শ্রীদণ্ড মহোৎসব একটি স্মরণাঞ্জলি

শ্রীদণ্ড মহোৎসব একটি স্মরণাঞ্জলি

 
শ্রীল রঘুনাথ আজ পানিহাটিতে এসেছেন। উদ্দেশ্য, প্রভু নিতাইচাঁদের চরণ দর্শন। নিতাইচাঁদ পানিহাটিতে অবস্থান করছেন। সাথে কিছু কীর্তনীয়া, অঙ্গসেবক এবং রামদাস, সুন্দরানন্দ, কমলাকর পিপ্পলাই, গৌরীদাস, উদ্ধারণ প্রমুখ পরিকরবৃন্দ।প্রভুর দর্শন পেলেন শ্রীল রঘুনাথ। দেখলেন প্রভু নিত্যানন্দ গঙ্গার তীরে একটি বৃক্ষমূলে বাঁধানো চবুতারার উপর উপবিষ্ট। তাঁর অঙ্গ থেকে যেন সূর্যের মত জ্যোতি নির্গত হচ্ছে। চবুতারার উপরে নীচে অনেক ভক্ত নিতাইচাঁদকে ঘিরে কৃষ্ণকথা আলাপনে মত্ত।
শ্রীরঘুনাথ এই প্রথম নিতাইচাঁদের দর্শন পেলেন। পরনে নীল পট্ট, মাথায় চাঁচর কেশ গুঞ্জামালা দিয়ে আঁটা, কর্ণে মকর কুণ্ডল, নাসায় বেসর। প্রভুর সুন্দর গ্রীবায় তুলসী কণ্ঠী আর বিস্তৃত বক্ষপটে নানা রত্নহার। প্রভু যখন হাসেন- মনে হয় মুকুতার পাঁতি ঝরছে। প্রভু যখন তাকান- মনে হয় মদন শর হানছে। প্রভুর গলার বনমালা সুরধুনীর মন্দ মন্দ বায়ে কম্পিত হচ্ছে আর আপনা আপনি বৃদ্ধি পেয়ে চরণ চুম্বন করছে। আহা ! সে চরণে শঙ্খ, গদা, মীন, হল প্রভৃতি কত মঙ্গলচিহ্ন। প্রভুর চরণ নখ যেন অর্ধ চন্দ্র, তায় সোনার নুপুর রুনুঝুনু রবে প্রভুচরণের গুণগান করছে আর ভ্রমরেরা ভ্রমবশতঃ পদ্ম ভেবে সে চরণের পাশে গুঞ্জরণ করছে। সেবকেরা চামর ঢুলাচ্ছেন। প্রভু নিতাইচাঁদ গৌরকথা বিনা রইতে পারেন না। তাই কীর্তনীয়ারা নানারাগে গৌরহরির কীর্তন করে চলেছেন আর তা শুনে প্রভু নিতাইচাঁদ কখনো হাসছেন, কখনো কাঁদছেন, কখনো গর্জন করছেন। শ্রীরঘুনাথ এই রূপ দর্শন করে মুগ্ধ হলেন। দূর হতে সাষ্টাঙ্গ দন্ডবৎ করলেন নিতাইকে। তা দেখে সেবক গিয়ে নিতাইচাঁদকে বললেন :"রঘুনাথ এসেছেন"।
"শুনি প্রভু কহে চোরা দিলি দরশন।
আয় আয় আজি তোরে করিমু দন্ডন।।"
- নিত্যানন্দপ্রভু রঘুনাথকে দেখে বললেন, "ওরে চোরা, তুই এতদিনে দেখা দিলি ? কাছে আয়, তোকে আজ দন্ড দিব।"
এই বলে প্রভু নিত্যানন্দ টেনে এনে রঘুনাথ দাস গোস্বামীর মস্তকে নিজ চরণ স্থাপন করলেন।
সেক্ষণে গঙ্গাতটে ভক্ত ও ভগবানের এক অপরূপ মিলনায়তন রচিত হল। সুরধুনী উচ্ছলিতা হলেন, শুক পিক মধুর কলতানে আনন্দ রব করতে লাগল, অন্তরীক্ষে দেবতাগণ জয় জয় রবে মুখর হলেন। ভক্তেরা "হরি হরি" ধ্বনি করলেন। অভিন্ন চৈতন্যতনু করুণাকর নিতাইচাঁদের চরণ পেয়ে দাস গোস্বামী নিজেকে ধন্য করলেন।
