শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ কি ? --------- শ্রীল ভক্তিচারু স্বামী গুরুমহারাজ

শুদ্ধ ভক্তির লক্ষণ কি ? --------- শ্রীল ভক্তিচারু স্বামী গুরুমহারাজ


পদ্ম-পুরাণে বলা হয়েছে, পাপকর্মের ফল চার রকমের হয়-
অপ্রারদ্ধ ,কুট ,বীজ এবং ফলোন্মুখ ।

সেখানে এও বলা হয়েছে যে, কেউ যখন ভগবান বিষ্ণুর শরণাগত হয়ে পূর্ণরূপে ভক্তি সহকারে তাঁর সেবায় তৎপর হন, তখন তার এ চার রকমের পাপফল তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট হয়ে যায়।

যে পাপের ফল ভোগ হতে চলেছে, তাকে বলা হয় ফলোন্মুখ। হৃদয়ে বীজরূপে যে পাপের ফল রয়েছে, তাকে বলা হয় বীজ। বীজের উন্মুখতার কারণকে বলা হয় কুট এবং যে পাপের ফল এখনও প্রকাশিত হয়নি, তাকে বলা হয় অপ্রারদ্ধ। পদ্ম-পুরাণের এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, জড় কলুষ অত্যন্ত সূক্ষ্ম। এর সূচনা, ফলন, পরিণাম এবং দুঃখরূপে তার ফলভোগ- এ সবই একটি বিশাল শৃঙ্খলের অন্তর্ভুক্ত। কারও যখন রোগ হয়, সাধারণত সেই রোগের কারণ নির্ণয় করা খুবই কঠিন। তার শুরু কোথায় এবং কিভাবে তা বর্ধিত হচ্ছে, তা বোঝা খুবই দুষ্কর। কিন্তু রোগের ক্লেশ অকস্মাৎ প্রকাশ হয় না, তার সময় লাগে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসক যেমন সাবধানতা অবলম্বন করে রোগের প্রতিকারের জন্য টীকা দেন, তেমনই সব রকমের পাপবীজকে অঙ্কুরিত হওয়া থেকে নিরোধ করার জন্য পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করা অত্যন্ত আবশ্যক।
এই সম্পর্কে শুকদেব গোস্বামী শ্রীমদ্ভাগবতে (৬/২/১৭) অজামিল উপাখ্যানে উল্লেখ করেছেন। অজামিল প্রথম জীবনে একজন কর্তব্যনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ছিলেন, কিন্তু যৌবনে বেশ্যার সঙ্গ করার ফলে তিনি সম্পূর্ণরূপে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁর পাপময় জীবনের অন্তিম সময়ে ‘নারায়ণের’ নাম উচ্চারণ করার ফলে, তিনি তাঁর সমস্ত পাপ থেকে উদ্ধার পান। শুকদেব গোস্বামী বলেছেন যে, তপস্যা, দান, ব্রত ইত্যাদির প্রভাবে পাপের নাশ হয়, কিন্তু হৃদয়ের পাপবীজের নাশ হয় না, যা অজামিলের যৌবনে হয়েছিল। এ পাপবীজের নাশ একমাত্র কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হওয়ার ফলেই হতে পারে, এবং তা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে মহামন্ত্র বা ‘হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র’ কীর্তন করার প্রভাবে অতি সহজেই লাভ করা যায়। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, ভগবদ্ভক্তির পথ অবলম্বন না করলে, সমস্ত পাপ থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত হওয়া যায় না।

