চাতুর্মাস্য ব্রত মাহাত্ম্য





চাতুর্মাস্য ব্রত মাহাত্ম্য


গৌড়ীয় বৈষ্ণব জীবনে চাতুর্মাস্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গদেশের বৈষ্ণবগণ রথযাত্রার পূর্বেই সদলবলে পুরীধাম পৌঁছে যেতেন। সেখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সাথে সংকীর্তনরঙ্গে তারা রথযাত্রা উদযাপন করতেন। আর রথযাত্রার পর সেখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সন্নিধানে থেকে এ চারটি মাস অতিবাহিত করতেন।
চারিমাস রহিলা সবে মহাপ্রভু-সঙ্গে।
জগন্নাথের নানা যাত্রা দেখে মহারঙ্গে ॥
(চৈ.চ. মধ্য ১৫/১৬)
এ চারটি মাস জগন্নাথের নানারকমের উৎসবে তারা শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর সঙ্গে অংশগ্রহণ করতেন।
এইমত রাসযাত্রা, আর দীপাবলী।
উত্থান-দ্বাদশীযাত্রা দেখিলা সকলি ॥
তবে মহাপ্রভু সব ভক্তে বোলাইল।
‘গৌড়দেশে যাহ সবে’ বিদায় করিল ॥
(চৈ.চ. মধ্য ১৫/৩৬, ৩৯)
উত্থান একাদশীর পর রাসপূর্ণিমায় চাতুর্মাস্য সমাপন পূর্বক তারা স্ব স্ব গৃহে ফিরে আসতেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পরমগুরু শ্রীপাদ মাধবেন্দ্র পুরী মহাশয়ও বৃন্দাবন যাবার পথে রেমুণায় গ্রীষ্মকালে চন্দনযাত্রা উৎসব প্রবর্তন করে নীলাচল প্রত্যাবর্তন করেন এবং সেখানেই চাতুর্মাস্য পালন করেন।
গ্রীষ্মকাল অন্তে পুনঃ নীলাচলে গেলা।
নীলাচলে চাতুর্মাস্য আনন্দে রহিলা ॥
(চৈ.চ. মধ্য ৪/১৬৯)
শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক- বছরের এ চারটি মাস বর্ষা লেগেই থাকে। এ সময়টি ভ্রমণের পক্ষে অনুকুল নয়, তাই পরিব্রাজক সন্ন্যাসীরা তাদের প্রচার পরিক্রমার বিশ্রাম দিয়ে একটি স্থানকে কেন্দ্র করেই ভজনে মনোনিবেশ করেন। অন্যদিকে এ চার মাসে প্রাকৃতিক কারনে মানুষের মাঝে রজো ও তমোগুণের প্রভাব বিস্তার করে, তাই যতদূর সম্ভব বিধিনিষেধের মধ্যে থাকলে বিপত্তি এড়ানো সম্ভব। ভবিষ্যপুরাণে বলা হয়েছে,
যো বিনা নিয়মং মর্ত্যাে ব্রতং বা জপমেব বা।
চাতুর্মাস্য নয়েন মূর্খো জীবন্নপি মৃতো হি সঃ ॥


চাতুর্মাস্য ব্রত
অর্থাৎ, যে ব্যাক্তি নিয়ম, ব্রত বা জপ ব্যাতীত চাতুর্মাস্য যাপন করে, সেই ব্যাক্তি অজ্ঞ ও জীবন্মৃত।শ্রীব্রহ্মাও নারদমুনিকে বলেছেন, হে নারদ, চাতুর্মাস্য ব্রত ভক্তি সহকারে পালন করলে মানুষ পরমাগতি লাভ করার সুযোগ পাবে। স্কন্দ পুরাণের নাগরখ-ে বলা হয়েছে,
শ্রাবণে বর্জয়েৎ শাকং দধি ভাদ্রপদে তথা।
দুগ্ধম্ আশ্বযুজে মাসি কার্তিকে চামিষং ত্যাজেৎ ॥

