রাজনীতিবিদদের মাঝে এক মহান সাধু


বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কূটনীতির জন্য অনুপ্রেরণা

ব্রজবিহারী দাস


“আমরা বলি ভগবান আমাদের পাশে রয়েছে কিন্তু তার চেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা উচিত সেটি হলো আমরা কি ভগবানের পাশে রয়েছি?...”। জর্জ ওয়াশিংটন গণতন্ত্র হওয়া চিত “ জনগণের মাধ্যমে জনগণের এবং জনগণের জন্য । কিন্তু আমার ভয় হয় শীঘ্রই এই ধারণাটি সংশোধন করে হতে পারে “জনগণকে কেন, জনগণকে ত্যাগ কর, জনগণ থেকে দূরে থাকো।” এই বিষয়টি একজন পচিঁশ বছরের একজন ব্যক্তি আমাকে মন্দিরের একটি উৎসব থেকে ফিরে আসার সময় বলেছিল তিনি হতাশ প্রকাশ করেন যে, ভারত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক দেশ। ২০০৯ সালের এক নির্বাচনে মাত্র ৩৫-৫০% ভোট এসেছিল। সুরেশ নামে সেই ব্যক্তিটি আরো বলছিল যে, ১৫০ জন সদস্য সংসদে নির্বাচিত হয়েছিল তাদের প্রত্যেকের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন অপরাধের জন্য মামলা। “নির্বাচনের অর্থটাই হারিয়ে গেল, গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ এবং এবিষয়ে দেখভাল করার জন্য আমাদের কোনো অনুপ্রেরণা নেই।”


মহাত্মা বিদুর একজন পারমার্থিক নেতা


ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে আব্দুল কালাম মন্তব্য ব্যক্ত করেছিলেন, যিনি তৎকালীন হস্তিনাপুর রাজ্যের মন্ত্রী অকথিত বীর মহাত্মা বিদুরের মতো হতে চেয়েছিলেন। ড. কালাম বিদুরের মহিমা নিয়ে একটি কবিতাও রচনা করেছিলেন। বিদুর হস্তিনাপুরের (দিল্লি) রাজ প্রাসাদে একজন সেবকের গৃহে জন্ম নিয়েছিলেন। কুরু পরিবারের জন্য তাঁর স্বভাবজাত উদ্বিগ্নতা ও প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের জন্য হস্তিনাপুরের শাসকগণ তাকে মন্ত্রীপদে অভিষিক্ত করেন। ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন জন্মান্ধ এবং তাই নিজেকে সম্রাট হওয়ার অযোগ্য বলে মনে করেছিলেন। তবুও তিনি তাঁর ভ্রাতা পাণ্ডুর হয়ে রাজ্যের শাসন ভার গ্রহণ করেছিলেন। পাণ্ডু সে সময় তপস্যার জন্য বনে গমন করেন। বনে অবস্থান কালে হঠাৎ পাণ্ডুর আকষ্মিক মৃত্য ঘটে। ধৃতরাষ্ট্র তখন পাণ্ডব পুত্রদেরকে সিংহাসন অধিকার না করার জন্য নানা রকম প্রচেষ্টা করেন। তার ইচ্ছা ছিল তার দুষ্টমতি পুত্র দুর্যোধনই সিংহাসনে আরোহণ করবে। এর মধ্যে দুর্যোধন সদ্গুণ সম্পন্ন পাণ্ডবদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে একেরপর এক চক্রান্ত করতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র তার সেই চক্রান্তগুলি অনুমোদন করেছিলেন।

