বিষ্ণুর সহস্রনাম ও গৌরাবতার

গৌড়ীয় ভাষ্য ও অন্য ভাষ্যসমূহ মূল্যায়ন

---------------------------------------------


বিষ্ণুসহস্রনাম মহাভারতের দানধর্ম্মের দানধর্ম্মে ১৪৯ অধ্যায়ে বর্ণিত ভগবান বিষ্ণুর ১০০০টি নাম। গুণাতীত শ্রীহরির অনন্তরূপ, তিনি অনন্তগুণসমূহের আকর, গুণানুসারে অনন্ত নাম। শ্রীমধ্বাচার্য্য বলেছেন, বিষ্ণুসহস্রনামে উল্লেখিত প্রতিটি নামের ১০০টি করে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হয়। 

বিষ্ণুসহস্রনামের বিবিধ ভাষ্য বিদ্যমান। আদিশঙ্করাচার্য্যকৃত ভাষ্য, রামানুজী পরাশরভট্টের 'গুণদর্পণ', মধ্ববৈষ্ণব গোবিন্দাচার্য্যের 'নামচন্দ্রিকা' ভাষ্য, রাঘবেন্দ্রানের ও সত্যসন্ধ যতিরাজের ভাষ্যও আছে। 

গৌড়ীয় সম্প্রদায়ে বিষ্ণুসহস্রনামের সবচেয়ে বিখ্যাতভাষ্য হলো বলদেববিদ্যাভূষণকৃত 'নামার্থ-সুধা' নামক ভাষ্য।


সম্প্রদায়ভেদে, মতভেদে, আচার্য্য-আচার্য্যভেদে একেক নামের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ পরিদৃষ্ট হয়। মহাভারতেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের একেকটি নামের একাধিক অর্থ বলেছেন৷ অতএব, আচার্য্যগণের করা কোন অর্থই ভুল নয়, বরং তা পরিপূরক। আজকের লিখনির মাধ্যমে আমরা বিষ্ণুসহস্রনাম হতে ভগবান বিষ্ণুর ১০টি নাম নিয়ে আলোচনা করবো এবং দেখবো গৌড়ীয় আচার্য্যের ভাষ্যের সাথে অন্য সম্প্রদায়ী আচার্যগণের ভাষ্যের কতটুকু মিল-অমিল হয়!


🔹শ্রীল জীব গোস্বামীপাদ তার 'ক্রমসন্দর্ভ' ও 'সৰ্ব্বসম্বাদিনী' গ্রন্থে ব্যাখা করেছেন, বিষ্ণুসহস্র নামের ৭৫ ও ৯২ নং শ্লোকে সুবর্ণবর্ণো,হেমাঙ্গো, বরাঙ্গ,চন্দনাঙ্গদী,সন্ন্যাসকৃৎ, শম,শান্তো, নিষ্ঠা, শান্তি, পরায়ণ- এ দশটি নাম শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে নির্দেশ করে, কারণ এ দশটি নামে বর্ণিত গুণসমূহ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মধ্যে দৃশ্যমান হয়। একই সম্প্রদায়ের বলদেব বিদ্যাভূষণ প্রভু বিষ্ণুসহস্রনামে ভাষ্যে বলেছেন 'সুবর্ণবর্ণাদি' ছয়টি নাম ও 'সন্ন্যাসকৃৎ' প্রভৃতি চারটি- মোট এ দশটি নামে উল্লেখিত লক্ষণসমূহ দ্বারা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে নির্দেশ করা হয়।

গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের বাইরে কুমার(নিম্বার্ক) সম্প্রদায়ের শ্রী বংশীধর স্বামী শ্রীমদ্ভাগবতমের (১১।৫।৩২) 'কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষাকৃষ্ণ' শ্লোকের  'ভাবার্থদীপিকাপ্রকাশ' নামক ভাষ্যে কলিকালে গৌরাবাতার নির্দেশ করতে বিষ্ণুসহস্রনাম হতে 'সুবর্ণবর্ণো হেমাঙ্গো বরাঙ্গশ্রন্দনাঙ্গদী' উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন এ নাম সমূহ চৈতন্য মহাপ্রভুকে নির্দেশ করে।। 

