পরম পবিত্র কার্তিক মাস ভক্তিলাভের অনন্য সুযোগ

পরম পবিত্র কার্তিক মাস ভক্তিলাভের অনন্য সুযোগ

শ্রীশ্রীরাধা-দামোদরের প্রিয় মাস কার্তিক। কার্তিক ব্রত সম্বন্ধে স্কন্দ পুরাণে ব্রহ্মা নারদকে বলেছিলেন, দুর্লভ মনুষ্য জন্ম পেয়ে যে ব্যক্তি কার্তিক ব্রত করেনা, সে নিতান্ত অভাগা বলে পরিগণিত হয়। এই বৈষ্ণব ব্রত না করলে জপ তপস্যা বিফল হয়, সাত জন্মের অর্জিত পুণ্য বৃথা যায়। সমস্ত তীর্থে স্নান ও সমস্ত বস্তু দানে যে ফল, কার্তিক ব্রতের কোটি অংশের একাংশেরও তার সমান হয় না। কার্তিক মাসে শ্রীহরির যা কিছু পুণ্য করা হয় তা অক্ষয় থাকে। এই মাসে পাপকর্মেরও ক্ষয় নেই। পদ্মপুরাণে নারদ মুনি শৌনক প্রমুখ মুনিদের বলেছিলেন, ভারতবর্ষে যে মানুষ শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় কার্তিক মাস নিয়ম ছাড়া অতিবাহিত করে, সে হাতের কাছে চিন্তামণি পেয়ে কাদাজলে নিক্ষেপ করে। দেবতা, ঋষি ও পিতৃগণ কার্তিক মাসের সেবা করেন। তাই কার্তিক ব্রত করলে অতি অল্পেও লোকের মহাফল লাভ হয়।
রাতের শেষ প্রহরে হরি জাগরণ, স্তুতি ও গান, প্রাতঃস্নান, শ্রীহরির পূজা-অর্চনা, হরিনাম জপ, গীতা অধ্যয়ন, মন্দির প্রদক্ষিণ, শ্রীহরির সম্মুখে নৃত্য গীত করা, ব্রহ্মচর্য পালন, ভূমিতে শয়ন, দিবা ভাগে একবার হবিষ্য ভোজন - এইগুলি হচ্ছে ব্রতের নিয়ম।
Image may contain: 2 people, flowerভগবান শ্রীদামোদরের প্রিয় মিছরি ও ঘি যুক্ত পায়েস নৈবেদ্য প্রসাদ ভক্তদের মধ্যে ভাগ করে নিজে ভোজন করতে হয়। শ্রীহরির নৈবেদ্য অপরকে দান করতে হয়। কর্পূর, অগুরু, চন্দন, ধূপ, শ্রীহরির উদ্দেশ্যে দান করতে হয়। তুলসী বন পালন করতে হয়। কার্তিক মাসে দামোদর অষ্টক গান, শ্রীহরির সহস্রনাম স্তোত্র, গজেন্দ্রমোক্ষণ পাঠ করলে শ্রীহরি প্রীত হন। শ্রীহরি সম্মুখে ভক্তিভরে হরিকথা শ্রবণ করতে হয়। পদ্মপুরাণে আরো বলা হয়েছে, ব্রতকারী যদি অসুবিধাবশত হরিমন্দিরে যেতে না পারেন মঙ্গল আরতির গান শিব মন্দির কিংবা তুলসী বন কিংবা অশ্বত্থ মূলে করবেন। ব্যাধির কারণে জলের অভাবে কিংবা অন্য কারণে স্নানের অসুবিধা হলে বিষ্ণুনাম দ্বারা মন্ত্রস্নান করবেন। তুলসী সেবার অভাবে বৈষ্ণবদের সেবা করবেন। বৈষ্ণব সেবার অভাবে গাভী বা বট-অশ্বত্থের সেবা করবেন। ব্রতকারী হয়ে উদ্যাপন বিধি পালন করতে অসমর্থ হলে পরের দেওয়া দীপকে উদ্দীপ্ত করবেন কিংবা অন্যের জ্বালানো দীপকে বাতাস প্রভৃতি থেকে রক্ষা করবেন। কার্তিক মাসে ভগবানের মন্দিরে দীপদানে সমস্ত পাতক শোধিত হয়ে যায়।
পূর্বে দ্রাবিড়দেশে বুদ্ধ নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ছিল খুবই দুষ্ট প্রকৃতির এবং দুরাচার সম্পন্ন। ঐ স্ত্রীর সঙ্গে থাকার ফলে ব্রাহ্মণের আয়ু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। পতির মৃত্যুর পরেও ঐ স্ত্রীলোকটি আরও বিশেষভাবে ব্যভিচারে লিপ্ত হলো। এমনকি লোকনিন্দার ভয় না করে সে নির্লজ্জের মতো ব্যবহার করতে লাগল। তার কোনো পুত্র বা ভ্রাতা ছিল না। সে সর্বদাই ভিক্ষার অন্ন ভোজন করত। নিজের হাতে প্রস্তুত না করে সর্বদাই পরের বাড়ি থেকে ভিক্ষা করে বাসি অন্ন খেত এবং অনেকসময় অপরের বাড়িতে রান্না করতে যেত। তীর্থযাত্রা আদি থেকে সর্বদাই দুরে থাকত। সে কখনও কোনো ভালো কথায় কর্ণপাত করত না।
