আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম ---সর্বভাবনা দাস



আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম ---সর্বভাবনা দাস




আর্মেনিয়ার মেগ্রি শহরে ১৯৭০ সালের ২৬ আগস্ট আমার জন্ম হয়েছিল। পূর্বাশ্রমে আমার নাম ছিল গাগিলস্ বওনিয়াৎযান। বাবার নাম সেরোজা বওনিয়াৎযান এবং মায়ের নাম মার্গো কাগ্রামনয়ান।
আমার জন্মের বহু আগে থেকেই আর্মেনিয়াতে কমিউনিস্ট শাসন চলছিল। ধর্ম সম্বন্ধে কোনও কথা বলা ছিল আইনত নিষিদ্ধ। বহু ধর্মপ্রচারককে সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়েছিল। রাশিয়ায় শ্রীল প্রভুপাদের পদার্পণের পর থেকেই সেখানে ইসকনের অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল। কেজিবি দল জানতে পেরেছিল যে, ইসকন ইতিমধ্যেই সমস্ত বিশ্বে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। রাশিয়াতে যেন তা না ঘটে, সেই জন্য আতঙ্কিত কেজিবি দলের চেষ্টার কোনও অন্ত ছিল না।

একদিন আমার পরিচিত একটি মেয়ে আমাকে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র সম্বন্ধে জানায়। সে বলেছিল, এই মন্ত্র জপ করলে দিব্য শক্তির অধিকারী হওয়া যায়। আমি সরল মনে তা মেনে নিয়েছিলাম। সুযোগ এবং সময় পেলেই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করতাম। সত্যিই শান্তি পেতাম। দেশের নিয়মমত, ১৮ বছর বয়স্ক যুবকদের জন্য দু’বছর অস্ত্রশিক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি দু’বছর সেই ভয়ঙ্কর অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। দু’বছর পর আমি ঘরে ফিরে আসি। ইতিমধ্যে গোপনে গোপনে ইসকনের দু’চারটা কেন্দ্র আর্মেনিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একদিন সেনিক নামে আমার এক বন্ধু আমাকে জানাল যে, সে এখন সম্পূর্ণরূপে ইসকনের ভক্ত। সেনিক আমাকে জানাল যে, ভক্তরা নাকি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। একদিন Coming back নামে একটি গ্রন্থ সে আমাকে উপহার দেয়। গ্রন্থটি পড়া মাত্রই আমি ইসকনকে আমার অন্তরের অন্তস্থলে গ্রহণ করি। সারারাত জেগে থেকে গ্রন্থটি আমি বহুবার পড়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এ এক দুর্লভ রত্ন।

কিন্তু সেনিক আমাকে বলেছিল, ভক্তরা ধূমপান করে না। এ ছিল আমার কাছে এক মস্ত বড় আঘাত। ভাবতাম, আমি ধূমপান ছাড়তে পারব না। একদিন সেনিক আমাকে একটি ক্যাসেট বাজিয়ে শোনায়। শ্রীমৎ হরিকেশ মহারাজ অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী সুরে হরেকৃষ্ণ গাইছিলেন। আমি আরও আকৃষ্ট হলাম। অবশেষে একদিন সেনিকের সঙ্গে আমি ইসকনের গোপন আস্তানায় গিয়ে পৌঁছাই।
সেদিনটি ছিল ১৯৮৪ সালের গৌরপূর্ণিমা। সেনিকের বাড়ি থেকে সাড়ে তিনশ মাইল দূরে অবস্থিত সেই মন্দিরে আমি পৌঁছেছিলাম। মন্দিরটি ছিল একটি সুউচ্চ অট্টালিকার দশতলায়। সেনিক সাঙ্কেতিকভাবে কলিং বেল টেপে। কলিং বেলের বিশেষ শব্দ শুনেই ভক্তেরা বুঝতে পারত, কার আগমন হয়েছে---কেজিবি না ভক্ত।