অদ্বয়জ্ঞান ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণের অভিন্ন তনু শ্রীবলরাম গৌড়মণ্ডলে নিতাইচাঁদ রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। ব্রজেশ্বরী রাধারাণীর অনুচরী অনঙ্গমঞ্জরী ও তাঁতে প্রবেশ করেছেন। আর দাস গোস্বামী হলেন স্বয়ং রতিমঞ্জরী। যোগপীঠে যুগলসেবায় অষ্টমঞ্জরীর অন্যতমা। আজ তিনিই রঘুনাথ দাস গোস্বামী রূপে এসেছেন।
দাস গোস্বামীপাদ প্রথমে নিত্যানন্দ প্রভুর চরণ দর্শন না করেই সরাসরি গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সেবা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু নিতাই চরণসেবা বিনা কখনোই গৌরসেবায় অধিকার হয় না। গৌর হলেন নিতাইচাঁদের সম্পত্তি। এই কারণে নিতাই তাঁকে "চোর" বলেছেন- যেন দাস গোস্বামী নিতাইচাঁদের নিজধন চুরি করেছেন। তাই চোরকে তো শাস্তি পেতেই হবে।
"নিকটে না আইস চোরা ভাগ দূরে দূরে।
আজ লাগ পাঞাছি দন্ডিমু তোমারে।।"
- শ্রীনিতাই বললেন, হে চোরা! তুমি কাছে আসো না; দূরে দূরে পালিয়ে বেড়াও। কিন্তু আজ তোমাকে ধরেছি। আজ দন্ড দেব।
কী দন্ড ??
"দধি চিড়া ভক্ষণ করাও মোর গণে।" - আমার গণকে দধিচিড়া ভোজন করাও।
হাতে চাঁদ পেলেন রঘুনাথ। জগৎপ্রাণ নিত্যানন্দ তাঁর কাছে দধিচিড়া খেতে চেয়েছেন। কত সৌভাগ্যে এমন সেবা করতে পারা যায়। নিজের গ্রাম হতে দধি, চিড়া, দুধ, কলা, চিনি ইত্যাদি নানা ভোগ আনালেন। কত পসারী এল পসার নিয়ে। দাম দিয়ে রঘুনাথ সব কিনে নিলেন। আশপাশের কত গাঁ থেকে দলে দলে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, শূদ্র নির্বিশেষে সবাই এলেন। সবাইকে যথাযোগ্য মর্যাদায় বসালেন প্রভু নিতাইচাঁদ। দুইচার শত মালসা আর সাতখানি বড় মৃৎকুণ্ডিকা আনা হল। চিড়া মাখা হল অনেক পদে। শ্রীল কবিরাজ গোস্বামী চরিতামৃতে তার অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন। ঘন দুধে চাঁপাকলা, ঘি, চিনি, কর্পূর দিয়ে এক পদে চিড়া মাখা হল। দধি, চিনি দিয়ে এক পদে আর গরম দুধে চিড়া ভিজিয়ে আরেক পদে চিড়া মাখা হল।
"ধুতি পরি প্রভু যবে পিণ্ডাতে বসিলা।
সাতকুণ্ডী বিপ্র তাঁর অগ্রেতে ধরিলা।।"
- নিত্যানন্দ প্রভু ধুতি পরে বৃক্ষতলে বসলেন। তখন বিপ্র তাঁকে সাতকুণ্ডী চিড়া ধরে দিলেন।
