ভগবান কপিলদেব!

ভগবান কপিলদেব!


পঞ্চম কপিলো নাম সিদ্ধেশঃ কালবিপ্লুতম।
প্রোবাচাসুরয়ে সাংখ্যং তত্ত্বগ্রামবিনির্ণয়ম।।
(ভাগবত- ১/৩/১০)

অনুবাদঃ- ভগবান পঞ্চম অবতার তিনি ঋষিশ্রেষ্ঠ শ্রী কপিল নামে অবতরণ করেন। তিনি আসুরি নামক ব্রাহ্মণকে সৃষ্টির উপাদান সমূহ বিশ্লেষণ করে সাংখ্য দর্শন প্রদান করেন, কেননা কালের প্রভাবে সেই জ্ঞান লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

যত্তৎ সত্ত্বগুণং স্বচ্ছং শান্তং ভগবতঃ পদম্ ।
যদাহুর্বাসুদেবাখ্যং চিত্ত তম্মহদাত্মকম্ ।। (ভাগবত- ৩/২৬/২১ )

ব্রহ্মার আদেশে কর্দম মুনির দাম্পত্য ধর্মানুসারে প্রজাবৃদ্ধি করা এক ভয়ানক সমস্যারূপে দেখা দিয়েছিল। সমস্যা সমাধানে কর্দম মুনি সরস্বতী নদীর তীরে সুদীর্ঘ দশ সহস্র বৎসরকাল তপস্যা করেছিলেন ।

সত্যযুগ আরম্ভের প্রাক্কালে কমলনয়ন ভগবান শ্রীহরি কর্দম মুনির তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শব্দব্রহ্মময় রূপ ধারণ করে তাঁকে দর্শন দান করেন। শ্রীহরি দর্শন দান কালে মস্তকে সুবর্ণনির্মিত কিরীট, কর্ণে দীপ্যমান কুণ্ডল ও হস্তে শঙ্খ, চক্র, গদা ও শ্বেতপদ্ম ধারণ করেছিলেন। তাঁর চরণকমল গরুড় স্কন্ধে সংস্থাপিত ছিল। বক্ষঃস্থলে ছিলেন শ্রীলক্ষ্মীদেবী আর গলায় ছিল কৌস্তুভমণি। শ্রীভগবান তখন অনিন্দ্যসুন্দর জ্যোতির্ময় মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

কর্দম মুনি শ্রীভগবানকে জানালেন যে তিনি কোনো উপযুক্ত ও গার্হস্থ্য ধর্মানুকূল শীলবতী রমণীকে ভার্যারূপে লাভ করবার অভিলাষে তাঁর শরণাগত হয়েছেন। কর্দম মুনি শ্রীভগবানের স্তবস্তুতিও করলেন।

শ্রীভগবান বললেন - ' হে কর্দম! তোমার আত্মসংযম ও আরাধনায় আমি প্রসন্ন হয়েছি। তোমার অভিলাষ পূর্ণ করবার ব্যবস্থা তো হয়েই আছে। আগামী পরশু পৃথিবীর শাসক বিরাটকীর্তি স্বায়ম্ভুব মনু তাঁর ভার্যা শতরূপাকে সঙ্গে নিয়ে তোমার নিকটে আসবেন।

তাঁদের কন্য রূপ - যৌবনসম্পন্না, সুশীলা, সদ্গুণান্বিতা, কৃষ্ণলোচনা ও বিবাহযোগ্য। তাঁরা সেই যোগ্য কন্যাই তোমাকে সম্প্রদান করবেন। তোমাদের থেকে নয়টি কন্যা - সন্তান হবে। মরীচি আদি তাঁদের বিবাহ করবেন।

তুমিও আমার আজ্ঞায় কর্মসকল অনুষ্ঠান করে শুদ্ধসত্ত্বময় হয়ে সকল কর্মফল আমাতে সমর্পণ করে আমাকেই লাভ করবে। সর্বজীবে দয়া করে তুমি আত্মজ্ঞান লাভ করবে এবং আমাকে তোমার মধ্যে স্থিত দেখবে।