একদিন এক বিদ্বান তীর্থযাত্রী ব্রাহ্মণ তার গৃহে আগমন করল। যার নাম ছিল কুৎস। তাকে (ঐ স্ত্রীকে) ব্যভিচারে আসক্ত দেখে সেই ব্রহ্মর্ষি কুৎস বললেন- ওরে মূর্খ নারী! মনোযোগ সহকারে আমার কথা শ্রবণ কর। পৃথ্বি আদি পঞ্চভূত দ্বারা তৈরী এই রক্তমাংসের শরীর, যা কেবল দুঃখেরই কারণ, তুই তাকে যত্ন করছিস? এই দেহ জলের বুদবুদের মতো, একদিন যা অবশ্যই বিনষ্ট হবে। এই অনিত্য শরীরকে যদি তুই নিজ বলে মানিস্ তাহলে নিজের বিচার পূর্বক এই মোহ পরিত্যাগ কর। ভগবান বিষ্ণুকে স্মরণ কর এবং তাঁর লীলাকাহিনী শ্রবণ কর। এখন কার্তিক মাস আগত হবে, তখন ভগবান দামোদরের প্রীতি বিধানের জন্য, স্নান, দান আদি কর্ম করে গৃহে বা মন্দিরে বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে দীপ নিবেদন করে শ্রীবিষ্ণুকে পরিক্রমা করবে এবং তাঁকে প্রণাম করবে। এই ব্রত বিধবা এবং সৌভাগ্যবতী নারী উভয়েরই অবশ্য পালনীয়। যার ফলে সমস্ত প্রকারের পাপের শাস্তি তথা সকল উপদ্রব নষ্ট হয়। কার্তিক মাসে দীপদান নিশ্চিতরূপে ভগবান বিষ্ণুর প্রীতিবর্ধন করে।
এই কথা বলে ব্রাহ্মণ কুৎস অপর একটি গৃহে গমন করলেন। তখন ঐ ব্রাহ্মণী ব্রহ্মর্ষি কুৎসের এই রকম উপদেশ শ্রবণ করে নিজ কর্মের জন্য অনুতাপ করতে লাগল এবং সে স্থির করল যে সে অবশ্যই কার্তিক মাসে এই ব্রত পালন করবে। তারপর যখন কার্তিক মাস আগত হলো তখন সে পুরো মাস সূর্যোদয়ের সময় প্রাতঃস্নান তথা বিষ্ণুকে দীপদান সহ নিষ্ঠা সহকারে এই ব্রত পালন করল। তারপর কিছুকাল বাদে আয়ু শেষ হলে তার মৃত্যু হলো। তখন সে স্বর্গলোকে গমন করল এবং পরে মুক্তি লাভ করল। যে সমস্ত মানুষ কার্তিক ব্রত পালন ও দীপদান আদি সম্পন্ন করে তারা যদি এই ইতিহাস শ্রবণ করে তাহলে তারাও মোক্ষ লাভ করে। এই সংসারে যে বিষ্ণুর প্রসন্নতা বিধানের জন্য আকাশদীপ প্রদান করে, তাকে ক্রুর মুখ বিশিষ্ট যমরাজের মুখ দর্শন করতে হয় না। একাদশীতে সূর্যের তুলারাশিতে অবস্থান অথবা পূর্ণিমাতে লক্ষ্মী সহিত ভগবান বিষ্ণুর প্রসন্নতা বিধানের জন্যই আকাশদীপ প্রদান করা চাই।
নমো পিতৃভ্যঃ প্রেতেভ্যো নমো ধর্মায় বিষ্ণবে।
নমো যমায় রুদ্রায় কান্তারপতয়ে নমঃ ॥
“পিতৃগণকে নমস্কার, প্রেতগণকে নমস্কার, ধর্মস্বরূপ বিষ্ণুকে প্রণাম, যমরাজকে নমস্কার তথা দুর্গম পথে রক্ষাকারী ইন্দ্রকে নমস্কার।”
এ মন্ত্র উচ্চারণ করে যে মানুষ পিতৃগণের নিমিত্ত আকাশে দীপদান করেন, তার পিতৃগণ নরকে থাকলেও উত্তম গতি প্রাপ্ত হন। যে দেবালয়ে, নদীর তীরে, রাজপথে দীপদান করে সে সর্বতোভাবে লক্ষ্মীপ্রাপ্ত হয়। যে কণ্টকাকীর্ণ দুর্গম উঁচু নিচু পথে দীপ দান করে সে কখনো নরকে পতিত হয় না। পূর্বকালে রাজা ধর্মনন্দন আকাশদীপ দানের প্রভাবে শ্রেষ্ঠ বিমানে আরোহন করে বিষ্ণুলোকে প্রস্থান করেছিলেন।
যিনি কার্তিক মাসে হরিবোধিনী একাদশীতে ভগবান বিষ্ণুর সম্মুখে কর্পূর দিয়ে দীপ প্রজ্জ্বলন করেন তাঁর কুলে উৎপন্ন সমস্ত মানুষ ভগবান বিষ্ণুর প্রিয় ভক্ত হন তথা অন্তঃকালে মোক্ষলাভ করেন। পূর্বকালে কোনো এক গোপ অমাবস্যা তিথিতে ভগবানের মন্দিরে দীপ প্রজ্জ্বলন করে তথা বারংবার জয়ধ্বনি উচ্চারণ করে রাজরাজেশ্বর হয়েছিলেন। এইভাবে স্বয়ং ব্রহ্মা নারদ মুনির কাছে কার্তিক মাসে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিয়মিত দীপ দান ও আকাশদীপ দানের মহিমা ব্যক্ত করেছিলেন। সকলেরই এইভাবে কার্তিক মাসে দীপদান করা উচিত।

Post a Comment

0 Comments