এমন সময় শ্রীল রাঘব পণ্ডিত হাজির। আজ তাঁর গৃহমন্দিরে নিতাইচাঁদের ভিক্ষার দিন। তা দেখে শ্রীপ্রভু বললেন, "রাত্রে তোমার ঘরে প্রসাদ করিমু ভক্ষণ"- অর্থাৎ, তুমি চিন্তা কর না। তোমার ঘরে প্রসাদসেবা রাতে করব।
এবার ধ্যানে বসলেন প্রভু নিত্যানন্দ। বৈকুণ্ঠে অনন্তরূপে যাঁর চরণ ধ্যান করেন, অযোধ্যায় লক্ষ্মণ রূপে যাঁর চরণ সেবা করেন, দ্বারকায় সংকর্ষণ রূপে যাঁকে আগলে রাখেন আর নিকুঞ্জে অনঙ্গমঞ্জরী রূপে যাঁর সেবা করেন- সেই পরাৎপর অখিলেশ্বর গৌরসুন্দরের ধ্যান করলেন। নিতাই ডাকলে গৌর কী না এসে পারেন ? এলেন গোরাচাঁদ। ভাগ্যবন্তরা পেল দর্শন; কেউ বা পেল না। মহাপ্রভুকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন নিতাই। ছোটভাইকে হাত ধরে নাচতে নাচতে মালসা আর কুণ্ডীর কাছে নিয়ে গেলেন। প্রতিটা মৃৎপাত্র থেকে এক এক গ্রাস করে তুলে দিলেন মহাপ্রভুর বদনে। গোরাচাঁদও হাসতে হাসতে খাইয়ে দিলেন নিতাইকে। তারপর গৌর লয়ে নিত্যানন্দ আসনে এসে বসলেন। চার কুণ্ডী আতপ চিড়া দুই ভাই গ্রহণ করতে লাগলেন। সকল ভক্তকে বললেন, "হরি বলি করহ ভোজন।" দুই প্রভুর ভোগ গ্রহণ হয়ে গেছে। প্রভু আজ্ঞা পেয়ে এবার সবাই মহাপ্রসাদ সম্মান করতে লাগলেন।
"গোপজাতি আমি বহু গোপগণ সঙ্গে।
আমি সুখ পাই এই পুলিন ভোজন রঙ্গে।।"
- নবদ্বীপলীলায় ব্রাহ্মণকূলে আবির্ভূত প্রভু নিত্যানন্দ নিজের বলরাম স্বরূপ স্মরণ করে বললেন, আমি গোপজাতি। আমি সকল গোপসখার সাথে পুলিন ভোজনে বড় সুখ পাই।
দুই চাঁদের লীলা দেখে নিত্যানন্দ প্রভুর যত গোপ পরিকর ছিলেন শ্রীরামদাস প্রমুখ প্রেমাবিষ্ট হলেন। পূর্বলীলায় যমুনাপুলিন ভোজন স্মরণপথে উদিত হল। ভোজন শেষে নিত্যানন্দ প্রভু পুনরাচমন করলেন। সেবক এসে প্রভুর কণ্ঠে প্রসাদী মাল্য দিলেন এবং প্রভু অঙ্গ প্রসাদী চন্দনে চর্চিত করলেন। এইভাবে চিড়া দধি মহোৎসবের বিশ্রাম হল।
অদ্যাবধি গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় এই ঘটনার স্মারক রূপে জৈষ্ঠ্য শুক্লা ত্রয়োদশীটি এই মহোৎসব হিসেবে পালন করেন। এই উৎসবের অপর নাম "শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামীর দন্ড মহোৎসব"। ভক্ত ও ভগবানের এক অনবদ্য প্রেমক্রীড়ার গাথা। যা শ্রবণে রসিকের হৃৎকর্ণরসায়ন তৃপ্তিলাভ করে।
মূলগ্রন্থ : শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, অন্ত্যলীলা, ষষ্ঠ।
গ্রন্থকার: শ্রীল কবিরাজ গোস্বামী

Post a Comment

0 Comments