যাই হোক, ভেতরে গিয়ে দেখি, শত শত ভক্ত হরিনাম সংকীর্তনের মেতে উঠেছে। মহাপ্রভুর আবির্ভাব তিথিতে কেজিবির ভয় যেন দূর হয়ে গেছে। মন্দিরে পঞ্চতত্ত্বের আলেখ্য বিরাজিত ছিলেন। সেনিক সেখানে দণ্ডবৎ করল। আমিও করলাম। আমি ভক্তদের কীর্তনে যোগ দিলাম। ভক্তেরা কীর্তন বন্ধ করলেও আমি শুধুই হরেকৃষ্ণ গাইছিলাম। ভক্তরাও পূনরায় আমার নেতৃত্বে নাচ গানে মেতে উঠে।
দীর্ঘকাল কীর্তনের পর ভক্তরা আমাকে একটি ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে একটি প্রসাদের পাহাড় দেখতে পেলাম। সমস্ত ভক্তরা সেদিন উপবাস করছিল। তারা আমাকে যথেচ্ছ প্রসাদ পেতে অনুরোধ করে। আমি প্রসাদ পেতে শুরু করি। কী অপূর্ব প্রসাদ! আমার জীবনে এত সুস্বাদু পদ কখনও খাইনি। আমি শুধু খেতেই লাগলাম। পাশাপাশি ভক্তরা মিলে আমার কাছে কৃষ্ণভাবনা প্রচার করছিল। আমি প্রশ্ন করছিলাম আর খাচ্ছিলাম।

প্রসাদের পাহাড় অর্ধেক হয়ে গেল। অবশেষে আমি তাঁদের জানালাম, ‘সবই চমৎকার, তবে ধূমপান ছাড়া আমি থাকতে পারব না।’

এই কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ সেখানে একদল পুলিশ এসে হানা দেয়। তারা আমাদের সকলের নাম ঠিকানা লিখে নেয়। কীর্তন করতে নিষেধ করে তারা চলে যায়।

পুলিশের খাতায় নাম লিখিয়ে, দু’ একখানা ছবি উপহার নিয়ে আমি বাড়িতে ফিরে আসি। সেই থেকে আমি সুযোগ পেলেই মন্দিরে যেতাম। আমি নিজেও প্রচার শুরু করি। আমার সব চেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধুকে আমি মন্দিরে নিয়ে যাই। সে আর বাড়ি ফিরে আসে নি। প্রায় দুমাস পরে আমিও ইসকনের সব নিয়ম মেনে নিয়ে মন্দিরে যোগদান করি।

কিছুদিন যেতে না যেতেই কেজিবি আমাদের সকলকে দু বছরের জন্য জেলে পাঠায়। পুলিশরা তখন আমাদের প্রচণ্ড মারধর করত। তারা শুধু জানতে চাইত, আমাদের গ্রন্থগুলি কোথায় ছাপানো হচ্ছে। আমরা সকলেই তা গোপন রেখেছিলাম, ফলে পুলিশ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার শুরু করে। হাতুড়ি দিয়ে আমাদের পায়ের আঙুলগুলি ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দরজার ফাঁকে হাতের আঙ্গুলগুলি নিষ্ঠুরভাবে চেপে ধরত পুলিশ। বিদ্যুতের তারে আমাদের শক লাগানো হত নিয়মিত। একদিন একটি বর্বর পুলিশ আমার মুখের উপর একটি জ্বলন্ত হিটার চেপে ধরে। আমার একটি চোখ জ্বলে অন্ধ হয়ে যায়। মার খেতে খেতে আমাদের কোমর ভেঙে গিয়েছিল। অনেক ভক্তকে বিষ ইনজেকশন করে পাগল বানিয়ে দেওয়া হয়। মহিলা ভক্তরাও অত্যাচার থেকে রক্ষা পায়নি। দু বছর আমরা প্রায় অনাহারে ছিলাম। আমাদের প্রায় সকলেরই যক্ষ্মা হয়েছিল। আমাদের শুধু এক টুকরা করে পঁচা পাঁউরুটি দেওয়া হত। দুজন ভক্ত মারা যায়। একটি শিশুও মারা গিয়েছিল।

অবশেষে একদিন আমি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু শ্রীগুরু-গৌরাঙ্গের কৃপায় সেদিনই আমি সংবাদ পেলাম যে, রাশিয়াতে ধর্মীয় স্বাধীনতা সরকারী স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই আমাদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

শীঘ্রই আমি জেল থেকে মুক্তি পেলাম। পরে জানতে পারলাম যে, জেলে থাকাকালীন শ্রীমৎ হরিকেশ স্বামী আমাদের সকলকেই দীক্ষা দান করেছেন। আমার নাম হয় সর্বভাবনা দাস।

কয়েক বছর রাশিয়াতে প্রচার করার পর আমি মায়াপুর চলে আসি। শুদ্ধ ভক্ত হয়ে গুরু-গৌরাঙ্গের বাণী প্রচার করাই আমার জীবনের লক্ষ্য। কেননা, এ ছাড়া পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অন্ধকার।

Post a Comment

0 Comments