দামবন্ধন লীলা পর্ব - ২
এদিকে কৃষ্ণ ঘরের ভেতর ঘুমিয়েছিলেন। আর ঘুম থেকে ওঠামাত্ৰই ক্ষুধার্ত হয়ে মা'কে খোঁজ করছিলেন। তখন মায়ের সুললিত কণ্ঠে গান শ্ৰবণ করে ভাবলেন, "আজ কি হলো! মা আমাকে রেখেই বিছানা থেকেই উঠে পড়েছে। আমার জন্য কি তার কোনো দুশ্চিন্তা নেই?” তাই, তিনি দু'খানি পদ্মহস্ত দ্বারা নেত্রযুগল মাৰ্জনা করতে করতে সেই দধি মন্থন স্থানে এলেন।
মা যশোমতির কি প্ৰগাঢ় সেবানিষ্ঠা। এদিকে কৃষ্ণ এসে দাঁড়িয়ে আছেন, তার কোন খেয়াল নেই। কৃষ্ণ ভাবলেন, আমার কিছু করা দরকার। তাই, সরাসরি মন্থন দণ্ডকে চেপে ধরলেন। কেননা, জ্ঞানীরা অগাধ শাস্ত্ৰরাজি মন্থন করে পরিশেষে কৃষ্ণকেই পায়। আর কৃষ্ণ এখানে সাক্ষাৎ দণ্ডায়মান। তাই, মন্থনকাৰ্য থামানোর মাধ্যমে যশোদা মায়ের সাধনার পূৰ্ণতার ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
মা অবশ্য চেষ্টা করছিলেন, “একটু সবুর কর বাছা; অল্প একটু মাখন তুলে নেই।” “না, আমি এখুনি দুধ খাব”। এই না বলে জোর করে মায়ের কোমরে জাপটে ধরে, জানুর উপর পা দিয়ে কোলে উঠে পড়লেন। আর স্তন্য থেকে স্বতঃনিঃসরিত দুগ্ধধারা আস্বাদনে মনোযোগ দিলেন। মা তখন কৃষ্ণের নয়নাভিরাম সুমধুর মুখপানে তাকিয়ে রইলেন।
কিন্তু সামনেই বৃহৎ চুল্লীর উপরে পদ্মগন্ধা গাভীর দুধ গরম করা হচ্ছিল। দুধ তখন ভাবল, "একি, পরস্পরের যেন প্রতিযোগিতা চলছে। হায়, স্নেহময়ী মা যশোদার দুগ্ধতো কখনো ফুরাবে না, আর প্রেমবুভুক্ষু শ্রীকৃষ্ণের তৃষ্ণাও তো মিটবে না। তবে, আমার কি হবে? যুগ যুগ ধরে সেই অধর স্পর্শ লাভের তপস্যা করছি, আর পেট ভরে গেলে তো কৃষ্ণ আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না। এ জীবন কৃষ্ণের সেবায় লাগলো না। বেঁচে থেকে কি লাভ বরং তাঁর সামনেই অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে বসি।" এই বলে অগ্নিতাপে স্ফীতা দুগ্ধ পাত্রের গা বেয়ে উপচে পড়তে লাগলো। মা হঠাৎ করে তা খেয়াল করলেন, আর সাথে সাথে দুধ নামানোর জন্য অতৃপ্ত কৃষ্ণকে কোল থেকে নামিয়ে মেঝেতে রেখে দৌঁড় দিলেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে মা যশোদার স্নেহ কি রকম? মনে হয়, কৃষ্ণের চেয়ে দুধের প্রতিই তাঁর মমতা। নতুবা তিনি কেন অতৃপ্ত অবস্থায় কৃষ্ণকে ফেলে চলে গেলেন? এর উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ, প্রেমী ভক্তের কাছে ভগবান 'পুরুষার্থ' নন, ভগবানের সেবাই 'পুরুষার্থ' শিরোমণি। একটু পরেই কৃষ্ণ এসে বলতে থাকবে, "দুধ দাও, নবনীত দাও"। তাই দুগ্ধ রক্ষার প্রতি এতো মনোযোগ।
এদিকে দুধ ভাবল, "একি! আমার মতো পাপিষ্ঠ আর কোথাও নেই। আমার জন্য আজ যশোদা মাতা ও কৃষ্ণের প্রেম আদান-প্রদান ব্যাহত হলো।" তাই সেও শান্ত হয়ে পড়ল।
