হরে কৃষ্ণ, এই কলিযুগে পরমেশ্বর ভগবান আজ থেকে পাঁচশ বছর পূর্বে
ভক্তভাব অঙ্গীকার করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরূপে নবদ্বীপের শ্রীমায়াপুরে
আবির্ভূত হন বদ্ধজীবের উদ্ধারের উপায় স্বরূপ শ্রীচৈতন্যদেব হরিনাম
সংকীর্তনের পন্থা প্রচার করেন তিনি চেয়েছিলেন তাঁর সংকীর্তন আন্দোলন যেন
সারা পৃথিবী জুড়ে প্রচারিত হয়
দু’শ বছর পূর্বে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তিত
শুদ্ধভক্তির মন্দকিনী ধারাকে সমগ্র বিশ্বে প্রচারের বাসনা হৃদয়ে পোষণ
করেন যা মায়াবাদ ও সহজিয়াবাদে আছন্নপ্রায় হয়ে গিয়েছিল তিনি লিখেছেন-”
সেদিন কবে আসিবে যেদিন ই্উরোপীয়ান ও আমেরিকান পাশ্চাত্যের বৈষ্ণবেরর
প্রাচ্য দেশীয় বৈষ্ণবদের সহিত ডঙ্কা বাজইয়া সমস্বরে ‘জয় শচীনন্দন’
বলিয়া উচ্চসংকীর্তন করিবে”
এরপরে গৌড়ীয় ভাস্কর শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর কঠোর ব্রত
অবলম্বন করে তাঁর শিষ্যদের সারা বিশ্বে মহাপ্রভুর বাণী প্রচারের অনুপ্রেরণা
দান করেন শ্রী গুরুদেবের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ৭০ বছর বয়সের একজন বৃদ্ধ
ভারতীয় সন্ন্যাসী সম্পূর্ণ সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় কেবল চল্লিশটি
টাকা-আমেরিকার মুদ্রার মান অনুসারে মাত্র আটটি ডলার সঙে নিয়ে আন্তর্জাতিক
কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ(ইস্কন) এর প্রতিষ্ঠাতা আচার্য শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ
ভক্তিবেদান্ত স্বামী ১৯৬৫ সালে নিউইয়র্ক শহরে যান একটা অসম্ভব
উদ্দেশ্য(ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য জগতে কৃষ্ণভাবনার অমৃত বিতরণ করা)
সাধন করার জন্য তিনি ১৮৯৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর কলকাতায় পিতৃদেব শ্রী
গৌর মোহন দে ও মাতা শ্রীমতি রজনী দেবীর গৃহে আবির্ভূত হন ১৯৫৯ সালে তিনি
সন্ন্যাস গ্রহণ করেন শৈশবে জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন “শিশুটির বয়স
যখন ৭০ বছর হবে তখন তিনি সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশ যাবেন।এক বিখ্যাত ধর্ম
প্রচারক রূপে স্বীকৃতি লাভ করবেন ও ১০৮টি মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন” ।
তাঁর আমেরিকা সম্বন্ধে কোন রকম অভিজ্ঞতা ছিল না এবং সেখানে এসে যে তিনি
কি করবেন তারও কোন পরিকল্পনা তাঁর ছিল না উদ্দেশ্যবিহীনভারে তিনি সেই
শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন বাওরীতে একটা আর্টিস্টের স্টুডিওতে তিনি
কিছুদিন থাকলেন
এই সময়ে ‘Village Voice’ নামে একটি পত্রিকায় শ্রীল প্রভুপাদের ছবিসহ
একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় সেই প্রবন্ধে বলা হয়েছিল-’ এ. সি.
ভক্তিবেদান্ত স্বামী এবং তাঁর আমেরিকারন অনুগামীদের মাধ্যমে পাশ্চাত্যর
সঙ্গে প্রাচ্যের মিলন মূর্ত হয়ে উঠেছে সত্তর বছর বয়স্ক,
সংস্কৃতিসম্পন্ন, উচ্চশিক্ষিত স্বামীজী এদেশে এক বছর ধরে শান্তি ও
সৌহার্দ্য সম্বন্ধে উপদেশ দিচ্ছেন’
’Butlar Eagle’ পত্রিকায় শ্রীল প্রভুপাদ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ বেরোয়
তাঁর শিরোনাম ছিল ’অনর্গল ইংরেজীতে হিন্দু সন্ন্যাসীর পাশ্চাত্যে আগমনের
উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ’ তাঁর একটি ছবিও ছাপা হয়, যাতে তাঁকে সম্বোধন করা হয়
‘বৈকুণ্ঠ দূত’ বলে
অবশেষে উৎসাহী যুবকেরা মিলে চাঁদা তুলে হিপী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল
ইস্ট ভিলেজ অঞ্চলের সেকেণ্ড এভিনিউতে একটা দোকানঘর ভাড়া করে তিনি আমেরিকায
তার প্রথম আশ্রম প্রতিষ্ঠা করলেন
দোকান ঘরটার বাইবে একটা সাইন বোর্ড
লেখা ছিল ‘Matchless Gifts’ বা অনুপম উপহার দোকানঘরের এই নামটি অলৌকিক ভাবে
সত্য প্রমাণিত হয়েছিল শ্রীল প্রভুপাদ সেখানে তিনি সমস্ত পাপকর্ম থেকে
নিবৃত্ত হয়ে ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত হওয়ার শিক্ষা দান করতে লাগলেন তাঁকে
সকলে স্বামীজী বলেই জানত এবং তিনি পাশ্চাত্য জগতে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এক
আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করতেন-তাঁর ঘরে বসে বৈদিক গ্রন্থ অনুবাদ করতেন,
হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করতেন, ভগবদ্গীতা শিক্ষা দিতেন তারপর একসময় তাঁকে
