আমার ভ্যালেন্টাইন
কথিত আছে যে, ভ্যালেন্টাইন নামে একজন ধর্মীয় ব্যক্তি ছিলেন যিনি তৃতীয় শতাব্দিতে রোমে সেবা করতেন । যখন সম্রাট ক্লডিয়াস-২ সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তার অবিবাহিত যুবক সৈন্যরা বিবাহ করতে পারবে না, কারন অবিবাহিত একজন যুবক ব্যক্তি স্ত্রী ও পরিবার সম্বলিত বিবাহিত ব্যক্তির চেয়ে উত্তম সৈন্য হিসেবে পরিগণিত । ভ্যালেন্টাইন এই অবিচার সম্পর্কে বুঝতে পেরে সম্রাট ক্লডিয়াসের এই সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করে গোপনে তাদের বিবাহ চালিয়ে যেতে লাগলেন । একসময় ভ্যালেন্টাইনের এই কার্যকলাপ ধরা পড়লে ক্লডিয়াস তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার আদেশ করলেন ।
এ বিষয়ে আরেকটি কাহিনি প্রচলিত হয় যে, রোমান কারাগার থেকে নির্যাতিত খ্রিষ্টানদের মুক্ত করার জন্য সহায়তা করতে উদ্যোগী হওয়ায় ভ্যালেন্টাইনকে হত্যা করা হয়েছিল । অনেকে আবার বলে থাকে যে, দুজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভ্যালেন্টাইন ছিল যারা উভয়ই শহীদ হয়েছিলেন ।
গল্প যাই হোক না কেন, ভ্যালেন্টাইন দিবসটি বিপণন ব্যবসায়ীদের জন্য নিশ্চিতভাবে প্রিয় একটি দিবস । কেননা এই দিবসটি রমরমা ব্যবসা করার একটি ভালো মাধ্যম ।
গ্রিটিং কার্ড এসোসিয়েশন (অভিবাদন কার্ড সংস্থা) অনুসারে, শুধুমাত্র আমেরিকাতে প্রতি বছর পাঠানো হয় এক বিলিয়ন (১০০ কোটি) ভ্যালেন্টাইন কার্ড । এর মাধ্যমে এই ভ্যালেন্টাইন দিবসটি বছরের অন্য কোনো দিবসে কার্ড পাঠানোর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হিসেবে আমেরিকায় স্বীকৃত পেয়েছে । ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশন অনুসারে শুধুমাত্র ২০১৯ সালে ১৬৯০ ডলার বরাদ্দ করা হয়েছিল । গড় হিসেবে যা প্রায় ১২০ ডলার ।
ভালোবাসা প্রকাশের অনেক মাধ্যম হিসেবে কেউ কেউ আবার এরকম কোনো কিছু কিনে অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষেত্রে নারাজ ।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে পূর্বে ভালোবাসার অভিব্যক্তি প্রকাশের সূত্রপাত ঘটেছিল? এ যুগের বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড সংস্কৃতি অন্যভাবে সেই অভিব্যক্তি প্রকাশ করে । তবে বৈদিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট থেকে এটিকে কিভাবে বলা যায় । ভগবদগীতায় ভগবান বলেছেন, তিনিই হলেন সবকিছুর পরম উৎস, তাঁর থেকেই সবকিছু উথিত । অতএব, প্রকৃত ভালবাসার নিদর্শন তাঁর মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যায় । এক্ষেত্রে কিভাবে তিনি সেই ভালবাসা প্রকাশ করেন? এজন্যে কৃষ্ণের কোনো নারীর অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয় না । তিনি সেই ভালবাসা বিনিময়ে করেন তাঁর নিজেরই চিন্ময় শক্তি রাধারাণীর সঙ্গে । রাধাকৃষ্ণ হল যথাক্রমে সূর্যরশ্নি ও সূর্যের মতো । যেখানে একজন হল শক্তি আরেকজন হলেন শক্তিমান । মহান ভগবভক্তরা এবং বিজ্ঞ পন্ডিতগণ এই সিধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, কৃষ্ণ ও বৃন্দাবনের গোপীদের মধ্যকার যে প্রেমের বিনিময় তা সর্বোচ্চ চিন্ময় স্তরে অবস্থিত । এধরনের প্রেমের আদান প্রদান চিন্ময় বিবর্তনজাত । এই জড় জগৎ হল চিন্ময় জগতের প্রতিবিম্ব যেরকম কোনো বৃক্ষের প্রতিনিম্ব প্রতিফলিত হয় জলাশয়ে । প্রকৃত বৃক্ষটির শিকড়গুলো নিম্নমুখী এবং এর শাখা-প্রশাখাসমূহ উর্ধ্বমুখী, কিন্তু প্রতিফলনের ফলে শিকড়গুলো উর্ধ্বমুখী এবং শাখা-প্রশাখাসমূহ নিম্নমুখী হিসেবে প্রতিভাত হয় ।