হে মহামুনি ! আমিও নিজ অংশকলা রূপে তোমার মধ্যে দিয়ে তোমার পত্নী দেবহূতির গর্ভে অবতীর্ণ হয়ে তত্ত্বসংহিতা ( সাংখ্য শাস্ত্র ) প্রণয়ন করর।

শ্রীভগবান নিজ ধামে গমন করলেন আর মহর্ষি কর্দম শ্রীহরির উপদিষ্ট সময়ের জন্য তপস্যাক্ষেত্র বিন্দু সরোবরের তীরেই অবস্থান করে রইলেন। যথাসময়ে আদিরাজ স্বায়ম্ভুব মনু কন্যাসহ শ্রেষ্ঠ তীর্থস্বরূপ সেই আশ্রমে প্রবেশ তরে দেখলেন যে মুনিবর কর্দম অগ্নিতে হোম সম্পাদন করে আসনে উপবিষ্ট।

মহর্ষি তখন উন্নতকায়, পদ্মপলাশলোচন, জটাজুট সুশোভিত ও চীরবসনেও দ্যুতিসম্পন্ন। মহর্ষি কর্দম স্বায়ম্ভুব মনুর নানাবিধ গুণ ও কর্মের উৎকর্ষ কীর্তন করলেন। আত্মপ্রশংসায় লজ্জিত সম্রাট মনু তখন বললেন - 'হে মুনিপ্রবর! নারদমুনির কাছ থেকে আপনার সুখ্যাতি শ্রবণ করে আমার কন্যা আপনাকে পতিত্বে বরণ করতে অভিলাষী। আমি অতীব শ্রদ্ধা সহকারে এই কন্যাকে আপনার হস্তে সম্প্রদান করছি। আপনি একে গ্রহণ করুন। গার্হস্থ্য ধর্মের সমস্ত কর্মে সর্বতোভাবে এই কন্যা আপনার উপযুক্ত।

'মহর্ষি কর্দম কন্যাকে গ্রহণ করবার সময়ে বললেন - ' সন্তান উৎপাদনকাল পর্যন্ত আমি গার্হস্থ্য ধর্মানুসারে এঁর সঙ্গে থাকব। অতঃপর শ্রীভগবানের উপদিষ্ট সন্ন্যাসপ্রধান অহিংসা ধর্মের সঙ্গে শম - দমাদি ধর্মসকল পালন করব।"

মহর্ষি কর্দম ও দেবহূতির বিবাহনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে গেলে কন্যার পিতা ও মাতা মনু ও শতরূপা স্বদেশে প্রস্থান করলেন। দেবহূতি কাম, দম্ভ, বাসনা, লোভ, পাপ ও গর্ব পরিত্যাগ করে বিশ্বাস, পবিত্রতা, গৌরব, সংযম, শুশ্রূষা, প্রেম ও মধুরবাক্যাদি সদ্গুণ দ্বারা পরম তেজস্বী পতিদেবতাকে সন্তুষ্ট করতে লাগলেন।

কমলনয়না দেবহূতি পতি মহর্ষি কর্দমের আদেশ অনুসারে সরস্বতী নদীর পবিত্র জলের আধার বিন্দু সরোবরে স্নান করে পতির যোগশক্তির বিভূতি দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন। দেব - দাম্পত্য শুরু হল।

অনন্তর দেবহূতি সর্বাঙ্গসুন্দর নয়টি কন্যাসন্তান প্রসব করলেন। এইসময় শুদ্ধাসত্ত্বা সতী দেবহূতি দেখলেন যে পূর্বপ্রতিজ্ঞানুসারে তাঁর পতিদেব সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণ করে বনগমনে উদ্যাত হয়েছেন।

তখন দেবহূতি অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে স্বামীকে বললেন - ' আপনি সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেলে আপনার এই কন্যাদেরই তাদের যোগ্য পাত্র জোগাড় করতে হবে এবং আমার জন্ম - মরণরূপ বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য সদ্গুরুর প্রয়োজন হয়ে পড়বে। আমি শ্রীভগবানের মায়ায় আপনার মতো পতিদেবতাকে লাভ করেও সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের জন্য চেষ্টা করিনি।'

