দামবন্ধন লীলা পর্ব - ৩
মা যশোদার পক্ষেও দ্রুত দৌড়ানো সম্ভব ছিল না। তাঁর শরীর ও বেশভূষায দুই'ই তাঁর সঙ্গে বিরোধিতা করছিল- 'কেন তুমি আজ কানাইকে তাড়না করছ?' প্রথমে ঘরের ভেতরে দৌড়াদৌড়ি হচ্ছিল। পরে কৃষ্ণ গোকুলের রাস্তায় চলে এলেন। এদিকে ব্রজবাসীরা এই দৌড় প্রতিযোগিতা দেখছিলেন।
দুরন্ত কৃষ্ণ এদিক-সেদিক দৌড়াতে লাগলেন। কিন্তু নিতম্বভারে যশোদাদেবীর গতি মন্থর হলো। ঘর্মাক্ত কলেবর অবস্থায় মাথার কবরী খুলে গেল। কৃষ্ণও পেছন দিকে তাকিয়ে দেখতে চাইলেন মা কত দূরে। কিন্তু যশোদাদেবী খপ করে তাঁর ডান হাত ধরে ফেললেন।
বাঁ হাতে কৃষ্ণ তাঁর নয়নপদ্মযুগলের অশ্রুমোচন করছিলেন। এতে চোখের কাজল সারা মুখে ছড়িয়ে গেছে, আর বারবার ভীতশঙ্কিত নেত্ৰে মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। মা তখন লাঠি দ্বারা ভয় দেখাতে দেখাতে বলতে লাগলেন, “রে দুষ্ট, বানরবন্ধু, দধিভাণ্ড ভগ্নকারী! এখন নবনীতাদি কোথায় পাবে? অাজ এমন ভাবে বেঁধে রাখব যেন বালকদের সাথে খেলতে না পার। এখন কেন ভয় পাচ্ছ?”
পুত্রের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীরূপে তিনি জানতেন যে, এতটুকু শিশুকে এতটা ভয় দেখানো ঠিক হবে না। অথচ তাঁকে একটু দণ্ড না দিলেই নয়। তাই, হাতের ছড়িটা ফেলে দিয়ে বেঁধে রাখতে মনস্থ করলেন। কেননা, ভয় পেয়ে আবার কোথায় পালিয়ে যায়, তার ঠিক নেই। তাই, যাঁর ভেতর-বাহির নেই, আদি-অন্ত নেই; যিনি জগতের পূর্বেও ছিলেন পরেও থাকবেন; যিনি জগতের ভেতরেও আছেন, বাইরেও আছেন আবার জগৎরূপেও বৰ্তমান; শুধু তাই নয়, যিনি ইন্দ্ৰিয়ের অতীত, অব্যক্ত কিন্তু মনুষ্য আকৃতি গ্ৰহণ করায় মা তাঁকে স্বীয়পুত্ৰ মনে করে উদুখলের সাথে বাঁধলেন। উদুখলের সাথে বাঁধার কারণ হচ্ছে, যে ব্যক্তি চুরিতে সহায়তা করে তিনিও চোর। তাই, দুই চোরকে একসাথে বেঁধে রাখলেন। মা যশোদা যখন অপরাধী বালকটিকে বাঁধার চেষ্টা করছিলেন, তখন দু-আঙ্গুল দড়ি কম পড়ল। কেননা, ভগবানের কৃপাদৃষ্টি যাঁর ওপর পড়ে সে মুক্ত হয়ে যায়। মুক্ত জিনিসে আবার বন্ধন হবে কি করে? অথবা, গো-বন্ধনকারী (ইন্দ্ৰিয়সমূহ বন্ধনকারী) দড়ি আবার গো-পতি (ইন্দ্রিয়াধীশকে) বন্ধন করবে কি করে?
