#জগন্নাথ_জগন্নাথ --------হরে:২ দিব্য লিলা
দেবীর বাণী কিংবা স্বপ্নযোগে সেই নির্দেশ পাওয়া যায়। নির্দেশ অনুসারে একটি বৃক্ষের সন্ধান কিংবা চারটি বৃক্ষের সন্ধান করতে হয়। চারটি বৃক্ষের সন্ধানের জন্য নির্দেশ হলে চার মূর্তির জন্য অর্থাৎ জগন্নাথের জন্য এক স্থানে, বলরামের জন্য অন্য স্থানে, সুভদ্রাদেবীর জন্য আবার অন্য স্থানে এবং সুদর্শনের জন্য অন্য স্থানে আলাদা চার বৃক্ষ আবিষ্কার করতে হয় । প্রায় বারো বছর অন্তর কিংবা আরও অধিক সময় ব্যবধানে এভাবে যতবার নবকলেবর অনুষ্ঠান হয়েছে। ততবারই দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সেই সব বৃক্ষ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে সংগ্রহ করা হয়েছে । বলা হয় এই সব বৃক্ষ যোগামায়াই প্রকাশ করে থাকেন। রাজপ্রতিনিধি, জগন্নাথের প্রধান পুরোহিত, দেউলকরণ (টাকা পয়সার হিসাবরক্ষক), বিশ্বকর্মা (সূত্রধর), সিপাহী, অন্যান্য সেবকদের সঙ্গে নিয়ে দয়িতাপতি সেবকগণ সেই বৃক্ষের অনুসন্ধান যাত্রা করেন। সেই বৃক্ষ সম্বন্ধে সূত-সংহিতা শাস্ত্রে কতক লক্ষণ বর্ণিত আছে, সেবকেরা সেই সব লক্ষণও পরীক্ষা করে দেখেন। চার বৃক্ষই নিম্ব বৃক্ষ হবে । প্রত্যেক বৃক্ষ তিন, পাঁচ কিংবা সাতটি বড়ো শাখাবিশিষ্ট হবে। বৃক্ষের স্বাদ তিক্ত না হয়ে ঈষৎ মিষ্ট হবে । সাধারণ গাছপালা থেকে বিশেষ পার্থক্য হলো, এই গাছগুলিতে কোনও পাখীর বাসা থাকবে না, কোনও পোকাও গাছের পাতা কামড়াবে না। গাছের মূলে উই ঢিপি থাকবে। অবশ্যই বিষধর সাপ বাস করবে। সেই দিব্য বৃক্ষ হয় তিনটি পর্বত, অথবা তিনটি নদী, নতুবা তিনটি পথের সংযোগ স্থলে অবস্থান করবে। আর অবশ্যই গাছের গায়ে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম-কোনও চিহ্ন থাকবে । শ্রীজগন্নাথের বৃক্ষ ঈষৎ কৃষ্ণবর্ণ, শ্রীবলরামের বৃক্ষ শ্বেতবর্ণ, শ্রীসুভদ্রাদেবীর বৃক্ষ ঈষৎ রক্তবর্ণ এবং শ্রীসুদর্শনের বৃক্ষ শ্বেত বর্ণের হবে । শ্রীজগন্নাথের বৃক্ষে শঙ্খ-চক্র চিহ্ন থাকে। শ্রীবলরামের বৃক্ষে হল ও মুষল চিহ্ন থাকে। শ্রীসুভদ্রাদেবীর বৃক্ষে শঙ্খ-চক্র চিহ্ন থাকে । শ্রীসুদর্শন বৃক্ষে চক্র চিহ্ন থাকে। প্রতি বৃক্ষের সামনে তিন দিন করে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে হয় । যজ্ঞের পর উপবাস ব্রতকারী বিদ্যাপতি বাদ্যভাণ্ডসহ সংকীর্তন রোলের মধ্যে সোনার কুঠার দিয়ে শ্রীভগবানকে স্মরণ করে বৃক্ষ ছেদন আরম্ভ করেন। তারপর দয়িতাপতি রূপার কুঠার দিয়ে দারু ছেদন করেন । তারপর সূত্রধরগণ লোহার কুঠারে দারু ছেদন করেন। তারপর অন্যান্য ব্রাহ্মণ প্রভৃতি সেবকগণ বৃক্ষ ছেদন করে ভূপাতিত করেন । বৃক্ষের শাখা প্রশাখা প্রভৃতি একটি গর্ত করে পুঁতে দেওয়া হয় । এই ডালপালা জ্বালানী বা অন্য কাজে কেউ নিতে পারবে না। বলা হয় উপযুক্ত ব্যক্তি বিনা অনধিকারী ব্যক্তি এই বৃক্ষ স্পর্শ করলে সর্প দংশনে প্রাণ হারাবে। অধিকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে সর্প শান্তভাবে সে স্থান থেকে চলে যায় । আষাঢ় মাসে নব কলেবর স্থাপন হলেও তার পূর্বে চৈত্র কিংবা বৈশাখ মাসে শুভ লগ্ন দেখে সেবকেরা বৃক্ষ অনুসন্ধানে বার হন। এই বছর ১৪২২ বঙ্গাব্দে বৈশাখ মাসে জগন্নাথের সেবকবৃন্দ মঙ্গলাদেবীর নির্দেশে যে যে স্থানে বৃক্ষ আবিষ্কার করেছিলেন, তার খবর পাওয়া গেল, জগন্নাথপুরী থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দূরে রঘুনাথপুর জেলার খোরাপেড়িয়া গ্রামে জগন্নাথ বৃক্ষ, জগৎসিংপুর জেলায় ঔরঙ্গগড় গ্রামে সুভদ্রা বৃক্ষ, কটক জেলায় ঝঙ্কর গ্রামে মা সরলাদেবী মন্দিরের পাশে বলরাম বৃক্ষ এবং ভুবনেশ্বরে বড়খঞ্চরিয়া গ্রাম সুদর্শন বৃক্ষ তাঁরা আবিষ্কার করেছেন । বৃক্ষ ছেদনের পর বৃক্ষের প্রধান গুঁড়ি নতুন বস্ত্রে ঢেকে আলাদা আলাদা চারটি গাড়িতে বাদ্য সংকীর্তন মুখে নিয়ে মন্দির অভিমুখে যাত্রা করেন। সেই শোভাযাত্রা দেখে স্থায়ী বাসিন্দারা ফল-মূল ও বিভিন্ন পূজা সম্ভার নিয়ে উপস্থিত হন । দয়িতাপতিরা সেই সব ভোগ নিবেদন করেন। গ্রামবাসী হাজারো হাজারো ভক্ত সেই দারুর সঙ্গে সঙ্গে সংকীর্তন মুখে চলতে থাকেন। আগে সুদর্শনের, তারপর বলদেবের, তারপর সুভদ্রার
শেষে জগন্নাথের দারুর বিজয় হয় । এইভাবে কয়দিন ধরে শোভাযাত্রা চলতে চলতে পুরীতে পৌঁছায় ।পুরীর গুণ্ডিচা মন্দিরের কাছে শ্রীনৃসিংহ মন্দিরের সামনে শোভাযাত্রা এসে পুরীর রাজার কাছে সংবাদ পাঠানো হলে রাজা হাতী, চামর, পাখা, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, বহু লোকজন সহ গুণ্ডিচা মন্দিরে উপস্থিত হয়ে প্রত্যেকে দারুকে প্রণতি জানিয়ে শ্রীজগন্নাথদেবের মন্দিরের উত্তর দ্বার দিয়ে কৈবল্য বৈকুণ্ঠ নামক দারুমণ্ডপে নিয়ে আসেন। কৈবল্য বৈকুণ্ঠের কাছে দক্ষিণ পাশে বিশ্বকর্মা মণ্ডপ নিৰ্মাণ করা হয়। সেখানেই যজ্ঞ ও বাদ্য সহযোগে নবকলেবর প্রকট আরম্ভ হয় । জগন্নাথের পূর্ব কলেবরের উদরে চন্দন-তুলসী দেওয়া থাকে সেই তুলসীপত্র বারো বছরের অধিককাল থাকলেও মলিন হয় না। এটি একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। চারজন ব্যক্তি চার বিগ্রহের জন্য হাত ও পা অতি সাবধানের সঙ্গে আবৃত করে চক্ষু দৃঢ়ভাবে বেঁধে গোপনে আগের মূর্তির উদর থেকে ব্রহ্মমণি নিয়ে নবকলেবরের (নতুন বিগ্রহের) উদরে অধিষ্ঠিত করেন । বলা হয়েছে, সেই সময়ে নানা রকমের দৈবী উপদ্রব ও আশঙ্কা পরিলক্ষ্যিত হয় । এই ঘটনাটি দর্শন করলে দর্শনকারীর অমঙ্গল হবে এবং মৃত্যু অনিবার্য দয়িতাগণ পূর্ব মূর্তিদেরকে শকটে করে দক্ষিণ দ্বার দিয়ে শ্রীমন্দিরের বাইরে উত্তর পাশে কৈবল্য বৈকুণ্ঠে নিয়ে আসেন । অনেকে বলেন, যারাই এভাবে পূর্ব কলেবর থেকে নতুন কলেবরে ব্রহ্মমণি স্থাপন করেন তাঁদেরও দেহত্যাগ হয় । যে ব্যক্তি দয়িতাদের আজ্ঞামালা দিয়ে দারু অন্বেষণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, কয়েক দিনের মধ্যে তাঁরও দেহত্যাগ হয় । কিন্তু এই রকম কথা যে সব সময় সত্য হয় তা নয় ।পূর্ব বিগ্রহ সমূহ সমাধিস্থানে সমাধিস্থ করা হয় । কখনও কখনও প্রিয় ভক্তের কাছে জগন্নাথদেব থাকার ইচ্ছা পোষণ করে রাজাকে কিংবা প্রধান পুরোহিতকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, আমার বিগ্রহ সমাধিস্থ না করে অমুকের কাছে প্রদান কর । যেমন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রিয় পার্ষদ শ্রীল জগদীশ পণ্ডিত পুরীধামে শ্রীমন্দিরের জগন্নাথদেবকে নদীয়ার যশোড়াতে এনে সেবা পূজা করতে থাকেন ।
(
0 Comments