আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম - শ্রীমৎ তমালকৃষ্ণ গোস্বামী মহারাজ

আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম - শ্রীমৎ তমালকৃষ্ণ গোস্বামী মহারাজ


মা-বাবার কাছ থেকে কোনও রকমের ধর্মকথা না শুনেই আমি বড় হয়ে উঠেছিলাম। তাঁরা আমাকে যে কোনও ধরনের ধর্মাচরণে নিরুৎসাহিত করলেও, ছোট থেকেই, আমার নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে রাত্রে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাতাম, আমি যাদের ভালোবাসি, ভগবান যেন তাদের ভাল রাখেন।

বাবা-মা মোটামুটি আদর্শবাদী ছিলেন এবং আমেরিকান জীবনধারার মাপকাঠিতে তাঁদের আচার-আচরণ ছিল ভব্যতা যুক্ত। তাঁরা ধূমপান করতেন না, সুরাপান সামান্যই করতেন, আর বুদ্ধিজীবী এবং সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মে ছিল তাঁদের প্রবণতা।
তাঁরা বেশ প্রাণখোলা স্বভাবেরই মানুষ ছিলেন, তাই আমি যখন বড় হয়ে উঠতে থাকি, তখন তেমন কোনই বিধিনিষেধ তাঁরা আমার উপরে চাপাতেন না। উনিশ বছর বয়সে যখন আমি আপন খুশিতে ভাগ্যান্বেষণে বেরোলাম, তাঁরা তখন কোনই আপত্তি করেননি।

কলেজে ঢুকে বিগত যুগের বড় বড় দার্শনিক আর সাহিত্যিকদের ভাবধারার মগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। ঈশ্বরবিহীন মতাদর্শের মাঝে বড় হয়ে উঠেছিলাম বলেই, আমার এক নিষ্ঠাবান ক্যাথলিকধর্মী নীতিশাস্ত্রের অধ্যাপক মশায়ের সাথে ঈশ্বরের অস্তিত্বের যৌতিকতা নিয়ে বেশ বিতর্ক জুড়ে দিতাম। তিনি আমার সুদৃঢ় প্রতিবাদ ধ্বনি শুনে আপাত বিরক্ত হলেও, আমার ঐ ধরনের আলোচনা বেশ উপভোগ্য বলেই অন্তরালে অভিমত প্রকাশ করতেন, আর তিনি সুনিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রকৃতপক্ষে অন্তরের অন্তস্তলে আমি ঈশ্বর-অনুরাগীই বটে!
যাই হোক, আমার বিতর্কের সমাধান তাতে হয়নি। আমি আহার-বিহারে কৃচ্ছ্রতা সাধন শুরু করলাম, শুকনো শস্যদানা খেতাম, পুরো সপ্তাহ উপবাস করে আইসক্রিম খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করতাম, হঠযোগ অভ্যাস করেও তেমন কোন সুফল পাইনি। যোগচর্চায় বইগুলিতে যে সমস্ত আসনাদি ও প্রাণায়ামের বড় বড় আদর্শের কথা থাকত, সেই সমস্ত চর্চা করে কিছুই আমার লাভ হয়নি।
১৯৬৬ সালে নিউ ইয়র্কের লোয়ার ইস্ট সাইড অঞ্চলটি কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সঙ্গীতজ্ঞ, তথাকথিত অধ্যাত্মবাদী আর নিছক ভবঘুরেদের আস্তানা হয়ে উঠেছিল। আমি ছিলাম ঐ সব কিছুর মিশ্রণ। টমকিনস্ পার্ক স্কোয়্যারে বহুবিজ্ঞাপিত পারমার্থিক প্রীতি-সমাবেশ হচ্ছে শুনে একদিন অক্টোবরের বিকালে আকৃষ্ট হলাম সেখানে। সঙ্গে আমার বাঁশিটা নিয়ে গিয়েছিলাম আর সেখানে উপস্থিত অন্যান্য সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে সুর মেলাচ্ছিলাম। গভীর মনোযোগে চোখ বুজে আমরা বাজিয়ে চলেছিলাম। অকস্মাৎ সারা পার্কটিতে এক বিপুল শব্দতরঙ্গ শোনা গেল। ভক্তরা এসেছে তাদের গুরুদেবের আদেশে ঐ উৎসব সমাবেশে হরেকৃষ্ণ মন্ত্র গান গাইতে।