শ্রী সম্প্রদায়ের বর্তমান জগতগুরু শ্রী রাঘবাচার্য্য মহারাজ ১০।০৪।২০১৫ ইং তারিখে কানপুরে ব্যাসাসনে বসে মহাপ্রভুর গুণকীর্তন করার সময় এ সমস্ত গুণ কিভাবে মহাপ্রভুর মধ্যে বিদ্যমান তা ব্যাখা করেছেন। 


---------------------------------------

শ্রীবলদেব বিদ্যাভূষণকৃত বিষ্ণু-সহস্রনামের

 'নামার্থ-সুধাভিধ' নামক ভাষ্য

--------------------------------------------

💠শ্লোক:

 সংন্যাসকৃচ্ছমঃ শান্তো নিষ্ঠা শান্তিঃ পরাযণম্ ॥৭৫||


নামার্থ সুধা ভাষ্য:

 অথ কৃষ্ণ চৈতন্যতাং দ্যোতয়ন্নাহ ষভিঃ । সন্ন্যাসং পরিব্রজ্যং করোতীতি সন্ন্যাসকৃত্ । শময়ত্যা- লোচযতি রহস্যং হরেরিতি শমঃ । শম আলোচনে চুরাদির্মত্ শাম্যত্যুপরমতি কৃষ্ণান্যবিষযাদিতি শান্তঃ । নিতিষ্ঠন্ত্বস্যাং হরিকীর্তনপ্রধানা ভক্তিযজ্ঞা ইতি নিষ্ঠা । "কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষা কৃষ্ণং সাক্ষোপাঙ্গাস্ত্রপার্ষদম্ । যজ্ঞৈঃ সংকীর্ত্তন প্রাযৈর্যজন্তি হি সুমেধস" ইতি স্মরণাত্ । সাম্যন্ত্যনযা ভক্তিবিরোধিনঃ কেবলাদ্বতপ্রমুখা ইতি শান্তঃ । মহাভাবান্তানাং ভাবভেদানাং পরমমযনমিতি পরাযণম্ ॥ ৭৫ ॥


ভাষ্যের বাংলানুবাদ:

এখন প্রেমাবতার শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর স্বরূপ বিশ্লেষণকারী ছয়টি নাম থেকে স্বরূপ নির্ণয় করা হচ্ছে। "সন্ন্যাসং পরিব্রজ্যং করোতীতি সন্ন্যাসকৃত্ ।"-তিনি সন্ন্যাসগ্রহণপূর্বক পরিব্রাজন করেছেন, তাই তাঁর এক নাম সন্ন্যাসকৃত। "শময়ত্যা- লোচয়তি রহস্যং হরেরিতি শমঃ।শম আলোচনে চুরাদির্মত্ শমঃ" শ্রীহরির নিগূঢ় রহস্য প্রকাশকারী তাই তিনি শমঃ। "আত্যুপরমতি কৃষ্ণান্যবিষয়াদিতি শান্তঃ ।"  - তিনি কৃষ্ণভিন্ন অন্য কিছু থেকে মনকে শান্ত করেন অথবা যাঁকে দর্শন করে যে কেউ বিষয়াদি ত্যাগ করে কৃষ্ণমুখী হন, তাই তাঁর এক নাম 'শান্ত'। "নিতিষ্ঠন্ত্বস্যাং হরিকীর্তনপ্রধানা ভক্তিযজ্ঞা ইতি নিষ্ঠা ।" - হরিকীর্তনরূপী ভক্তিযজ্ঞে নিষ্ঠাপ্রদানকারী, তাই তাঁর এক নাম 'নিষ্ঠা'। প্রমাণস্বরূপ "কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষা কৃষ্ণং সাক্ষোপাঙ্গাস্ত্রপার্ষদম্ । যজ্ঞৈঃ সংকীর্ত্তন প্রাযৈর্যজন্তি হি সুমেধস"(ভাগবত ১১।৫ ৩২) "সাম্যন্ত্যনযা ভক্তিবিরোধিনঃ কেবলাদ্বতপ্রমুখা ইতি শান্তঃ।" শান্তি — তিনি  কেবলাদ্বৈতবাদাদি ভক্তিবিরোধী মতবাদকে বিদূরিত করেছেন, তাই তাঁর এক নাম শান্তি। "মহাভাবান্তানাং ভাবভেদানাং পরমময়নমিতি পরায়ণম্ ॥" অর্থাৎ, তিনি মহাভাবাদি ভাবসমূহের পরম আশ্রয়, তাই তাঁর এক নাম 'পরায়ণ'।


