আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম - শ্রীমৎ গোপালকৃষ্ণ গোস্বামী মহারাজ
ইসকনের বর্তমান আচার্যগণের অন্যতম শ্রীমৎ গোপালকৃষ্ণ গোস্বামী মহারাজের পূর্বাশ্রমের নাম ছিল গোপালকৃষ্ণ সিং। ১৯৪৪ সনের ১৪ আগস্ট তারিখে, পবিত্র অন্নদা একাদশী তিথিতে, এক পাঞ্জাবী পরিবারে ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লীতে আবির্ভূত হন। তাঁর স্কুল ও কলেজ জীবন অতিবাহিত হয় নতুন দিল্লীতেই। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হবার পর ফরাসী সরকারের মেধা বৃত্তি প্রাপ্ত হয়ে তিনি প্যারীসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীকালে মন্ট্রিলের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে স্নাতোকত্তর ডিগ্রীও লাভ করেন।
বিদেশে থাকাকালীন সময়েই গোপালকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের কয়েকজন ভক্তের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি তাঁদের কাছে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) প্রতিষ্ঠাতা আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের কথা শুনেছিলেন এবং তাঁকে দর্শন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। একসময় তৎকালীন মন্ট্রিলের ইসকন কেন্দ্রের অধ্যক্ষ তাঁকে জানান যে, ১৯৬৮ সনের ১ জুন শ্রীল প্রভুপাদ মন্ট্রিলে আসছেন। সেই তথ্য অনুসারে দু'দিন আগে অর্থাৎ ৩০মে গোপালকৃষ্ণ মন্ট্রিল ইসকন মন্দিরে চলে আসেন। ঐ দিন কীর্তনের পর গোপালকৃষ্ণ ভক্তদের কাছে অনুসন্ধান করেন তিনিও কোন সেবা করতে পারেন কিনা! তাঁকে তৎক্ষণাৎ শ্রীল প্রভুপাদের কক্ষটি পরিষ্কার করার জন্য প্রেরণ করা হয়। পরবর্তীকালে শ্রীমৎ গোপালকৃষ্ণ মহারাজ জানিয়েছেন যে, এইভাবে ভক্তি জগতের প্রথম সেবায় শ্রীল প্রভুপাদের কক্ষ পরিষ্কারে নিয়োজিত হয়ে তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছিলেন। তিনি শ্রীল প্রভুপাদের কক্ষের জানালা, দরজা এবং আলমারির তাক্ সমূহ পরিষ্কার করেছিলেন। এইভাবে তাঁর গুরুমহারাজ শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্বেই শ্রীল প্রভুপাদের প্রতি তাঁর সেবা মনোভাব প্রকাশিত হয়েছিল। অবশেষে ১ জুন ১৯৬৮, সন্ধ্যায় শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে গোপালকৃষ্ণ প্রথম মিলিত হলেন। শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে সাক্ষাতের দু'সপ্তাহের মধ্যেই তরুণ গোপালকৃষ্ণ ঠিক করলেন যে শ্রীল প্রভুপাদকেই তিনি তাঁর পরমারাধ্য গুরু মহারাজ রূপে গ্রহণ করবেন। পরবর্তীতে শ্রীমৎ গোপালকৃষ্ণ গোস্বামী মহারাজ বলেছেন, "যখন আমি প্রথম শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে মিলিত হই, ভগবানের কাছে আত্মসমর্পিত হওয়ার উদ্দেশ্যটি ইতিমধ্যে আমার মধ্যে ছিল, আর তাঁর সঙ্গে মিলিত হবার দু'সপ্তাহ পরে আমি বুঝেছিলাম যে শ্রীকৃষ্ণ চাইছেন আমি শ্রীল প্রভুপাদের কাছে শরণাগত হই।"
শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে প্রকৃতপক্ষে ১৯৬৭ সনের ডিসেম্বর মাস থেকেই পরম সত্য বা ভগবানকে অবগত হওয়ার জন্য বহু হিন্দু মন্দির, গুরুদ্বার এবং চার্চে যাতায়াত শুরু করেছিলেন। প্রতি রবিবারেই তিনি এই উদ্দেশ্যে এই রকম কোন না কোন স্থানে অতিবাহিত করতেন।
অনেক ভারতীয়ই শ্রীল প্রভুপাদকে দর্শন করতে আসতেন। তারা সকলেই শ্রীল প্রভুপাদকে প্রণতি নিবেদন করে অল্প কিছুক্ষণ বসে চলে যেতেন। কিন্তু সেই সময় তরুণ গোপালকৃষ্ণ ছিলেন একমাত্র ভারতীয়, যিনি নিয়মিতভাবে শ্রীল প্রভুপাদের কাছে আসতেন এবং তাঁর প্রবচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকতেন। সেবার, যেবার শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে তরুণ বয়সী গোপালকৃষ্ণের প্রথম দেখা হল, শ্রীল প্রভুপাদ মন্ট্রিলে তিনমাস অবস্থান করেছিলেন। ঐ সময় প্রসঙ্গে শ্রীমৎ গোপালকৃষ্ণ গোস্বামী মহারাজ বলেন, "আমি সেই সময় শ্রবণের গুরুত্ব বিষয়ে কিছুই জানতাম না, আমার একমাত্র যোগ্যতা ছিল আমি শ্রীল প্রভুপাদকে দর্শনের প্রথম দিন থেকেই তাঁর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলাম এবং তাঁর প্রবচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকতাম আর তিনি মন্দির ছেড়ে চলে যাওয়ার পরই কেবল চলে যেতাম।"
সেই সময় তরুণ গোপালকৃষ্ণ আমেরিকায় পেপসি কোলায় কর্মরত ছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রতি শ্রীল প্রভুপাদ ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই শ্রীল প্রভুপাদ গোপালকৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলতেন। সেই থেকে উভয়ের মধ্যে পত্র বিনিময় শুরু হয় নিয়মিতভাবে। প্রতিমাসে শ্রীল প্রভুপাদ গোপালকৃষ্ণকে তিনখানি দীর্ঘ পত্র লিখতেনই। ফলে, ইতিমধ্যে তাঁদের দুজনের মধ্যে গুরু শিষ্যের এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছিল।
১৯৬৯ সনের ২৭ যে শ্রীল প্রভুপাদ এক চিঠি দিয়ে জানালেন, "যেহেতু তোমার নাম ইতিমধ্যেই গোপালকৃষ্ণ, তাই সেটি পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। এখন থেকে তুমি গোপালকৃষ্ণ দাস নামে পরিচিত হবে।" সেই সময় গোপালকৃষ্ণ দাস প্রভুর বয়স মাত্র ২৫ বৎসর। এরপর সম্পূর্ণভাবে শ্রীল প্রভুপাদের সেবায় নিয়োজিত হবার জন্য গোপালকৃষ্ণ প্রভু সবকিছু ছেড়ে মন্দিরে চলে আসেন এবং বেশ কয়েক বৎসর শ্রীল প্রভুপাদের ব্যক্তিগত সচিব রূপে সেবা করেছেন। ১৯৭৫ সনে শ্রীল প্রভুপাদ গোপালকৃষ্ণ প্রভুকে ভারতে প্রেরণ করেন এবং ১৯৭৫-৭৬ সনের জন্য তাঁকে সমগ্র ভারতের জিবিসি অর্থাৎ গভর্নিং বডি কমিশনার নিযুক্ত করেন। শ্রীল প্রভুপাদ বিশেষভাবে তাঁকে ভারতে গ্রন্থ প্রকাশ ও বিতরণ বর্দ্ধিত করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এছাড়াও তাঁর ঐকান্তিক সেবা মনোভাব দেখে শ্রীল প্রভুপাদ তাঁকে বৃন্দাবন, হায়দ্রাবাদ, মায়াপুর ও মুম্বাইয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের দেখভাল করার কাজে নিযুক্ত করেন।
