★☞সরস্বতী দেবী কে?
সরস্বতী শব্দটি ‘সার’ এবং ‘স্ব’ দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। সেই অনুসারে সরস্বতী শব্দের অর্থ যিনি কারো মধ্যে সারজ্ঞান প্রকাশ করেন। আবার সরস্বতী শব্দটি সংস্কৃত ‘সুরস বতি’ শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ হচ্ছে জলের আধার। সরস্বতী সাক্ষাৎ দেবী মূর্তি এবং নদী-দুইরূপেই প্রকটিত।
ঋগ্বেদে (২/৪১/১৬) বর্ণানা করা হয়েছে-
অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী।
অপ্রশস্তা ইব স্মসি প্রশস্তিমন্ব নস্কৃধি।।
অর্থাৎ "মাতৃগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, নদীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, দেবী গণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হে, সরস্বতী, আমারা অসমৃদ্ধের ন্যায় রয়েছি, আমাদের সমৃদ্ধশালী করো।"
সরস্বতী দেবী জ্ঞান, সঙ্গীত, কলা এবং বিদ্যার দেবী।
সরস্বতী দেবী কিভাবে দেবী, মাতা ও নদীশ্রেষ্ঠ?
বেদে সরস্বতী সম্বন্ধে তিনটি সমোন্ধন করা হয়েছে, "দেবীতমে" "অম্বিতমে" ও "নদীতমে"। দেবী তমার অর্থ দেবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, অম্বিতমার তমার অর্থ সকল মায়েদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং নদী তমার অর্থ সকল নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এদিক থেকে তাঁর মহিমা ত্রিবিধ-তিনি দেবী, তিনি মা, তিনি নদীরূপা।
সকল দ্যোতনশীল (প্রকাশমান) বস্তুর মধ্যে ইনি শ্রেষ্ঠ, ইনি দিব্য ব্রহ্মজ্যোতিঃ স্বরূপিনী, তাই ইনি দেবীতমা, জ্ঞানরূপ পরম পীযূষদানে আমাদের মতো অবোধ, অজ্ঞান, অসহায় সন্তানকে নিত্য প্রতিপালন করেন, হাত ধরে আমাদিগকে তমসা থেকে আলোকদীপ্ত পথে যেতে শিক্ষা দেন, জননীর (মায়ের) ন্যায় আমাদের মূখ (বোকা) কন্ঠে ভাষা ফুটিয়ে তোলেন তিনিই, তাই তিনি অম্বিতমা বা মাতৃশ্রেষ্ঠা। সন্তানের প্রতি বিগলিত বাৎসল্যে (মাতৃসুলভ ভালোবাসায়)।
ইনিই পুনরায় জলময়ী এবং ইনিই স্থুল সূক্ষ্মাদি সকল নাদের উৎসভূমি রূপে নিত্য নাদময়ী তথা শৃঙ্গার করুন বীর শান্তাদি নব রসাত্মক বাক্যের ছন্দে ও অলংকারে পরম রসময়ী কাব্য কলনাদিণী, তাই এই রসতমা সরস্বতী নদীতমা বা নদীশ্রেষ্ঠ।
★☞সরস্বতী দেবীর আবির্ভাব
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী গোলোকে শ্রীকৃষ্ণের কন্ঠদেশ থেকে দেবী সরস্বতী উদ্ভূতা হয়েছিলেন। চৈতন্য ভাগবত (আদিলীলা ২/৯-১৪) তে বর্ণনা করা হয়েছে-
পূর্বে ব্রহ্মা জন্মিলেন নাভিপদ্ধ হৈতে।
তথাপিও শক্তি নাই কিছুই দেখিতে।।
তবে যবে সর্ববারে লইলা শরণ,
তবে প্রভু কৃপায় দিলেন দরশন।
তবে কৃষ্ণ কৃপায় স্ফুরিত সরস্বতী।
তবে সে জানিলা সর্ব অবতার স্থিতি।।