ঘিরে জন সমুদ্রে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রের বড় বড় ঢেউ উঠতে শুরু করে হাজারে
হাজারে, লাখে লাখে মানুষ হরিধ্বনিতে মত্ত হয়ে উঠে, আমেরিকার মাটিতে
হরিনামের বান ডেকে যায় একবছরের মধ্যে, ১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠা
করেন আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ(ইস্কন) নিউইয়র্কে নথিভুক্ত
সংস্থাটিকে শ্রীল প্রভুপাদের ১০ বছরের অবিশ্রা্ন্ত সংগ্রাম আন্তর্জাতিক রূপ
দিলেন
১৯৬৬ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর জন্মাষ্টমীর পরের দিন তিনি পাশ্চাত্যে প্রথম
দীক্ষানুষ্ঠানে ১১জনকে দীক্ষা দান করেন পরবর্তী দশ বছরে তিনি দশ সহস্রাধিক
মানুষকে দীক্ষাদান করেছিলেন
সানফ্রান্সিসকো শহরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে ১৯৬৭ সালের ৯ই জুলাই প্রথম
রথযাত্রা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন পরবর্তীতে তিনি লণ্ডনে আমন্ত্রিত হলেন
দলে দলে সাংবাদিকরা তাঁর সাক্ষাতকার নেন ও তাঁর আগমনে ইংল্যাণ্ডে বিপুল
সাড়া পড়ে যায় তিনি লণ্ডনেও মন্দির ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করলেন সমস্ত
অনুষ্ঠানটি বি. বি. সি. দূরদর্শনের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল
১৯৭০সালের জুলাই মাসে শ্রীল প্রভুপাদ ইস্কনের প্রকাশনা সংস্থা
‘ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট’ স্থাপন করেন পৃথিবীর ৫০টিরও অধিক ভাষায়
ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থগুলি ছাপাচ্ছে বর্তমানে
প্রতি সেকেণ্ডে বিশ্বের যে কোন স্থানে শ্রীল প্রভুপাদের একটির অধিক
গ্রন্থের বিতরণ হচ্ছে
১৯৭২ সালে শ্রীল প্রভুপাদ ডালাস গুরুকুল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এখন সারা পৃথিবীজুড়ে ১৫টির অধিক গুরুকুল বিদ্যালয় রয়েছে
১৯৭২ সালে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারত-তত্ত্ববিদ্ পণ্ডিত প্রফেসর
কটভস্কির আমন্ত্রনে রাশিয়ায় যান মাত্র তিন দিন সময়ের মধ্যেই একজনকেই
দীক্ষা দিয়েছিলেন আজ রুশ দেশগুলিতে হাজার মানুষ কৃষ্ণভক্তে পরিণত
হচ্ছেন তারপরে তিনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন
ও অষ্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে প্রচার, মন্দির ও
বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন
১৯৭৪ সালে শ্রীল প্রভুপাদ পশ্চিম ভর্জিনিয়ার পার্বত্য-ভূমিতে গড়ে তোলেন নব বৃন্দাবন যা হচ্ছে বৈদিক সমাজের প্রতীক
১৯৭৬ সালে বিজ্ঞানী, পণ্ডিত ও বিদগ্ধ সমাজে প্রচারের উদ্দেশ্যে কয়েকজন
বৈজ্ঞানিক শিষ্যকে নিয়ে ইস্কনের বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিভাগ ‘ভক্তিবেদান্ত
ইন্স্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন’
বিশ্বব্যাপী পণ্ডিত ব্যাক্তিগণ শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থের ভূয়সী
প্রসংশা করেন এই স্বল্প পরিসরে সকলের বক্তব্য দেয়া সম্ভব নয়, তন্মধ্যে
বংলাভাষী আধুনিক কালের শ্রেষ্ট কবি ও লেখক শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
লিখেছেন “এটি একটি বিরাট ফেনোমেনান, আমাদের জানা দরকার, এ যুগে এ রকম
রিয়েল অ্যাভঞ্চার ষ্টোরি কল্পনাও করা যায় না” এটা একটা দিগ্বিজয়
কাহিনী পশ্চিমী জগৎ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আর ব্যাবসা দিয়ে এতদিন আমাদের জয়
করেছিল, এখন এদের জয় করেছেন শ্রীল প্রভুপাদ
শ্রীল প্রভুপাদ জীবদ্দশায় পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশে যান এবং চৌদ্দবার
গোটা পৃথিবী পরিক্রমা করেন সাত হাজারেরও অধিক চিঠি লিখেন, প্রাচীন বৈদিক
শাস্ত্রের ৫০টিরও অধিক খণ্ডের ইংরেজীতে অনুবাদ ও তাৎপর্য্য রচনা করেন
১৮৪৩টিরও অধিক প্রবচন প্রদান করেন তাঁর সযত্ন নির্দেশনায় এক দশকের মধ্যে
গড়ে ওঠে বিশ্বব্যাপী শতাধিক আশ্রম, বিদ্যালয়, মন্দির ও পল্লী-আশ্রম
১৯৭৭ সালের ১৪ই নভেম্বর, শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ভগবানের নিত্যলীলায় প্রবিষ্ট হন
সম্পূর্ণ সহায়সম্বলহীন অবস্থায় পাশ্চাত্য দেশে গিয়ে যে শুদ্ধভক্তির
ধারা প্রবাহিত করেন আজ তা পাশ্চাত্যে নবজাগরণের সৃষ্টি করেছে রজতমো
গুণাচ্ছদিত হাজার হাজার দিগভ্রান্ত মানুষ খুঁজে পেয়েছেন প্রকৃত শান্তির
পথ মহাপ্রভুর প্রেমবন্যায় ডুবল সারা পৃথিবীর মানুষ
0 Comments