ধারাবাহিক শ্রী জগন্নাথ লীলা মহিমা ♥️ ♥ পর্ব - ২২ ♥♥️ আজকের লীলাঃ লক্ষ্মীদেবী ও শ্রীয়া চণ্ডালিনী।

ধারাবাহিক শ্রী জগন্নাথ লীলা মহিমা
♥️  পর্ব - ২২ ♥️
আজকের লীলাঃ লক্ষ্মীদেবী ও শ্রীয়া চণ্ডালিনী।


অগ্রহায়ণ মাসে উড়িষ্যার অধিবাসীগণ লক্ষ্মীদেবীর বিশেষ পূজা করে থাকেন।
এই মাসের প্রত্যেক বৃহস্পতিবার গৃহের মহিলারা বিবিধ নিয়ম-রীতি ও উপচার সহকারে সাড়ম্বরে লক্ষ্মীদেবীর পূজার আয়োজন করে থাকেন।
ঐদিন লক্ষ্মীদেবী শ্রীজগন্নাথের অনুমতিক্রমে মন্দির থেকে বাইরে আসেন তাঁর ভক্তদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
...
একবার এক শুভ বৃহস্পতিবারের সকালে এক বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর ছদ্মবেশে লক্ষ্মীদেবী বিভিন্ন গৃহ পরিদর্শন করতে গেলেন।
এক বণিক-গৃহে গিয়ে দেখলেন, তাঁরা তখনও শয্যাত্যাগ করে নি, সেজন্য তাঁদের বাড়ীঘরও পরিষ্কার করা হয় নি।
তিনি ঐ গৃহের এক মহিলাকে ঐ বিশেষ দিনে লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা করার গুরুত্ব বোঝালেন।
কিন্তু ঐ বৃদ্ধা লক্ষ্মীদেবীর কথায় কর্ণপাত না করায় তিনি তাঁদের গৃহ থেকে সকল ঐশ্বর্য অপহরণ করলেন এবং ক্রমশঃ ঐ পরিবার অত্যন্ত দরিদ্র হয়ে পড়ল এবং ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহন করল।
....
তারপর লক্ষ্মীদেবী একটি গ্রামে গেলেন যেখানে চণ্ডালেরা থাকে।
তিনি শ্রীয়া চণ্ডালিনীর গৃহে গেলেন। তিনি ঐদিন ব্রত পালন করতঃ খুব ভোরে উঠে সমস্ত গৃহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে লক্ষ্মীদেবীর পূজার উদ্দেশ্যে আল্পনাদি দিয়ে সুন্দরভাবে সুসজ্জিত করেছিলেন। এসব দেখে লক্ষ্মীদেবী অত্যন্ত প্রীত হয়ে তাঁকে আরও ধন ঐশ্বর্য বৃদ্ধির জন্য আশীর্বাদ করে সকল মনস্কামনা পূর্ণ করলেন।
.....