এক সময় শ্রীব্রহ্মা সৃষ্টিকার্যের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। শান্তভাবে ধ্যানস্থ আছেন। কী করবেন, কী করা উচিত চিন্তা করছেন। এমন সময় তাঁর শরীর থেকে এক সুন্দরী দেবীমূর্তি প্রকাশিত হয়। দেবী ব্রহ্মাজীকে বললেন, হে বিধাতা আমি আপনার থেকে প্রকাশিত হলাম। এখন দয়া করে আপনি আমার স্থান এবং কী কর্ম তা নির্দেশ করুন। ‘ব্রহ্মা বললেন “তোমার নাম সরস্বতী। তুমি অবস্থান করো সকলের জিহ্বাতে বিশেষভাবে সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের জিহ্বাতে তুমি নৃত্য করো।পৃথিবীতে তুমি একটি নদীরূপে প্রকাশিত হও।”
দেবী সরস্বতী প্রশ্ন করলেন- হে বিধাতা, আপনি বললেন, আমি সবার জিহ্বাতে অবস্থান করবো; আবার বললেন, নদীরূপে থাকবো। এর ব্যাখ্যা কী? ব্রহ্মা বললেন-সরস্বতী তুমি যখন লোকের জিহ্বাতে অবস্থান করবে, তথন লোকের জিহ্বা থেকে বাকশক্তি হবে। তাই তোমার নাম বাকদেবী। তুমি আমার মুখ থেকেই প্রকাশিত। তুমি পবিত্রবতী। জগৎ-সংসারে বহু অপবিত্র মানসিকতা সম্পন্ন জীব থাকবে, অপবিত্র মানুষের জিহ্বায় কদর্য বাক্য স্ফুরিত হবে, সেসব জিহ্বাতে তুমি অবস্থান করে সুখি হতে পারবে না।
হে সরস্বতী, তুমি সাক্ষাৎ বুদ্ধি স্বরূপিণী। তুমি বলো, কোথায় তুমি আনন্দ লাভ করবে? সরস্বতী বললেন-যে সমস্ত ব্যক্তি পরম সুন্দর পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করেন, তাদের জিহ্বায় সর্বদা পরম প্রভুর নাম কীর্তিত হবে। আমি তাঁদের পবিত্র জিহ্বায় অধিষ্ঠান করবো।
ব্রহ্মাজী ব্রহ্মসংহিতায় বর্ণনা করেছেন-সেই পরম সুন্দর ভগবান কে? তিনি বর্ণনা করেছেন,
ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ।
অনাদির্রাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্।।
“সেই পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর রূপ সচ্চিদানন্দ। তিনি অনাদির আদি এবং সর্বকারণের পরম কারণ। সেই আদি এবং সর্বকারণের পরম কারণ। সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।”
কলিসন্তরণ উপনিষদে বর্ণনা করা হয়েছে-
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
ইত ষোড়শকং নাম্নাং কলিকল্মাষ নাশনম্।
নাতো পরতর উপায় সর্ববেদেষু দৃশ্যতে।।
শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/৫/৩২) বর্ণনা করা হয়েছে-
কৃষ্ণবর্ণ তিষাকৃষ্ণং সাঙ্গোপাঙ্গো অস্ত্রপার্ষদম্।
যজ্ঞৈঃ সঙ্কীর্তন প্রায়ৈর্যজন্ত হি সুমেধসঃ।।
কলিযুগে সুমেধাসম্পন্ন মানুষেরা কৃষ্ণনাম কীর্তনের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেন।
★☞সরস্বতী দেবীর বৈভব