💠শ্লোক:

 সুবর্ণবর্ণো হেমাঙ্গো বরাঙ্গশ্রন্দনাঙ্গদী  ॥৬২॥


নামার্থ-সুধা ভাষ্য:

সুবর্ণস্যেব বর্ণো রূপমস্যেতি সুবর্ণবর্ণঃ । "যদা পশ্যঃ পশ্যতে রুক্মবর্ণং কর্ত্তারমীশং পুরুষং ব্রহ্মযোনিমিতি" (মুণ্ডকোপনিষদ ৩/১/৩) শ্রুতেঃ । হেমবত্ স্পৃহণী - যানি বর্ণাধিষ্ঠানান্যঙ্গানি যস্য স হেমাঙ্গঃ । বরাণি সৌন্দর্য্য- বন্ত্যঙ্গানি শ্রস্যেতি বরাঙ্গঃ । চন্দনে ভক্তচিত্তাহ্লাদকে প্রঙ্গদে অস্যেতি চন্দনাঙ্গদী । সুবর্ণবর্ণাদিচতুষ্টযং কেচিত্ কৃষ্ণচৈতন্য- তাযাং যোজযন্তি । তদা সুবর্ণবর্ণশব্দেন লক্ষরণা। 


ভাষ্যের বাংলানুনাদ:

"সুবর্ণস্যেব বর্ণো রূপমস্যেতি সুবর্ণবর্ণঃ । "যদা পশ্যঃ পশ্যতে রুক্মবর্ণং কর্ত্তারমীশং পুরুষং ব্রহ্মযোনিমিতি" শ্রুতেঃ ।" অর্থাৎ,  যাঁর রূপ সুবর্ণের মতো বর্ণ বিশিষ্ট।  শ্রুতি প্রমাণ "যদা পশ্যঃ.." (মুণ্ডকোপনিষদ ৩/১/৩)- শ্রুতি বলে যে- যখন দ্রষ্টা সুবর্ণ বর্ণময় পুরুষকে দেখেন। "হেমবত্ স্পৃহণীযানি বর্ণাধিষ্ঠানান্যঙ্গানি যস্য স হেমাঙ্গঃ ।"— সকলে যেমন হেম বা স্বর্ণ স্পৃহা করে, তিনিও তেমন স্পৃহণীয় বর্ণবিশিষ্ট তাঁর অঙ্গ, তাই তাঁর নাম 'হেমাঙ্গ'। তাঁর সর্ব অঙ্গ পরম সৌন্দর্যমন্ডিত এবং শ্রেষ্ঠ, তাই তাঁকে 'বরাঙ্গ' বলা হয়। ভক্তদের চিত্তকে আনন্দপ্রদানকারী অঙ্গ তাঁর, তাই তাঁকে চন্দনাঙ্গী ডাকা হয়। এই চারটি নামের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর কিছু লক্ষণ প্রযুক্ত হয়েছে।


----------------------------------

🌼বিষ্ণুসহস্রনামের গৌড়ীয় ভাষ্য ও অন্যান্য ভাষ্য মূল্যায়ন🌼

-----------------------------------


🔺(১) সুবর্ণবর্ণ: 

এ নামের অর্থে গৌড়ীয় আচার্য্য বলদেব বিদ্যাভূষণ মুণ্ডকোপনিষদাদি শ্রুতি হতে ব্যাখা করেছেন যাঁর রূপ সুবর্ণের মতো, সেই পুরুষ সুবর্ণবর্ণো৷ 

শঙ্করাচার্য্য, পরাশরভট্ট, সত্যসন্ধযতিরাজ তীর্থ ও রাঘবেন্দ্রানকৃত প্রত্যেকেই বলদেব বিদ্যাভূষণের মতো মুণ্ডোকপনিষদ হতে একই মন্ত্র উল্লেখ করে একই অর্থ করেছেন। 

