স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে এই কলিযুগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন, সেই সম্পর্কে শাস্ত্রীয় যুক্তি কি?

প্রশ্নঃ স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে এই কলিযুগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন, সেই সম্পর্কে শাস্ত্রীয় যুক্তি কি?

উত্তরঃ প্রায় সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রসম্ভারে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তার অসংখ্য প্রমাণ পরিলক্ষিত হয়।‌ সেই জন্য শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে ঘোষণা করা হয়েছে---
ভাগবত, ভারতশাস্ত্র, আগম, পুরাণ।
চৈতন্য কৃষ্ণ-অবতার প্রকট প্রমাণ॥
প্রত্যক্ষে দেখহ নানা প্রকট প্রভাব।
অলৌকিক কর্ম, অলৌকিক অনুভাব॥
দেখিয়া না দেখে যত অভক্তের গণ।
উলূকে না দেখে যেন সূর্যের কিরণ॥
(চৈঃ চঃ আদি ৩/৮৩-৮৫)

শ্রীঅথর্ববেদে শ্রীব্রহ্মা মহর্ষি পিপ্পলাদকে বলেছেন-- "রহস্যং তে বদিষ্যামি,--জাহ্নবীতীরে নবদ্বীপে গোলোকাখ্যে ধাম্নি গোবিন্দো দ্বিভুজো গৌরঃ সর্বাত্মা মহাপুরুষো মহাত্মা মহাযোগী ত্রিগুণাতীতঃ সত্ত্বরূপো ভক্তিং লোকে কাশ্যতীতি।"
অর্থাৎ, "এক পরম নিগূঢ় তত্ত্ব তোমাকে বলব। সকলের আত্মস্বরূপ, মহাপুরুষ, পরমাত্মাস্করূপ মহাযোগী, ত্রিগুণাতীত, বিশুদ্ধ সত্ত্বময়, দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর স্বয়ং জাহ্নবীতীরে গোলোকাখ্য নবদ্বীপ ধামে শ্রীগৌরসুন্দররূপে অবতীর্ণ হয়ে জগতে ভক্তি প্রকাশ করবেন।"
শ্রীমৎস্য পুরাণে ভগবান বলেছেন---
মুণ্ডো গৌরঃ সুদীর্ঘাঙ্গস্ত্রি স্রোতস্তীর সম্ভবঃ।
দয়ালু কীর্তনগ্রাহী ভবিষ্যামি কলৌযুগে ॥

"আমি কলিযুগে গঙ্গাতটে সুদীর্ঘ গৌরাঙ্গরূপে প্রকটিত হয়ে জগতের প্রতি করুণাবশত মুণ্ডিতমস্তক সন্ন্যাসীবেশে সকলকে যুগধর্ম হরিনাম সংকীর্তন
করাব।"

শ্রীকূর্ম পুরাণে ভগবান বলছেন---
কলিনা দহ্যমানানামুদ্ধারাম মহীতলে।
জন্ম প্রথম সন্ধ্যায়াং প্রহীষ্যানি দ্বিজাতিষু॥

"কলিকবলিত জনগণকে উদ্ধার করবার জন্য আমি কলিকালের প্রারম্ভে পৃথিবীতে ব্রাহ্মণকুলে আবির্ভূত হব।"
শ্রীবৃহন্নারদীয় পুরাণে শ্রীভগবানের উক্তি---
অহমেব কলৌ বিপ্র নিত্যং প্রচ্ছন্ন বিগ্রহঃ।
ভগবদ্ভক্তরূপেন লোকান্ রক্ষামি সর্বদা॥
দিবিজা ভুবি জায়ধ্বং ভক্তরূপিনঃ।
কলৌ সংকীর্তনারন্তে ভবিষ্যামি শচীসূতঃ॥

"হে বিপ্র, আমি কলিকালে ভগবদ্ভক্তরূপে প্রচ্ছন্ন মূর্তিতে সকল লোককে নামপ্রেম প্রদান করত রক্ষা করব। হে দেবতাগণ, তোমরা সকলে শীঘ্র পৃথিবীতে ভক্তরূপে জন্মগ্রহণ কর। আমি কলিকালে শচীপুত্ররূপে প্রকটিত হয়ে জগতে হরিনাম সংকীর্তন প্রবর্তন করব।"
শ্রীপদ্ম পুরাণে শ্রীভগবান উল্লেখ করেছন---
কলৌ প্রথম সন্ধ্যায়াং গৌরাঙ্গঽহং মহীতলে।
ভাগীরথীতটে ভূম্নি ভবিষ্যামি সনাতনঃ॥

"আমি কলিযুগ প্রারম্ভে গঙ্গাতটে শ্রীনবদ্বীপে শ্রীগৌরাঙ্গরূপে প্রকটিত হব।"
শ্রীগুরুড় পুরাণে ভগবানের উক্তি---
অহং পূর্ণো ভবিষ্যামি যুগো সন্ধৌ বিশেষতঃ।
মায়াপুরে নবদ্বীপে ভবিষ্যামি শচীসূতঃ॥