তবে কেন মাত্ৰ দু-আঙ্গুল কম পড়ল, এ বিষয়ে অনেক সিদ্ধান্ত রয়েছে-
১) ভক্তের পূৰ্ণ প্রচেষ্টা, আর ভগবানের দয়ার ঘাটতি ছিল।
২) সামনে আরো দু'টি বৃক্ষকে উদ্ধার করতে হবে, তারই সূচনা করা হচ্ছে প্রভৃতি।
তাই, যশোদা মা তখন সেই দড়িটির সাথে আরেকটি দড়ি যুক্ত করলেন। কিন্তু সেটিও দু-আঙ্গুল কম পড়ল। এভাবে, যত দড়ি যোগ করা হয়, তা-ই দু-আঙ্গুল কম পড়ে। এভাবে নিজগৃহের সমস্ত দড়ি ফুরিয়ে গেলে, অন্যান্য ব্ৰজবাসীদের গৃহ থেকে দড়ি আনার পরেও একই অবস্থা। এতে গোপীরা হাসতে শুরু করল, আর যশোদাও হাসতে হাসতে বিস্ময়াপন্ন হলেন। কেননা, যাঁর কোমর মাত্ৰ কয়েক মুষ্টি, কিন্তু একশ হাত দড়িতেও তা বাঁধা পড়ছে না। তখন গোপীরা বলতে লাগল, “দেখ যশোদা, ওর কোমরে ছোট্ট সূতোয় বাঁধা কিঙ্কিনি কেমন রুনুঝুনু বাজছে। আর এত দড়িও দিয়ে তুমি তাঁকে বাঁধতে পারছ না। হয়তো, এর কপালে আজ বন্ধন নেই।” যশোদা বললেন, “আজ যদি সন্ধ্যা হয়ে যায়, গ্রামের সমস্ত দড়ি প্রয়োজনও হয়, তবুও এঁকে ছাড়ব না।” ভগবান যখন ভক্তের চেষ্টা দেখেন, তখন তিনি কৃপাপূর্বক বন্ধন স্বীকার করেন। তাই, যশোদার একান্ত জেদ দেখে, ভগবান তাঁর জেদ ছেড়ে দিলেন।
যিনি স্বীয় মায়ারজ্জুতে নিখিল জগৎ বন্ধন করে রেখেছেন, তিনি আজ মায়ের রজ্জুবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। শিব, ব্ৰহ্মা, ইন্দ্ৰ প্ৰভূতি মহান দেবতারা সহ এই নিখিল বিশ্ব যাঁর বশীভূত, সেই স্বতন্ত্ৰ ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ এভাবে তাঁর ভক্তবশ্যতা দেখিয়েছেন। মা যশোদা মুক্তিদাতা শ্ৰীকৃষ্ণের কাছে যে অনুগ্রহ লাভ করেছেন, তা ব্ৰহ্মা, মহেশ্বর এমনকি ভগবানের অর্ধাঙ্গ বিলাসিনী লক্ষ্মীদেবীও প্রাপ্ত হননি। যশোদানন্দন ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ স্বতঃস্ফূর্ত প্ৰেমময়ী সেবায় যুক্ত ভক্তদের পক্ষে যে রকম সুলভ, মনোধৰ্মীজ্ঞানী, আত্মোপলব্ধিকামী তাপস বা দেহাত্মবুদ্ধি পরায়ণ ব্যক্তির কাছে তেমন সুলভ নন।
