শ্রীমতী রাধারাণী কে???

শ্রীমতী রাধারাণী কে???


ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদিশক্তি শ্রীমতী রাধারাণী। শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, তাঁরা এক। কেবলমাত্র লীলারস আস্বাদন করার জন্য দুই দেহ ধারণ করেছেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বর্ণিত আছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে আনন্দ প্রদান করার জন্যে নিজের বাম অংশ থেকে শ্রীরাধাকে সৃষ্টি করলেন । শ্রীমতী রাধারাণী আদিশক্তি রূপে জগতে খ্যাত হয়ে তাঁর নিজের চিৎশক্তির বলে অসংখ্য গোপী ও লক্ষ্মীদেবীদের কৃষ্ণের প্রীতিবিধান করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। তবে সাধারণ লোকেরা এ তত্ত্ব না জেনে শ্রীমতী রাধারাণীকে একজন সাধারণ নারী বলে জ্ঞান করেন। কারণ কামের বশবর্তী হয়ে তারা এ জগতে সমস্ত বস্তুকে কামময় দৃষ্টিতে দর্শন করেন। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীমতী রাধারাণীর সমস্ত লীলা হচ্ছে প্রেমময় I
এ জগতে প্রেমের লেশমাত্র গন্ধ নেই, এটি কামময় জগত । কাম ও প্রেমের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ।
‘’আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি-বাঞ্ছা তারে বলি, ‘কাম’ I
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি - বাঞ্ছা ধরে ‘প্রেম’ নাম ।।‘’ (চৈতন্য চরিতামৃত ৪/১৬৫)
অর্থাৎ,- “নিজের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির বাসনাকে বলা হয় কাম, আর পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয়ের প্রীতিসাধনের ইচ্ছাকে বলা হয় প্রেম।‘’
শ্রীমতী রাধারাণীর অন্য একটি নাম ‘ক্যাচিৎ’, অর্থাৎ যিনি শ্রীকৃষ্ণকে অখণ্ড সুখ প্রদান করেন। “সর্বত্যাগ করি করে কৃষ্ণের ভজন।‘’ দেহধর্ম, বেদ ধর্ম, লোক ধর্ম সব ত্যাগ করে কৃষ্ণের সেবা করেছিলেন। তবে এ তত্ত্ব সম্বন্ধে সকলে অবগত নয়।
কখনও কখনও কেউ যুক্তি প্রদান করেন যে শ্রীমতী রাধারাণীর নাম শ্রীমদভাগবতে নেই। কিন্তু এটি জানা উচিত শ্রীমতী রাধারাণীর নাম ও মহিমা শ্রীমদভাগবত ছাড়াও শ্রীব্যাসদেবের রচিত বহু প্রামাণিক শাস্ত্রে উল্লেখিত আছে। শ্রীবৃহৎ ভাগবতামৃতে শ্রীপরীক্ষিত মহারাজের উক্তি,-
‘’গোপীনাং বিততাদ্ভুতস্ফুটতর প্রেমানলার্চিশ্ছটাদগ্ধানাং
কিল নামকীর্ত্তনকৃতাত্তাসাং স্পর্শেন সদ্যো মহা-
বৈকল্যং স ভজন্ কদাপি ন মুখে নমানি কর্তুং পভুঃ ।।‘’ (বৃহদ্ভাগবতামৃতম্ – ১/৭/১৩৪)
অর্থাৎ,- মহারাজ পরীক্ষিত নিজ জননী উত্তরাকে বললেন,- “হে মাতা ! আমার গুরুদেব শুকদেব মুনী ভাগবত কথা কীর্ত্তন করার সময় গোপীদের কারোর নাম উচ্চারণ করতে সমর্থন হননি। তার কারণ গোপীদের নাম উচ্চারণ করলে বিশেষ স্মৃতিতে তাঁর চিত্ত অতি বিস্মৃত জ্বালাময় প্রেমানলে মহাবিহ্বল হয়ে পড়তেন, যার ফলে আর ভাগবত কথা বলতে পারতেন না।‘’
তবে বহু প্রামাণিক শাস্ত্রে শ্রীমতী রাধারাণীর মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে । যেমন, শ্রীগোপাল তাপনীতে বলা হয়েছে, –
‘’তস্যাদ্যো প্রকৃতি রাধিকা নিত্য নির্গুণা।
যস্যাংশে লক্ষ্মী দুর্গাদিকা শক্তয়ঃ ।।‘’
অর্থাৎ,- “শ্রীকৃষ্ণের নিত্য শক্তি, আদিশক্তি শ্রীরাধা নিত্য নির্গুণা; এবং লক্ষ্মী, দুর্গাদি সব ভগবৎ শক্তিবর্গ যাঁর অংশ।‘’
‘শ্রীবৃহদেগৌতমীয় তন্ত্রে’, শ্রীকৃষ্ণের উক্তি, –
‘’সত্ত্বং তত্ত্বং পরত্বঞ্চ তত্ত্বত্রয়মহং কিল।
