দামোদর ব্রতের মহিমা গুণবতী উপাখ্যান
একবার দেবৰ্ষি নারদ স্বৰ্গের কল্পবৃক্ষ থেকে একটি দিব্য পুষ্প সংগ্ৰহ করে পরমেশ্বর শ্ৰীকৃষ্ণকে দৰ্শন করার অভিপ্ৰায়ে দ্বারকায় এলেন। শ্ৰীকৃষ্ণ দেবৰ্ষি নারদকে সাদর সম্ভাষণ পূর্বক পাদ্য, অর্ঘ প্ৰদান করে বসবার জন্য আসন প্ৰদান করলেন। আসন গ্রহণ করে নারদ সেই দিব্য পুষ্প ভগবানকে নিবেদন করলেন। ভগবান তখন ঐ পুষ্পটি তাঁর ষোল হাজার মহিষীর মধ্যে ভাগ করে দিলেন।
তাঁর অন্যতমা মহিষী সত্যভামা কৌতুহলী হয়ে ভগবানকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে প্ৰাণনাথ, আমি পূৰ্বজন্মে কি এমন দান, তপস্যা বা ব্ৰত পালন করেছিলাম যার ফলে সত্যলোকে জন্ম নিয়েও তার উর্ধ্বে উঠতে সক্ষম হয়ে আজ আপনার অর্ধাঙ্গিনী হতে পেরেছি?” এই প্রশ্নের উত্তরে ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ স্মিত হেসে সত্যভামাকে বললেন- ‘'প্রিয়ে, তুমি পূৰ্বজন্মে যা কিছু ব্ৰত অনুষ্ঠান করেছিলে তার সমস্ত কিছুই আজ আমি তোমাকে বৰ্ণনা করছি, একাগ্ৰচিত্তে শ্ৰবণ কর"।
সত্যযুগের শেষভাগে মায়াপুরীতে (হরিদ্বার) দেবশৰ্মা নামক অত্ৰিকুলজাত এক ব্ৰাহ্মণ বাস করতেন। তিনি ছিলেন সমগ্ৰ বেদশাস্ত্ৰে পারঙ্গম এক বিদ্বান, অতিথিবৎসল, অগ্নিহোত্ৰ ও সূৰ্যব্ৰত পালনে অত্যন্ত নিষ্ঠাপরায়ন। প্রতিদিন নিয়মিত সূর্য আরাধনার ফলে তিনি সাক্ষাৎ সূর্যদেবের মতো জ্যোতি লাভ করেছিলেন, ফলে তাকে দ্বিতীয় সূর্যদেবরূপে ভ্রম হতো। তাঁর ছিল একটিই মাত্ৰ সন্তান, গুণবতী নামক এক কন্যা। তাঁর সেই একমাত্ৰ কন্যা গুণবতীকে তিনি চন্দ্ৰ নামক তার এক শিষ্যের সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন। ব্ৰাহ্মণ দেবশৰ্মা, চন্দ্ৰকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করতেন আর সেই জিতেন্দ্ৰিয় চন্দ্রও দেবশৰ্মাকে পিতৃতুল্য জ্ঞান করতেন। একদিন দেবশৰ্মা ও চন্দ্ৰ উভয়ে একসঙ্গে কুশ ও সমিধ সংগ্ৰহ করার উদ্দেশ্যে হিমালয়ে গমন করলেন। সেখানে কোনো এক অঞ্চলে ইতস্তত ভ্ৰমণ করতে করতে তারা হঠাৎ এক ভয়ঙ্কর রাক্ষসের সম্মুখীন হলেন। রাক্ষসটিকে তাদের দিকে ধেয়ে আসতে দেখে তাদের সমস্ত কাঁপতে লাগল। তখন রাক্ষস এসে তাদের দুজনকেই মেরে ফেলল। তবে জীবনভর সূৰ্য আরাধনা ও অন্যান্য ধৰ্মকৰ্মাদি করার ফলে স্বয়ং ভগবান তাঁদের উপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁরা মুক্তিলাভ করেছিলেন ।