বিদুর ছিলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একজন শুদ্ধভক্ত। তিনি ভগবানের ইচ্ছাকে তার ভক্তদের তথা পাণ্ডবদের সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন। বিদুর পাণ্ডবদের প্রতি পুনঃ পুনঃ চরম অবিচার দর্শন করে ব্যতীত হতেন। দুর্যোধন যখন পাণ্ডবদের অগ্নিদাহের মাধ্যমে হত্যা করার জন্য পরিকল্পনা করছিল তখন বিদুর তাঁর রাজনৈতিক সুচতুরতার সহিত পাণ্ডবদের রক্ষা করেছিলেন। পাণ্ডবদের সেবা করার মাধ্যমে তিনি ভগবানের প্রতি ভালবাসা ব্যক্ত  করেছিলেন। বিদুর এমনকি দুর্যোধন ও তার ১৯জন ভ্রাতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও অকুতোভয় ছিলেন। সমস্ত দুষ্ট মন্ত্রী ও দুর্যোধনের দুষ্ট বন্ধুদের মাঝেও বিদুর সুচরিত্র ও সততার মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি দৃঢ়ভাবে দুর্যোধনের অসৎ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ প্রকাশ করেন এবং পুনঃ পুনঃ ধৃতরাষ্ট্রকে অভিহিত করেন যেন তিনি এই দুষ্ট ত্যাগ করেন। কৃষ্ণের শুদ্ধভক্ত পাণ্ডবের বিরুদ্ধে দুর্যোধনের দুষ্ট চক্রান্তের কারণে যে সমগ্র পরিবার ধ্বংস হতে পারে সে বিষয়ে বিদুর পুনঃ পুনঃ সতর্ক করেছিলেন।

প্রতারণামূলক এক পাশা খেলার মাধ্যমে দুর্যোধন পাণ্ডবদেরকে ১৩ বছরের জন্য বনবাসে পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তীতে পাণ্ডবরা যখন বনবাস থেকে ফিরে আসে তখন সিংহাসনের জন্য দাবী করলে দুর্যোধন তা অস্বীকার করেন। এভাবে একটি যুদ্ধের সমীপবর্তী হয়। বিদুরের রাজ্য রক্ষায় দুর্যোধনের পুনঃ পুনঃ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর কৃষ্ণ শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে পাণ্ডবদের পক্ষ হয়ে এই রক্তক্ষয়ি যুদ্ধের পরিবর্তে এক শান্তির বার্তা নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে আসেন। দুর্যোধন তখন মূর্খতার সহিত অসফলভাবে কৃষ্ণকে বন্ধী করেছিল।

অবশেষে রাজপ্রসাদ প্রস্থান করার সময় কৃষ্ণ ঘোষণা করেন যে, কৌরবদের ধ্বংস এখন অবশ্যম্ভাবী। বিদুর ঐ পরিস্থিতিতেও ধৃতরাষ্ট্রকে সদুপদেশ দিয়ে এই যুদ্ধ না করতে অনুরোধ করেছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র সর্বদা বিদুরের সঙ্গে আলোচনা করতেন কেননা তিনি ছিলেন পরিবারের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। যাইহোক দুর্বল হৃদয় ও পারমার্থিকভাবে অন্ধ হওয়ার জন্য তিনি বিদুরের উপদেশ গ্রহণ করেননি । বরং কৌশলে তাঁর অসৎ আচরণ সফল করতে দুষ্ট পুত্রকে সহযোগিতা করেছিল। রাজ্যের প্রতি তার অহৈতুকী সেবা সম্পর্কে দুর্যোধন ভুল বুঝে ছিলেন এজন্যে রাজ সভায় বিদুরকে রাজ্যের প্রতি অবহেলার জন্য অভিযুক্ত এবং অপধস্ত হয়েছিলেন। দুর্যোধন বিদুরকে বন্ধু ভেসে একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তিনি বিদুরকে এজন্যে রাজ্য পরিত্যাগ করার আদেশ দেন। রাজ্যের প্রতি বিদুরের বহু দিনের বিশ্বস্ত সেবার পুরষ্কার স্বরূপ বিদুরের প্রতি অকৃত কথা ও অপমান প্রদর্শন করা হয়েছিল।