বেদবিহিত কর্ম, দান, তপস্যা ইত্যাদির দ্বারা মানুষ কিছু সময়ের জন্য পাপকর্মের ফল থেকে মুক্ত হতে পারে, কিন্তু তার পরেই আবার সে পাপকর্মে প্রবৃত্ত হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, অতিরিক্তভাবে অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ করার ফলে যৌন রোগাক্রান্ত পুরুষ যখন ভীষণ কষ্ট পায়, তখন সে সাময়িকভাবে স্ত্রীসঙ্গ থেকে বিরত থাকে। কিন্তু যেহেতু তার হৃদয় থেকে স্ত্রীসঙ্গ করার বাসনা দূর হয়নি, তাই রোগ নিরাময়ের পরে সে আবার স্ত্রীসঙ্গে লিপ্ত হয় এবং তার ফলে আবার রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং চিকিৎসার প্রভাবে সাময়িকভাবে এ যৌনব্যাধির নিরাময় হতে পারে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ বুঝতে পারছে যে, যৌনজীবন অত্যন্ত জঘন্য, ততক্ষণ পর্যন্ত তার এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভ করা অসম্ভব। তেমনই বৈদিক কর্ম, দান, তপস্যা ইত্যাদির ফলে সাময়িকভাবে পাপকর্মের নিবৃত্তি হতে পারে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না হৃদয় সম্পূর্ণভাবে নির্মল হচ্ছে, ততক্ষণ মানুষ বারবার পাপকর্মে লিপ্ত না হয়ে পারে না।

শ্রীমদ্ভাগবতে এই সম্বন্ধে হস্তী স্নানের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। হাতি সরোবরে খুব ভালভাবে স্নান করে। কিন্তু জল থেকে ডাঙ্গায় উঠে এসে সে আবার তার সারা গায়ে ধূলি ছড়িয়ে দেয়। এ উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করার শিক্ষা যে পায়নি সে পাপকর্মের বাসনা থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত হতে পারে না। কর্ম, জ্ঞান বা যোগের দ্বারা পাপকর্মের বাসনা থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। শুধু শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তির প্রভাবেই তা সম্ভব হয়।

শ্রীমদ্ভাগবতে (৪/২২/৩৯) আর একটি দৃষ্টান্ত দেখা যায়, যেখানে সনৎকুমার বলছেন, “হে রাজন মানুষের মিথ্যা অহঙ্কার এতই প্রবল যে, তা রজ্জুর মতো মানুষকে ভববন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। ভক্তরাই কেবল ভক্তি সহকারে ভগবানের সেবায় যুক্ত হওয়ার ফলে, এ বন্ধন থেকে অনায়াসে মুক্ত হতে পারেন। যারা কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত না হয়ে যোগী বা সকাম কর্মী হওয়ার চেষ্টা করছেন, তারা কখনই ভগবদ্ভক্তের মতো কর্মবন্ধন মোচন করতে পারেন না। তাই সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে অহঙ্কার ও প্রাকৃত কর্মের দৃঢ় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভগবৎ-সেবায় নিযুক্ত হওয়া।”

মিথ্যা অহঙ্কারের এ দৃঢ় গ্রন্থি অজ্ঞানতা-প্রসূত। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তার স্বরূপ সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকে, ততক্ষণ সে অবশ্যই অনুচিত কর্মে প্রবৃত্ত হবে এবং প্রাকৃত বন্ধনে আবদ্ধ হবে। এ তত্ত্বজ্ঞানের অভাব কৃষ্ণভাবনার প্রভাবে দূরীভূত হতে পারে, যা পদ্ম-পুরাণে প্রমাণিত হয়েছে- “কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত শুদ্ধভক্তি হচ্ছে পরমউজ্জ্বল জ্ঞানবর্তিকা, যা বাসনারূপ অমঙ্গলকারী সর্পদের জন্য দাবানল স্বরূপ।” বনে যখন দাবানল জ্বলে ওঠে, তখন সেই আগুনে সমস্ত সাপ দগ্ধ হয়। অন্যান্য পশুরা পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে পারে, কিন্তু সাপেরা কোন মতেই নিস্তার পায় না, তারা সেই আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। সেই রকম, কৃষ্ণভাবনারূপী প্রজ্জ্বলিত অগ্নি এতই প্রবল যে, তার প্রভাবে অবিদ্যারূপ সর্প অচিরেই ভস্মীভূত হয়ে যায়।
--------- শ্রীল ভক্তিচারু স্বামী গুরুমহারাজ

Post a Comment

0 Comments