ইতিমধ্যে শ্রীজগন্নাথ ও বলদেব প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে লক্ষ্মীদেবীকে চণ্ডালের গৃহ থেকে প্রত্যাবর্তন করতে দেখলেন। এতে বলদেব অত্যন্ত বিচলিত হয়ে জগন্নাথকে কঠোর ভাষায় বললেন - "তোমার স্ত্রী আজকাল চণ্ডালের গৃহে যাচ্ছে। তারা অপবিত্র, সদাচারহীন - কোনো বিধিনিয়ম পালন করে না। কিভাবে এমন চণ্ডালের গৃহে যাবার পর ইনি আমাদের মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেন? আমাদের মন্দির অপবিত্র হয়ে যাবে। তোমাকে অবশ্যই তাঁকে পরিত্যাগ করতে হবে।" জগন্নাথ বলদেবকে এই বলে শান্ত করার চেষ্টা করলেন যে লক্ষ্মীদেবীকে এইবার মার্জনা করা হোক এবং আর কখনও এমন না করার জন্য বলা হোক। কিন্তু বলরাম তাঁর এই সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন যে তাঁকে আর মন্দিরে প্রবেশের অনুমোদন দেয়া হবে না। "তুমি যদি লক্ষ্মীদেবীকে প্রবেশের অনুমতি দাও, তাহলে তোমার আমাকে ছাড়তে হবে। আমি মন্দিরের বাইরে অবস্থান করব।" যেহেতু জগন্নাথের অগ্রজ ভাইয়ের প্রতি অত্যন্ত বাধ্য, সেজন্য তিনি শ্রীবলরামের আজ্ঞা পালন করে লক্ষ্মীদেবীকে ডেকে বললেন যে তাঁর মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি নেই।
জগন্নাথের নিকট হতে একথা শ্রবণ করে লক্ষ্মীদেবী অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। বিবাহের সময় শ্রীজগন্নাথ তাঁর পিতার এই কথায় সম্মত হয়েছিলেন যে তিনি তাঁর স্ত্রী-কৃত দশটি অপরাধ ক্ষমা করবেন। অধিকন্তু, তাঁর এই গ্রাম পরিদর্শন অপরাধমূলক ছিল না, কেননা সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হয়েছিল যে মার্গশীর্ষ (অগ্রহায়ণ) মাসের বৃহস্পতিবার তিনি তাঁর ভক্তদের আশিস দান করার জন্য গ্রামগুলি পরিদর্শন করতে বাইরে যেতে পারেন। তাঁকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হল। এর ফলে তিনি অত্যন্ত ক্রোধান্বিতা হলেন এবং জগন্নাথদেবকে এই বলে অভিশাপ দিলেন যে আগামী ১২ বছর তিনি নিজেকে পরিতৃপ্ত করার জন্য যথেষ্ট আহার্য পাবেন না এবং তিনি কেবল লক্ষ্মীদেবীর রন্ধন করা ও পরিবেশন করা খাদ্যদ্রব্য ভোজন করতে সমর্থ হবেন। জগন্নাথকে অভিশাপ দানের পর তিনি যখন তাঁর সকল পরিচারিকাসহ মন্দির ত্যাগ করলেন, তখন মন্দির ঐশ্বর্যশূণ্য, শ্রীহীন হয়ে উঠল। ভাণ্ডারঘর শূণ্য হল।
পরদিন সকালে জগন্নাথ ও বলরাম প্রাত-রাশের জন্য অপেক্ষা করলেন, কিন্তু কিছুই এল না। বলরাম জগন্নাথকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আমাদের প্রাত-রাশের কি হল? এত বিলম্ব হচ্ছে কেন?" জগন্নাথ উত্তরে বললেন, "কোনও প্রাত-রাশ তৈরি করা হয় নি, কেননা লক্ষ্মীদেবী তাঁর সকল পরিচারিকাসহ মন্দির ছেড়ে চলে গিয়েছে, সেজন্য রান্না করার কেউ নেই এখানে।" তখন বলরাম ও জগন্নাথ কিছু আহার্য প্রস্তুত করার জন্য রন্ধনশালায় প্রবেশ করলেন। মন্দির থেকে তাঁদের দেবীকে বরখাস্ত করায় ক্রোধান্বিতা হয়ে লক্ষ্মীদেবীর অনুচরগণ রন্ধনশালার সমস্ত উনুনগুলি ভেঙে দিয়ে গেছে। তারা দু'ভাই রান্নার কিছু উপকরণ সংগ্রহের জন্য ভাণ্ডাঘরে প্রবেশ করে দেখলেন, ঘর শূণ্য, কিছুই নেই সেখানে, কেননা লক্ষ্মীদেবী তাঁর সকল শ্রী-ঐশ্বর্য মন্দির থেকে অপসৃত করেছিলেন। সেই সময় দুই ভ্রাতা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লেন। লক্ষ্মীদেবীর উপস্থিতি থেকে বঞ্চিত হয়ে এবং ক্ষুধায় ক্লিষ্ট হয়ে, তাঁরা উভয়ে ভিক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে বাইরে যেতে মনস্থ করলেন।
আমাদের জানতে হবে যে যদিও ভগবানই সকল ঐশ্বর্যের অধীশ্বর এবং প্রত্যেকের পালনকারী, তবুও তিনি একজন সাধারণ ভিক্ষুকের মতো ভিক্ষা করতে যাওয়ার এই বিশেষ লীলাটি করেছিলেন তাঁর ভক্তের মহত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য। এইভাবে শ্রীজগন্নাথ ও শ্রীবলদেব দুজন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করে গৃহে গৃহে ভিক্ষা করার জন্য নগরে গেলেন। লক্ষ্মীদেবী থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাঁদের উভয়কেই অত্যন্ত অশুভ দেখাচ্ছিল এবং সেজন্য কেউই তাঁদের ভিক্ষা দিচ্ছিল না।
ইতিমধ্যে, লক্ষ্মীদেবীর নির্দেশে সূর্যদেব সূর্যের তাপ বৃদ্ধি করেছিলেন। দুই ভাইকেই অত্যন্ত উত্তপ্ত বালুকার উপর দিয়ে অত্যন্ত কষ্ট করে হাঁটতে হচ্ছিল। তাঁরা একটি সুন্দর পুষ্করিণী দেখতে পেয়ে তৃষ্ণা নিবারণ হেতু কাছাকাছি আসামাত্র জল শুকিয়ে গেল। অবশেষে তাঁরা বৃক্ষের কচিপাতা ভক্ষণের উদ্দেশ্যে বৃক্ষের কাছে যাওয়া মাত্রই বৃক্ষের পত্ররাজি শুকিয়ে ঝরে পড়ে গেল। উভয়েই খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলেন। বস্তুত, তাঁরা মন্দিরে এতই ঘন ঘন ভোজন করতেন যে একবার ভোজনের পর হাত ধোওয়া মাত্রই পরবর্তী ভোজনের সময় সমাগত হত। সেদিন সারাদিন অতিবাহিত হল, কিন্তু তাঁরা কিছুই ভোজন করতে পারলেন না।
শীঘ্রই তাঁরা একটি মন্দিরে গেলেন যেখানে তখন প্রসাদ বিতরণ করা হচ্ছিল। বহু মানুষ সেখান থেকে প্রসাদ নিয়ে গৃহে ফিরছিল। জগন্নাথ ও বলরাম প্রসাদসহ প্রত্যাগমনরত মহিলাদের একজনের কাছে গেলে দয়াবশতঃ তিনি তাঁদেরকে কিছু প্রসাদ দিতে সম্মত হলেন। তাঁর কাছে কিছু নিবেদন করা মুড়ি প্রসাদ ছিল, তিনি তাঁদেরকে যেই একমুঠো মুড়ি দিতে যাবেন, ঠিক তখনই লক্ষ্মীদেবীর নির্দেশে প্রবল দমকা বাতাস এসে সমস্ত মুড়ি উড়িয়ে নিয়ে গেল। দুই ভাই কিছু আহার পাওয়ার এই সুযোগটিও হারালেন।