"আমি যুগসন্ধিতে অর্থাৎ, কলির প্রারম্ভে শ্রীনবদ্বীপে মায়াপুরে শচীনন্দন শ্রীগৌরাঙ্গ স্বয়ং পূর্ণস্বরূপে প্রকটিত হব।"
শ্রীভবিষ্য পুরাণে শ্রীভগবান বলছেন---
আনন্দাশ্রুকলারোমহর্ষপূর্ণং তপোধন।
সর্বে মামেব দ্রক্ষ্যন্তি কলৌ সন্ন্যাসিরূপিনম্॥

"হে তপোধন! কলিকালে আমাকে সকলে প্রেমানন্দে বিহ্বল সন্ন্যাসীরূপে দেখতে পাবে।"
শ্রীবামন পুরাণে শ্রীভগবান বলছেন---
কলিঘোর তমশ্ছন্নান্ সর্বানাচারবর্জিতান্।
শচীগর্ভে সম্ভবায় তারয়িষ্যামি নারদ ॥

"হে নারদ! আমি শচীগর্ভে প্রকটিত হয়ে আচারবিহীন কলিহত জনগণকে উদ্ধার করব।"
শ্রীদেবী পুরাণে উল্লেখ রয়েছে---
নাম-সিদ্ধান্ত সম্পত্তি প্রকাশন পরায়ণঃ।
ক্বচিৎ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নামা লোকে ভবিষ্যতি ॥

"কোন সময় ভগবান শ্রীহরি নামসংকীর্তনরূপ পরম-সম্পত্তি বিতরণের জন্য জগতে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য রূপে প্রকাশিত হবেন।"
শ্রীভবিষ্য পুরাণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উক্তি---
অজায়ধ্বমজায়ধ্বমজায়ধ্বং ন সংশয়ঃ।
কলৌ সঙ্কীর্তনারম্ভে ভবিষ্যামি শচীসুতঃ॥

"কলিযুগে সংকীর্তনারম্ভে আমি শচীদেবীর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করব, জন্মগ্রহণ করব, জন্মগ্রহণ করব। এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।"
শ্রীমার্কণ্ডেয় পুরাণে নির্দেশ রয়েছে---
গোলোকং চ পরিত্যক্তা লোকানাং ত্রাণকারণাৎ।
কলৌ গৌরাঙ্গরূপেন লীলালাবণ্য বিগ্রহঃ॥

"লীলাময় বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র কলিযুগে জীবদের উদ্ধারের জন্য গোলোক থেকে ভূলোকে শ্রীগৌরাঙ্গরূপে অবতীর্ণ হন।"
শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/৫/৩২) বলা হয়েছে---
কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষাঽকৃষ্ণ সাঙ্গোপাঙ্গাস্ত্রপার্ষদম্।
যজ্ঞৈঃ সংকীর্তনপ্রায়ৈর্যজন্তি হি সুমেধসঃ॥

"যাঁর মুখে সর্বদা 'কৃষ্ণ' এই দুটি বর্ণ, যাঁর অঙ্গকান্তি অকৃষ্ণ অর্থাৎ, গৌর, সেই অঙ্গ উপাঙ্গ অস্ত্র ও পার্ষদ পরিবেষ্টিত মহাপুরূষকে সুবুদ্ধিমান ব্যক্তিগণ সংকীর্তনপ্রধান যজ্ঞ দ্বারা আরাধনা করেন।"
মহাভারতে কলিযুগে ভগবান সম্বন্ধে বলা হয়েছে---
সুবর্ণবর্ণো হেমাঙ্গো বরাঙ্গশ্চন্দনাঙ্গদী।
সন্ন্যাসকৃচ্ছমঃ শান্তো নিষ্ঠাশান্তিপরায়ণঃ॥

"সুবর্ণ বর্ণ, সুগলিত হেমবৎ অঙ্গ, সর্বাঙ্গ সুন্দর গঠন, চন্দন ও মালা শোভিত----এই চারটি গৃহস্থলীলায় লক্ষিত। সন্ন্যাস আশ্রয়, হরিরহস্য অালোচনারূপ শমগুণ বিশিষ্ট, হরিকীর্তনরূপ মহাযজ্ঞে সুদৃঢ়নিষ্ঠ, কেবলাদ্বৈতবাদীর, অভক্তিনিবৃত্তিকারি শান্তিলব্ধ মহাভাব পরায়ণ।"
শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/৮/১৩) উল্লেখ রয়েছে---
আসন্ বর্ণাস্ত্রয়ো হাস্য গৃহ্নতোঽনুযুগং তনূঃ।
শুক্লো রক্তস্তথা পীত ইদানীং কৃষ্ণতাং গতঃ॥