চতুর্বেদে সরস্বতী মাতাই গায়ত্রী, ত্রিষ্টুপ অনুষ্টাপাদি ছন্দোবৈভব। তিনিই ছয়রাগ, ছত্রিশ রাগিণী তথা ত্রিসপ্তমূর্চ্ছনায় নিত্য সঙ্গীতময়ী; সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি, (ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদাদি) সরসপ্তকরূপে ইনিই উদারা, মুদারা, তারাদি গ্রামে আরোহ ওঅবরোহক্রমে বিশ্বময় সে মহা দিব্য সঙ্গীতের অপূর্বা লহরী বিস্তার করেন; ইনিই উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত স্বর তথা হ্রস্ব, দীর্ঘ, প্লুতাদি ত্রিমাত্রা; ইনিই অ-কারাদি স্বরবর্ণ এবং ক-কারাদি ব্যঞ্জনবর্ণ। বেদে ইনিই মন্ত্রাত্মিকা।
ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের তৃতীয় সুক্তের ১০/১১/১২ ঋকের স্তুতিটি হচ্ছে-
পাবকা নঃ সরস্বতী বাজেভির বাজিনীবতী।
যজ্ঞং বষ্টু ধিয়া বসুঃ।।
চোদয়িত্রী সূনৃতানাম্ চেতন্তী সূমতীনাম্।
যজ্ঞং দধে সরস্বতী।।
মহো অর্নঃ সরস্বতী প্রচেতয়তি কেতুনা
ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি।।
সরস্বতী দ্বিবিধা বিগ্রহবতী দেবীরূপা এবং তোয়বতী নদীরূপা। দশম ঋকে তাকে "পাবকা" বলা হয়েছে অর্থাৎ তিনি শোধয়িত্রী। যিনি পাপনাশ পূর্বক মনুষ্যগণের হৃদয়কে জ্ঞানালোকে শুদ্ধ ও নিষ্কলুষ করেন, অর্থাৎ যিনি পতিত পাবনী, পাপনাশিনী।
তাকে বলা হয়েছে "বাজিনীবতী" মানে অন্নবৎ ক্রিয়াবতী, খুব সহজ কথায় অন্নদাত্রী। তিনি ধনদাত্রীও। তিনি যজ্ঞের ধাত্রীও বটে। তাই তার তত্ত্ব অনন্ত ও অসীম।
★☞নদীরূপে সরস্বতী
সরস্বতী মাতা বললেন আমি নদী রুপে প্রবাহিত হলে, ভগবানের শুদ্ধভক্ত আমার তটে বসে ভাগবত কথা কীর্তন করবে, লিপিবদ্ধ করবে। আর আমার তটে ভগবানের নাম কীর্তন হলে আমি আনন্দিত হবো। আমিও স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের নাম গান করেই আনন্দিত থাকবো।
★☞পুরাণে সরস্বতী
বেদের যজ্ঞধাত্রী সরস্বতী পুরাণে ধরা দিয়েছেন বিচিত্র লীলাময়ী রূপে। অনেকগুলো পুরাণেই আমরা সরস্বতীর সাক্ষাৎ পাই। কিন্তু বৈদিককালের সরস্বতী মৌলিক ভাবনিচয় পুরাণের বর্ণনায় কোথাও ক্ষুণ্ণ হয়নি বরং হয়েছে অধিকতর সুপ্রকাশিত। দেবী ভাগবতে (৯/৭) বলেন, দেবী সরস্বতী আদ্যা প্রকৃতির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। তিনি বোধস্বরূপিণী, সমুদয় সংশয়ছেদনকারিণী এবং সর্বসিদ্ধি প্রদায়িণী। সঙ্গীতের সন্ধান ও তাল প্রভৃতির কারণ স্বরূপিণীও তিনিই।
কীভাবে ব্রহ্মা ও সরস্বতী সমন্ধ জাগতিকতা মুক্ত?
বায়ু পুরাণে বলা হয়েছে, কল্পান্তে সমুদয় জগৎ রুদ্র বা শিব কর্তৃক ধ্বংস হলে পুনর্বার প্রজা সৃষ্টির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা ধ্যানমগ্ন হলেন। সেই অবস্থায় অবতীর্ণ হলেন দেবী সরস্বতী- মহা নাদশালিনী, বিশ্বধারিণী এই সরস্বতীকে আশ্রয় করেই ব্রহ্মার নতুন প্রজা সৃষ্টির সূচনা।
এ ঘটনার ভিতরে কেউ কেউ কুরুচির প্রকাশ দর্শন করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মা ও সরস্বতীর মিলিত চেষ্টায় নতুন প্রজা সৃষ্টির ব্যাপারের মধ্যে যৌনভাবের কোনো সমন্ধ একেবারেই নেই, এটা সম্পর্ণ তাত্ত্বিক ব্যাপার।