প্রতিকূল পরিস্থিতে বিদুরের প্রতিক্রিয়া


এই ঘটনায় যদিও বিদুর আঘাত পেয়েছিল। তবুও তার ভক্তিমূলক বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তিনি এসবকিছুকে ভগবানের পরিকল্পনা হিসেবে দর্শন করেছিলেন। তিনি দুর্যোধনকে কাম শক্তির শিকার হিসেবে এবং ভগবানের মায়া শক্তির পুতুল হিসেবে দর্শন করেছিলেন। বরং তিনি বিষয়টিকে ভগবানের কৃপার সৌভাগ্য হিসেবে দর্শন করেছিল এবং এভাবে তিনি নিরবে দুর্যোধনের এই আচরণের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানান। এটি ছিল তার জন্য একটি আশির্বাদ যা তাকে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা ছাড়া কৃষ্ণের প্রতি নিবিড় ভক্তিমূলক সেবা অনুশীলন একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। শীঘ্রই তিনি কৃষ্ণ ভজনার জন্য বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে পরিভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হন ।

কৃষ্ণের প্রতি আসক্তি বিদুরকে শুধু সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার শক্তিই যোগাইনি বরং ব্যক্তিগত অবিচার সহ্য করার ক্ষমতাও প্রদান হয়েছিলেন। তার সেই তীর্থ ভ্রমণের সময় তিনি ভগবানের একজন পার্ষদ উদ্ধবের সাক্ষাৎ লাভ করেন। তিনি ব্যক্তিগত দুর্ভোগের জন্য শোক প্রকাশ না করে বরং তার কাছ থেকে কৃষ্ণকথা শ্রবণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কৃষ্ণকে জানার প্রবল আগ্রহ তাকে জীবনের চরমে বিপর্যয়ের মুখেও আনন্দিত রেখেছিল। বিদুরের এই দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করে কৃষ্ণের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থাকা যায় এবং এমনকি রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সর্বদা উৎসাহী থাকা যায়। কৃষ্ণভাবনা একনিষ্ঠভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে যে আভ্যন্তরীন শক্তি ও পারমার্থিক জ্ঞান উদ্ভাসিত হয় তার মাধ্যমে ভক্ত সর্বদাই সুখী ও শান্তি অনুভব করেন। আধুনিক যুগের অধিকাংশ রাজনীতিবিদদের ক্যারিয়ার অনৈতিক অনুশীলন ও দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ। তাদের চরিত্র বিশ্বাস যোগ্য নয় পক্ষান্তরে বিদুর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন যে, সমস্ত নেতাদেরকে ভগবৎ ভাবনাময় হওয়া উচিত।

একজন পারমার্থিক নেতা সেই বনেই হোক বা প্রাসাদেই হোক সর্বদা হৃদয়ে সেবার মনোভাব বহন করেন এবং জনগণকে ভগবদমুখী করার জন্য তার সর্বোত্তম প্রচেষ্টা করেন।

ইস্‌কন প্রতিষ্ঠাতা ও আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকে সর্বদা পারমার্থিক অনুশীলন করার পুনঃ পুনঃ আহ্বান জানান। তিনি এমনকি ভারতের সাবেক প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকেও পরামর্শ দেন যেন তিনি সংসদে ভগবানের পবিত্র নাম জপ কীর্তন করেন এবং সেই সাথে মন্ত্রীদেরকে ভগবৎ ভাবনাময় হতে সহায়তা করেন।


