দামোদর ব্রতের মহিমা ধৰ্মদত্ত উপাখ্যান
পদ্মপুরাণে বৰ্ণিত আছে একবার পৃথু মহারাজ নারদ মুনিকে বললেন- হে মুনিশ্ৰেষ্ঠ, কাৰ্তিক ব্ৰত পালনকারী পুরুষ যে প্রকার মহান ফল প্ৰাপ্ত হয়, তা আপনি বৰ্ণনা করুন। কারা এই ব্রত অনুষ্ঠান করে থাকে!
নারদ বললেন-- হে রাজন! পূর্বকালে ধৰ্মদত্ত নামে এক ধৰ্মজ্ঞ ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। তিনি শ্ৰীবিষ্ণুব্ৰত পালন তথা নিষ্ঠাপূর্বক সর্বদা বিষ্ণুপূজায় তৎপর থাকতেন। তিনি দ্বাদশ অক্ষর মন্ত্রজপ করতেন এবং অতিথি সৎকার তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিল। একদিন কাৰ্তিক মাসে শ্ৰীহরির নিকট জাগরণ করার জন্য ভগবানের মন্দিরাভিমুখে যাত্ৰা করলেন; তখনও এক প্রহর রাত্ৰি বাকী ছিল। ভগবানের পূজার সামগ্ৰী নিয়ে যেতে যেতে ব্ৰাহ্মণ পথিমধ্যে দেখলেন যে এক রাক্ষসী আসছে। তার আওয়াজ ছিল অত্যন্ত ভয়প্ৰদ। সারা শরীরে কাঁটা কাঁটা লোম, লক্ লক্ করছে জিব, নগ্ন শরীর থেকে গম্ভীর ঘর্ঘর শব্দ। ঐসব দেখে ব্ৰাহ্মণ ভয়ে শিউরে উঠলেন। তাঁর সারা শরীর কাঁপতে থাকল। রাক্ষসী সামনে এলে কোনো প্রকারে সাহস করে পূজার সামগ্ৰী ও জল নিয়ে অত্যন্ত ক্ৰোধে রাক্ষসীর উপর ছুঁড়ে মারলেন। হরিনাম স্মরণ করতে করতে তুলসী মিশ্ৰিত জল রাক্ষসীর গায়ে ছুঁড়ে মেরেছিলেন। এইজন্য সেই রাক্ষসীর সমস্ত পাপ তৎক্ষণাৎ নষ্ট হয়ে গেল। তখন সে তার পূর্বজন্মের কাহিনী স্মরণ করতে সক্ষম হয়ে বুঝতে পারল তার পূর্বকৃত কর্মের পরিণামই তার এই দুর্দশা। সে ব্ৰাহ্মণকে দণ্ডবৎ প্ৰণাম করে বলতে লাগল-- হে ব্ৰাহ্মণ! আমি পূৰ্বজন্মের কুকৰ্মের ফলে এই দশা প্ৰাপ্ত হয়েছি। এখন কিভাবে আমি উত্তম গতি লাভ করব আমাকে বলে দিন।
নারদ বললেন-- হে রাজন! পূর্বকালে ধৰ্মদত্ত নামে এক ধৰ্মজ্ঞ ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। তিনি শ্ৰীবিষ্ণুব্ৰত পালন তথা নিষ্ঠাপূর্বক সর্বদা বিষ্ণুপূজায় তৎপর থাকতেন। তিনি দ্বাদশ অক্ষর মন্ত্রজপ করতেন এবং অতিথি সৎকার তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিল। একদিন কাৰ্তিক মাসে শ্ৰীহরির নিকট জাগরণ করার জন্য ভগবানের মন্দিরাভিমুখে যাত্ৰা করলেন; তখনও এক প্রহর রাত্ৰি বাকী ছিল। ভগবানের পূজার সামগ্ৰী নিয়ে যেতে যেতে ব্ৰাহ্মণ পথিমধ্যে দেখলেন যে এক রাক্ষসী আসছে। তার আওয়াজ ছিল অত্যন্ত ভয়প্ৰদ। সারা শরীরে কাঁটা কাঁটা লোম, লক্ লক্ করছে জিব, নগ্ন শরীর থেকে গম্ভীর ঘর্ঘর শব্দ। ঐসব দেখে ব্ৰাহ্মণ ভয়ে শিউরে উঠলেন। তাঁর সারা শরীর কাঁপতে থাকল। রাক্ষসী সামনে এলে কোনো প্রকারে সাহস করে পূজার সামগ্ৰী ও জল নিয়ে অত্যন্ত ক্ৰোধে রাক্ষসীর উপর ছুঁড়ে মারলেন। হরিনাম স্মরণ করতে করতে তুলসী মিশ্ৰিত জল রাক্ষসীর গায়ে ছুঁড়ে মেরেছিলেন। এইজন্য সেই রাক্ষসীর সমস্ত পাপ তৎক্ষণাৎ নষ্ট হয়ে গেল। তখন সে তার পূর্বজন্মের কাহিনী স্মরণ করতে সক্ষম হয়ে বুঝতে পারল তার পূর্বকৃত কর্মের পরিণামই তার এই দুর্দশা। সে ব্ৰাহ্মণকে দণ্ডবৎ প্ৰণাম করে বলতে লাগল-- হে ব্ৰাহ্মণ! আমি পূৰ্বজন্মের কুকৰ্মের ফলে এই দশা প্ৰাপ্ত হয়েছি। এখন কিভাবে আমি উত্তম গতি লাভ করব আমাকে বলে দিন।
রাক্ষসীকে সম্মুখে প্ৰণাম করতে দেখে তথা পূর্বজন্মের কাহিনী বর্ণনা করতে দেখে ব্ৰাহ্মণ বড়ই আশ্চৰ্যান্বিত হলেন। তিনি রাক্ষসীকে বললেন-- 'কোন কর্মের ফলে তুমি এই দশাপ্ৰাপ্ত হয়েছ?' কোথা থেকে এসেছ? তোমার নাম কি?' তোমার আচার আচরণই বা কিরকম ছিল? এই সমস্ত কথা আমাকে বলো।
সেই শাপমুক্ত রাক্ষসী তখন বলল-- হে ব্ৰাহ্মণ! আমার পূর্বজন্মের কথা শ্ৰবণ করুন। সৌরাষ্ট্ৰ নগরে ভিক্ষা নামে এক ব্ৰাহ্মণ বাস করতেন। আমি ছিলাম তাঁর পত্নী। আমার নাম ছিল কলহ। আমি খুবই ভয়ংকর স্বভাবের স্ত্ৰীলোক ছিলাম। আমি কথাবাৰ্তাতেও কখনো নিজ পতিকে যথাৰ্থ মর্যাদা দান করিনি। তার জন্য কখনো ভালো খাদ্যদ্ৰব্য প্ৰস্তুত করিনি। আমি সর্বদাই তাঁর আজ্ঞা অমান্য করতাম। আমি অত্যন্ত কলহপ্রিয় ছিলাম। আমার স্বামী ঐ ব্ৰাহ্মণ আমাকে নিয়ে সর্বদাই উদ্বিগ্ন ছিলেন। শেষ পৰ্যন্ত আমার পতি দ্বিতীয় এক স্ত্ৰীকে বিবাহ করবে বলে স্থির করলেন। তখন আমি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করি। তারপর যমদূতেরা এসে আমাকে বেঁধে পেটাতে পেটাতে যমলোকে নিয়ে গেল। যমরাজ আমাকে উপস্থিত দেখে চিত্রগুপ্তকে জিজ্ঞাসা করলেন-- 'চিত্রগুপ্ত! খাতা খুলে দেখ এ কিরূপ কর্ম করেছে! এর জন্য শুভকর্মের ফল মিলবে না অশুভ কর্মের?
চিত্রগুপ্ত বললেন-- হে ধৰ্মরাজ! এই মনুষ্যটি কোনরকম শুভ কৰ্ম করে নাই, বরং নিজে মিষ্টান্ন আদি ভোজন করত কিন্তু তার পতিকে কোনকিছু দিত না। এখন একে বল্গুলী যোনিতে জন্মগ্রহণ করে নিজ বিষ্ঠা ভক্ষণ করে জীবন ধারণ করতে হবে। এই স্ত্ৰীলোকটি সর্বদা তার স্বামীকে দোষ দিত এবং কলহপরায়ণতা ছিল এর প্রবৃত্তি। সেইজন্য তার পরের জন্মে শুকর যোনিতে জন্মগ্রহণ করে দিন কাটাতে হবে। সে যে পাত্রে রান্না করত, সেই পাত্ৰেই ভোজন করত। সেই দোষের জন্য তারপরের জন্মে আপন সন্তান ভক্ষণকারী বিড়াল রূপে জন্মগ্ৰহণ করবে। তাছাড়া আপন স্বামীর জন্য এ আত্মহত্যা করেছে, সেইজন্য এই অত্যন্ত নিন্দনীয় স্ত্ৰীলোকটি এখন থেকে কিছুকাল প্ৰেত শরীরে অবস্থান করতে হবে। দুতেদের দিয়ে একে মরুপ্রদেশে পাঠানো দরকার যেখানে ও প্রেত শরীর ধারণ করে থাকবে। এরপর ঐ পাপিনী উক্ত তিন যোনিতে কষ্ট ভোগ করবে।
কলহ বলতে লাগল- বিপ্লবের! আমিই সেই পাপিনী কলহ, প্ৰেতশরীরে আমার পাঁচশত বৎসর অতিবাহিত হয়েছে। আমি সর্বদাই নিজ কৃতকর্মের জন্য দুঃখিত তথা ক্ষুধা পিপাসায় অত্যন্ত পীড়িত হয়ে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছি। একদিন ক্ষুধায় কাতর হয়ে এক বণিকের শরীরে প্ৰবেশ করি এবং তার সাথে দক্ষিণ দেশে কৃষ্ণা এবং বেণীর সঙ্গমস্থলে উপস্থিত হই। সেখানে আসার পর যখন ঐ সঙ্গমের কিনারায় দাঁড়িয়েছি তখন শিব এবং বিষ্ণুর পার্ষদেরা তার শরীর থেকে বেড়িয়ে আমাকে বলপূর্বক সেখান থেকে বিতাড়িত করে দিল। দ্বিজশ্রেষ্ঠ! তখন থেকেই আমি ক্ষুধায় কষ্ট পেতে পেতে এদিক ওদিক ভ্ৰমণ করছি। ঠিক এই সময়ই আপনার ওপরে আমার দৃষ্টি পড়ে। আজ আপনার হাত থেকে তুলসী মিশ্ৰিত জলের স্পৰ্শে আমার সমস্ত পাপ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বিপ্ৰবর আমাকে কৃপা করুন, এবং আমাকে বলুন আমি এই প্ৰেত শরীর তথা ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর তিন যোনিতে জন্মগ্রহণের যন্ত্ৰণা থেকে কিভাবে মুক্ত হব?
নারদ বললেন- কলহের এই সমস্ত কথা শুনে দ্বিজশ্রেষ্ঠ ধৰ্মদত্ত তার কৰ্মের পরিণাম বিচার করে বড় আশ্চৰ্যাম্বিত এবং দুঃখিত হলেন। অনেক ভাবনাচিন্তার পরে আক্ষেপের সঙ্গে বললেন- তীর্থ, দান এবং ব্রত আদি শুভকর্মের দ্বারা পাপ নষ্ট হয় কিন্তু, তুমি এখন প্রেত শরীরে অবস্থান করছ, এই সমস্ত শুভ কর্মে তোমার অধিকার নেই। তবুও তোমার এই দুর্দশা দেখে আমার মনে অত্যন্ত দুঃখ হচ্ছে। আমি মনুষ্যজন্ম নিয়ে এখন পৰ্যন্ত কাৰ্তিক ব্রত পালন করে যে পুণ্য সঞ্চয় করেছি, তার অৰ্ধেক তোমাকে দান করলাম। সেই অর্ধেক পুণ্য নিয়ে তুমি উত্তম গতি প্ৰাপ্ত হও।