প্রজাপতি ব্রহ্মার মধ্যে দুটি গুনের আধিক্য রজঃ এবং সত্ত্ব। রজোগুণে কর্মশক্তি এবং সত্ত্বগুণে জ্ঞানশক্তির প্রকাশ। ব্রহ্মার সামগ্রিক সত্তা থেকে শুধু তাঁর সত্ত্ব বা জ্ঞানময় ভাবটি নিষ্কাসিত করে নিলে যা হয় সেই নিষ্কাসিত সত্তাই সরস্বতী। অর্থাৎ, ব্রহ্মার জ্ঞানশক্তির অভিব্যক্তিই হলেন সরস্বতী। জ্ঞানশক্তিকে সহচরী করেই ব্রহ্মা নতুন সমষ্টির পরিকল্পনা করেন। আমরাও তো তাই করে থাকি করে থাকি।
জাগতিক ক্ষেত্রে আপন আপন উদ্দিষ্ট বা পরিকল্পিত কার্যসম্পাদনে এবং নবনব সৃজনী প্রতিভার প্রকাশ, বিকাশে আমরাও তো আমাদের আপন আপন জ্ঞানশক্তিরই সাহচর্য নিয়ে থাকি, তাকে নৃত্যসঙ্গিনী করি। ব্রহ্মাও তাই করেছিলেন। শুধু কর্মত্মক রজোগুণের সাহায্যে ব্রহ্মার সৃষ্টিকর্ম যথাযথ প্রতিপালিত হওয়া সম্ভব নয়, চাই সত্ত্বগুণের সহায়তা, চাই জ্ঞানশক্তির আনুকূল্য।
বস্তুতঃ ব্রহ্মার নব সৃষ্টির প্রকাশে জ্ঞানই প্রধান। সরস্বতী প্রধানা-মহাপ্রকৃতি, বিশ্বজননী ব্রহ্মার ব্রহ্মাণী, তার সহধর্মিনী সহকর্মিনী। তত্ত্বের দিক থেকেই বিষয়টি বিচার করতে হবে। এরমধ্যে বিরূপ ভাবনার কোনো অবকাশ নেই। এটি আত্মজ জ্ঞানের প্রতি ব্রহ্মার স্বাভাবিক আসক্তি।
গরুড় পুরাণে সরস্বতী শক্তি অষ্টবিধ। যথাঃ শ্রদ্ধা, ঋদ্ধি, সিদ্ধি, কলা, মেধা, পুষ্টি, প্রভা, ও মতি।
★☞দেবী সরস্বতীর উপদেশ
মহর্ষি কশ্যপের এক বংশের ছিলেন তার্ক্ষ্য। সেই তার্ক্ষ্য ঋষি একদিন তপস্যাকালে দেবী সরস্বতীর সাক্ষাৎ পেলেন। শ্বেতবসনা, বীণাধারিণী, দুগ্ধবর্ণা দেবী সরস্বতী। ঋষি তাঁকে প্রণতি নিবেদন করলেন। দেবী বললেন, হে বৎস, তোমার মনে অনেক প্রশ্ন আছে বলে জানি। তুমি যদি এখন কিছু জানতে চাও, তবে বলো। তার্ক্ষ্য ঋষি জানালেন হে ভদ্রে, দয়া করে বলুন ইহলোকে মানুষের কল্যাণ কীভাবে হবে?
দেবী সরস্বতী বললেন, হে তপবোন, যে ব্যক্তির হৃদয় শুদ্ধ, শাস্ত্র নির্দেশ যে যত্ন সহকারে পালন করে, তারই যথার্থ কল্যাণ হয়। কী কর্ম করলে মানুষ এ জীবনের পর উর্ধ্বগতি বা নিম্নগতি লাভ করে? যদি কোনো ব্যক্তি অন্য সাত্ত্বিক ব্যক্তিকে ধন দান, আশ্রয় দান, চিকিৎসা দান, অন্ন দান, বস্ত্র প্রভৃতি দান করে তবে সুখময় স্বর্গীয় গ্রহলোকে উপনীত হবে। যে ব্যক্তি কাম ও ক্রোধ দ্বারা নিরন্তর মোহাচ্ছন্ন থাকে, সে ঘোরতর নরকলোকে নিপতিত হবে।
হে দেবী, কারা বৈকুণ্ঠ বা গোলোক ধামে উপনীত হতে পারবে? যাঁরা যজ্ঞাবশেষ ভোজী অর্থাৎ শ্রীহরির মহাপ্রসাদ যাঁরা ভোজন করেন, যাঁরা সত্যব্রত অর্থাৎ ভগবৎ-ভক্তি অনুশীলন করেন, যাঁরা শ্রদ্ধাবান অর্থাৎ ভগবান ও ভক্তের নির্দেশ মেনে চলতে আগ্রহান্বিত, যাঁরা নিরহংকার অর্থাৎ ভগবৎ সম্বন্ধ ছাড়া অন্য কারো সম্বন্ধে আকৃষ্ট নন, তাঁরাই শ্রীহরির সেবা করার উপযুক্ত হন। পরিণামে তাঁরা অতি পবিত্র ধাম গোলোক লাভ করেন এবং পরম সত্য স্বরূপ শ্রীকৃ্ষ্ণকে তাঁরা নিরীক্ষণ করে থাকেন।
