আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম - শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী মহারাজ

আমি কিভাবে কৃষ্ণভক্ত হলাম - শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী মহারাজ


গুরুমহারাজ প্রণাম

নমো ওঁ বিষ্ণুপাদায় কৃষ্ণ প্রেষ্ঠায় ভূতলে।
শ্রীমতে ভক্তি চারু স্বামীনিতি নামিনে॥
স্নিগ্ধচেতাঃ সুপ্রনেতা বাগ্মীনং চ রসাপ্লুতম।
প্রভুপাদগতপ্রাণা নৌমি ভক্তিচারুপদম॥

.
১৯৭৬ সালে শ্রীল প্রভুপাদের হাজার হাজার বিদেশী শিষ্য-শিষ্যা ছিল। তাঁদের মধ্যে বাঙ্গালী শিষ্যের সংখ্যা প্রায় জনা ত্রিশ। সেইসব বাঙালী শিষ্যদের মধ্যে যিনি শ্রীল প্রভুপাদের প্রভূত কৃপার অধিকারী হয়েছিলেন, তিনি হলেন সকলের প্রিয় শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী মহারাজ।


১৯৪৫ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় এক বর্ধিষ্ণু কায়স্থ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শ্রীকুমুদবন্ধু দাস ও মাতা শ্রীমতী চিন্ময়ীদেবী দাসী শ্রীভগবানের কৃপায় এইরূপ ভক্ত সন্তান লাভ করে ধন্য হয়েছিলেন। পূর্বাশ্রমে তাঁর নাম ছিল কিশোর দাস। ১৯৭০ সালে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য তিনি জার্মানীতে গিয়েছিলেন।


জার্মানীতে থাকাকালীন সময়ে বৈদিকসাহিত্য সমূহের সান্নিধ্যে এসে তিনি ভারতীয় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের পূর্ণ সমৃদ্ধতা বিষয়ে হৃদয়ঙ্গম করেন। ঐকান্তিকভাবে পারমার্থিক পথ অনুসরণ করার বাসনায় ১৯৭৫ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। বিস্তারিতভাবে বৈদিক শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়ন করার পর সঠিক পারমার্থিক পথে তাঁকে পরিচালিত করতে পারেন এমন একজন গুরুদেবের প্রয়োজনীতা সম্বন্ধে তিনি সচেতন হলেন। কিন্তু এক বৎসর ধরে অন্বেষণের পরেও তিনি এমন একজনও পারমার্থিক গুরু খুঁজে পেলেন না, যাঁর কাছে তিনি নিজেকে পূর্ণভাবে সমর্পণ করতে পারেন। তিনি হতাশ ও হতোদ্যােম হলেন। তিনি যখন তাঁর গুরুদেব প্রাপ্তির আশা প্রায় ত্যাগ করেছিলেন, ঠিক এমনি এক সময়ে তিনি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের 'দ্য নেকটর অব্ ডিভোশন' (ভক্তিরসামৃতসিন্ধু) নামক এক গ্রন্থের সংস্পর্শে আসেন। সেই গ্রন্থের বিষয়ের ও লেখনীর গভীরতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি উপলব্ধ হলেন, যে পথ ও গুরুর সন্ধান তিনি করছিলেন, তাঁকে তিনি পেয়েছেন। তিনি শ্রীল প্রভুপাদের আরও গ্রন্থাবলী গভীর মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করতে লাগলেন। যতই তিনি শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থাবলী পাঠ করছিলেন ততই শ্রীল প্রভুপাদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস প্রগাঢ় হচ্ছিল এবং শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে সাক্ষাতের আকাঙ্খাও আকুল হচ্ছিল।


তারপর তিনি শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য শ্রীধাম মায়াপুরে আসেন। কিন্তু শ্রীল প্রভুপাদ তখন আমেরিকায় ছিলেন। তাই তিনি মায়াপুরে ইসকনের ভক্তগণের সঙ্গে যোগদান করে ভগবানের সেবায় নিজেকে আরও ঐকান্তিকভাবে নিযুক্ত করে শ্রীল প্রভুপাদের ভারতে ফিরবার অপেক্ষা করতে থাকেন। অবশেষে ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে শ্রীল প্রভুপাদ ভারতে ফিরে এলে শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়।