এই কথা বলে ধৰ্মদত্ত কলহকে শ্ৰীবিষ্ণুর দ্বাদশ অক্ষর মন্ত্ৰ জপ করে শ্রবণ করাতে লাগলেন এবং তুলসী মিশ্ৰিত জলদ্বারা তার অভিষেক করলেন। তখন সেই রাক্ষসী প্ৰেত শরীর পরিত্যাগ করে দিব্যরূপময়ী এক দেবীতে পরিণত হলো। তাকে অগ্নির সমান উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। সে এমনই অনুপম সৌন্দৰ্য্য লাভ করল যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মীদেবী। তারপর সে ভূমিতে মস্তক নত করে সেই ধৰ্মদত্ত ব্ৰাহ্মণকে প্ৰণাম করে গদগদ কণ্ঠে বলতে লাগল- দ্বিজশ্রেষ্ঠ! আপনার কৃপায় আমি নরক যন্ত্ৰণা থেকে উদ্ধার পেয়েছি। আমি পাপের সমুদ্রে ডুবে ছিলাম। আপনি আমার জন্য নৌকার সমান হয়ে আমাকে উদ্ধার করলেন। আপনি আমার প্রণাম গ্ৰহণ করুন।
সে যখন এইভাবে ব্ৰাহ্মণের সঙ্গে কথা বলছিল সেই সময় দেখা গেল আকাশ থেকে দিব্যবিমান অবতরণ করছে যাতে শ্ৰীবিষ্ণুর মতো রূপ ধারণকারী শ্ৰীবিষ্ণুর পাৰ্ষদগণ রয়েছেন। কাছে এসে বিমানের দ্বারদেশে অবস্থানকারী পুণ্যশীল এবং সুশীল নামে দুই বিষ্ণুর পাৰ্ষদ রাক্ষুসী থেকে রূপান্তরিত সেই দেবীকে বিমানে ওঠালেন। ঐ সময় এরকম বিমান দেখে ধৰ্মদত্ত বড়ই আশ্চাৰ্যন্বিত হলেন। তিনি বিষ্ণুরূপধারী পার্ষদের দৰ্শন করে তাঁদের সাষ্টাঙ্গে প্ৰণাম করলেন। ব্ৰাহ্মণকে প্ৰণাম করতে দেখে পুণ্যশীল এবং সুশীল দুজনে তাঁকেও বিমানে উঠিয়ে নিলেন এবং তাঁর প্রশংসা করতে করতে ধৰ্মীয় তত্ত্ব বলতে লাগলেন।
দুই বিষ্ণু পাৰ্ষদ বললেন- দ্বিজশ্রেষ্ঠ! তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ। কারণ তুমি সৰ্বদাই বিষ্ণু আরাধনায় যুক্ত। দীন দুঃখীদের দয়া করা তোমার স্বভাব। তুমি অত্যন্ত ধৰ্মাত্মা এবং শ্ৰীবিষ্ণুব্ৰত অনুষ্ঠান আদি পালনে নিষ্ঠাযুক্ত। তুমি প্ৰতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আজ পৰ্যন্ত এই কল্যাণময় কাৰ্তিক ব্ৰত পালন করেছ এবং তার অৰ্ধেক দান করার ফলে দ্বিগুণ পুণ্য লাভে সক্ষম হয়েছ। তুমি অত্যন্ত দয়ালু, তোমার কাৰ্তিক ব্ৰত এবং তুলসীপূজন আদি শুভকৰ্মের ফল দান করার ফলে এই স্ত্ৰীলোকটি আজ ভগবান শ্ৰীবিষ্ণুর নিকট গমন করছে। তুমিও এই শরীর অন্তে দুই স্ত্ৰীকে সঙ্গে নিয়ে ভগবান বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠধামে যাবে এবং তাঁর সমান রূপ ধারণ করে সর্বদাই তাঁর (ভগবানের) কাছে বাস করবে। ধৰ্মদত্ত! যে ব্যক্তি তোমার মতো নিষ্ঠার সঙ্গে ভক্তিভরে শ্ৰীবিষ্ণুর আরাধনা করবে, সে ধন্য এবং কৃতকৃত্য তথা এই সংসারে তার জন্মলাভ সাৰ্থক। যিনি পূর্বকালে রাজা উত্তানপাদের পুত্র ধ্রুবকে 'ধ্রুবপদ' প্রদান করেছিলেন, সেই শ্রীবিষ্ণুকে যদি কেউ নিষ্ঠা সহকারে আরাধনা করে তাহলে সেই প্রাণীকে কেন তিনি কিছু প্রদান করবেন না?
ভগবানের নাম স্মরণ মাত্রেই দেহধারী জীব সদ্গতি প্রাপ্ত হয়। পূর্বকালে যখন গজরাজকে কুমির আক্রমণ করে ধরে রেখেছিল, সেই সময় সে শ্রীহরির নাম স্মরণ করে সেই সংকট থেকে মুক্ত হয়ে ভগবানের নিকট স্থান লাভ করেছিল এবং এখনও সে ভগবানের নিকটে স্থান লাভ করেছিল এবং এখনো সে ভগবানের 'জয়' নামে পার্ষদরূপে বিখ্যাত। তুমিও শ্রীহরির আরাধনা করেছ, অতএব তোমাকে অবশ্যই নিজসমীপে তিনি স্থান দেবেন। এই কার্তিক ব্রতে তুলসীমিশ্রিত জলের মাহাত্ম্য এমনই যে তা জীবের সর্ব পাপ বিনষ্ট করে তাকে ভগবদ্ধামে গতি লাভ করায়।
0 Comments