দামবন্ধন লীলা পর্ব - ১



দামবন্ধন লীলা (পর্ব ১)
শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের নবম ও দশম অধ্যায়ে লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্তবশ্যতা স্বীকার স্বরূপ দামবন্ধন লীলা বর্ণিত আছে। অমল পুরাণ শ্রীমদ্ভাগবতে বিধৃত লীলাদির প্রভূত রস আস্বাদন করেছেন বিখ্যাত বৈষ্ণব আচার্যগণ। তন্মধ্যে শ্রীল শ্রীধর স্বামী 'ভাবার্থ দীপিকা', শ্রীল সনাতন গোস্বামী 'শ্রীবৈষ্ণবতোষণী', শ্রীল জীব গোস্বামী 'ক্রমদীপিকা' ও 'গোপালচম্পু', শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী (রসিকাচার্য) 'সারার্থদর্শিনী টীকা', শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ রচিত শ্রীমদ্ভাগবতের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্যে যেসব লীলার চমৎকারিত্ব ও প্রাঞ্জলতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এই গ্রন্থে বর্ণিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তথা দামোদরের দামবন্ধন লীলা শ্রীল জয়পতাকা স্বামী, শ্রীল রাধাগোবিন্দ গোস্বামী ও শ্রীমৎ ভক্তিপুরুষোত্তম স্বামী মহারাজের মুখনিঃসৃত কৃষ্ণলীলা প্রবচন থেকে সংগৃহীত হয়েছে।

লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভৌমলীলায় অনেক আশ্চর্য ও চমকপ্রদ লীলা সম্পাদন করে গেছেন। তাঁর অনন্ত লীলার মধ্য শৈশব লীলা অত্যন্ত মধুর। আর শৈশবকালে সম্পাদিত সকল লীলার মধ্য দামবন্ধন লীলা ও যমলার্জুন উদ্ধার লীলা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এই দু'টি লীলাতেই ভগবান তাঁর ভক্তবশ্যতা প্রদর্শন করেছেন।
শ্রীল সনাতন গোস্বামীর মতে দামবন্ধন লীলাটি হয়েছিল দীপাবলি উৎসবের দিনে। তখন কৃষ্ণের বয়স ছিল ন্যূনাধিক তিন বছর চার মাস। শ্রীকৃষ্ণ তখন গোকুল মহাবনে ছিলেন। শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তীপাদের মতে শ্রীকৃষ্ণ গোকুলে ছিলেন তিন বছর চার মাস। তারপর নন্দবাবা বৃন্দাবনে যমুনার পশ্চিম তীরে ছটিকরাতে চলে যান। সেখানে আরো তিন বছর চার মাস থাকার পর কাম্যবন এবং পরিশেষে নন্দগ্রামে অবস্থান করেন।
একদিন মাতা যশোদা চিন্তা করছিলেন যে, কৃষ্ণ কেন অন্যান্য গোপীদের দধি, নবনীত ইত্যাদি চুরি করছে। নিশ্চয়ই তাঁর ঘরের তৈরি মাখন সুস্বাদু লাগছে না।


এখানে যশোদা নামের অর্থটি খুবই প্রাসঙ্গিক। যশোদা- যিনি যশ দান করেন। মা যশোদাই কৃষ্ণকে ভক্তবশ্যতার যশ প্রদান করেছেন।



মহীয়সী যশোদা মাতাই ঠিক করলেন যে, তিনি আজ নিজেই দধি মন্থন করবেন। কৃষ্ণ তখনও ঘুম থেকে ওঠেন নি। এদিকে রোহিনী দেবীও বলরামকে নিয়ে উপানন্দের বাড়িতে নিমন্ত্ৰণ রক্ষাৰ্থে গিয়েছেন। তাই তিনি গৃহপরিচারিকাদের অন্যান্য কৰ্মে নিযুক্ত করে নিজেই দধি মন্থন করতে বসলেন। নন্দ বাবার নবলক্ষ গাভী ছিল। তার মধ্যে সাত-আটটি গাভী ছিল দুপ্ৰাপ্য পদ্মগন্ধিনী গাভী। তাদেরকে বিশেষ প্রকারের ঔষধি ও সুগন্ধি তৃণগুল্মাদি খাওয়ানো হতো। যশোদা মাতা ভাবলেন, হয়তো দাসীরা ভালভাবে দধি মন্থন করছে না। এজন্য কৃষ্ণের মধ্যে ভয়ংকর চৌর্যবৃত্তি দেখা দিয়েছে। তিনি আপন মনে দধি মন্থন করছিলেন আর ইতিমধ্যে সংঘটিত বিভিন্ন কৃষ্ণলীলা গান করছিলেন।