বাকি বিকালটা হরেকৃষ্ণ কীর্তনের সমাবেশ মেতে রইল এবং ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, যাই হোক, সেই কীর্তনে আমিও মেতে গিয়েছিলাম টানা দুটি ঘন্টা। অজানা মন্ত্র, ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারছিলাম না, তাই মাঝে মাঝে শুধু বাঁশিতে কীর্তনের সুর মেলাচ্ছিলাম, কখনও গাইছিলাম, আর ভক্তদের সাথে নেচে উঠছিলাম।
এরপরে বন্ধুদের সাথে সেকেন্ড এভিন্যুতে ছোট্ট দোকানঘরের মন্দিরে একদিন গিয়ে দেখবার ইচ্ছা হয়েছিল, কিন্তু দ্বিধাও ছিল। তবে ইতিমধ্যে নিরামিষ আহার এবং হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। বেশ ভাল লাগত।
যাই হোক, একদিন মন্দিরে যখন ঢুকলাম, যেন এক অন্য জগতে এলাম মনে হল। সুগন্ধে ভরপুর। তরুণরা জমায়েত হয়েছে। সেখানে শ্রীল প্রভুপাদ একটি উঁচু আসনে বসে রয়েছেন আর তাঁর উপস্থিতি যেন ঘরটিকে গৌরবান্বিত করে তুলছে--এমনই সেই মানুষটির ব্যক্তিত্ব! তাঁর কীর্তন শুনলাম, প্রবচন শুনলাম, তাঁকে কাছ থেকে দেখলাম। প্রসাদ পেলাম।
সেই থেকে নিয়মিত মন্দিরে যেতাম এবং সব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতাম। তবু একটা সন্দেহ আমার মনের মাঝে ঘুরে বেড়াত। প্রবচনের পরে প্রভুপাদ প্রশ্ন আহ্বান করতেন দেখে, আমি দেখলাম-- এই একটা মস্ত সুযোগ। একদিন হাত তুলে ফেললাম, এবং তিনিও সম্মতি জানালেন ঘাড় নেড়ে। দাঁড়িয়ে উঠে প্রশ্ন করেছিলাম, "কেউ যদি কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করে কিন্তু তাতে সম্পূর্ণ সাফল্য লাভ করতে না পারে--সিদ্ধিলাভ তার না হয়--তবে কি হয়? তার ভাগ্যে কি জোটে?"
তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, কৃষ্ণ আমাদের নিত্য চেতনা, তা কখনও হারিয়ে যায় না। একবার তা পুনরুজ্জীবিত হলে, সেটাই চিরন্তর সম্পদ হয়ে ব্যক্তিসত্তার মধ্যে থেকে যায়। ভগবদ্ভক্তির চর্চায় এক-শতাংশ সফল হলেও তা কখনও নষ্ট হয়ে যায় না, পরজন্মেও তা থেকে আরও এগিয়ে চলা যায়।
তাঁর এই আশ্বাসবাণীতে আমি সাহস পেলাম, ধন্যবাদ জানালাম। সন্দেহ ছিল, কৃষ্ণভাবনামৃত চর্চায় সম্পূর্ণ সফল হব কি না। এখন জানলাম, যতটুকু সফল হব, ততটুকুই চিরকালের অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে। মনে বড় আশা হল।
পরে শুনেছিলাম, শ্রীল প্রভুপাদ আমার প্রশ্নে খুশি হয়েছিলেন। তিনি তাঁর পরিচারকদের কাউকে যেন বলেছিলেন, 'দেখবে, ঐ ছেলেটি ভক্ত হবে।"
সত্যিই, একদিন শ্রীল প্রভুপাদেরই চরণপদ্মে ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম নিজেকে অজান্তে।

২০০২ সালে গৌরপূর্ণিমার প্রাক্ লগ্নে ১৬ মার্চ তারিখে এই মহান সন্ন্যাসী সহসা শ্রীধাম মায়াপুরে নিত্যলীলায় প্রবিষ্ট হন।

Post a Comment

0 Comments