গুণবতী যখন শুনল যে তার পিতা ও পতি উভয়েই রাক্ষসের হাতে মারা গিয়েছে, তখন সে গৃহের সমস্ত দ্রব্য বিক্ৰয় করে তাঁর পিতা ও পতির পারলৌকিক ক্ৰিয়া সম্পন্ন করল। শান্তভাবে সত্য, শৌচাদি পালন পূর্বক নিজেকে বিষ্ণুর আরাধনায় সমৰ্পণ করে ঐ নগরীতেই বাস করতে লাগল। গুণবতী সারা জীবন গভীর নিষ্ঠাসহকারে বিধিপূর্বক দুটি ব্ৰত পালন করেছিল: একাদশী ব্ৰত ও কাৰ্তিক ব্ৰত। ভগবান বলেছেন, এই দুটি ব্ৰতের ফলেই যেমন পুণ্য সঞ্চয় হয়ে ধনজন প্রাপ্ত হওয়া যায় তেমনি মোক্ষও লাভ হয়। স্বয়ং ভগবান আরও উল্লেখ করেছেন যে, কাৰ্তিক মাসে সূৰ্যের তুলা রাশিতে অবস্থানকালে যে প্ৰাতঃস্নান করে, সে মহাপাপী হলেও মুক্তি লাভ করে। যে মানুষ কাৰ্তিক মাসে স্নান, জাগরণ, দীপদান ও তুলসীসেবা পালন করে সে অবশ্যই ভগবান বিষ্ণুকে লাভ করতে সক্ষম হয়। এই সময় বিষ্ণুর মন্দির মাৰ্জন বা ঝাড়ু দিয়ে, স্বস্তিক আদি নিবেদন করে যে বিষ্ণুর আরাধনা করে থাকে সে জীবন্মুক্ত স্তর লাভ করে। যে কাৰ্তিক মাসের তিনদিন মাত্ৰ এই ব্ৰত পালন করে সে দেবতাদেরও পূজনীয়। আর আজন্ম যে এই কাৰ্তিক ব্ৰতের অনুষ্ঠান করে তার তো কথাই নেই।
গুণবতীও এইভাবে প্রতি বৎসর, আজন্ম কাৰ্তিক ব্ৰত পালন করে যেতে লাগল। অবশেষে এক কাৰ্তিক ব্ৰতের সময় সে জ্বরে পীড়িত হয়ে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ল। তবুও ঐ জ্বরে পীড়িত অবস্থাতেও সে কোনো রকমে ধীরে ধীরে স্নান করার জন্য গঙ্গার তীরে উপস্থিত হলো। আর জলে নামা মাত্ৰই শীতে কাতর হয়ে কাঁপতে কাঁপতে গুণবতী সেই গঙ্গাতীরেই অচেতন হয়ে পড়ল। গুণবতী এরপর দেখল আকাশ থেকে এক সুদৃশ্য বিমান নেমে আসছে। সেই বিমান গরুড় চিহ্নিত পতাকায় সুশোভিত এবং সেই বিমানে শঙ্খ, চক্ৰ, গদা ও পদ্মধারী বিষ্ণু পাৰ্ষদগণ রয়েছেন। বিমানটি তার কাছে এলে গুণবতী এক দিব্যরূপ ধারণ করে তাতে আরোহণ করল। আর তখন তাকে চামর দোলাতে দোলাতে সম্মান জ্ঞাপন করে ভগবানের পাৰ্ষদগণ বৈকুণ্ঠে নিয়ে চললেন।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এরপর মহিষী সত্যভামাকে উদ্দেশ্য করে বললেন- ''ব্ৰহ্মা আদি দেবতাদের প্রার্থনায় আমি যখন এই পৃথিবীতে অবতরণ করলাম, তখন আমার সমস্ত পাৰ্ষদগণও আমার সঙ্গে এই পৃথিবীতে এসেছে। হে প্রিয়ে, এই যে সমস্ত যাদবগণকে দেখছ, এরা সকলেই আমার পাৰ্ষদ, যারা আমার অত্যন্ত প্রিয়। যিনি পূর্বে গুণবতীর পিতা দেবশৰ্মা ছিলেন, সেই তিনিই এখন সত্ৰাজিৎ। গুণবতীর স্বামী চন্দ্ৰ এখন অক্রুর, আর সত্যভামা তুমিই হচ্ছ সেই গুণবতী। কাৰ্তিক ব্ৰত পালন করে তুমি আমার অত্যন্ত প্ৰসন্নতা বিধান করেছিল। পূর্বজন্মে তুমি আমার মন্দিরের দ্বারে যে তুলসীবৃক্ষ রোপন করেছিলে, এখন তা এক কল্পবৃক্ষের রূপ ধারণ করেছে। পূর্বে কাৰ্তিক মাসে তুমি যে দীপদান করেছিলে, তার প্রভাবে তোমার গৃহে আজ লক্ষ্মী অচলা হয়ে আছেন। আর তুমি যা কিছু ব্ৰত আদি করেছিলে তা সকলই তুমি বিষ্ণুকে পরম পতি জ্ঞানে নিবেদন করেছিলে। তাই তুমি আজ আমার পত্নী হয়েছ। যেহেতু তুমি মৃত্যুর সময় পৰ্যন্ত কাৰ্তিকব্রত পালনে অনড় ছিলে, তাই তার প্রভাবে তোমার থেকে আমার কখনও বিচ্ছেদ হবে না। উৎস- পদ্মপুরাণ।
0 Comments