ত্রিতত্ত্বরূপিনী সাপি রাধিকা মম বল্লভা ।।‘’
অর্থাৎ,- “আমি যেমন নিত্য আনন্দময় হয়ে বিশ্বের কার্য, কারণ ও ত্রিতত্ত্ব-স্বরূপ, তেমনই শ্রীরাধা নিত্য আনন্দময়ী হয়ে কার্য, কারণ স্বভাবস্থিতা।‘’
শ্রীপদ্মপুরাণে পাতালখন্ডে শ্রীশিবজী নারদকে বললেন –
‘’দেবী কৃষ্ণময়ী প্রোক্তা রাধিকা পরদেবতা ।
সর্বলক্ষ্মী-স্বরূপা সা কৃষ্ণাহ্লাদ স্বরূপিনী ।।
তৎ সো প্রোচ্যতে বিপ্র হ্লাদিনীতি মনীষিভিঃ ।
তৎকলাকোটিকোট্যাংশা দুর্গাদ্যাস্ত্রীগুণাত্মিকাঃ ।।‘’
অর্থাৎ,- “ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমপুরুষ দেবাদী দেব, এবং শ্রীমতি রাধিকা হচ্ছেন নিত্য শক্তি। রাধিকা সর্বলক্ষ্মী তাঁর অংশ স্বরূপা। হে নারদ, দুর্গাদি দেবীগণ শ্রীমতি রাধিকার কোটি কোটি অংশের এক কলা।‘’
শ্রীপদ্মপুরাণে পাতালখণ্ডে,-
বহুনাং কিং মুনিশ্রেষ্ঠ বিনাতাভ্যাং ন কিঞ্চন।
চিদ্ তিল্লক্ষণং সর্ব রাধাকৃষ্ণ ময়ং জগত।।
ইত্থুং সর্ব তয়োরেব বিভূতি বিধি নারদ।
নশ্যক্যতে মায়াবক্তুং বর্ষ কোটি শতৈরপি ।।
অর্থাৎ,- “শ্রী শিবজী নারদ মুনিকে বললেন, হে মুনিবর ! আমি তোমাকে আর কি বলব ? শ্রীরাধাকৃষ্ণ ছাড়া জগতে আর কিছুই নেই । এইভাবে সবই তাঁদের বিভূতি বলে জানবে। আমি শত কোটি বছর ধরে বললেও শ্রীরাধাকৃষ্ণের মহিমা বর্ণনা করতে সক্ষম হব না।‘’
‘শ্রীগৌতমীয় তন্ত্রে’ বর্ণিত আছে ,-
‘’দেবী কৃষ্ণময়ী প্রোক্তা রাধিকা পরদেবতা।
সর্বলক্ষ্মীময়ী সর্বকান্তিঃ সম্মোহিনী পরা ।।‘’
অর্থাৎ,- “শ্রীমতী রাধারাণী হচ্ছেন কৃষ্ণের আদিশক্তি এবং আদি লক্ষ্মী । সর্বগুণ বিভূষিতা এবং সমস্তকে আকর্ষণ করেন।‘’
‘শ্রীনারদ পঞ্চরাত্রে’ বলা হয়েছে ,-
‘’সৃষ্টিকালে চ সাদেবী মূলপ্রকৃতিরীশ্বরা।
মাতা ভাবেন্মহাবিষ্ণোঃ স এব চ মহান্ বিরাট্ ।।‘’
অর্থাৎ – “শ্রীরাধাই মূল প্রকৃতি এবং ঈশ্বরী। জগত সৃষ্টির সময় যে মহাবিষ্ণু থেকে জগত সৃষ্টি হয়, সেই বিরাট পুরুষের মাতা শ্রীরাধা। মহাবিষ্ণু হতে জগত সৃষ্টি এবং শ্রীরাধা থেকে মহাবিষ্ণু উদ্ভব বলে শ্রীরাধাকে তত্ত্বতঃ জগন্মাতা বলা হয়।‘’
‘শ্রীনারদ পঞ্চরাত্রে’ আবার বলা হয়েছে ,-
‘’রাধা বাম শসম্ভূতা মহালক্ষ্মী প্রকীর্ত্তিতা।
ঐশ্বর্য্যাধিষ্ঠাত্রী দেবীশ্বরস্যৈব নারদ ।।‘’
অর্থাৎ,- যে মহালক্ষ্মী ঈশ্বরের ঐশ্বর্য্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তিনি শ্রীরাধার বামসম্ভূতা অর্থাৎ তিনি শ্রীরাধার অংশ। সুতরাং শ্রীরাধা হচ্ছেন সর্ববিধ ঐশ্বর্য্যের মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
ঋগবেদে (১/৩০/৫) “স্ত্রোত্রং রাধানাং পতে গির্বাহোবীর যস্যতে I I’’
অর্থাৎ,- “হে বীর রাধানাথ স্তুতি ভাজন তোমার এ রূপ স্তুতি, তোমার বিভূতি সত্য ও প্রিয় হোক ।‘’এই রকম শাস্ত্রে বহু প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায় যে শ্রীমতী রাধারাণী শ্রীকৃষ্ণের আদিশক্তি ।
‘’শ্রীরাধারাণীর কৃপা ছাড়া শ্রীকৃষ্ণ গোবিন্দ চরণে ভক্তি লাভ অসম্ভব।‘’
পরমকরুনাময় সচ্চিদানন্দঘন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর একান্ত মাধুর্য শক্তির দীপ্ত প্রতিমূর্তি শ্রীরাধিকার চরণকমলে সবার মঙ্গল আর কল্যাণ প্রার্থনা আমার। হে আমার প্রাণধন কৃষ্ণ তুমি আমাদের হৃদয়ে ভক্তির ভাব জাগিয়ে দাও। সবাই একমনে তন্ময় হয়ে শ্রীহরিনাম জপ করুন,-
''হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।''
-জয় শ্রীরাধে

Post a Comment

0 Comments