বৈকুন্ঠের দ্বারপাল -কে?

বৈকুন্ঠের দ্বারপাল জয় বিজয়
একবার সনক প্রবৃত্তি জনকয়েক মুনিঋষি গেলেন বৈকুন্ঠধাম এ ভগবান বিষ্ণুর চরণ দর্শন করতে। প্রসাদে ঢুকতে গেলে সাতটা দার পেরোতে হবে। ঋষিরা ছয়টা দ্বার নির্বিবাদে পেরিয়ে এলেন। যতই দেখতে দেখতে এগিয়ে আসেন ততই ভরে ওঠে মন। চারদিকে গন্ধর্বরা মধুর সুরে গান করছে, নিল নিল সরবরে হাঁসেরা খেলা করে বেড়াচ্ছে।
কতনা মিষ্টি ফুল। তার সুবাসে বৈকুন্ঠের বাতাস যেন ভরপুর। ঋষিরা এবার এলেন সপ্তম দ্বারে। দেখলেন দ্বারের দুপাশে দাঁড়িয়ে দুজন। এতগুলো দ্বার পেরিয়ে এলেন, তারা -কেউ তাঁদের কোন কথা জিজ্ঞেস করেনি, আর তাদেরও কাউকে কোনো কথা বলতে হয়নি। এখানেও সেইভাবেই তারা যেই ঢুকতে গেলেন, বাধা দিল দুই রক্ষী, জয় আর বিজয়। কেমন করে চিনবে তাঁদের জয়-বিজয়?
তারা দেখল ওদের পরনে নেই কোনো পোশাক, অল্প বয়স। তাঁরা দাঁড়িয়ে দ্বারে, অথচ কোন জিজ্ঞাসাবাদ নেই। এতো উদ্ধত্য যে তাদের উপেক্ষা করে সোজা কিনা ঢুকে যাচ্ছে ভগবানের ঘরে!
-কে হে তোমরা? এখানে কি মনে করে?
থমকে দাঁড়ালেন ঋষিরা। বললেন- আমরা এসেছি ভগবানের চরণ দর্শন করতে।