দেবহূতির কথায় মহর্ষি কর্দমেরর শ্রীভগবানের দেওয়া আশ্বাস - বাণী মনে পড়ল। তিনি তখন দেবহূতিকে বললেন - 'শ্রীভগবান স্বয়ং অংশকলারূপে তোমার গর্ভে আবির্ভূত হয়ে তোমাকে ব্রহ্মজ্ঞানোপদেশ দান করবেন। অতএব তুমি এখন শ্রীভগবানের আরাধনায় প্রবৃত্ত হও।'

যথাসময়ে শ্রীভগবান দেবহূতির গর্ভে পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেলেন। এই পুত্রই কপিল নামে পরিচিত। অতঃপর কর্দম মুনি তাঁর নয়টি কন্যার উপযুক্ত পতি সন্ধান করে তাদের সম্প্রদান করে সন্ন্যাস গ্রহণে কৃতসংকল্প হলেন।

কর্দম ঋষি তাঁর কলা নাম্নী কন্যাকে মরীচির হস্তে, অন্সূয়াকে অত্রির হস্তে, শ্রদ্ধাকে অঙ্গিরার হস্তে, হবির্ভূকে পুলস্তরে হস্তে, গতিকে পুলহের হস্তে, ক্রিয়াকে ক্রতুর হস্তে। খ্যাতিকে ভৃগুর হস্তে, অরুদ্ধতীকে বশিষ্ঠ ও শান্তিকে অথর্বা ঋষির হস্তে সম্প্রদান করেছিলেন।

এদিকে সাক্ষাৎ দেবাদিদেব শ্রীহরিই তাঁর গৃহে অবতীর্ণ হয়েছেন বুঝতে পেরে কর্দম ঋষি একান্তে তাঁকে প্রণাম করে বললেন - 'তোমাকে আমার গৃহে অবতরণ করতে দেখে ধন্য হয়েছি।

হে প্রভু ! তুমি ভক্তের সম্মান বৃদ্ধি করে থাক। তুমি নিজ সত্য পালনার্থে এবং সাংখ্যযোগ প্রচার করবার জন্যই আমার গৃহে পদার্পণ করেছে।

সাধকগণ তত্ত্বজ্ঞানলাভের ইচ্ছায় সর্বদাই তোমার পাদপীঠ বন্দনা করেন। ঐশ্বর্য, বৈরাগ্য, যশ, জ্ঞান, বীর্য ও শ্রী - এই ষড়ৈশ্বর্যে তুমি পরিপূর্ণ। আমি তোমার শরণাগত হলাম। হে প্রভু! তোমার কৃপায় আমি ঋণত্রয় থেকে মুক্ত। এইবার আমি সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণ করে তোমার চিন্তা করতে করতে সমস্ত দৈন্য থেকে মুক্ত হয়ে ভূমণ্ডলে বিচরণ করব। অনুমতি দাও।'

শ্রীভগবান বললেন - 'হে মুনিবর! বৈদিক ও লৌকিক সমস্ত রকমের কর্মে আমার বাক্যই প্রামাণ্য। এই জগতে মুক্তিকামী আত্মদর্শনের উপযোগী তত্ত্বাদি জ্ঞান সম্পাদনের জন্য ও তা পুনঃপ্রবর্তিত করবার জন্যই আমার অাগমন। হে মুনিবর ! আমি অনুমতি দিলাম। তুমি স্বেচ্ছায় প্রস্থান করো আর সমস্ত কর্মফল আমাতে আহুতি দিয়ে দূর্জয় মৃত্যুকে অতিক্রম করে মোক্ষপদ লাভের জন্য আমার ভজনায় নিত্যযুক্ত হও।'