মা যশোদা তাঁর ছেলেকে বেঁধে রেখে গৃহকৰ্মে ব্যস্ত হলেন। তখন উদুখলে বাঁধা শ্ৰীকৃষ্ণ বাড়ির সামনে দু'টি অর্জুন গাছ দেখতে পেলেন। এ দু'টি গাছের একটি ইতিহাস আছে। এরা ধনপতি কুবেরের পুত্র নলকুবের ও মনিগ্ৰীব। সাক্ষাৎ শিবের অনুচর হওয়া সত্ত্বেও এদের মাথায় কুবুদ্ধি প্ৰবেশ করে। তারা বারুণী সুধাপানে উন্মত্ত হয়ে দিগম্বর অবস্থায় জলে নেমে, প্ৰমত্ত হাতির মতো দেবাঙ্গনাদের সাথে জলক্রীড়া করতে লাগল। তখন নারদ মুনি সেদিকে আসছিলেন। তা দেখে দেবাঙ্গনারা তাদের স্বীয় বস্ত্ৰ পরিধান করল। কিন্তু সেই পাষণ্ডদ্বয় নারদ মুনিকে উপেক্ষা করল। কিন্তু নারদ মুনি তাঁদের দুরাবস্থা দেখে করুণার্দ্র হলেন এবং বৃক্ষ যোনি প্ৰাপ্ত হয়ে চিরকাল নগ্ন থাকার অভিশাপ দিয়েছিলেন। তারাই সেই অৰ্জুন বৃক্ষদ্বয়। কৃষ্ণ ভাবলেন, “যদিও এরা কুবেরের পুত্ৰ, এতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যেহেতু নারদ মুনি এদেরকে উদ্ধার করতে মনস্থ করেছেন। তাই এদের উদ্ধার করতে হবে।”
তাই শ্ৰীকৃষ্ণ তখন গাছ দু'টির মাঝখােন দিয়ে যাওয়া শুরু করলেন। এতে পেছনে বাঁধা উদুখলটি বক্ৰভাবে গাছটিতে আটকে পড়ে। তিনি তখন প্রবল বিক্ৰমের প্রকাশরূপ অবলীলায় গাছ দু'টি ভেঙ্গে ফেললেন। সাথে সাথে বৃক্ষ দুটির মধ্যে থেকে অগ্নির মতো দুই মহাপুরুষ নিৰ্গত হলেন। তাঁদের সৌন্দর্যের ছটায় সৰ্বদিক আলোকিত হয়েছিল এবং তাঁরা অবনত মস্তকে শ্ৰীকষ্ণকে প্ৰণতি জানিয়ে স্তুতি করতে লাগলেন।
শ্ৰীকৃষ্ণ তখন বললেন, “দেবৰ্ষি নারদ অত্যন্ত কৃপাময়। ধনমদে অন্ধ, তোমাদের দু'জনকে অভিশাপ দিয়ে তিনি তোমাদের প্রতি তাঁর মহৎ কৃপা প্ৰদৰ্শন করেছেন। যদিও তোমরা স্বৰ্গ থেকে অধঃপতিত হয়ে বৃক্ষ যোনি প্রাপ্ত হয়েছিল, তবুও তোমরা নারদমুনির অনুগৃহীত। সূর্যের আগমনে যেভাবে চক্ষুর অন্ধকার দূরীভূত হয়, তেমনি ঐকান্তিকভাবে আমার শরণাগত এবং আমার সেবায় কৃত সঙ্কল্প ভক্তের সাক্ষাৎকারের ফলে, কারও আর জড় বন্ধন থাকতে পারে না। তোমরা দু'জনে এখনগৃহে ফিরে যেতে পার। তোমরা যেহেতু সর্বদা আমার ভক্তিতে মগ্ন হতে চেয়েছিল, তাই তোমাদের বাসনা পূৰ্ণ হলো, আর সেই স্তর থেকে তোমাদের কখনও অধঃপতন হবে না।”
তখন তাঁরা কৃষ্ণকে প্ৰদক্ষিণ করে চলে গেল। কিন্তু নিকটে ক্ৰীড়ারত বালকেরা সব দেখছিল। এদিকে প্ৰচন্ড বজ্রপাতের শব্দে গাছ পড়ে যাওয়াতে নন্দ মহারাজ আদি গোপেরা নতুন বিপদের আশংকা করে সেখানে এলেন। কিন্তু দুটি গাছকে পতিত দেখতে পেয়েও, তার কারণ নিৰ্ণয় করতে অসমৰ্থ হলেন। কৃষ্ণতো সেখানে উদুখলে বদ্ধ হয়ে আছে। তবে কে এই কাজটি করল?