বৈরাগ্য বনাম সমাজের প্রতি সেবা


বিদুর কি তার বৈরাগ্যের মাধ্যমে এই শিক্ষা দিচ্ছেন যে, একজন নেতার উচিত জনগণের প্রতি তার সেবা পরিত্যাগ করে বরং বনে গমন করাই শ্রেয়? না, তা নয়। বিদুর এমনকি তীর্থ ভ্রমণের সময় ক্রমাগত সাধারণ জনগণের কৃষ্ণ বিমুখতার পরিস্থিতি নিয়ে ভেবেছিলেন। জনগণের দুর্দশার জন্য তার হৃদয় অনুকম্পায় জ্বলছিল। সেই ভ্রমণে তার সঙ্গে আরেক এক মহান ঋষি মৈত্রীয় ঋষির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে এবং তখন তিনি তার সঙ্গে দিগ্‌ভ্রান্ত জনগণের মধ্যে পারমার্থিক পুনঃর্জাগরনের পন্থা সম্পর্কে আলোচনা করেন। এভাবে একজন পারমার্থিক নেতা সেই বনেই হোক বা প্রসাদেই হোক সর্বদা হৃদয়ে সেবার মনোভাব বহন করেন এবং জনগণকে ভগবদ্বমুখী করার জন্য তার সর্বোত্তম প্রচেষ্টা করেন। কৃষ্ণভাবনায় একজন আন্তরিক ভক্তের কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন তার হৃদয়কে ভগবৎ প্রেমের মাধ্যমে কোমল করে তোলে এবং সমস্ত জীবের প্রতি অনুকম্পা সৃষ্টি করে। কারণ ভক্ত সমস্ত জীবকে তার প্রিয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দর্শন করেন। বিদুরের নিঃস্বার্থ সেবা ও অসমান্তরাল অনুকম্পা শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শিত হয় তখন তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর হস্তিপুরে প্রত্যাবর্তন করে।

সেই যুদ্ধে কৌরবদের বিনাশ ঘটেছিল এবং পাণ্ডবদেরকে কৃষ্ণের দিক-নির্দেশনায় নায্য অধিকার প্রদান করা হয়। পাণ্ডবরা এমতাবস্থায়ও ধৃতরাষ্ট্রের সেবা অব্যাহত রেখেছিল। বিদুরের রাজপ্রসাদে প্রত্যাবর্তন কোনো সম্পদের অংশিদার হওয়ার লক্ষ্যে নয় বরং অন্ধ ভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্রকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। বৃদ্ধ বয়সে যাতনা এবং শতপুত্রের মৃত্যু সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্র জাগতিক আরাম আয়েশের জীবন অব্যাহত করেছিলেন। তিনি এখন সেই ব্যক্তিদের গৃহেই বাস করছেন যাদেরকে তিনি একসময় সমগ্র জীবন ধরে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। এজন্যে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে তিরষ্কার করেছিলেন এবং সমস্ত বিষয়ে আসক্তি পরিত্যাগ করে বৈরাগ্যের জীবন অবলম্বন করার আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি তাকে ভক্তিমূলক সেবার অনুশীলন করার জন্য অনুরোধ করেন। ঐসময়ে বিদুরের বাক্যগুলো দৃশ্য অনেক কঠোর ও তীক্ষ্ণ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সেগুলো উচিত হয়েছিল। বিদুরের অনুকম্পাময় হৃদয় থেকে। তার বাক্যগুলো অনেকটা একজন সার্জনের মতো যিনি রোগীর আরোগ্য বিধানের জন্য দেহ কর্তন করেন। বিদুরের বাক্যগুলো ধৃতরাষ্ট্রের জাগতিক আসক্তি কর্তন করেছিল এবং তার পারমার্থিক দূরদর্শিতা ও দৃঢ়তা পুনঃস্থাপন করেছিল। সেই রাতেই অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র গোপনে ভগবৎ চেতনা লাভ করার জন্য রাজ প্রাসাদ থেকে প্রস্থান করেছিল এবং চরমে পারমার্থিক সর্বোচ্চ গতি প্রাপ্ত হয়েছিল । প্রথম দিকে বিদুরের বিনম্রতা ও নির্বাসন দেখে মনে হয়েছিল বিদুর তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে খুব একটা সফল হননি। কিন্তু এখন এমনকি একজনের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি প্রকৃত সফলতার উপলব্ধি প্রকাশ করেন যে, সবার সেবক হিসেবে যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের সর্বোচ্চটুকু উজার করে দেওয়া। বিদুরের আনুগত্যতা ও বিশ্বাস থেকে আমাদের বিনম্রতার শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। বিশেষত যারা নৈতিক আনুগত্যতা পরিত্যাগ করেছেন এবং উত্তম কোনো ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটেন তাদের জন্য এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য ।