লক্ষণার্থক ন্যায় অনুসারে, শ্রী রামানুজ সম্প্রদায়ের বর্তমান জগতগুরু শ্রীরাঘবাচার্য্যজী মহারাজ ১০।০৪।২০১৫ ইং. তারিখে কানপুরে প্রবচনে স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন, শ্রীহরি 'নীলাম্বুশ্যামকোমলঙ্গম' অর্থাৎ সর্বদা শ্যামবর্ণ বিশিষ্ট, কিন্তু এ কলিকালে সাক্ষাৎ শ্রীকৃ্ষ্ণ গৌরবর্ণ(সুবর্ণ বর্ণ) ধারণপূর্বক অবতার নেন।গোপীগণ শ্রীকৃষ্ণ বিরহে রক্তিমবর্ণ(সুবর্ণ) হয়ে যেতেন ,সে সুবর্ণ রূপ স্বয়ং ধারণের জন্য তিনি কলিকালে শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু রূপে আবির্ভূত হন।

 নিম্বার্কী বংশীধর স্বামী স্বর্ণবর্ণ দ্বারা গৌরের অবতারত্ব ব্যাখা করেছেন তাঁর (ভা. ১১।৫।৩২) ভাষ্যে৷ গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণও একইভাবে উক্ত অর্থে 'সুবর্ণবর্ণ' দ্বারা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে বুঝান। 

 

গৌড়ীয়গণ 'সুবর্ণবর্ণ' নামের আরেক অর্থ করেন- 'সু+বর্ণ+বর্ণ' অর্থাৎ যিনি সু অর্থাৎ 'কৃ' ও 'ষ্ণ' এ বর্ণগুলো বর্ণন করেন অর্থাৎ কৃষ্ণ নামের মহিমা প্রচার করেন, তিনিই 'সুবর্ণবর্ণ'। 

'মধ্ব' সম্প্রদায়ের আচার্য্য গোবিন্দকৃত ভাষ্যেও তিনি বলেছেন 'যিনি সুখরূপ ক ও অ অক্ষর আদি বর্ণ (অর্থাৎ ব্যঞ্জনবর্ণ ও স্বরবর্ণসমূহ) দ্বারা বর্ণিত হয়েছে। তিনি সুবর্ণবর্ণ ও বর্ণনীয়।' 

অতএব, এ স্থলেও গৌড়ীয় ভাষ্য মধ্ব ভাষ্যের অনুরূপ অথচ আরো সুস্পষ্ট। গোবিন্দাচার্য্য যেখানে স্পষ্টভাবে কোন বর্ণসমূহের উল্লেখ করতে পারেন নি, গৌড়ীয় আচার্য্যগণ তা দ্বারা যে কৃষ্ণ নাম বুঝায় তা স্পষ্টভাবে বলেছেন৷ যথা শাস্ত্র প্রমাণ- ভাগবতের ১১।৫।৩২ শ্লোকে 'কৃষ্ণবর্ণ ত্বিষাকৃষ্ণ' শ্লোকের অর্থ হতে দেখা যায়, কলিকালে ভগবানের অবতার কৃষ্ণবর্ণম অর্থাৎ কৃ ও ষ্ণ এ বর্ণসকল বর্ণন করেন। 


অর্থাৎ লক্ষণার্থক ন্যায়ে 'স্বর্ণের ন্যায় অঙ্গকান্তি' ও 'সুখকর কৃষ্ণ নাম বর্ণকারী' অর্থ দ্বারা শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যকে বুঝায়। নিম্বার্কী বংশীধর স্বামীও ভাগবতমের উক্ত শ্লোকের 'ভাবার্থদীপিকাপ্রকাশ' ভাষ্যে 'সুবর্ণবর্ণ' শব্দ দ্বারা চৈতন্য মহাপ্রভুকে নির্দেশ করেছেন। 


🔺(২) হেমাঙ্গ-

গৌড়ীয়াচার্য্য বিদ্যাভূষণের মতে, 'সকলে যেমন হেম বা স্বর্ণ স্পৃহা করে, তিনিও তেমন স্পৃহণীয় বর্ণবিশিষ্ট তাঁর অঙ্গ, তাই তাঁর নাম 'হেমাঙ্গ'।' শাঙ্করাচার্য্য, মধ্বমতী রাঘবেন্দ্রান্ ও সত্যসন্ধ যতীরাজ তীর্থও স্বর্ণময় অঙ্গবিশিষ্ট পুরুষকে হেমাঙ্গ বলেছেন৷ অতএব, গৌড়ীয় আচার্য্যের সাথে ইনাদের ভাষ্যের পার্থক্য নেই।


