🦚 *একটি সুন্দর শিক্ষামূলক গল্প:*


বেশ কয়েক বছর আগে একটি ছোট অঞ্চলে  গিরিশ চন্দ্র নামে একজন ব্যক্তি বাস করতেন। তিনি খুব দুঃসাহসী ছিলেন।


 একদিন নিজে একাই মাছ ধরার একটি নৌকা নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিলেন।


কয়েক মাইল পথ যাওয়ার পর হঠাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরু হয়ে গেলো এবং তিনি সমুদ্রের সেই  জলোচ্ছাসের মধ্যে অচৈতন্য হয়ে পড়লেন।


 যখন তাঁর জ্ঞান ফিরল, তখন তিনি দেখতে পেলেন তিনি সমুদ্রতটে পড়ে আছেন আর তাঁর চারপাশে অপরূপ সুন্দর পরিবেশ। তিনি বুঝতে পারলেন যে তিনি কোনো একটা দ্বীপে এসে পৌঁছেছেন।


সেই সময় দূর থেকে ভেসে আসা কিছু সুরেলা ধ্বনি তাঁর কানে আসলো। কিছুক্ষণ পর তিনি দেখতে পেলেন, তাঁর সামনের পথ ধরে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন লোক বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মধুর সঙ্গীত গাইতে গাইতে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। তাঁরা ঠিক তাঁর সামনে এসে উপস্থিত হলো।


তারপর তাঁদের মধ্যে দুজন লোক বড় দুটি পাখা নিয়ে এগিয়ে এসে তাঁকে বাতাস করতে লাগলেন। অন্য আর একজন একটি বিশালাকায় বরণডালা নিয়ে এগিয়ে এসে গিরিশ বাবু কে বরণ করতে লাগলেন। বরণ শেষে আরও একজন একটি মিষ্টি ভর্তি পাত্র নিয়ে এসে তার থেকে বড় একটি রসগোল্লা তুলে নিয়ে গিরিশ বাবুর মুখে পুরে দিলেন এবং বললেন, "আপনি আজ থেকে আমাদের রাজা।"


গিরিশবাবু ওই লোক গুলোর কাছে সম্পূর্ন অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও, তাঁকে এত সুন্দর ভাবে আদর আপ্যায়ন করতে দেখে তিনি প্রথমে হতবাক হয়েছিলেন তো বটেই, কিন্তু যেই মাত্র তিনি শুনলেন যে তিনি নাকি তাদের রাজামশাই, তখন তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না, ভাবলেন হয়ত তাঁরা তাঁর সাথে মজা করছেন।  


তাই, তিনি তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনারা আমার সাথে কি মজা করছেন?"


তখন তাঁরা সবাই একসাথে বলল," না মহারাজ, আজ থেকে  আপনিই আমাদের রাজা। আসুন, এই পালকিতে উঠুন, রাজপ্রাসাদে চলুন।"


যথারীতি এর রহস্য কিছু বুঝতে না পারলেও একপ্রকার খুশি হয়েই গিরিশ বাবু পালকিতে করে রাজপ্রাসাদে গিয়ে সিংহাসনে বসলেন। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজ সভায় সকল মন্ত্রীরা এসে উপস্থিত হলেন এবং গিরিশ বাবু কে প্রণাম করে একে একে নিজের পরিচয় দিতে লাগলেন।  


*সবার শেষে প্রধান মন্ত্রী রাজামশাই গিরিশ চন্দ্রকে প্রণাম জানিয়ে নিজ পরিচয় দিয়ে বললেন,*

*_" মহারাজ, আমাদের এই রাজ্যে রাজা নির্বাচন করার একটি অতি পুরাতন প্রথা আছে। আমরা আমাদের রাজ্যে আগত অপরিচিত ব্যক্তিকে রাজা হিসেবে নির্বাচন করি। কিন্তু, তিনি কেবল মাত্র ৩৬৫ দিনের জন্যই তিনি এই রাজ্যের রাজা থাকতে পারবেন।_*