শ্রীভগবান বললেন - 'হে মুনিবর! বৈদিক ও লৌকিক সমস্ত রকমের কর্মে আমার বাক্যই প্রামাণ্য। এই জগতে মুক্তিকামী আত্মদর্শনের উপযোগী তত্ত্বাদি জ্ঞান সম্পাদনের জন্য ও তা পুনঃপ্রবর্তিত করবার জন্যই আমার অাগমন।

হে মুনিবর! আমি অনুমতি দিলাম। তুমি স্বেচ্ছায় প্রস্থান করো আর সমস্ত কর্মফল আমাতে আহুতি দিয়ে দূর্জয় মৃত্যুকে অতিক্রম করে মোক্ষপদ লাভের জন্য আমার ভজনায় নিত্যযুক্ত হও।'

আদেশ পেয়ে প্রজাপতি কর্দম ঋষি শ্রীভগবানকে প্রদক্ষিণ করে হৃষ্টচিত্তে বনগমন করলেন। বনগমনের পূর্বে তিনি তাঁর কাছে এই প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলেন যে ভার্যা দেবহূতিকেও সমস্ত কর্মবন্ধন থেকে নিষ্কৃতি প্রদানকারী আত্মজ্ঞান তিনিই দেবেন। কালে কর্দম ঋষির বুদ্ধি অন্তর্মুখী ও নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের মতন শান্ত হয়ে গেল।

পরমভক্তিভাবের দ্বারা সর্বান্তর্যামী সর্বজ্ঞ ভগবান বাসুদেবে চিত্ত স্থির হয়ে যাওয়াতে তিনি সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গেলেন। সর্বভূতে নিজ আত্মা শ্রীভগবানকে এবং শ্রীভগবানের মধ্যে সর্বভূতকে দর্শন করে তিনি ইচ্ছাদ্বেষরহিত সমদর্শী হয়ে ভক্তিযোগের সাধনদ্বারা শ্রীভগবানকে পরমপদ লাভ করলেন।

পিতা কর্দম ঋষি সন্ন্যাস গ্রহণ করে বনে চলে যাওয়ার পর ভগবান কপিল জননীর কল্যাণ সাধনের জন্য সেই বিন্দু সরোবর তীর্থেই অবস্থান করতে লাগলেন। একদিন তত্ত্ববেত্তা ভগবান কপিল কর্ম সম্পাদন করে নিজাসনে উপবিষ্ট ছিলেন। তখন দেবহূতি তাঁকে প্রশ্ন করলেন।

'দেবহূতি বললেন - ' হে বিরাট! হে প্রভু! দুষ্ট ইন্দ্রিয়বর্গ ভোগের আসক্তিতে আমাকে অস্থির করছে আর আমাকে ঘোর অন্ধকারময় অজ্ঞানে আবদ্ধ রেখেছে। তুমি সমস্ত জীবের প্রভু ভগবান আদিপুুরুষ তথা অজ্ঞানান্ধকারে অন্ধ জীবের কাছে নেত্রস্বরূপ সূর্যের মতন উদিত হয়েছ।

এই দেহ - গেহের প্রতি' আমি, আমার' রূপ দুরাগ্রহ তোমারই দেওয়া, তাই তুমিই এই মহামোহ দূর করো। তুমি তোমার ভক্তজনের সংসাররূপ বৃক্ষ ছেদনের কুঠারস্বরূপ। আমি তোমার শরণাগত - প্রকৃতি ও পুরুষের তত্ত্বজ্ঞান লাভের অভিলাষী। তুমি শ্রেষ্ঠ ভাগবতবেত্তা। তোমাকে প্রণাম করছি।'

ভগবান কপিল বললেন -- 'হে মাতা! অধ্যাত্মযোগই মানুষের আত্যন্তিক কল্যাণের মুখ্য সাধন। এই যোগ প্রাকৃত সুখ ও দুঃখ নিবারণ করে। জীবের চিত্তই তার বন্ধন ও মুক্তির কারণ। বিষয় চিত্ত বন্ধনের কারণ আর পরমাত্মায় চিত্তের মুক্তি। মানব মন যখন দেহাদিতে অহংবুদ্ধি ও গেহাদিতে মমত্ববুদ্ধিজনিত কাম , লোভ আদি বিকার থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ নির্মল হয়ে যায় তখন সেই মন সুখ - দুঃখরহিত হয়ে সমভাবাপন্ন অবস্থায় এসে যায়।