শ্রীবৈষ্ণব পরাশরভট্ট ছান্দোগ্য উপনিষদের মন্ত্রের উল্লেখ করেছেন, যেখানে বর্ণিত আছে হিরণ্যবর্ণ যার মধ্যে অধিষ্ঠান করেন সেই নিত্য, দিব্য, শুদ্ধসত্ত্ব ও মঙ্গলময় ভগবৎ-অঙ্গই হেমাঙ্গ। 

শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বর্তমান জগতগুরু শ্রীরাঘবাচার্য্যজী মহারাজ ১০।০৪।২০১৫ ইং. তারিখের প্রবচনেও ব্যাখা করেছেন, 'রাধিকা যখন কৃষ্ণপ্রেমে কাতর হতেন তখন তারা রক্তিমবর্ণ ধারণ করতেন৷ শ্যামবর্ণ শ্রীকৃষ্ণ রাধিকাদি ভাব বুঝার জন্য তার রক্তিমতেজ(গৌরাঙ্গবর্ণ) নিজমধ্যে ধারণ করেন, তাই কলিকালে তিনি গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুরূপে আবির্ভূত হন। তাঁর নাম হয় গৌরহরি।'

গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ও একইভাবে মান্য করে স্বয়ং শ্রীকৃ্ষ্ণ শ্রীমতি রাধিকার ভাব ও কান্তিকে ধারণ করে অবতীর্ণ হন, তাই ভাগবত(১১।৫।৩২) প্রমাণ 'কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষাকৃষ্ণ'- কলিকালে কৃষ্ণবর্ণের ভগবান অবতীর্ণ হন কিন্তু তার জ্যোতিময় প্রকাশ অকৃষ্ণ অর্থাৎ হেমবর্ণ।  

নিম্বার্কী বংশীধরও তার ভা.১১।৫।৩২ শ্লোকে বিষ্ণুসহস্র নামের 'হেমাঙ্গ' নাম দ্বারা চৈতন্য মহাপ্রভুকে নির্দেশ করেছেন।


🔺৩.বরাঙ্গ-

গৌড়ীয়াচার্য্য বিদ্যাভূষণ প্রভু এ নামের অর্থ বলেছেন, 'তাঁর সর্ব অঙ্গ পরম সৌন্দর্যমন্ডিত এবং শ্রেষ্ঠ, তাই তাঁকে 'বরাঙ্গ' বলা হয়।' আচার্য্য শঙ্কর, মধ্বমতী রাঘবেন্দ্রান্ ও সত্যসন্ধযতিরাজ তীর্থ-ও একই অর্থ করেছেন এ নামের।


শ্রীবৈষ্ণব পরাশরভট্ট এ নাম দ্বারা দেবকীনন্দন কৃষ্ণকে বুঝিয়েছেন। মধ্বমতী রাঘবেন্দ্রান ও সত্যসন্ধযতিরাজ পুনরায় এ নামের আরেক অর্থ বলেছেন, যা দ্বারা তার রঙ্গনাথ স্বামীকে নির্দেশ করেছেন৷ অর্থাৎ, এক্ষেত্রে শ্রীবৈষ্ণব ও মধ্ববৈষ্ণবদের মতে পার্থক্য দৃশ্যত। 


শ্রী ও মধ্বগণ যেমন উক্ত নামের অর্থ দ্বারা ভগবানের ভিন্ন ভিন্ন রূপকে নির্দেশ করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে গৌড়ীয় আচার্য্য জীবগোস্বামী, বলদেব প্রভৃতি আচার্য্য ও নিম্বার্কী বংশধর স্বামী ইত্যাদিগণ উক্ত নাম দ্বারা শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুকে বুঝিয়েছেন।


🔺৪. চন্দনাঙ্গদী: 

গৌড়ীয়াচার্য্য বলদেব বিদ্যাভূষণ ব্যাখা করেছেন, 'ভক্তদের চিত্তকে আনন্দপ্রদানকারী অঙ্গ তাঁর, তাই তাঁকে চন্দনাঙ্গী ডাকা হয়। 

গৌড়ীয় ভাষ্যের মতোই এ নামের ব্যাখায় শ্রীবৈষ্ণব পরাশরভট্ট 'আহ্লাদনানি', শঙ্করাচার্য্য 'চন্দনৈরাহ্লাদনৈরঙ্গদৈঃ, মধ্ববৈষ্ণব 'রাঘবেন্দ্রান 'আহ্লাদনে ইতি চন্দনাঙ্গদী', গোবিন্দাচার্য্য 'চন্দনমাহ্লাদকম্' পদ দ্বারা প্রত্যেকেই আনন্দদানকারী অঙ্গবিশিষ্ট পুরুষকে 'চন্দনাঙ্গদী' বলেছেন৷ 