ঋষি তার্ক্ষ্য আবার স্বরসতী দেবীকে প্রশ্ন করলেন, হে পরমাত্মারূপা প্রজ্ঞা, আপনি কে? দেবী সরস্বতী বললেন, আমি পরাপর বিদ্যারূপা দেবী। অর্থাৎ পরা বিদ্যা হচ্ছে ভগবান ও ভক্তি সম্বন্ধীয় বিদ্যা এবং অপরা বিদ্যা হচ্ছে জড়জগতের কর্মকান্ডীয় বিদ্যা। এ উভয় বিদ্যাই আমি জীবকে প্রদান করি।
হে ঋষি, যারা বহু বহু বর্ষব্যাপী সুখ ভোগের উদ্দেশ্যে উচ্চতর লোক ব্রহ্মলোক, স্বর্গলোক ইত্যাদি গ্রহে যাওয়ার জন্য কামনা করে, তাদের আমি দান ব্রত ইত্যাদির নানাবিধ পুণ্য পবিত্র কর্মে প্রবৃত্ত করি। আর যাঁরা ভগবদ্ধধামে গোলোকে বৈকুণ্ঠে যাত্রা করবার আকাঙ্ক্ষা করেন, তাঁদের আমি ভক্তি বিদ্যা দান করি।
তার্ক্ষ্য বললেন, হে দেবী সকল পন্ডিত ব্যক্তি বিশ্বস্ত মনে যাকে শ্রেয় জ্ঞান করে ইন্দ্রিয় সংযম প্রভৃতি কঠোর ব্রত অনুষ্ঠান করেন, সেই দুঃখশোক শূন্য মোক্ষ কী? সাংখ্য শাস্ত্রে যাঁকে চিরন্তন ও শ্রেষ্ঠ বলে নির্দেশ করে, সেই পরমাত্মা কে? আমি জানি না, তাই আপনি দয়া করে সেই বিষয়ে উপদেশ দিন।
দেবী সরস্বতী বললেন, হে তার্ক্ষ্য, বিচক্ষণ পন্ডিত ব্যক্তিরা শোকরহিত ও বিষয় বাসনা শূন্য হয়ে ব্রতপরায়ণ হন এবং ভক্তিযোগে যে আদি পুরুষকে প্রাপ্ত হয়ে থাকেন, তিনি হচ্ছে সেই পরম ব্রহ্ম, পরমাত্মা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। হে ঋষি, যে স্থানে ভক্তরা সেই পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের প্রীতির উদ্দেশ্যে যাবতীয় কর্ম করেন, সেই স্থান আমার আশ্রয়স্বরূপ।
★☞প্রকৃত বিদ্যার পরিচয়
দুপ্রকারের বিদ্যা রয়েছে। পরা বিদ্যা ও অপরা বিদ্যা। পরা চিন্ময় বিদ্যা দ্বারা অক্ষরব্রহ্ম ভগবানকে জানা যায়। আর অপরা বিদ্যা জীবকে ভগবদ্বিমুখ করে। যারা মায়া দ্বারা অপহৃত জ্ঞান হয়ে কৃষ্ণতর বিষয়ে ভোগবাঞ্ছা করে, তারা অপরা বিদ্যা অধিষ্ঠাত্রী অশুদ্ধা সরস্বতীর উপাসনা প্রবৃত্ত। মায়ামুক্ত জীব সরস্বতীকে কৃষ্ণের স্বরূপ শক্তির বৃত্তি সাক্ষাৎ কৃষ্ণভক্তি স্বরূপিণী রূপে দর্শন করেন।
(ভা ১/২/৪) শ্রীল সূত গোস্বামী প্রার্থনায় বলেছেন- "দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎ"। শ্রীল শুকদেব গোস্বামীও "প্রচোদিতা যেন পুরা সরস্বতী।"
ঈশো-৯: অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি...বিদ্যায়ংরতা।।
সরলার্থ: যিনি অবিদ্যায় অবস্থিত, তিনি অন্ধকারময় স্থানে প্রবেশ করেন, আর যিনি বিদ্যায় রত তিনি তা থেকে অধিকতর অন্ধকারময় স্থানে প্রবেশ করেন। বিদ্যাবৃত্তি জড়কে বিনাশ করে আর অবিদ্যা জড়কে প্রসব করে। জড়াভিভূত মানুষ জড়ের অন্ধকারে তাদের চিৎ প্রকৃতিকে আবৃত করে দেয়।
জীব অবিদ্যা বৃত্তির বশীভূত হয়ে শোক প্রাপ্ত হয় এবং ঐ ক্লেশ নিবারণের জন্য বিদ্যাকে আশ্রয় করেন। তখন নির্বিশেষ চিন্তা তাকে অধিকতর ক্লেশে পতিত করে। বিদ্যা অবিদ্যার আশ্রয় হচ্ছে মায়া। মায়া ভগবানের চিৎ শক্তির ছায়ারূপা বিকৃতিমাত্র। ছায়া তে যা যা থাকে মূলস্বরূপে তা সম্পূর্ণ ও নির্দোষভাবে থাকে।