তখন জীব নিজ জ্ঞান - বৈরাগ্য ও ভক্তিযুক্ত হৃদয়ে আত্মাকে সম্পর্করহিত, একমেবাদ্বিতীয়, ভেদরহিত, অখণ্ড, স্বয়ং প্রকাশ, নির্লিপ্ত ও সুখ - দুঃখরহিত রূপে দর্শন করে এবং প্রকৃতিকে দুর্বল মনে করে। যোগীদের কাছে ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য সর্বাত্মা শ্রীহরির প্রতি একান্ত ভক্তি ছাড়া অন্য কোনো কল্যাণকর পথ নেই।

বিবেকযুক্ত ব্যক্তি জানতে পারে যে আসক্তি হল জীবাত্মার দৃঢ় বন্ধনপাশ আর তা সাধুমহাত্মাদের দিকে ঘুরিয়ে দিলে তবে মোক্ষ দ্বার উন্মুক্ত হয়। যারা সহিষ্ণু, দয়ালু,জীবে সমভাবাপন্ন, দ্বেষরহিত, শান্ত, সরল ও সজ্জনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারী, অনন্য ভক্তিসম্পন্ন, ঈশ্বর লাভের জন্য স্বজন ও কর্ম পরিত্যাগী এবং মদ্গতচিত্তে ভগবানের পবিত্র লীলা শ্রবণ - কীর্তন করে, তাদের ত্রিতাপ ব্যথিত করতে সক্ষম হয় না।

হে মাতা! এই সর্বসঙ্গপরিত্যাগী মহাপুরুষগণই সাধু। সাধুসঙ্গই আসক্তি জনিত সমস্ত দোষ হরণ করে নেয়।'

দেহহূতি প্রশ্ন করলেন -- 'হে ভগবান! ভক্তির স্বরূপ কী? যে যোগের দ্বারা তত্ত্বজ্ঞান লাভ হয়, তার লক্ষণ কী? সরল করে বলো।'

শ্রীভগবান বললেন - 'হে মাতা! বেদবিহিত কর্মে নিরত ও বিষয়াদির জ্ঞানপ্রকাশকারী ইন্দ্রিয়াদির ও একাগ্রচিত্তে পুরুষের শুদ্ধসত্ত্বময় শ্রীহরির প্রতি যে নিষ্কাম আকর্ষণ তার নামই ভগবানে অহৈতুকী ভক্তি। এই ভক্তি মুক্তির চেয়েও শক্তিশালী কারণ তা কর্মসংস্কারের আধাররূপ লিঙ্গ শরীরকেও অবিলম্বে ভস্মীভূত করে।

ভগবানের সেবায় নিত্যযুক্ত ও তাঁর প্রসন্নতা অর্জনের জন্য কর্মানুষ্ঠানকারী একনিষ্ঠ ভক্তগণ সমবেত লীলা সংকীর্তন কালে আমার সাযুজ্য মোক্ষও কামনা করে না। এই ভক্তিই তাদের ব্রহ্মানন্দ লাভ করিয়ে থাকে। তারা ঐশ্বর্য কামনা করে না কিন্তু বৈকুন্ঠধামে গমন করে সেই সকল বিভূতি স্বাভাবিকভাবেই লাভ করে থাকে। অনন্য ভক্তকে আমি ভবসাগর পার করিয়ে দিয়ে থাকি। তীব্র ভক্তিযোগের দ্বারা আমাতে চিত্ত সমাহিত করাই হল এই জগতে মানুষের পক্ষে পরম পুরুষার্থ লাভ।

'হে মাতা! পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব জানলে পুরুষ প্রকৃতির গুণ অর্থাৎ অহংকারাদি থেকে মুক্ত হতে পারে। এই পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব এইরকম--
পুরুষ এবং পঞ্চমহাভূত ( ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম ),
পঞ্চতম্মাত্র ( গন্ , রস, রূপ, স্পশ , শব্দ ),
অন্তকরণ ( মন, বুদ্ধি , চিত্ত, অহংকার ),
পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ( বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ )
পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ( চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক্ )।'