পরবর্তীকালে শ্রীমৎ গোপালকৃষ্ণ গোস্বামী মহারাজ বলেছেন "ভারতে গ্রন্থ মুদ্রণ ও তার বিস্তৃতির বিষয়ে শ্রীল প্রভুপাদ খুবই চিন্তিত ছিলেন। ভারতে আমাকে প্রেরণের প্রথম দু'বছর শ্রীল প্রভুপাদ বার বার আমাকে আরও এবং আরও গ্রন্থ মুদ্রণের জন্য জোর করেছিলেন। আমি যখন তাঁকে শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধের হিন্দী সংস্করণটি উপস্থাপন করেছিলাম শ্রীল প্রভুপাদ অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।"
১৯৭৬ সালে শ্রীল প্রভুপাদ গোপালকৃষ্ণ দাস প্রভুকে রাশিয়ার জিবিসি নিযুক্ত করেন। এইজন্য তাঁকে তৎকালীন কম্যুনিষ্ট রাশিয়ায় ঝুঁকি নিয়ে বেশ কয়েকবার যেতে হয়েছিল। শ্রীল প্রভুপাদের নির্দেশে তিনি ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার'এও অংশ গ্রহণ করেছিলেন। শ্রীল প্রভুপাদের নির্দেশ ছিল তাঁর জীবন স্বরূপ। সোভিয়েত ইউনিয়নে কম্যুনিষ্ট শাসনের পতনের পর যখন ধর্মীয় স্বাধীনতা অনুমোদিত হল তখন বিভিন্ন স্থানে ইসকন কেন্দ্র স্থাপনে তিনি সাহায্য করেছিলেন।
১৯৮১ সনে শ্রীপাদ গোপালকৃষ্ণ দাস প্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করে শ্রীমৎ গোপালকৃষ্ণ গোস্বামী রূপে পরিচিত হন। তারও প্রায় এক বৎসর পরে ১৯৮২ সনের মার্চ মাসে পবিত্র গৌরপূর্ণিমার দিন থেকে শ্রীমৎ গোপালকৃষ্ণ গোস্বামী মহারাজ ইসকনের অন্যতম দীক্ষাগুরু হন।
বর্তমানে শ্রীমৎ গোপালকৃষ্ণ গোস্বামী মহারাজ মুম্বাই, উত্তর ভারত (নতুন দিল্লী, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, বৃন্দাবন, চণ্ডীগড় সহ), মায়াপুর, কেনিয়া, কানাডা, আমেরিকার কিছু রাজ্য, ও কমনওয়েলথ দেশভুক্ত রাষ্ট্র সমূহের অন্যতম জিবিজি। তিনি পৃথিবীর বৃহত্তম বৈদিক সাহিত্য প্রকাশক ও বিতরক 'ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাষ্ট' এর ট্রাষ্টি ও চেয়ারম্যান।
১৯৭৭ সনে শ্রীল প্রভুপাদের অপ্রকটের পর ইসকন যে সকল প্রকল্পগুলি শ্রীমৎ গোপালকৃষ্ণ গোস্বামী মহারাজের দায়িত্ব ও প্রেরণায় সম্পূর্ণ হয়েছে সেগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৯৯৪ সনে আফ্রিকার নাইরোবিতে শ্রীশ্রীরাধা-বাঁকেবিহারী মন্দির, ১৯৯৮ সনে নতুন দিল্লীতে শ্রীশ্রীরাধা-পার্থসারথি মন্দির, ২০০৩ সনে মুম্বাইয়ে 'হেভেন অন আর্থ' প্রকল্প, ২০০৪ সনে শ্রীশ্রী লুধিয়ানায় শ্রীশ্রীজগন্নাথ মন্দির, ২০০৭ সনে ফরিদাবাদে শ্রীশ্রীরাধা-গোবিন্দ মন্দির, ২০০৭ সনে নিউ দিল্লীর পশ্চিমভাবে পাঞ্জাবীবাগ অঞ্চলে শ্রীশ্রীকৃষ্ণবলরাম মন্দির এবং ২০০৮ সনে গাজিয়াবাদে শ্রীশ্রীজগন্নাথ মন্দির।
1 Comments
ধন্যবাদ
ReplyDeleteভালো লাগা তথ্য পেশ করার জন্য।
https://cutt.ly/uvkygXA এখান থেকেও অনেক কিছু জানতে পারলাম