বিন্রতার সঙ্গে উৎসাহের সংমিশ্রন


বিদুরের দৃষ্টান্তমূলক বৈরাগ্য ও নায্য অধিকারের সঙ্গে মিশেছিল যথার্থ বিনম্রতা। কৃষ্ণের একজন অন্তরঙ্গ পার্ষদ হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজেকে ভগবানের কৃপা গ্রহণের জন্য অত্যন্ত নিচু ও অযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। যখন তিনি দুর্যোধন কর্তৃক অপমানিত হন তখন তিনি চাইলে অবিলম্বেই দ্বারকাতে শ্রীকৃষ্ণের কাছে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু সেটি না করে তিনি সাধু ব্যক্তিদের সঙ্গ লাভের জন্য এবং তাদের কাছ থেকে কৃষ্ণ কথা শ্রবণের জন্য পবিত্র তীর্থস্থান পরিভ্রমণ শুরু করেন। তিনি হস্তিনাপুরের নোংরা পাপময় রাজনীতির মাধ্যমে কলুষিত অনুভব করেছিলেন এবং নিজেকে এ থেকে পরিশুদ্ধির জন্য সরাসরি কৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভ করার পূর্বে এ পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। একজন ভক্তের বিনম্রতা কৃষ্ণের হৃদয়কে সবচেয়ে গভীরভাবে আকর্ষণ করে । কৃষ্ণ কোন ধনী, শিক্ষিত ও সুদর্শন ব্যক্তিদের সম্পদ নয়। যারা ভক্তিশূন্য তাদের কাছে অপ্রকাশিতই রয়ে যান। পক্ষান্তরে যদি একজন ভক্ত সরল হয় এবং ভগবানের ইচ্ছার শরণাগত হয় তখন এভাবে কৃষ্ণকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। প্রথম দিকে যখন কৃষ্ণ হস্তিনাপুরে এসেছিলেন তিনি নিয়মিতই বিদুরের গৃহ পরিদর্শন করতেন। এমনকি দূর্ত দুর্যোধনের রাজকীয় আতিথেয়তা প্রত্যাখ্যান করে কৃষ্ণ বিদুরের গৃহে সাদরে গমন করেছিলেন। তিনি সেখানে বিদুরের সরল প্রেমপূর্ণ নিবেদন সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। এভাবে বিনম্রতা হলো একজন সত্যিকারের নেতার প্রকৃত পরিচয়। একজন ভক্ত সর্বদাই ভগবান ও সমস্ত জীবের প্রতি সেবা নিবেদনের মনোভাব অবলম্বন করেন এবং এই চেতনার মাধ্যমে তিনি তার পারমার্থিক ও জাগতিক দায়িত্ব কর্তব্যগুলি নির্বাহ করেন। বিদুরের এই প্রকার অক্লান্ত সেবা মনোভাব পরিশেষে সফলতার সহিত তার দুষ্টমতি ভ্রাতার চেতনার পুনঃজাগরনের ফল হিসেবে বেরিয়ে আসে।

আমাদের মহান আধুনিক নেতাদেরও সাধারণ জনগণের সেবক হিসেবে ভাবা উচিত এবং নির্বাচনের সময় তাদের সেবা করার অভিপ্রায় নিয়ে ভোট প্রার্থনা করা উচিত। ক্ষমতা লাভের পর তিনি এমনভাবে আচরণ করেন যাতে করে পরবর্তী নির্বাচনের পূর্বেও সবাই তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে পারে। এক্ষেত্রে অবাকের বিষয় নয় যে ভারতীয়রা তাদের রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করতেই ভালবাসে। বিদুরের দৃষ্টান্ত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমাদের জীবনে অনেক প্রতিবন্ধকতা আসবে তবে এরকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কৃষ্ণ স্মরণ পবিত্র মতাদর্শ ধারণ করে জীবনযাপন ও বিনম্র সেবার মাধ্যমে আমরা সর্বদা সুখী থাকতে পারি এবং জীবনকে একটি অর্থবহ উদ্দেশ্যের দিকে পরিচালিত করতে পারি।


এপ্রিল-জুন ২০১৮ ব্যাক টু গডহেড

Post a Comment

0 Comments