শ্রীগর্গ মুনি শ্রীনন্দ মহারাজকে বলছেন--- "হে নন্দ! তোমার এই বালক শুক্ল, রক্ত ও পীত (গৌর) বর্ণ অন্য তিন যুগে ধারণ করেন। অধুনা দ্বাপরে কৃষ্ণবর্ণ প্রাপ্ত হয়েছেন"।
আদি পুরাণে ভগবান বলছেন---
অহমেব দ্বিজশ্রেষ্ঠ নিত্যং প্রচ্ছন্নবিগ্রহঃ।
ভগভদ্ভক্তরূপেণ লোকান্ রক্ষামি সর্বদা#

"হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! আমার এই প্রচ্ছন্ন বিগ্রহ নিত্য। আমিই নিজরূপ গোপনপূর্বক ভগবদ্ভভক্তরূপে লোকসমূহে ধর্ম স্থাপন করে সর্বদা তাদের রক্ষা করি।"
শ্রীমদ্ভাগবতে (৭/৯/৩৮) উল্লেখ রয়েছে---
ইত্থং নৃতির্যগৃষিদেবঝষাবতারৈ-
র্লোকান্ বিভাবয়সি হংসি জগৎপ্রতীপান্।
ধর্মং মহাপূরুষ পাসি যুগানুবৃত্তং
ছন্নঃ কলৌ যদভবস্ত্রিষুগোঽথ স ত্বম্॥

শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজ শ্রীভগবানকে বলছেন, "হে কৃষ্ণ! তুমি এই প্রকারে নর, তির্যক, ঋষি, দেব, মৎস্য ইত্যাদি অবতাররূপে লোকদের পালন কর এবং জগৎশত্রুদের বিনাশ কর। হে মহাপুরুষ! কলিকালে যুগানুবৃত্ত নামসংকীর্তন ধর্ম ছন্নভাবে প্রচার করবে। এই জন্য তোমার নাম ত্রিযুগ। কেননা প্রচ্ছন্ন-অবতার কোন শাস্ত্র সহজে প্রকাশ করেন না।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে---
সেই কৃষ্ণ অবতারী ব্রজেন্দ্র কুমার।
আপনে চৈতন্যরূপে কৈল অবতার॥
(চৈঃ চঃ আদি ২/১০৯-১১০)

উপপুরাণে উল্লেখ রয়েছে---
অহমেব ক্বচিদ্ ব্রহ্মন্ সন্ন্যাসাশ্রমমাশ্রিত।
হরিভক্তি গ্রাহয়ামি কলৌ পাপহতান্নরান্॥

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মহর্ষি ব্যাসদেবকে বলছেন, "হে ব্রাহ্মণ, আমি বিশেষ কলিযুগে অধঃপতিত পাপী মানুষদের হরিভক্তি প্রদান করবার জন্য সন্ন্যাস অাশ্রম গ্রহণ করি"।
শ্রীচৈতন্যমঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে---
যেই দ্বাপরে হয় কৃষ্ণ-অবতার।
সেই কলিযুগে গৌরচান্দ্রের প্রচার॥
(চৈঃ মঃ আদি ৫৮৬)

দ্বাপর যুগে অভক্ত অসুরেরা সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলে মনে করত না। তারা তাঁকে সাধারণ মানুষরূপে চিন্তা করেছিল। কলিযুগের মহাবদান্য অবতার শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুকে অভক্ত ও আসুরিক ব্যক্তিরা পরমেশ্বর ভগবান বলে মনে করবে না। তাই--
শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী লিখেছেন---
কৃষ্ণ নাহি মানে তা'তে দৈত্য করি' মানি।
চৈতন্য না মানিলে তৈছে দৈত্য তা'রে জানি॥
হেন কৃপাময় চৈতন্য না ভজে যেই জন।
সর্বোত্তম হইলেও তা'রে অসুরে গণন॥
(চৈঃ চঃ আদি ৮/৯, ১২)

শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে স্তুতি করছেন এইভাবে---
নমো মহাবদান্যায় কৃষ্ণপ্রেমপ্রদায়তে।
কৃষ্ণায় কৃষ্ণচৈতন্যনাম্নে গৌরত্বিষে নমঃ॥

"মহাবদান্য, কৃষ্ণপ্রেম প্রদাতা, কৃষ্ণস্বরূপ, কৃষ্ণচৈতন্যনামা, গৌরাঙ্গরূপধারী প্রভূকে নমস্কার।" অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর গুণ হচ্ছে মহাবদান্যতা, তাঁর লীলা--কৃষ্ণপ্রেম প্রদান, তিনি তত্ত্বত কৃষ্ণ, তাঁর নাম--কৃষ্ণচৈতন্য, তাঁর রূপ--গৌরবর্ণ।

Post a Comment

0 Comments