লাল লাল চোখ ভাটার মত ঘুরিয়ে যেন ভেংচি কেটে উঠল দ্বারীরা- এসেছি ভগবানের চরণ দর্শন করতে! বলি, ডেঁপো ছোকরার দল এ কি গাছের ফল যে, টুপ করে গাছ থেকে পড়ল, আর হাতের মুঠোয় ভরে ফেলেল?
দ্বাররক্ষীর মুখ থেকে, বিশেষ করে বৈকুণ্ঠধামের মত এমন পবিত্র জায়গায় স্বয়ং বৈকুণ্ঠনাথের দ্বারীর মুখে এমন অশোভন, অপবিত্র কথা যে বেরোতে পারে, ঋষিরা তা ভাবতেও পারিনি।
যেমন অবাক হলেন, তেমনি খুণ্নও হলেন। তবুও ওই তাচ্ছিল্য হজম করে শান্ত কণ্ঠে বললেন- এসব তোমরা কি কথা বলছ, দ্বারী! একথা কি কোন বিষ্ণু ভক্তের মুখে মানায়?
জয় আর বিজয় হেসে দুজনে দুজনকে চোখে ঠেরে বলে উঠল- আরে কাল কা যোগী, আমাদের আবার জ্ঞান দিতে আসছে?
যেন শুনেও শুনতে পেলেন না ঋষিরা, এমন ভান করে বললেন আচ্ছা দ্বারী তোমরা তো এখানে অনেকদিন ধরেই আছ, তোমরাই বল না, চট করে কি এই বৈকুণ্ঠধামে কেউ আসতে পারে? কাউকে কি কখনো সেইভাবে দেখেছো?
-ওসব পাকা পাকা কথা রাখো তো। বিরক্ত করো না। এখান থেকে সরে পড়। খিঁচিয়ে উঠে দ্বারীরা।
চরণ দর্শন না করে তো সনকরা চলে যাবার জন্য আসি নি। তাই তারা আবার শান্ত কণ্ঠে বললেন- তোমরা কি ভাবছ, আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে চোরের মত এখানে এসে ঢুকেছি? তা কি কেউ কখনো আসতে পারে? তোমরা কি জানো না, কতো সাধন-ভজন করলে, তবে এখানে আসা যায়? তোমরা আমাদের অন্যরকম ভাবছো কেন দ্বারী পথ ছেড়ে আমাদের যেতে দাও।
জয় বিজয়ের সেই একঘেয়ে!
সনক বললেন- যারা প্রকৃত বিষ্ণুভক্ত তাদের মধ্যে যেমন দুই দুই ভাব থাকা ঠিক নয় তেমনি এরকম গোঁয়ার্তুমি থাকাও উচিত নয়। এরকম মনোভাব নিয়ে স্বয়ং ভগবান বৈকুণ্ঠনাথের অনুচর হবার যোগ্যতা তোমাদের নেই। মর্ত্যে যারা কাম-ক্রোধ-দম্ভ- অহংকার নিয়ে থাকে, তাদের সঙ্গে তাহলে তোমাদের পার্থক্য কোথায়?
এবার জয়-বিজয় আত্নসম্মানে কথাগুলো খুব লাগল। রেগে দন্ড উঁচিয়ে তেড়ে এল তারা ঋষিদের দিকে- আবার পাকা পাকা কথা! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।
সনক ঋষিরাও আর ক্রোধ সংবরণ করতে পারলেন না। অভিশাপ দিয়ে বসলেন -তোমাদের স্থান বৈকুন্ঠে নয় পাতালে যাও। সেখানে তোমরা তোমাদের এই দম্ভের বাসনা মিটিয়ে এসো।
ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে যেন জোঁকের মুখে চুন পড়ার মত অবস্থা হলো জয় আর বিজয়ের। বুঝল, দারুণ ভুল করে ফেলেছে তারা। বলল বুঝতে- পারি নি। আমাদের অপরাধ ক্ষমা করুন।
ঠিক সেই সময়ে সেখানে এসে হাজির হলেন স্বয়ং লক্ষ্মীনাথ ভগবান, খালি পায়ে হেঁটে সঙ্গে লক্ষীদেবীকে নিয়ে। অবাক চোখ মেলে ঋষিরা দেখলেন- পরনে পীতবসন, সর্বাঙ্গে অলংঙ্কার, বুকে বনমালা, আর কৌস্তুভমনি। দুপাশে হাঁসের মত ঝুলছে দুটো সাদা চামড়, মাথায় সাদা ছাতা। ছাতার চারপাশ দিয়ে ঝুলছে মুক্তার হার।
মুখে অমল- ধবল হাসি। একবার তাকাচ্ছেন জয়-বিজয়ের দিকে, আর একবার তাদের দিকে। করুণা যেন ঝরে পড়ছে আত্মারাম সেরূপ দেখতে যেমন চোখ জুড়োয়, তেমন মন জুড়োয়।
তিনি জানতেন, ব্রাহ্মণরা এসেছেন তাঁর চরণ দর্শন করতে। তাই তিনি নিজে থেকেই এসেছিলেন তিনি খালি পায়ে, যাতে তার চরণ দেখার জন্য তাদের অনুরোধ জানাতে না হয়, আর অভিলাস পূরণ হলেই শান্তি পান।
সঙ্গে আবার লক্ষ্মীকেও এনেছেন। অহংকার যাদের নেই যাদের মন প্রাণ জুড়ে শুধু শ্রদ্ধা আর বিনয় লক্ষী তো সেখানেই বাস করেন।
সামনে লক্ষ্মীনাথকে দেখে মুনিরা আর স্থির থাকতে পারলেন না। তারা একবার দেখেন বৈকুণ্ঠনাথের সেই মুখ, আর একবার পদ্ম রঙ্গ চরণ। বারবার প্রণাম জানান। সঙ্গে সঙ্গে মনে জাগে অনুশোচনা। এর অনুচরদের অভিশাপ দিয়ে কাজটা বোধহয় ভালো করলেন না।
শ্রী হরির কাছে কাছে তো লুকানো কিছুই নেই। আর সাধ্যও নেই কারো, যে মনে কিছু লুকিয়ে রাখে। তিনি যে বৈকুণ্ঠ সর্বত্র অপ্রতিহত গতি তাঁর।
জয় বিজয় মাথা হেঁট করে উঠে দাঁড়িয়েছে।
তাদের দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসলেন ভগবান-বিষ্ণু। কি মধুর সে হাসি। আবার তাকালেন মুনিদের দিকে। সেই মধুর হাসি যেন কোথাও কোনো অভিযোগ নেই।

