রাধাকুণ্ডের আবির্ভাব তিথি (বহুলাষ্টমী)



রাধাকুণ্ডের আবির্ভাব তিথি | বহুলাষ্টমী।

বৃন্দাবনের রাধাকুণ্ডে লাখো ভক্তের স্নান |





"রাধাকুণ্ডে স্নান যেই করে একবার।

রাধিকা সমান প্রেম জনমে তাহার।।"

রাধাকুণ্ড তিথিতে মধ্য রাতে স্নান করলে কৃষ্ণ তাঁকে ‘‘রাধাসম প্রেম’’ দান করেন। তাই বহুলাষ্টমী, রাধাকুণ্ডের আবির্ভাব তিথির পূণ্য তিথিতে স্নান করে পূণ্যলাভ করেন হাজার হাজার ভক্ত।


শ্রীরাধাকুণ্ডের মহিমা। শ্রীল জয়পতাকা স্বামী।


আগামিকাল রাধাকুণ্ডের আবির্ভাব তিথি। আমি তাই প্রথমে রাধাকুণ্ডের আবির্ভাব সম্পর্কে কিছু বলব। কংস একবার কৃষ্ণ এবং বলরামকে হত্যা করার জন্যে এক অসুরকে প্রেরণ করেছিলেন, অরিষ্টাসুর নামের সেই অসুরটি এক বিরাট ষাড়ের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। তিনি ছিলেন বিশাল! তার লেজ এবং শিং যেন আকাশ ছুঁয়েছে, মেঘেরাও ভাবত তার শিংগুলো যেন পর্বতশিখর, এবং সেগুলোর চারপাশে জড়ো হত। মাটিতে সে পদাঘাত করছিল এবং বৃন্দাবনবাসীদের মনে ভয় ধরিয়ে দিল সে। কয়েকজন মহিলা গর্ভবতী ছিলেন, সেই ষণ্ডাকৃতি অসুরকে দেখে তাদের গর্ভপাত হল। কিছু কিছু গাভীরও গর্ভপাত হল। তো সেই অসুরটি মাটিতে সজোড়ে পদাঘাত করেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণ ছিলেন নির্বিকার৷ কৃষ্ণ তাঁর হাত এক সখার কাধে রেখে সেই অসুরকে বললেন, "তুমি এই ব্রজবাসীদের- যারা গোপালক এবং গাভী- তাদের কেন ভয় দেখাচ্ছ? আমি এখানে! আমি তোমাকে হত্যা করব। তোমার মত অসুরদের হত্যা করাই সমীচীন। তুমি শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছ৷"

তখন সেই ষাড়রূপী অসুর তার মাথা নামিয়ে এবং শিং ভগবান কৃষ্ণের দিকে তাক করে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটে এল। কিন্তু কৃষ্ণ তার শিং ধরলেন এবং তাকে আঠারো কদম পেছনে ঠেলে দিলেন। সেই ষাড় আবার শক্তিসঞ্চার করল, তার পুরো শরীর ঘামছিল। তিনি আবার কৃষ্ণের দিকে ধেয়ে গেলেন, এবার কৃষ্ণ তার শিং পাকড়ে ধরে তাকে নিচে ছুড়ে ফেলল। কৃষ্ণ সেই অসুরের মাথা থেকে একটি শিং উৎপাটন করল, এবং তাকে এমন মার মারল, যেন ধোপা কাপড় ধুচ্ছে। কৃষ্ণ তাকে ততক্ষণ মারল যতক্ষণ পর্যন্ত সেই অসুর রক্তবমি করতে করতে প্রাণবায়ু ত্যাগ করল।

