কৃষ্ণভক্তির আদর্শ মীরাবাঈ
শ্রীমতি মীরা ছিলেন রাজপুত রাজকুমারী এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহান শুদ্ধভক্ত। মীরা বাঈ ১৩০০ মত বৈষ্ণবীয় ভক্তিগীতি হিন্দি ও গুজরাট ভাষায় রচনা করে তার সুলালিয়ত কন্ঠে তা গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেছেন।
মীরা ছিলেন অপরুপা সুন্দরী এবং কৃষ্ণভক্তির প্রচারক। তিনি সারা ভারতে হাজার হাজার শিষ্য-শিষ্যা করে কৃষ্ণভক্তির শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
মীরা বাঈ ১৪৯৮ সালে ভারতের রাজস্থানে নাগৌর জেলার কুরকী নামক গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা ছিলেন রাঠোর বংশীয় রাজপুত জমিদার যোদ্বা রতন সিং রাঠোর। মীরা বাঈএর মাতা বীরকুমারী ছিলেন ভক্তিময়ী নারী।
একবার বীরকুমারী তার মেয়ে মীরাকে নিয়ে এক বিবাহ অনুষ্ঠানে যান। বিয়ের বরকে সুন্দর পোশাকে সজ্জিত দেখে মীরা তার মাকে জিজ্ঞাসা করেন তার বর কেমন হবে। মা মৃদ হেঁসে শ্রীকৃষ্ণের ছবি দেখিয়ে বললেন, এই কৃষ্ণই তোমার বর হবেন।
সেইদিন থেকে মীরা কৃষ্ণকে নিজের স্বামী ভেবে ভেবে বিভিন্ন অপ্রাকৃত স্বপ্ন দেখতেন। তার বিশ্বাস হয়েছিল একদিন কৃষ্ণ তাকে বিবাহ করতে আসবেন।
একবার এক সন্ন্যাসী সাধু বাবাজী তাদের বাড়ীতে ভিক্ষা করতে আসেন উনার হাতে ছিল এক সুন্দর পিতলের গোপাল মূর্ত্তি। তা দেখে মীরা সেই গোপাল মুর্ত্তিটির জন্য বায়না ধরল এবং কান্নাকাটি শুরু করে দিল। সাধু বাবাজী বুঝলেন এই মেয়ে শ্রীকৃষ্ণের মহান ভক্ত হবেন সংগে সংগে তিনি তার গোপালকে তার হাতে দিয়ে দিলেন।
শৈশবেই চিতোর-রাজ রানা সিংহের জ্যেষ্ঠ পুত্র ভোজ রাজের সাথে মীরার বিয়ের হয়। যোদ্ধা পরিবারের সদস্য হয়ে মীরা তার স্বামীসহ সকলকে উল্লেখ করেন যে তিনি প্রকৃতই শ্রীকৃষ্ণের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। ফলে, শ্বশুরবাড়ীর লোকজন তার ঈশ্বর ভক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু তার স্বামী ভোজরাজ তা বিশ্বাস করেছেন। তাকে কোনদিন উত্তক্ত করেন নি।
তৈমুর কর্তৃক হিন্দুস্তান দখলের পর ইসলামী শাসনে আবদ্ধ দিল্লীর সুলতানের রাজত্বকালে রাজপুতেরা জোরপূর্বক নিজেদেরকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করে। কিন্তু বাবুর কর্তৃক সাম্রাজ্য দখল করলে রাজপুতদের সাথে যুদ্ধ হয়। মীরার স্বামী ভোজ রাজ ১৫২৭ খ্রীষ্টাব্দের ঐ যুদ্ধে নিহত হয়।
মীরার ২০ বছর বয়সী জীবনে মায়ের মৃত্যুর পর এটি ছিল ধারাবাহিক শোকের আরও একটি। তিনি মনে করলেন, ভালবাসা-প্রেম-আবেগ সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। কৃষ্ণপ্রেমে মত্ততা মীরার একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় হলেও কখনও কখনও এই মত্ততা নিয়ে তাকে শহরের অলি-গলিতে নাঁচতে হয়েছিল।
তার দেবর ও চিতোরগড়ের নতুন শাসক বিক্রমাদিত্য ছিলেন দুষ্ট-প্রকৃতির যুবক। মীরা'র খ্যাতি, সাধারণ ব্যক্তিদের সাথে তার মেলামেশা এবং নারী হিসেবে লজ্জাশীলতা না থাকায় কয়েকবারই বিক্রমাদিত্য তাকে বিষ মিশিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও, তার ননদ উদাদেবী মীরা বাঈ এর নামে বিভিন্ন কুৎসা রটাতে থাকেন।
মীরা বাঈ এই পারিবারিক সমাজ জীবন থেকে বেড়িয়ে এসে তৎকালীন শুদ্ধভক্ত ও সাধক রবিদাসের নিকট কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত হন।
বিক্রমাদিত্য জোর করে মীরা বাঈকে গৃহবন্দী করেন, তার খাবারে, আচমন জলে বিষ মিশিয়ে দিত, বিছানায় কাঁটা সূচ দিত, ফুলের ঝুড়িতে বিষধর সাপ রেখে দিত কিন্তু মীরা বাঈ এর কিছুই হয়নি শ্রীকৃষ্ণ তার সব বিপদ মুক্ত করে দিতেন।
একবার কোন খাবার না দিয়ে অনেক দিন একটি ছোট্ট ঘরে মীরাকে পনর ফিন আটকে রাখেন চিরতরে তাকে মারার জন্য। সেই ঘরের বাহির থেকে সবাই মীরা বাঈএর সুলালিয়ত মধুর গীত শুনতে পেতেন। পনর দিন পর দরজা খুললে সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখলেন মীরা বাঈ নৃত্য করছেন, ঘরের ভিতরে বিভিন্ন প্রসাদের থালা-বাটি , সুবাসিত গন্ধ আর সামনে তার সেই কৃষ্ণমুর্ত্তিটি মিটমিট করে যেন হাসছে।
কোন বাধাই তাকে কৃষ্ণভক্তি ও প্রচারে কেউ আটকাতে পারেনি। পরবর্ত্তীতে তিনি ভারতের বিভিন্ন তীর্থেভ্রমন ও কৃষ্ণভজন-কীর্ত্তন করে জীবন অতিবাহিত করেন।
কথিত আছে দ্বারকার এক কৃষ্ণমন্দিরে তিনি প্রবেশ করে আর বের হননি অর্থাৎ কৃষ্ণবিগ্রহে লীন হয়ে যান।।
0 Comments