ব্রাহ্মণদের বললেন - আপনাদের সংকোচের কোন কারণ নেই। আপনারা নতুন কিছু করেননি, আর অন্যায়ও কিছু করেননি। আমার ইচ্ছাই পূরণ করেছেন।
তারপর জয় বিজয়ের দিকে তাকিয়ে তেমনি মধুর হেসে বললেন, ভালোই হয়েছে। এক জায়গায় চিরকাল থাকলে মনটা একটু অন্যরকমের হয়ে যায়। বেশ হয়েছে কিছুকাল মর্ত পাতাল ঘুরে এসো, তাতে মনটা আর বেচাল করবে না। যাওয়া অবশ্য তোমাদের অনেক আগেই হয়ে গিয়েছিল, আমার যোগনিদ্রায় থাকার সময় লক্ষীকেই প্রসাদে ঢুকতে বাধা দিয়েছিল। এখনই ব্রাহ্মণদের অভিশাপ আমার যত ক্ষমতায় থাক, কাটাতে আমি পারবো না। ফলভোগ তোমাদের করতেই হবে।
প্রভু আমাদের কি উদ্ধার হবে না? নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে জয় বিজয় অনুরোধ জানালে ভগবানের কাছে।
যেদিন তোমরা দারুন স্বার্থপর আর ঘোর অনাচারী হয়ে উঠবে, যখন তোমাদের দৌরাত্ম্য চরমে উঠবে, তখন আমি তোমাদের উদ্ধার করে আনব। ভৃত্যকে কষ্ট পেতে দেখলে কি মনিব চুপ করে থাকতে পারে?
তারপর মুনিদের বললেন-ভৃত্য যে অন্যায় করেছে, সে অন্যায় তো আমারই। ভৃত্য দোষ করলে দোষটা মনিবেরই হয়, অপবাদ তারই হয়। আপনারা সত্যি মহৎ। তা নইলে আমাকে এই অপবাদ এমনভাবে মুক্ত হবার জন্য কি সাহায্য করতেন? শুধু একটা অনুরোধে পরিমাণটা একটু কমিয়ে দিন, যাতে ওরা আবার এখানে ফিরে আসতে পারে।
তাই করে দিলেন মুনিরা জয় বিজয়ের করুন মুখ দেখে। এই ঔদ্ধত্যের ফল তিনটে জন্ম ভোগ করতে হবে। তারপর ওরা বরাবরের জন্য এখানে ফিরে আসতে পারবে।
প্রথম জন্মে তাই ওরা হয়েছিল কশ্যপ-তনয়। দিতির ছেলে হিরণ্যকশিপু আর হিরণ্যাক্ষ। দ্বিতীয় জন্মে হয়েছিল, সুকেশিনীর ছেলে রাবন আর কুম্ভকর্ণ। আর তৃতীয় অর্থাৎ শেষ জন্মে হয়েছিল শিশুপাল আর দন্তবক্র। আর প্রতিবারেই স্বয়ং ভগবানকে বিভিন্ন মূর্তি ধরে আসতে হয়েছিল তার প্রিয় অনুচরদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবার জন্য।

Post a Comment

0 Comments