এইভাবে তাঁকে ফেলে চলে যাবার ফলে মায়ের ওপর ভীষণ রাগ হলো। এখানে দেখার বিষয় এই যে, যদিও ভগবান 'আত্মারাম' ও 'আত্মকাম', তবে তিনি ক্রুদ্ধ হলেন কেন? মা যশোদার প্রীতিবন্ধনে তিনি যে কতটুকু আবিষ্ট সেটা একটু পরেই প্রমাণ করবেন সেজন্য। ক্রোধবশত, তাঁর অরুণবর্ণ ঠোঁটে সাদা দুধের দাঁত দিয়ে তিনি কামড় দিচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন, “মা তুমি এতো কৃপণ, আজ দুধ-ই তোমার কাছে বড় হয়ে দাঁড়ালো। আমি কতো ক্ষুধাৰ্ত, আমার জন্য কোনো চিন্তাই নেই। আমি বৈকুণ্ঠ ধাম ছেড়ে তোমাদের কাছে এসেছি। আর সামান্য দুধের জন্য এটি করতে পারলে! ঠিক আছে, মজা দেখাচ্ছি।” এই বলে কপট অশ্রু মোচন করতে করতে নিকটস্থ পেষণী (নোড়া- মশলা বাটাতে ব্যবহৃত) দিয়ে দধিভাণ্ডটি ভেঙ্গে ফেললেন। দধিভাণ্ডটিও আবার তলদেশ দিয়ে ভাঙ্গলেন যেন, বড় ধরনের শব্দ না হয়। আর সদ্যোজাত নবনীত খেতে খেতে পাশের ঘরে চলে যেতে লাগলেন। আর ভাবলেন, “যদি তোমার কোলে না রাখো, তবে আমি কোনো খল ব্যক্তির কাছে চলে যাব।” তাই সেখানে গিয়ে উল্টোভাবে রাখা উদুখলের উপর বসে বানরদেরকে শিখায় রাখা মাখন বিতরণ করছিলেন। আর চুরি করার ফলে ভীত সন্ত্ৰস্ত হওয়ার ফলে, শঙ্কিত নেত্ৰে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন। আচার্যেরাও ভাবছেন, হয়তো রাম অবতারের কথা স্মরণ হয়েছে, তখন কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই বানরদের কাজে লাগানো হয়েছে। তাই, এদেরকে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কিছু দেওয়া উচিত। আবার, এটাও হতে পারে যে, ক্ৰোধবশতঃ দধিভাণ্ড ভাঙ্গার অপরাধের প্রায়শ্চিত্তই এই দানব্ৰত।
মা যশোদা চুলা থেকে গরম দুধ নামিয়ে রেখে, দধি মন্থন স্থানে ফিরে এসে দেখলেন যে, দধিভাণ্ড ভগ্ন হয়েছে এবং সেখানে কৃষ্ণকে না দেখতে পেয়ে তিনি স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, সেটি কৃষ্ণেরই কাৰ্য। আবার ঘরে স্থিত দধির মধ্যে ছোট ছোট পায়ের ছাপ দেখতে পেয়ে হাসলেন। একটি ছোট ছড়ি নিয়ে পেছন দিকে লুকিয়ে, আস্তে আস্তে কৃষ্ণের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
শ্ৰীকৃষ্ণ যখন দেখলেন যে, মা ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তখন তিনি উদুখল থেকে লম্ফ প্ৰদান করে দ্ৰুত বেগে পলায়ন করেছিলেন, যেন তিনি অত্যন্ত ভীত হয়েছেন। আর যোগীরা মনের গতিতে যাঁর দিকে ধাবিত হয়েও তাঁকে প্রাপ্ত হয় না, তাঁকে ধরবার জন্য মা যশোদা ছড়ি হাতে পশ্চাদ্ধাবন করছেন। কৃষ্ণ জানতেন যে, আজ মা যদি ধরতে সক্ষম হয়, তবে আর রক্ষা নেই। কেননা আজ অনেকগুলো দুষ্কৰ্ম করা হয়েছে। তাই, সৰ্বগ্রাসী কাল যাঁর ভয়ে ভীত, সেই ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ আজ ভীত শঙ্কিত হয়ে পলায়ন করছেন। (চলবে)
0 Comments