্তিটি তাঁকে দেওয়া হয়েছিল এবং সম্ভবত তিনি সারা জীবন মূর্তিটি নিজের কাছে রেখেছিলেন। তাঁর মা তাঁর এই ধর্মভাবের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তিনি অকালেই মারা যান।


শৈশবেই চিতোর-রাজ রানা সঙ্গার জ্যেষ্ঠ পুত্র ভোজ রাজের সাথে মীরার বিয়ের হয়। যোদ্ধা পরিবারের সদস্য হয়ে মীরা উল্লেখ করেন যে তিনি প্রকৃতই শ্রীকৃষ্ণের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। ফলে, শ্বশুরবাড়ীর লোকজন তার ঈশ্বর ভক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তৈমুর কর্তৃক হিন্দুস্তান দখলের পর ইসলামী শাসনে আবদ্ধ দিল্লীর সুলতানের রাজত্বকালে রাজপুতেরা জোরপূর্বক নিজেদেরকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করে। কিন্তু ষোড়শ শতকে বাবর কর্তৃক সাম্রাজ্য দখল করলে এবং কিছু রাজপুত তাকে সমর্থন করলে বাকীরা নিজেদের জীবনবাজী রেখে তার সাথে যুদ্ধ করে। মীরার স্বামী ভোজ রাজ ১৫২৭ খ্রীষ্টাব্দের ঐ যুদ্ধে নিহত হয়। মীরার ২০ বছর বয়সী জীবনে মায়ের মৃত্যুর পর এটি ছিল ধারাবাহিক শোকের আরও একটি। তিনি মনে করলেন, ভালবাসা-প্রেম-আবেগ সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। কৃষ্ণপ্রেমে মত্ততা মীরার একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় হলেও কখনও কখনও এই মত্ততা নিয়ে তাকে শহরের অলি-গলিতে নাঁচতে হয়েছিল। তার দেবর ও চিতোরগড়ের নতুন শাসক বিক্রমাদিত্য ছিলেন দুষ্ট-প্রকৃতির যুবক। মীরা'র খ্যাতি, সাধারণ ব্যক্তিদের সাথে তার মেলামেশা এবং নারী হিসেবে লজ্জাশীলতা না থাকায় কয়েকবারই বিক্রমাদিত্য তাকে বিষ মিশিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও, তার ননদ উদাবাঈ মীরা'র সম্বন্ধে বিভিন্ন দূর্নাম রটাতে থাকেন।[২] এর কিছুদিন পর মীরা গুরু হিসেবে রবিদাসের নাম ঘোষণা করেন এবং বৃন্দাবনে কৃষ্ণনাম করতে করতে চলে যান। তিনি মনে করতেন যে, পূর্বজন্মে গোপী হিসেবে ললিতা নামে কৃষ্ণপ্রেমে পাগল ছিলেন। মীরা'র অভিমত যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র পরমপুরুষ হচ্ছেন প্রভু শ্রীকৃষ্ণ। তিনি সন্ন্যাসব্রত অব্যাহত রাখলেন এবং নৃত্যসহযোগে উত্তর ভারতের বিভিন্ন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বেড়াতে লাগলেন।[৩] মীরা'র সাথী হিসেবে বারাণশীতে কবীরের সাথে ঘনিষ্ঠতা সামাজিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। শেষের বছরগুলোতে সন্ন্যাসীনি হয়ে গুজরাটের দ্বারকায় মীরাকে দেখা গিয়েছিল।


 ভজন


মীরা'র গানগুলো সাধারণ ধারারই পদ, শ্লোক বা চরণ যা আধ্যাত্মিক গানেরই অংশবিশেষ। পদগুলো একত্রিত হয়ে "মীরা'র পদাবলী" বা মীরা'র ভজন নাম ধারণ করে। বর্তমানে প্রচলিত অনুবাদগুলো রাজস্থানী ভাষায় এবং কৃষ্ণের জন্মভূমি বৃন্দাবনে হিন্দীতে ব্রজ ভাষায় ব্যাপক হারে উচ্চারিত হচ্ছে। পদগুলোর কিছু কিছু আবার রাজস্থানী এবং গুজরাটি - উভয় ভাষায়ই লিখিত।


যদিও মীরা নির্গুণ ব্রহ্মত্বের আধ্যাত্মিকতা এবং উত্তরের শান্ত ভক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন, তবুও সন্দেহ নেই যে তিনি তার হদয়, মন ও মন্দির শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণকে ঠাঁই দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন যে প্রিয়া ও প্রভু হিসেবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিদ্যমান। তার কবিতাগুলোয় কৃষ্ণের পদচরণে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের কথকতা বর্ণিত আছে। কবিতায় কৃষ্ণের প্রিয় রঙ গোধূলীতে রঙ্গীন হবার বাসনার কথাও মীরা উল্লেখ করেছেন।

(সংকলিত)

Post a Comment

0 Comments