*_সেই সময়কাল অতিবাহিত হওয়ার পর ঠিক ৩৬৬ দিনের দিন রাজ্যের সকলে মিলে তাঁকে সিংহাসন থেকে টেনে নামিয়ে বেত্রাঘাত করতে করতে পাশের একটি ঘন জঙ্গলে ভরা দ্বীপে নিক্ষেপ করা হয়।_*

*_সেই দ্বীপে কোনো জলের ব্যবস্থা নেই, থাকার মত নিরাপদ কোনো আশ্রয় নেই, গাছের ফল গুলো সব বিষাক্ত যা খেলে মৃত্যু অবধারিত। এছাড়াও হিংস্র সব পশু রয়েছে সেই দ্বীপে।_*

*_এটাই আমাদের এই রাজ্যের রাজা নির্বাচনের নিয়ম। তাই, আজ থেকে শুরু করে আগামী ৩৬৫ দিন আপনি আমাদের রাজা এবং এই ৩৬৫ দিন আমরা আপনার দাস, তবে ৩৬৬ দিনের দিন আমরা আর আপনার আজ্ঞা শুনতে বাধ্য থাকবো না, সেই দিন আপনার সাথে পূর্বে বলা আমাদের রাজ্যের রীতি অনুযায়ী ব্যবহার করে রাজ সিংহাসন থেকে আপনাকে সরিয়ে ওই দ্বীপে নিক্ষেপ করা হবে।"_*


এতক্ষণ রাজা হতে পেরে গিরিশ বাবুর খুব আনন্দ হচ্ছিল, কিন্তু প্রধান মন্ত্রীর কাছে সব কিছু শোনার পর তাঁর আর চিন্তায় সেই রাত্রে ঘুম আসলো না। 


*সারা রাত্রি ধরে তিনি চিন্তা করতে থাকলেন,"এর থেকে বেরোনোর উপায় কি?!"*


অবশেষে তিনি এক উপায় খুঁজে পেলেন।


*_পরদিন রাজ সভায় তিনি প্রধানমন্ত্রীকে আদেশ দিলেন," ৩৬৫ দিন পর ৩৬৬ দিনের দিন যে দ্বীপে আমাকে নিক্ষেপ করা হবে, সেই দ্বীপ কোথায় আমাকে বলো।_*

*_যত লোক লাগে লাগুক, লোক পাঠিয়ে ওই দ্বীপ বসবাসের উপযোগী কর, ওখানে যাতে জলের অভাব না থাকে, নিরাপদ আশ্রয় তৈরি কর, জঙ্গল সাফ করিয়ে ফসল উৎপাদনের উপযোগী ক্ষেত তৈরি কর যাতে খাদ্যের অভাব না থাকে।"_*


রাজার আদেশ শিরোধার্য করে প্রধানমন্ত্রী সকল বন্দোবস্ত করলেন। ৩৬৪ দিনের মধ্যেই জঙ্গলে ভরা বসবাসের অযোগ্য ওই দ্বীপ রাজার ইচ্ছা অনুযায়ী বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠলো।  


অত: পর উপস্থিত হলো সেই দিন, অর্থাৎ ৩৬৬ তম দিন।


রাজ্যের রীতি অনুযায়ী গিরিশ বাবুকে নিক্ষেপ করা হবে ওই দ্বীপে।  কিন্তু, তাঁর আর কোনো দুশ্চিন্তা রইল না, কারণ তিনি জানেন শুধু মাত্র সিংহাসনচ্যুত  করে ওই দ্বীপ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁকে প্রজাগণের বেত্রাঘাত টুকুই সহ্য করতে হবে মাত্র।

একবার ওই দ্বীপে পৌঁছানোর পর বাকি জীবন টা তিনি অনায়াসে সুখে শান্তিতে কাটাতে পারবেন, কারণ ওই দ্বীপ তিনি বসবাসের যোগ্য করে তুলেছেন আগে থাকতেই। 


যথারীতি সব কিছু ওই রাজ্যের রীতি মেনেই  ঘটল। কিন্তু, গিরিশ বাবু একান্তই তাঁর নিজের বুদ্ধিমত্তার জন্যই বাকি জীবনটা ওই দ্বীপে শান্তিতে কাটাতে লাগলেন।