ঐকান্তিক ভক্তগণ পূজিতা ভগবদছিদশক্তি পরাবিদ্যা বদূদেবী সরস্বতী জীবনধন শ্রীকৃষ্ণ সংকীর্তন। সুতরাং পরাবিদ্যা বধূ জীবন কৃষ্ণ সংকীর্তনৈক পিতা শ্রী গৌরানুগত্যই যথার্থ সরস্বতী পূজা।
অন্যাভিলাষিতা শুন্য, জ্ঞানকর্মাদ্যঅনাবৃতম...তাৎপর্যময়ী বাণীই তার একমাত্র কীর্তনীয় বিষয়। সম্মুখরিত কৃষ্ণকথা শ্রবণ কীর্তন মুখেই সেই পরাবিদ্যা বধূর উপাসনা হয়ে থাকেন। আত্মন্দ্রিয় তর্পন চিন্তা রহিত হয়ে ভক্ত যিনি নিজভক্তি শ্রীকৃষ্ণকে প্রকাশিত করেন সেই ভক্তবানী সুষ্ঠুভাবে শ্রবণ কীর্তন করাই যথার্থ সরস্বতী পূজা।
ভগবদ্ভক্তগণই যথার্থ সরস্বতী পূজক। কৃষ্ণন্দ্রিয় তর্পন পরায়নী কীর্তনাখ্য ভক্তি স্বরূপিনী পরাবিদ্যা বধূই সেই সর্বজনারাধ্য স্বেত সরোজবাসিনী বীণাপাণি বাগদোবী। শুদ্ধা সরস্বতী প্রাকৃত জীবেন্দ্রিয় তোষনী নয় বরং তিনি কৃষ্ণেন্দ্রীয় তোষণী। তার পূজা রহস্য একমাত্র কৃষ্ণভক্তই অবগত আছেন।
শ্রীমন্মহাপ্রভু বলেছেন,
দিগ্বিজয় করিব বিদ্যার কার্য নহে।
ঈশ্বরে ভজিলে সেই বিদ্যা সত্য কহে।।
সেই সে বিদ্যার ফল জানিহ নিশ্চয়।
কৃষ্ণপদ পাদপদ্মে যদি চিত্ত বৃত্তি রয়।।
★☞সরস্বতী পূজার বর্তমান প্রেক্ষাপট
বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে, মানুষ ধর্মের নামে নিজের ইন্দ্রিয় তৃপ্তিতে ব্যস্ত। এমনকি মানুষ মনে করছে তারা ধর্ম করছে, কিন্তু দেব-দেবীদের সামনে যে আচরণ করছে, তা এমনকি সভ্য সমাজে অপাঙক্তেয়। যুবক-যু্বতী, মধ্য বয়স্করা বলিউডের গানের তালে তালে নিজেদের ইন্দ্রিয় তোষণের চেষ্টা করছে, আর ভাবছে সে মায়ের বা দেবীর আরাধনা করছে। যে ধরনের আচরণ সে এমনকি নিজের মায়ের সম্মুখে করতে পারে না, সেই অসদাচরণ জগজ্জননী মায়ের তথাকথিত পূজার ছলে করছে।
এমনকি শোনা যায়, মায়ের পূজার জন্য যে অর্থ সংগ্রহ করনে, তা তারা নিজেদের ইন্দ্রিয় তোষণের জন্য বিভিন্ন জাগতিক (তথা যৌন উদ্দীপক) গানের আসরের আয়োজন করছে। কখনো কখনো মদ্যপানের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই যথার্থ মনোভাব ও ভাগগাম্ভীর্য নিয়ে পূজা সম্পাদন করা। সর্বতোভাবে সন্তুষ্ট করে না এমন সব গান বা কার্য থেকৈ সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা। পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে, কোন কার্য মাতা সরস্বতীকে সন্তুষ্ট করতে পারে। আমরা পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করব কোন মনোভাবে আমাদের মায়ের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা উচিত, কোন বাহ্যিক বিষয় মায়ের প্রার্থনায় গুরুত্ব বহন করে না, কোন প্রতিমায় মা অবস্থান গ্রহণ করেন।
★☞সরস্বতী পূজা কি লৌকিক প্রথা?