মধ্ববৈষ্ণব রাঘনেন্দ্রান ও সত্যসন্ধ আবার বালির পুত্র অঙ্গদ যার ভক্ত তাকে চন্দনাঙ্গদী বলেছেন, যা অন্যান্য আচার্য্যরা ব্যাখা করেন নি ।

জীব,বলদেবাদি গৌড়ীয়াচার্য্যগণ ও বংশীধরাদি নিম্বার্কী বৈষ্ণব(ভাবার্থদীপিকাপ্রকাশ ১১।৫।৩২) এ নাম দ্বারা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে নির্দেশ করেন। 


🔺৫.সন্ন্যাসকৃৎ: 

এ নামের ব্যাখায় পরাশরভট্ট ও শঙ্করাচার্য্য উপলব্ধ হয় তাদের মত হলো, বৈকুন্ঠপতি নারায়ণ তো নিত্যপত্নীযুক্ত, তাই তার সন্ন্যাস কেমনে সম্ভব, তাই তারা 'সন্ন্যাসকৃৎ' নামের অর্থ করেছেন যথেক্রমে ত্রিগুণছিন্নকারী ও সন্ন্যাসাশ্রমের স্রষ্টা হিসেবে।


কিন্তু মধ্ববৈষ্ণব গোবিন্দাচার্য্যজী স্পষ্টভাবে বলেছেন নানা অবতারে ভগবানের সন্ন্যাসাশ্রমের কথা উল্লেখ করেছেন, যথা - "স্বয়ং চ সনৎকুমারাদিরূপেষু সন্ন্যাসধর্মমাচরণ্ দর্শয়তি।।" অর্থাৎ,  ভগবান স্বয়ং সনৎকুমার প্রভৃতি রূপে সন্ন্যাসধর্ম আচরণ করেন দেখান।।

এখানে গোবিন্দাচার্য্যজী যেমন ব্যাখা করেছেন, ভগবান নানা অবতারে সন্ন্যাস নেন, ঠিক একইভাবে কৃষ্ণাবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জীবোদ্ধারে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তাই গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ এ নাম দ্বারা মহাপ্রভুকে নির্দেশ করেছেন। শ্রী সম্প্রদায়ের জগতগুরু রাঘবাচার্যজীও ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সন্ন্যাসলীলা বর্ণন করেন ব্যাসাসনে অধিষ্ঠীত হয়ে।


🔺৬.শম: 

বলদেব বিদ্যাভূষণের মতে, "শ্রীহরির নিগূঢ় রহস্য প্রকাশকারী তাই তিনি শমঃ। "

পরাশরের ভাষ্যতে তিনি ভয় ক্রোধাদিকে শান্ত করার উপায় বর্ণনকারীকে 'শম' বলেছেন।

শঙ্করাচার্য্য ভিন্ন অর্থ করে বলেছেন, যিনি সকল প্রাণীকে শমন করেন, তিনি শম।

সত্যসন্ধ যতিরাজ পূর্বোক্তগণের থেকেও ভিন্ন অর্থ করে বলেছেন, যিনি ব্রহ্মাদি দেবতাদের সুখ সম্বন্ধে অবগত তিনিই শম। 

গোবিন্দাচার্য্য আবার বলেছেন, আনন্দরূপময় বিধায় তিনি শম।


অর্থাৎ 'শম' শব্দের অর্থ একেক আচার্য্য একেকভাবে করেছেন। 


🔺৭.শান্ত: 

গৌড়ীয়াচার্য্য বলদেব প্রভুর মতে, 'তিনি কৃষ্ণভিন্ন অন্য কিছু থেকে মনকে শান্ত করেন অথবা যাঁকে দর্শন করে যে কেউ বিষয়াদি ত্যাগ করে কৃষ্ণমুখী হন, তাই তাঁর এক নাম 'শান্ত'।'


শঙ্করাচারর্য্য, পরাশরাদি পূর্বোক্ত সকল আচার্য্যগণ এ নামের ব্যাখায় একই অর্থ স্বীকার করেছেন। কেউ সরাসরি বলেছেন, কেউ কেউ আবার ব্যাস,পতঞ্জলী ইত্যাদির উদাহরণ টেনে একই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।