কৃষ্ণ সেই রাতে রাসনৃত্যের জন্যে প্রতীক্ষা করছিলেন। তিনি রাধারাণী এবং গোপীদের খোঁজে বের হলেন। কিন্তু তাঁরা বলল, "আমাদের কাছে আসবে না। তুমি এক অসুর হত্যা করেছ, কিন্তু সে ছিল এক ষাড়, তুমি তাই গোহত্যার দোষে দোষী! তুমি পাপী! তোমাকে বিশ্বের সকল পবিত্র স্থানে যেয়ে এই গোহত্যা, ষাড় হত্যার পাপ স্খলন করতে হবে।" কৃষ্ণ বলল, "আমাকে কোথাও যেতে হবে কেন? আমি এখানেই সকল পবিত্র তীর্থদের ডাকছি।" তিনি ভূমিতে পদাঘাত করলেন এবং শ্যামকুণ্ডের সৃষ্টি হল। তখন তিনি সকল তীর্থদের আহ্বান করলেন- "এখানে আস!", এবং পরমেশ্বর ভগবানের আদেশ পেয়ে সেখানে সকল তীর্থরা স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হলেন। সেখানে সবাই নিজেদের পরিচয় দিলেন- "আমি গঙ্গাদেবী, আমি যমুনা দেবী, আমি সরস্বতী দেবী- তাঁরা প্রয়াগে মিলিত হয়েছেন। আমি প্র‍য়াগ তীর্থ, আমি পুষ্কর তীর্থ- এভাবে একে একে তাঁরা সকলে নিজেদের পরিচয় দান করলেন। কৃষ্ণ তাঁদের জল দ্বারা সেই কুণ্ড পরিপূর্ণ করার নির্দেশ দিলেন। তখন তীর্থসমূহ সেই কুণ্ড পরিপূর্ণ করল এবং কৃষ্ণ সেখানে অবগাহন করলেন। স্নান শেষে কৃষ্ণ উঠে এসে বললেন, "আমার নিজেকে খুব পবিত্র মনে হচ্ছে!" তিনি গোপীদের এবং রাধারাণীকে বললেন, "আসো, আমার কুণ্ডে অবগাহন কর।"

রাধারানী বললেন, "না, কক্ষনো না! কোনভাবেই না! আমরা আমাদের নিজস্ব কুণ্ড খনন করব।" তিনি তাঁর সখী গোপীদের বললেন, "তোমাদের এই কৃষ্ণের কুণ্ডের চেয়েও সুন্দর এক কুণ্ড নির্মান করতে হবে। তাই এখনই একটি কুণ্ড খনন কর!" গোপীরা সকলেই রাধারাণীর শক্তি, তাঁরা খনন শুরু করলেন এবং এক ঘণ্টারও কম সময়ে তাঁরা এক বিশাল কুণ্ড খনন করলেন, কিন্তু সেটি ছিল শুষ্ক! তখন কৃষ্ণ বললেন, "তুমি আমার কুণ্ডের জল নাও এবং তোমার কুণ্ড পরিপূর্ণ কর।" কিন্তু রাধারাণী বললেন, "না, আমি আমার অনন্ত গোপীদের আহ্বান করছি এবং তাঁরা স্বর্গলোক সমূহে, মানসী গঙ্গায় যাবে এবং কোটি কোটি কুম্ভ তাঁরা ভরে নিয়ে আসবে এবং আমার কুণ্ড পরিপূর্ণ করবে। এই কুণ্ড সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিখ্যাত হবে, কেননা তাঁরা এসকল চিন্ময়বারি মানসী গঙ্গায় নিয়ে এসেছে।"

তখন মূর্তিমেয় তীর্থসমূহ শ্যামকুণ্ড থেকে উঠে এসে রাধারাণীর চরণ কমলে প্রণতি নিবেদন করলেন এবং বললেন, "প্রিয় কন্যারা, যদি আমরা আপনাদের সেবা করতে না পারি, তবে আমাদের কল্পবৃক্ষ ফলপ্রসূ হবে না। তাই, আমাদের কৃপা করুন এবং আপনার সেবা করার সুযোগ দিন। রাধারাণী প্রশ্ন করলেন, "আপনারা কী চান?" তিনি বললেন, "আপনি ভগবানের অদিশক্তি, তাই আমরা চাই আমরাও যেন আপনার কুণ্ডে প্রবেশ করতে পারি এবং আপনি সেই কুণ্ডে অবগাহন করবেন। তবেই আমরা সফল এবং সন্তুষ্ট হব।"