'পুরুষ অনাদি ( নিত্য ), নির্গুণ, সর্বব্যাপী ও অনন্ত। তিনি হলেন স্বপ্রকাশ ও চৈতন্যস্বরূপ পরমাত্মা, ত্রিগুণময়ী প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। জড় জগতের প্রকাশ পুরুষের শক্তিদ্বারাই হয়ে থাকে। এই পরমাত্মারূপ পুরুষ সৃষ্টিতে সচেষ্ট হলে নিজ ত্রিগুণাত্মিকা শক্তি যা প্রকৃতি নামে পরিচিত তা তার সম্মুখে উপস্থিত হয়। পুরুষ তাকে স্বীকার করলে সৃষ্টি হয়।'

"সত্ত্বগুণপ্রধান, নির্মল, শান্ত ( বাসনাদিরহিত ), ভগবৎ উপলব্ধি স্থান যে চিত্ত তাই মহতত্ত্ব এবং তাকেই' বাসুদেব' বলা হয়। ভূত, ইন্দ্রিয় ও মনরূপ অহংকারকেই পণ্ডিতগণ সাক্ষাৎ 'সংকর্ষণ ' নামক সহস্রশীর্ষ অনন্তদেব বলে থাকেন। মনের সংকল্প ও বিকল্প দ্বারাই কামনার উৎপত্তি হয়। মনস্তত্ত্বই ইন্দ্রিয়গণের অধীশ্বর ' অনিরুদ্ধ ' নামে প্রসদ্ধি।"

"শ্রীভগবান বললেন -- হে মাতা! তৈজস অহংকার বিকারপ্রাপ্ত হলে তার থেকে ' বুদ্ধি ' নামক তত্ত্ব উৎপন্ন হয়। বিষয়ের প্রকাশরূপ বিজ্ঞান এবং ইন্দ্রিয়বিষয়ে সহায়ক হওয়া ও পদার্থসমূহের বিশেষ জ্ঞান উৎপাদন - এই হল বুদ্ধিতত্ত্বের কার্য।

বৃত্তিভেদ অনুসারে সংশয়, বিপর্যয় (বিপরীত জ্ঞান, নিশ্চয়, স্মৃতি এবং নিন্দ্রাও বুদ্ধিরই লক্ষণ। এই বুদ্ধিতত্ত্বই' প্রদ্যুম্ন'।"

তদনন্তর কপিলদেব মাতাকে মনের মালিন্য দূর করবার জন্য পরিমিত আহার, শ্রীভগবানের স্মরণ - মনন, ব্রহ্মচর্য, তপস্যা, অষ্টাঙ্গ যোগ সাধন ইত্যাদির উপদেশ দিলেন। শ্রীভগবানের যে মূর্তিতে সাধন মন স্থির করে থাকে, তার বর্ণনা দিলেন।

কপিলদেবের সবিস্তারে দান করা উপদেশসকল মাতা দেবহূতি মন দিয়ে শুনলেন। পুত্ররূপে অবতীর্ণ শ্রীভগবান কপিলদেব মাতাকে মুক্তিমার্গের সন্ধান দিলেন। ধ্যানযোগ অবলম্বন করে শ্রীভগবানের নির্দেশিত পথে সাধনা করে মাতা অচিরেই বাঞ্ছিত মুক্তি লাভ করেছিলেন।

মহাযোগী ভগবান কপিলদেবও মাতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য করে পিতার আশ্রম থেকে বেরিয়ে ঈশানকোণের দিকে চলে গেলেন। সেখানে স্বয়ং সমুদ্র তাঁর পূজার্চনা করেন ও তাঁকে স্থান দেন। ত্রিলোকে শান্তি প্রদানের জন্য তিনি যোগযুক্ত হয়ে সমাধিন্থ হন।

Post a Comment

0 Comments