আমরা বেশির ভাগই ধর্ম করি, পূর্বপুরুষের ধারা অনুযায়ী অথবা সকল কর্মের ফল লাভের জন্য অথবা না বুঝে আনন্দ পাই বলে পূজার লৌকিক প্রয়াস করি। এধরনের প্রয়াসের ফলে মনের শান্তি অনুভব হয় বটে; কিন্তু তা কি আমাদের বিদ্যা লাভের প্রকৃত উদ্দেশ্যে সাধিত হয়? এ ধরণের লৌকিক প্রয়ােসই লৌকিকতা বা প্রথাগত ধর্মাচার বলে পরিগণিত হয়।
উইকিপিডিয়া-এর সংজ্ঞানুযায়ী, লৌকিকতা ও কর্তব্যবোধে আচরিত অনুভূতিবিহীন ধর্মাচরণকে Ritual বলা হয়। আমরা হয়তো বেশির ভাগই লৌকিকতার কারণেই পূজা করছি; কিন্তু কীভাবে ধর্মাচরণ করলে বা পূজা করলে লৌকিকতা মুক্ত হয়ে প্রকৃত অর্থেই বিদ্যা লাভের পথে এগিয়ে যেতে পারব, সেভাবে এগিয়ে যাওয়া উচিত।
প্রার্থনা বলতে শাস্ত্রে বলা হয়েছে-“প্রার্থনা হলো এমন একটি কার্য যার দ্বারা একজন ব্যক্তি তার মন ও চিত্তকে ভগবানে/দেবতার কাছে নির্দিষ্ট করতে পারে। প্রার্থনার মাধ্যমে আমরা ভগবানের/দেবতার কাছে আমাদের অসহায়ত্ব ও ক্ষুদ্রত্ব স্বীকার করে তাঁর চরণে সমর্পিত হই। প্রার্থনা মগ্ন হওয়ার অর্থ, পরমেশ্বর ভগবান/আরাধ্য দেবতার কথা স্মরণ করা, তাঁকে দর্শন করা, তার সঙ্গে কথা বলা অথবা তাঁর বিষয়ে চিন্তা করা।
শ্রীমদ্ভাগবতে প্রার্থনায় আমাদের যা করতে বলা হয়েছে তা হলো:
১. তাঁর মহিমা কীর্তন
২. কৃতজ্ঞতা স্বীকার
৩. হৃদয়ের আকুলতা
৪. ক্ষমা প্রার্থনা
প্রার্থনা আমাদের হৃদয় থেকে উৎসারিত হওয়া উচিত। যদি প্রার্থনা হৃদয় থেকে না আসে, তবে সেটা শুধুমাত্র মুখের কসরত ছাড়া আর কিছু হবে না। প্রাথমিক অবস্থায় হৃদয় থেকে প্রার্থনা করা কঠিন হতে পারে, তাই ভগবান/দেবতার কাছে আমাদের বিনীত হওয়ার অক্ষমতার জন্য অনুতপ্ত হয়ে বিনীত প্রার্থনা করা উচিত।
★☞আমরা কোন বিদ্যা চাইব?