রাধারাণী তখন ললিতা সহ অন্যান্য সখীদের দিকে তাকালেন, এবং সখীগণ তাঁদের সন্মতি জ্ঞাপন করলেন। তখন রাধারাণী বললেন, "হ্যাঁ, আপনারা প্রবেশ করতে পারেন।" একথা শেষ হতে না হতেই তাঁরা শ্যামকুণ্ড এবং রাধাকুণ্ডের মধ্যবর্তী ভূমি ভেঙে রাধাকুণ্ডের দিকে ধাবিত হল। তখন কৃষ্ণ বললেন, "আমিও রাধাকুণ্ডে অবগাহন করব। রাধারাণী আমার কতই না প্রিয়! তাঁর কুণ্ডও আমার অতীব প্রিয়! যে এই কুণ্ডে একবারের জন্যে হলেও অবগাহন করবেন, তিনি আমার প্রতি রাধারাণীর যে প্রেম, সেটি লাভ করবেন।"

আগামিকাল রাধাকুণ্ডের আবির্ভাব তিথি, এবং এই স্থান মহাপবিত্র। উপদেশামৃতে ঘোষণা করা হয়েছে যে সকল পবিত্র স্থানের মধ্যে এটিই সর্বোত্তম। তাই নবদ্বীপ ধামেও, ঋতুদ্বীপে রাধাকুণ্ড রয়েছে। অন্তর্দ্বীপে ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রভুপাদের কৃপাপ্রভাবে রাধাকুণ্ড এখানে আবির্ভূত হয়েছেন। তাই আমাদের ঋতুদ্বীপ অথবা চৈতন্যমঠের রাধাকুণ্ড থেকে সামান্য জল নিয়ে মস্তকে স্থাপন করা উচিৎ।

আমাদের তাই স্মরণ করা উচিৎ যে রাধাকুণ্ড ভগবান কৃষ্ণ এবং রাধারাণীর কতটা প্রিয় এবং রাধারাণী কীভাবে এই কুণ্ডে কৃষ্ণের সেবা করতেন। তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন এখানে ভ্রমণ করেছেন, তিনি আনন্দে বিহ্বল ছিলেন, তিনি রাধাকুণ্ডের তীরে নৃত্য করতে শুরু করেছিলেন। তিনি রাধাকুণ্ডের তীর হতে সামান্য কাদা নিয়ে তিলক রূপে ধারণ করেছিলেন। গৌরাঙ্গ! গৌরাঙ্গ! গৌরাঙ্গ! গৌরাঙ্গ! গৌরাঙ্গ!

এটিই রাধাকুণ্ডের আবির্ভাবের লীলা। শ্রীল প্রভুপাদ উল্লেখ করেছেন যে ১৯৩৫ সালের দিকে যখন তাঁর গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদ রাধাকুণ্ডে অবস্থান করছেন, শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর গুরুদেবকে দর্শন করতে গিয়েছিলেন। সেসময় তিনি প্রভুপাদকে গ্রন্থ মুদ্রন করার গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি প্রভুপাদকে বলেছিলেন, মন্দির নির্মান করতে এবং গ্রন্থপ্রকাশ করতে। তিনি বলেছিলেন, মন্দির নির্মানের চেয়েও গ্রন্থপ্রকাশ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীল প্রভুপাদ তাই বলেছেন, এই দিকনির্দেশনাগুলো তাঁর মনে বহুবছর ধরে অবস্থান করেছে। আমরা তাই দেখেছি যে শ্রীল প্রভুপাদ ১০৮টি মন্দির প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপর অনেক গ্রন্থও রচনা করেছেন।
শ্রীল জয়পতাকা স্বামী গুরুমহারাজ,
২১-১০-২০১৯, শ্রীধাম মায়াপুর।

Post a Comment

0 Comments