এখানে শ্রীল প্রভুপাদ বলছেন, যাঁরা চব্বিশ ঘন্টা কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত থাকতে চান, তাঁদের পক্ষে এই অভ্যাসটি আয়ত্ত করা কর্তব্য। কায়, মন ও বাক্য দ্বারাই সেবা করতে হয়। শ্রীমন্মহাপ্রভুও তাই বলছেন- "কি শয়নে, কি ভোজনে কিবা জাগরণে। অহর্নিশি চিন্ত কৃষ্ণ, বলহ বদনে।" আমরা সকল কাজ করার সময় মনে মনে- হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে॥ জপ করতে পারি।
শ্রীল শুকদেব গোস্বামী যশোদা মাতার রূপ ও গুণ বর্ণনা করছেন। মাতা যশোমতি যখন স্যাফরন হলুদ রঙের রেশমী কাপড় পরেছিলেন। এটি অতি পবিত্র কাপড়। দধিমন্থন কার্যে যেন কোনো অপবিত্র প্রভাব না পড়ে সেই জন্যই এই আয়োজন। খুব ভোরেই মা এই কাজটি শুরু করেছিলেন, যেন কৃষ্ণের নিদ্রাভঙ্গের আগেই মাখন তোলা যায়। তবুও দধি মন্থনজনিত পরিশ্রমের কারণে তিনি ঘর্মাক্ত ছিলেন। তাঁর সর্বাঙ্গ কম্পিত হচ্ছিল। মাথার ফুলের মালাটি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে খসে পড়ছিল।


এই দৃশ্য সম্পর্কে আচার্যেরা বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। কঙ্কন ও কুণ্ডল নৃত্যচ্ছলে মাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। 'যে হাত ভগবানের সেবায় ব্যস্ত, আমরা সেই হাতে থেকে ধন্য'- এই কথা বোঝাতে হাতের কঙ্কনদ্বয় অস্ফূট ঝন্ ঝন্ শব্দ করছে। কানের কুণ্ডলগুলো নেচে নেচে এটিই সূচিত করছে যে, মায়ের মুখে ভগবানের লীলাগান শুনে কান তার উৎপত্তির সার্থকতা লাভ করেছে। আর মস্তকের কবরীস্থিত মালতি পুষ্প খসে পড়ার মাধ্যমে বোঝাচ্ছে যে, "হায়! হায়! বাৎসল্য প্রেমের মূর্তিমতী মাতা যশোদার মস্তকে থাকার ঔদ্ধত্য কি আমাদের সাজে, তাঁর চরণ পেলেই ধন্য হব আমরা।" চিন্ময় জগতের সবকিছুই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তাই সবকিছুর পৃথক পৃথক অভিব্যক্তি রয়েছে। এদিকে মাতার হৃদয়ের স্নেহই স্তনদুগ্ধরূপে বহির্গত হচ্ছে। কেননা একবার সুস্বাদু নবনীত দেখে, কৃষ্ণ যদি স্তন্যপান না করে। এই ভয়েতে কৃষ্ণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আপনাআপনি দুগ্ধ নিঃসরিত হচ্ছে। আবার, কঙ্কনের ঝন্ ঝন্ শব্দ আর দধি মন্থনের ঘর ঘর শব্দ করতাল ও মৃদঙ্গ বাদ্যরূপে মায়ের মুখের কৃষ্ণলীলা গানের সহায়তা করছে। একারণেই আমরাও ভগবানের বিভিন্ন সেবা করে আনন্দ লাভ করি। কেননা, ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ইন্দ্রিয়াধিপতির সেবা করলেই তো ইন্দ্রিয়ের প্রকৃত তৃপ্তি লাভ করা যায়।


Post a Comment

0 Comments