🔺৮.নিষ্ঠা: 

"নিতিষ্ঠন্ত্বস্যাং হরিকীর্তনপ্রধানা ভক্তিযজ্ঞা ইতি নিষ্ঠা ।" - হরিকীর্তনরূপী ভক্তিযজ্ঞে নিষ্ঠাপ্রদানকারী, তাই তাঁর এক নাম 'নিষ্ঠা'। 

পরাশরভট্ট বলেছেন,  "ততো ব্যুত্থিচিত্তৈঃ শুভাশ্রয়ভূতে অস্মিন্ নিষ্ঠীয়তে  ইতি নিষ্ঠা।"- তাঁকে প্রতিনিধিত্বকারী বস্তু চিত্তের শুভ আশ্রয়, তাই তার নাম নিষ্ঠা।। - অর্থাৎ গৌড়ীয়ানুরূপ অর্থ বহন করছে।


পরাশরের থেকে ভিন্ন অর্থ করে শঙ্করাচার্য্য ও গোবিন্দাচার্য্যকৃত ভাষ্যে বলেছে প্রলয়কালে যাতে সমস্ত জীব স্থিত হয় তিনিই নিষ্ঠা।

রাঘবেন্দ্রান উলটো অর্থ করে বলেছেন, জীবের মধ্যে যার স্থিতি তিনিই নিষ্ঠা।


🔺৯.শান্তি: 

গৌড়াচার্য্য বলদেব প্রভুর মতে, 'তিনি  কেবলাদ্বৈতবাদাদি ভক্তিবিরোধী মতবাদকে বিদূরিত করেছেন, তাই তাঁর এক নাম শান্তি।' শঙ্করাচার্য্য বলেছেন, সম্পূর্ণ অবিদ্যার নিবৃত্তিই শান্তি, সেই শান্তি ব্রহ্মরূপই।


পরাশরের মতে, যোগীগণ অন্যসব ভুলে গিয়ে শান্ত হয়ে যায়, তাই তাঁর নাম শান্তি।🙂 রাঘবেন্দ্রান অন্য অর্থ করে বলেছেন, উন্নতসুখের জন্য তিনি শান্তি। 


অর্থাৎ আচার্য্যভেদে উনিশ-বিশ ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বিদ্যমান। 


🔺১০. পরায়ণ: 

গৌড়াচার্য্য বলদেব প্রভুর মতে,  "মহাভাবান্তানাং ভাবভেদানাং পরমময়নমিতি পরায়ণম্ ॥" অর্থাৎ, তিনি মহাভাবাদি ভাবসমূহের পরম আশ্রয়, তাই তাঁর এক নাম 'পরায়ণ'। 

শঙ্করাচার্য্যও 'পরমুকৃষ্টময়নং স্থানং' দ্বারা বলদেব প্রভুর মতোই বলেছেন, পরম উৎকৃষ্ট স্থান তিনি, তাই পরায়ণ।

রাঘবেন্দ্রানও 'পরমং উৎকৃষ্টং অয়নং স্থানং' এবং গোবিন্দাচার্য্য 'পরং তদয়নম্' দ্বারা বলদেব বিদ্যাভূষণপাদের মতোই পরম আশ্রয় যিনি, তাকেই পরায়ণ বলেছেন।


অথচ শ্রীবৈষ্ণব পূর্বোক্ত মহান আচার্য্যদের থেকে ভিন্নার্থ করে বলেছেন, একাগ্রতা হেতু আমরা পরমাভক্তি নির্ব্যবধানে প্রাপ্ত হই এজন্য তিনি পরায়ণ নামে অভিহিত।


—-----------

অতএব, দেখা আছে, বিষ্ণুসহস্রনামে গৌড়ীয়াচার্য্যদের ব্যাখার সাথে অন্যান্য সম্প্রদায়ীগণের ব্যাখা অধিকাংশ স্থানেই একই। যে যে স্থলে আংশিক ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়, সে সব স্থানে দেখা যায় সকল আচার্য্যের অর্থই ভিন্ন ভিন্ন৷ এ সমস্ত ভিন্ন অর্থ পরম্পর বিরোধী নয়, বরং সম্পূরক। সবটাই সঠিক৷ 