ভক্তগণও সরস্বতী পূজা করেন। কিন্তু মায়াবদ্ধ ও মায়ামুক্ত জীবের মধ্যে পার্থক্য আছে বলে তাদের পূজায়ও পার্থক্য আছে। মায়াগ্রস্ত জীবের মায়িক বস্তুতে আসক্তি থাকে। যখন জীব মায়ার সেবায় প্রবৃত্ত হন, তখন তিনি কর্মী; আবার যখন মায়ার বিদ্যাবৃত্তির সেবায় রত হন, তখন তিনি জ্ঞানী। ঈশোপনিষদে (শ্লোক-৯) বলা হয়েছে-
অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহবিদ্যামুপাসতে।
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ বিদ্যায়াং রতা।।
“যারা অবিদ্যা অনুশীলন করে, তারা অজ্ঞানের ঘোর অন্ধকারময় লোকে প্রবেশ করে, যারা তথাকথিত বিদ্যা অনুশীলনে রত, তারা আরও ঘোরতর অন্ধকারময় স্থানে গতি লাভ করে।”
অর্থাৎ, অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক, তবে বিপথচালিত বা ভ্রান্ত বিদ্যা তার চেয়ে আরো ভয়ংকর। গণশিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমান সভ্যতা যথেষ্ট অগ্রগতি লাভ করেছে। কিন্তু জীবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পারমার্থিক বিদ্যা বা পর বিদ্যা। সেখান থেকে বিমুখ হয়ে জড়-জাগতিক উন্নতিতে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করায়, মানুষ পূর্বাপেক্ষা আরও অধিক অসুখী হয়ে পড়ছে। বিদ্যাবৃত্তি জড় বিষয়ে আসক্তি বৃদ্ধি করে।
জড় জগতে বন্ধনে আবদ্ধ জীবগণ অবিদ্যায় অবস্থিত। অবিদ্যার আবরণে তাদের প্রকৃত স্বরূপ আচ্ছাদিত। যারা মায়ামুক্ত, তাঁরা বিদ্যা ও অবিদ্যা উভয়ের স্বরূপ সম্যক প্রকারে অবগত আছেন। তারা নিজেদের ভগবানের দাস জ্ঞান করে ভগবানের সেবায় প্রকৃত হন। মায়াবশীভূত জীবগণ সত্ত্ব, রজ ও তমো গুণে আবদ্ধ হয়ে দেবতাদের ভজনা করেন। বিভিন্ন গুণসম্পন্ন জীবগণ তাদের নিজ নিজ রুচি অনুসারে শান্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্র বা বৈষ্ণব নামে অভিহিত হন।
তারা ভোগবাসনা চরিতার্থ করার জন্য ধন কামনায় লক্ষ্মী এবং বিদ্যালাভ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য লৌকিক প্রথা অনুসারে দেবী স্বরস্বতীর পূজা করেন। তারা যে বিষয় কামনায় পূজা করেন তা সবই নশ্বর। আমি ধনী হবো, পন্ডিত হবো, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবো, সমগ্র জগতে আমার যশ কীর্তিত হবে। এসমস্ত বাসনা সবই নশ্বর। চারবেদ, ষড় দর্শন অধ্যয়ন করেও যদি ভগবানের প্রতি অহৈতুকী ভক্তির উদয় না হয় তবে সবই বৃথা।
শাস্ত্রে বর্ণনা করা হচ্ছে- আচারহীনং ন পুনন্তি বেদা....। যে বস্তু দেহত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ত্যাগ করে সেসমস্ত বিষয় নিয়ে নিত্য আত্মার কতটুকু স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে। তাই যারা উন্নত বিচারবোধসম্পন্ন, তারা কখনো নশ্বর বিষয়ে মুগ্ধ হয়ে দুর্লভ মনুষ্য জীবনের সুযোগটুকু হেলায় হারাতে ইচ্ছা করেন না।
ঐকান্তিকী ভক্তগণ সরস্বতী দেবীকে চিৎ-শক্তিরূপে পূজা করেন। ভাগবত কীর্তনের প্রারম্ভে শ্রীল সূত গোস্বামী মঙ্গলাচরণের মধ্যে পরাবিদ্যাস্বরূপিণী সরস্বতীর প্রণাম করছেন যে, “দেবীং সরস্বতীং ব্যঅসং ততো জয়মুদীরয়েৎ”। আদিগুরু শ্রীব্রহ্মার হৃদয়ে সৃষ্টি বিষয়ক স্মৃতি প্রকাশের জন্য যে সরস্বতী দেবী ভগবানের প্রেরণায় প্রকটিত হন, তিনি শ্রীকৃষ্ণকেই উপাস্য মনে করেন।
....হরিবোল....
0 Comments