--------------------------------------------------------------------------------------------


একটু বিচার করলে আমরা সহজেই বুঝতে পারবো উপরের এই গল্প টি আমাদের এই মনুষ্য জন্মের সাথে কতটা প্রাসঙ্গিক। 


আমরা এই মায়ার জগতে জন্মলাভ করেছি ( বলা যায় পতিত হয়েছি) অল্প কিছু আয়ুকাল নিয়ে। বলা হয় কলিযুগে মানুষের গড় আয়ু মাত্র ১২০ বছর। কিন্তু, দিন দিন এই সংখ্যা কমে বর্তমানে গড় আয়ু ৭০ বছরে এসে দাঁড়িয়েছে এবং ভবিষ্যতে তা আরও কমবে। অর্থাৎ, এই পৃথিবীতে আমরা ক্ষণিকের অতিথি মাত্র। 


*তবু, এই চরম সত্যকে উপলব্ধি না করে সারাজীবন ধরে শুধু অর্থ, মান, যশ এর মত সাময়িক সুখ লাভের আশায় ছুটে বেড়াচ্ছি। অপরকে ছোট করে নিজেকে বড় দেখানোর চেষ্টা করছি। ওপরের ভালো তে নিজের অন্তরে হিংসার বিষ কে লালন পালন করে চলেছি।*


 *আবার কেউ বা অত্যধিক ধনবান হওয়ার ফলে সেই অর্থ বা ধনসম্পদকে জাগতিক সুখ -স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার পিছনে, মদ, জুয়া, অবৈধ নারীসঙ্গ করে , বিভিন্ন পাপকার্যে লিপ্ত হয়ে, নেশা করে ব্যয় করে দিচ্ছে।*


*কিন্তু, একটা বারও ভেবে দেখছে না যে, এতে যে শুধু তার অর্থ অপচয় হচ্ছে তা -ই নয়, বরং আয়ু হিসেবে বরাদ্দ জীবনের অতি মূল্যবান মাত্র কয়েকটা বছরের ( কারো ৭০ বছর, কারো ৮০ , আবার কারো বা ৩০ বা ৪০) অতি মূল্যবান প্রতিটা দিন, প্রতিটা ঘণ্টা, প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা সেকেন্ড অপচয় করে ফেলছে, যা কোটি কোটি অর্থের বিনিময়েও আর কক্ষনো ফেরত পাওয়া যাবে না।*


এই ভাবুন না, যে ঠিক এখন ঘড়ির কাঁটায় ১ মিনিট হয়ে গেলে আর কক্ষনো তা  ফিরিয়ে আনতে পারবেন কিনা।


মনুষ্য জীবন টা উপরের গল্পের গিরিশ বাবুর মাত্র ৩৬৫ দিনের জন্য পাওয়া রাজ্যের মত। 


তিনি চাইলেই, ৩৬৬ দিনের দিন কি হবে তা না বিচার বিবেচনা করে ৩৬৫ দিন মনের সুখে রাজ্য সুখ ভোগ করতে পারতেন।


 কিন্তু, তার ফলে ৩৬৬ দিনের দিন তাঁকে ওই দ্বীপে নিক্ষেপ করার পর অনাহারে, তেষ্টায় কোনো এক হিংস্র পশুর নির্মম শিকার হয়ে যন্ত্রণা বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করতে হত। 


কিন্তু,  তিনি ছিলেন বুদ্ধিমান এবং সচেতন ব্যক্তি। তাই, তিনি রাজ্যসুখ ভোগে অনর্থক সময় অপচয় না করে রাজ্য থেকে বিতাড়িত হবার পর যাতে কোনো প্রকার দুঃখ, যন্ত্রণা ভোগ করতে না হয় এবং বাকি জীবন টা যাতে সুখের ও আনন্দময় হয় তার ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছিলেন।


ঠিক তাঁর মতোই আমাদের এই মায়াজগতে বরাদ্দ মাত্র কয়েক বছরের আয়ু ফোরালেই আমাদেরকেও, গিরিশ বাবুকে যেমন বেত্রাঘাত করতে করতে সিংহাসন চ্যুত করা হয়েছিল, তেমন ভাবে গরুড় পুরাণে বর্ণিত ৪০,০০০ হাজার বিষাক্ত ছারপোকার কামড়ের সমান মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুবরণ করতে হবে।