প্রথম সাক্ষাতেই শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর সুপ্ত প্রতিভা ও ভক্তি ভাবের কথা উপলব্ধি করে তাঁকে কাছে টেনে নিলেন। তিনি শ্রীমান কিশোরকে কৃষ্ণভাবনার অমৃত পান করালেন এবং তাঁর গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনুবাদের দায়িত্ব প্রদান করলেন। সেই সঙ্গে শ্রীল প্রভুপাদ তাঁকে ভারতীয় বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব পদে নিয়োগ করেন। ১৯৭৬ সালেই শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীমান্ কিশোরকে আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষা দেন। তাঁর দীক্ষিত নাম হয় শ্রীক্ষীরচোরা গোপীনাথ দাস। অচিরেই ক্ষীরচোরা গোপীনাথ শ্রীল প্রভুপাদের বিশেষ স্নেহভাজন হয়ে ওঠেন।


শ্রীল প্রভুপাদ দেখলেন, ক্ষীরচোরা গোপীনাথ অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গেই গ্রন্থগুলি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে চলেছেন। তখন তিনি তাঁকে আদেশ দিলেন---তাঁর রচিত সমস্ত ইংরেজি গ্রন্থগুলি যেন বাংলাভাষায় অনুবাদ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। শ্রীমান্ গোপীনাথ সেকার্য শিরোধার্য করে নিলেন এবং সব্যসাচীর মতো তাঁর দুহাত শ্রীল প্রভুপাদের নির্দেশাধীনে শ্রীকৃষ্ণসেবায় পরমাগ্রহে নিয়োজিত রাখলেন।
১৯৭৭ সালে শ্রীমান্ গোপীনাথ শ্রীধাম বৃন্দাবনে শ্রীল প্রভুপাদের কাছ থেকে সন্ন্যাস প্রাপ্ত হন। শ্রীল প্রভুপাদ তখন তাঁকে নাম দেন শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী মহারাজ। সত্যি সত্যি শ্রীল প্রভুপাদের দেওয়া এই নামটি আজ সার্থক হয়েছে। তাঁর সুষ্ঠু ও সৃজনশীল প্রচারের বৈভব আজ বিশ্বের দিকে দিকে পুষ্প সৌরভের মতোই মনোরমভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনিই একমাত্র প্রথম বাঙালী যিনি ইসকনের গভর্নিং বডি কমিশনের চেয়ারম্যান (১৯৮৯ সালে) পদে নিযুক্ত হয়েছেন। তাঁর সুদক্ষ ও সুপরিচালনায় ইসকনের নতুন নতুন মন্দির ও আশ্রম গড়ে উঠেছে।


১৯৯৬ সালে শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী মহারাজ তাঁর পরমারাধ্য গুরুদেব শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের জীবন নির্ভর এক ভিডিও চলচ্চিত্র (অভয় চরণ) নির্মাণের বিশাল কার্যক্রম গ্রহণ করে তা সমাপ্ত করেন। এই ভিডিও চলচ্চিত্রটি সারা বিশ্বে প্রদর্শিত হয় এবং সেই সঙ্গে ভারতীয় দূরদর্শন থেকেও ধারাবাহিক ভাবে সম্প্রচারিত হয়েছিল।


২০০৬ সালে শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী মহারাজ মধ্যপ্রদেশের উজ্জ্বয়িনীতে একটি সুন্দর মন্দির নির্মাণ করেন। ঐ মন্দিরের বিশাল তিনটি বেদীতে শ্রীশ্রীমদন-মোহন, শ্রীশ্রীকৃষ্ণ-বলরাম এবং শ্রীশ্রীগৌর-নিতাই পূজিত হচ্ছেন। বর্তমানে শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী মহারাজ সারা বিশ্বে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার সহ উজ্জ্বয়িনী মন্দিরের বিভিন্ন প্রকল্প উন্নয়নে রত রয়েছেন।

Post a Comment

0 Comments