কলিকালে ভগবান যেমন ছন্নাবতার নেন, ঠিক একইভাবে তাঁর পার্ষদ সকলও ছন্নাবতার নেন। পূর্ব হতে জানার উপায় নেই তার পরিচয়। তিনি/তারা যখন নানাবিধ লীলা করেন, সে লীলাসমূহ বিশ্লেষণপূর্বক বুঝা যায় তিনি কার অবতার। উদাহরণস্বরূপ শঙ্করাচার্য্য, মধ্বাচার্য্য, রামানুজ আচার্য্য- ইনারা কার অবতার তা পূর্ব হতে লোকে বুঝতে পারেন না। তাঁরা যখন আবির্ভূত হয়েছেন, তখন শাস্ত্রে বর্ণিত লক্ষণ বিচার করে বুঝায় গেলো তারা অবতার। শঙ্করাচার্য্য মায়াবাদ প্রচারক,পদ্মপুরাণে মায়াবাদ প্রচারক শিবাবতারের ভবিষ্যতবাণী আছে, তাই শঙ্করাচার্য্য আবির্ভাবের পর তার কর্মকান্ড দেখে বুঝতে পারলাম তিনি সেই শিবাবতার। মধ্বাচার্য্যের কথা আগেই ঋগবেদে ছিলো, কিন্তু তার আবির্ভাবের পূর্বে কেউ তা বুঝতে পারেন নি, মধ্বাচার্য্য যখন ঋগবেদ থেকে ব্যাখা করলেন, তখন তারা বুঝতে পারলেন মধ্বাচার্য্য একজন অবতার৷ একইভাবে গুণবিচারে রামানুজ আচার্য্য অনন্তশেষের অবতার, যদিও ব্যাসশাস্ত্রে তা বলা নেই, পূর্ব হতেও কেউ তা জানতো না কিন্তু তিনি অবতারের পরে লোকে গুণবিচারে তা বুঝতে পারলো৷ ! যে সকল মানদন্ডে শঙ্কর,রামানুজ,মধ্ব ভগবদপার্ষদ হন, ঠিক একই ভাবে শ্রীমদ্ভাগবতমাদি ব্যাস বাক্যের মানদন্ডে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং কৃষ্ণাতার এবং তা সমস্ত প্রামাণিক সম্প্রদায়ের আচার্য্যগণ দ্বারা স্বীকৃত৷ 


ভাগবতমেই বলা আছে, কলিকালে ভগবানের 'ছন্ন অবতার', তাই তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে লোকে তা বুঝতে পারে না৷ কিন্তু ভগবানের গৌরাবতারের সান্নিগ্ধ্যে যে সকল সম্প্রদায়ের আচার্য্য এসেছেন সকলেই লক্ষণার্থ বিচারে তাঁর ভগবানত্ব স্বীকার করেছেন এবং করছেন৷ আজও শ্রীজগন্নাথপুরী ধামে সচল জগন্নাথ হিসেবে ষড়ভুজ মহাপ্রভুর পূজা হয়। মহাপ্রভুর সময়কার শ্রীরঙ্গমের প্রধান পূজারী বেঙ্কট ভট্ট থেকে শুরু করে বর্তমানে রামানুজ সম্প্রদায়ের জগতগুরু শ্রীরাঘবাচার্য্যজী মহারাজ, দীক্ষাগুরু অনিরুদ্ধাচার্য্যজী প্রমুখ আচার্য্যগণ নিষ্কপটভাবে মহাপ্রভুর ভগবানত্ত্বের লক্ষণসমূহ প্রচার করেন তাদের প্রবচনে। নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের বংশীধর তাঁর 'ভাবার্থদীপিকাপ্রকাশ' নামক ভাগবতম ভাষ্যে(১১।৫।৩২) স্বয়ং ভগবানের ভগবতত্ত্বা ব্যাখা করেছেন। নিম্বার্কীগুরু শ্রীপাদ দেবকীনন্দন ঠাকুর জী তাঁর প্রবচনসমূহে প্রায়ই মহাপ্রভুর লীলাকীর্তন করেন। রামানন্দী শ্রী সম্প্রদায়ের  শ্রী রাজেন্দ্র মহারাজী তো মহাপ্রভুকে 'গোলোকবিহারী হরি', 'গৌর হরি' বলে ডাকতেই অধিক আনন্দ পান। এভাবে সকল সম্প্রদায় আচার্য্যগণই শ্রীমন্মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের চরণাশ্রয়।

Post a Comment

0 Comments