 তার পর নিজের কর্ম অনুযায়ী যমরাজ আমাদের পাপ পুণ্যের বিচার করবেন।  

যাঁরা এই মনুষ্য জন্ম টাকে কেবল ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্যই কাজে লাগিয়ে শুধুই বিভিন্ন পাপকর্ম করে গেছে, তাদের স্থান হবে নরক, যেখানে অসীম যন্ত্রণায় যন্ত্রণাদগ্ধ হয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে  (গিরিশ বাবুর গল্পে প্রথমের ওই জঙ্গল ঘেরা বসবাসের অযোগ্য দ্বীপের মত)। 


অথচ, আমরা যদি গিরিশ বাবুর মত নিজেদের বিচার বুদ্ধি কে কাজে লাগিয়ে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন যাতে সুখ ও শান্তি ময় হয়, সেই প্রচেষ্টা করি, তাহলে সেটাই হবে আমাদের পক্ষে উত্তম।


*যদি প্রশ্ন করেন, "সেটা আমরা কিভাবে করতে পারি?!"*


তবে শুনুন ---- *_এই পৃথিবীতে কেউ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সৎ পথে চলতে চাইলেও অনেক সময় তাঁর দ্বারা নিজের অজান্তেই  অনেক পাপ হয়ে থাকে,কারণ এটা কলি যুগ। চারপাশের এত কলুষতার মাঝে  সম্পূর্ণ শুদ্ধ  জীবন যাপন করা সম্ভব হয় না সবসময়। আর এর ফল স্বরূপ প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী শাস্তি পেতে হয়।_*


এর থেকে মুক্তির উপায়  ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় অর্জুনকে বলেছেন,


*"সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ*

 *অহং তাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামী মা শুচঃ।।"*


অর্থাৎ, *_সর্বধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমার শরণ গ্রহণ কর; আমি তোমাকে সর্বপাপ হতে মুক্ত করব, তুমি শোক করো না।_*


তাই, আমাদের সকলের উচিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে নিজেদের মন, বুদ্ধি, দেহ কে সমর্পণ করা,  নিয়মিত তাঁর প্রসাদ গ্রহণ করে দেহ কে পবিত্র করা এবং সর্বোপরি ভগবান এর দিব্যনাম জপ করে হৃদয় কে শুদ্ধ করা। 


আর এভাবেই গল্পের গিরিশ বাবু যেমন করে সময় অপচয় না করে সিংহাসন চ্যুত হওয়ার পরবর্তী বাসস্থান সেই দ্বীপ টাকে আগে থেকেই সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিলেন, আর তার ফলে তিনি বাকি জীবন টা শান্তিতে কাটাতে পেরেছিলেন,  তেমন যদি আমরাও এই মহামূল্যবান মনুষ্য জন্ম টাকে হেলায় ইন্দ্রিসুখ ভোগে লিপ্ত হয়ে অপচয় না করে যদি মৃত্যু পরবর্তী নিবাস, অর্থাৎ, ভগবানের পূর্ণ আনন্দময় ধাম সেই চিৎ জগৎ অর্থাৎ ভগবৎ ধাম এ প্রবেশের জন্য নিজেদের কে যোগ্য করে তুলতে পারি, তাহলে পরম করুণাময় ভগবানের কৃপায় আমরা তাঁর চির আনন্দময় ধামে প্রবেশ করে জন্ম - মৃত্যুর যন্ত্রণাময় আবর্ত থেকে মুক্তি পেয়ে চির শান্তি লাভ করতে পারবো। 


তাই, সকল জীবের উচিত মিছে মায়ায় বদ্ধ না হয়ে কৃষ্ণ নাম জপ করা, কৃষ্ণ গুন কীর্তন করা, যা এই মহা মূল্যবান মানব জীবনের মূল উদ্দেশ্য। 

*ভগবানের দিব্যনাম জপ করুন,*


"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে*

*হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে*

Post a Comment

0 Comments