তখন সেই ছোট বালকেরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু খুলে বলল। গভীর বাৎসল্য প্রেমের ফলে নন্দ মহারাজ প্রমুখ গোপেরা বিশ্বাস করতে পারেননি যে, শ্রীকৃষ্ণ এত আশ্চর্যজনকভাবে বৃক্ষ দু'টি উৎপাটন করেছিলেন। কিন্তু কেউ কেউ ভাবতে লাগলেন, "যেহেতু ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, কৃষ্ণ নারায়ণের সমতুল্য হবে, তাই সে এই কার্য করেও থাকতে পারে।"
নন্দ মহারাজ তাঁর পুত্ৰকে রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় উদুখল নিয়ে টানাটানি করতে দেখে হাসতে হাসতে তাঁকে বন্ধনমুক্ত করেছিলেন। এই দুটি লীলার মাঝেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর 'ভক্তবশ্যতা' গুণ প্রদর্শন করলেন।
কৃষ্ণকে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেয়ে বলরাম অত্যন্ত ক্ৰোধাম্বিত হয়েছিলেন। তিনি হুঙ্কার করতে লাগলেন, “কে বেঁধেছে? কার এত বড় সাহস?” তখন সামনে বালকদের মধ্যে কেউ মাতা যশোদার নাম বলে দিল। তখন যশোদা মাতাও এদিকে এল। বলরামকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হয়েছে? চেঁচামেচি করছ কেন?”
বলরাম বললেন, “তুমি জানো কৃষ্ণ কে? এই কৃষ্ণই নারায়ণ, ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু, এই কৃষ্ণই বামন, কৃষ্ণই মৎস্য, কৃষ্ণই কূৰ্ম, এই কৃষ্ণই নৃসিংহরূপে হিরণ্যকশিপুর বক্ষ বিদারণ করেছিল . . .।” যশোদা বলল, “আর তুমি কে?” বলরাম জানাল, “আমি সঙ্কৰ্ষণ, আমি শেষ নাগ, আমার মাথায় এই সমগ্ৰ ব্ৰহ্মাণ্ড সৰ্ষপাকৃতির ন্যায় বিরাজ করে। আমি মুহুর্তেই এই বিশ্ব ধ্বংস করে দিতে পারি।” যশোদা বলল, “আরে আরে . . . । সব অবতারই আমার ঘরে ঢুকে বসে আছে। কেন? আর কোনো ব্ৰজবাসীর ঘরে কি জায়গা ছিল না? আমার ছড়িটা কোথায়? এখুনি নৃসিংহ আর সঙ্কৰ্ষণের ভূত পিটিয়ে ছাড়াব।” বলরাম তখন ভয় পেয়ে দৌড়ে পালালেন। বাৎসল্য প্রেমের কাছে ভগবানের ঐশ্বৰ্য আজ পরাভূত।
শ্রীকৃষ্ণ এখানে অনেকগুলো আশ্চর্যমণ্ডিত ও অপ্রকাশিত গুণাবলী প্রদর্শন করেছেন---
★স্তন্যকাম -- যিনি আত্মারাম, যাঁর কিছুই দরকার নেই, তিনি মাতৃদুগ্ধের জন্য লালায়িত হলেন।
★আপ্তকাম -- যিনি সর্বদাই সন্তুষ্ট, তিনি পর্যাপ্ত দুগ্ধ পান করেও অতৃপ্ত।
★ক্রোধান্বিত -- যিনি সবচেয়ে শুদ্ধ, ত্রিগুণাতীত, তিনি রজোগুণাত্মক ক্রোধান্বিত হলেন।
★যাঁর ভয়ে ভয়ঙ্কর কাল, যমরাজ, এমনকি মূর্তিমান ভয়ও ভীত হয়, তিনি মাতার শাসনের জন্য ভয় পাচ্ছেন।
★মনের গতিতে ধাপমান হয়েও যোগীরা যাঁকে ধরতে পারেন না, মাতা যশোদা একটু দৌড় দিয়েই তাঁকে ধরে ফেললেন।
★যিনি কর্মবন্ধন দ্বারা ইন্দ্র থেকে শুরু করে সমস্ত দেবতা ও জীবদের কর্মবন্ধনে আবদ্ধ করে রাখেন, যাঁর আদি-মধ্য-অন্ত্য নেই, তিনি মাতা যশোদার রজ্জুতে আবদ্ধ ইত্যাদি।
0 Comments