পরিশেষে, কোথায় আহার্য পাওয়া যাবে এ সম্বন্ধে লোকদের জিজ্ঞেস করলে তাঁদের একজন তাঁদেরকে চণ্ডালদের গ্রামে যেতে বলল, সেখানে অত্যন্ত দানশীল একজন ব্যক্তি থাকেন। জগন্নাথ ও বলরাম সেই গৃহে গিয়ে কিছু আহার্য চাইলেন। গৃহস্থ তাঁদের ভোজন করাতে পারবেন জেনে অত্যন্ত প্রীত হলেন, কিন্তু বলরাম একজন চণ্ডালের রান্না করা আহার্য ভোজন করতে সম্মত হলেন না। বরং তিনি নিজেই রান্না করে আহার্য প্রস্তুত করবেন বলে গৃহস্থকে কিছু অরন্ধিত আহার্যদ্রব্য ও রান্নার সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করতে বললেন। একটি নতুন উনুন তৈরি করে দেওয়া হল এবং রান্নার জন্য নূতন কিছু মাটির পাত্র তাঁদের দেওয়া হল। জগন্নাথ রান্না শুরু করার জন্য প্রস্তুত হলেন - কিন্তু কিছুতেই উনুনে আগুন ধরাতে পারলেন না, আহার তৈরীর কথা তো বলাই বাহুল্য। বলরাম জগন্নাথকে তাঁর অপারদর্শিতার জন্য ভৎর্সনা করলেন এবং নিজে আহার্য প্রস্তুত করতে গেলেন। কিন্তু যখন বলরাম কাঠে আগুন ধরানোর চেষ্টা করলেন, কাঠ কিছুতেই জ্বলল না, কেবল প্রচুর ধোঁয়ার সৃষ্টি হতে লাগল। তাঁদের চোখ থেকে জল পড়তে লাগল,আর সকলেই কাশতে লাগল। তখন বলরাম ও জগন্নাথ গৃহপতিকে কিছু রান্নাকৃত খাবার আনতে বললে গৃহের পরিচারিকারা দুই ভাইকে আহার্য পরিবেশন করলেন। তাঁরা যখন ভোজন করেছিলেন, তখন তাঁরা সহমত হলেন যে ঐ খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু, বস্তুতঃ মন্দিরে পরিবেশিত আহার্যের মতোই সুস্বাদু, যেখানে লক্ষ্মীদেবী রান্না করেন। ভোজনের শেষে তাঁদের কিছু সুস্বাদু পিঠে পরিবেশন করা হল। সচরাচর মন্দিরে ভোজনের শেষে লক্ষ্মীদেবী তাঁদের বিশেষ পিঠে খেতে দিতেন। লক্ষ্মীদেবী অবশ্যই এই গৃহে বিরাজ করছেন - জগন্নাথ ও বলরাম ভাবলেন। অন্য কেউ কিভাবে জানতে পারবে যে তাঁরা ভোজনের শেষে বিশেষ পিঠে আহার করেন? জগন্নাথের অগ্রজ হওয়ায় বলরাম লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারতেন না, কেননা তিনি তাঁর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী; উড়িষ্যায় এটাই রীতি। বলরাম জগন্নাথকে লক্ষ্মীদেবীর নিকটে গিয়ে মার্জনা চাইতে এবং হাত ধরে তাঁকে মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে অনুরোধ করলেন। তিনি লক্ষ্মীদেবীকে বলতে বললেন যে তাঁর ভক্তবৃন্দকে পরিদর্শন করতে মন্দিরের বাইরে যেতে আর কখনোই বাধা দেয়া হবে না আর তিনি যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারবেন, কেবল সর্বদা তাঁকে মন্দিরে ফিরে আসতে হবে।
জগন্নাথের নিকট সবকিছু শ্রবণ করে লক্ষ্মীদেবী পরিতৃপ্ত হলেন। তিনি জগন্নাথকে প্রতিজ্ঞা করালেন যে জগন্নাথের প্রসাদ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে উঁচু জাতি বা নিচু জাতির মধ্যে কোন পার্থক্য করা হবে না। অদ্যাবধি জগন্নাথ মন্দিরে জাতি-বর্ণ-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলকে প্রসাদ পরিবেশন করা হয়। এখানে ব্রাহ্মণ ও চণ্ডাল এক পাত্রে প্রসাদ ভোজন করতে পারেন।
জয় জগন্নাথ! জয় বলদেব!!
জয় শ্রীমতী লক্ষ্মীদেবী!!

Post a Comment

0 Comments