চিন্ময় জগতে সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত চিন্ময় প্রেমের, আর সেই চিন্ময় প্রেমেরই বিকৃত প্রতিফলন দেখা যায় এই জড়জগতে । চিন্ময় জগতে বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড হিসেবে থাকার ব্যাপারটি সর্বোচ্চ আনন্দের আধার, কিন্তু এ জড় জগতে ঐ একই বিষয়টি সবচেয়ে হিতকর হিসেবে পরিগণিত । শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণের যুগল প্রেমের আদান-প্রদানের মূল বিষয়টি উপলব্ধি না করলে আমরা তা অনুসরণ করতে পারি না ।
আমাদের এটি উপলব্ধি করতে হবে, পরমেশ্বর ভগবানের মধ্যে যদি এই ভালবাসার প্রবৃত্তি না থাকত তবে কিভাবে সেটি জীবের নধ্যে প্রতিফলিত হতে পারে? এক্ষেত্রে জীবের মধ্যে সেটি বিকৃতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তবে সেটির অবশ্যই একটি উৎস রয়েছে । অতএব, যারা বলে যে, ভগবান হলেন ব্যক্তিত্বহীন বা তাঁর কোন আকার নেই । কিংবা তাঁর কার্যকলাপসমূহ হল মোহময় তবে তা অপ্রত্যক্ষভাবে জড় জগতের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির কার্যকলাপের প্রতি আমাদের প্রশয় দানের জন্য উৎসাহ প্রদান করে, যার পরিসমাপ্তি ঘটে চরম দুঃখ দুর্দশার মাধ্যমে ।
বৈষ্ণব দর্শন অনুসারে কৃষ্ণের এই প্রেমময় কার্যকলাপসমূহ উপলব্ধির ফলে আমাদের জীবনে যে প্রভাব রাখে তা হল আমাদের জড় কামুক বাসনাসমূহ নির্মূল হয়ে যায় । আমারা সবাই কামের দ্বারা প্ররোচিত । কিন্তু চিন্ময় জগতে কাম অস্তিত্বহীন ।
কাম প্রসঙ্গে মহান ভক্ত যামুনাচার্য বলেছেন,
“যখন থেকে আমার মন শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দিব্য ভক্তিমূলক সেবায় নিযুক্ত হয়েছে এবং তাঁর মধ্যে নব নব রস আস্বাদন করতে শুরু করেছে, সেদিন থেকে যখনই আমি জঘন্য যৌন সুখের কথা ভাবি, তখনই বিরক্তিতে আমার মুখ বিকৃত হয় এবং সেই জঘন্য চিন্তার উদ্দেশ্যে আমি থুথু ফেলি ।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ব্রহ্মানন্দের উৎস হিসেবে অভিহিত করা হয়, যা অনেক ত্যাগী মুনি-ঋষিরা অনুসন্ধান করে থাকেন । এই ব্রহ্মানন্দ লাভ করার জন্য এ সমস্ত ভক্তরা শুধু মৈথুন জীবন নয়, এর চেয়েও চরম আনন্দসহ সবকিছু বিসর্জন দেয় । এভাবে এটি ভাবা অযৌক্তিক যে, যিনি ব্রহ্মানন্দের উৎস তিনি সামান্য এই জড়জগতের আনন্দ উপভোগের জন্য কিংবা তথাকথিত মৈথুন জীবনে নিয়োজিত হওয়ার জন্য অবতরণ করবেন ।
পরিশেষে, ঐ সমস্ত তথাকথিত ভ্যালেন্টাইন কার্ডগুলো কেনার পরিবর্তে বা নিজেকে এরকম জড় উন্মাদনার আনন্দে গা ভাসানোর পরিবর্তে কেন হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ কীর্তন নয় কিংবা যদি ভ্যালেন্টাইন কার্ড কিনতেই হয় তবে “I Want to Love You”(আমি তোমাকে ভালবাসতে চাই) লেখা সম্বলিত কার্ড পরম প্রেমময়ী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্য উপহার স্বরূপ নয়?
0 Comments