শ্রাবণ মাসে শাক, ভাদ্রে দই, আশ্বিনে দুধ এবং কার্তিকে মাষকলাই ডাল খাওয়া চলবে না। এ সময়ে এই দ্রব্যগুলো রোগ সৃষ্টি করে। মন বিক্ষিপ্ত করে। কর্মী, জ্ঞানী, যোগী ও ভক্ত প্রভৃতি সকলের মঙ্গলের জন্যই চাতুর্মাস্য পালন করা আবশ্যক। চাতুর্মাস্য ব্রতের মাধ্যমে অনেকগুলো কর্মকা-ীয় ফল পাওয়া যায়। যেমন, এই চারমাসে লবণ বর্জনকারী মধুর কণ্ঠস্বর, তৈল বর্জনকারী দীর্ঘায়ু সন্তান, যোগাভ্যাসী ব্রহ্মপদ, শ্রীবিষ্ণুর গীতবাদ্যকারী গন্ধর্বলোক প্রভৃতি প্রাপ্ত হয়। সেজন্য অনেকে চাতুর্মাস্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে চান না। তারা আসলে চাতুর্মাস্যের ভক্তিমূলক সুকৃতি সম্পর্কে তেমন একটা অবগত নন। শ্রীহরিভক্তিবিলাসে (১৫/১১৩) বলা হয়েছে,
চতুর্মাসেষু কর্তব্যং কৃষ্ণভক্তি বিবৃদ্ধয়ে ॥
অর্থাৎ, কৃষ্ণভক্তি বৃদ্ধির জন্যই চাতুর্মাস্য ব্রত কর্তব্য। সুতরাং কৃষ্ণভক্তিলিপ্সু ভক্তগণ কেন এ সুযোগ হাত ছাড়া করবেন। তদুপরি এ মাসে শ্রবণ-কীর্তনেরও ব্যাপক মহিমা কীর্তিত হয়েছে।

জপ হোমাদ্যনুষ্ঠানং নামসংকীর্তনস্তথা।
স্বীকৃত্য প্রার্থয়েদ্দেব্য গৃহীত নিয়মোবুধঃ ॥
(হ.ভ.বি ১৫/১২২)

অর্থাৎ বিজ্ঞব্যাক্তিগণ জপযজ্ঞাদি অনুষ্ঠান ও শ্রীনামসংকীর্তন প্রভৃতি ব্রতনিয়ম স্বীকার করবেন। এ ব্রতের অন্যান্য নিয়মাদি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যাবে শ্রীহরিভক্তিবিলাসের ১৫শ অধ্যায়ে। অনেকে চাতুর্মাস্য বিষয়ে শ্রীল প্রভুপাদ কী বলেছেন সে সম্পর্কে জানতে চান। তাদের জন্য শ্রীল প্রভুপাদের উক্তিগুলো নিম্নে প্রদত্ত হলো : “আষাঢ় (জুন-জুলাই) মাসের শুক্লপক্ষে শয়ন একাদশী থেকে শুরু করে কার্তিক (অক্টোবর-নভেম্বর) মাসের শুক্লপক্ষে উত্থান একাদশী পর্যন্ত এ চারমাসকে বলা হয় চাতুর্মাস্য। কোনো কোনো বৈষ্ণব আষাঢ়ের পূর্ণিমা থেকে কার্তিকের পূর্ণিমা পর্যন্ত চাতুর্মাস্য-ব্রত পালন করেন। এ চান্দ্রমাসের গণনা অনুসারে শ্রাবণ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্তও চাতুর্মাস্য ব্রত পালন করেন। সৌর অথবা চান্দ্র উভয় গণনাতেই এ সময়টি বর্ষাকাল। কেউ গৃহস্থই হোন আর সন্ন্যাসীই হোন, চাতুর্মাস্য ব্রত সকলের পালন করা অবশ্য কর্তব্য। এই ব্রতটি সকল আশ্রমেরই করা বাধ্যতামূলক। এ ব্রত পালনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে এ চার মাস কাল ভোগবাসনা সংকুচিত করা। সেটি খুব একটা কঠিন নয়। শ্রাবণ মাসে শাক, ভাদ্র মাসে দই, আশ্বিন মাসে দুধ ও কার্তিক মাসে সকল প্রকার আমিষ আহার পরিত্যাগ করতে হয়। আমিষ আহার মানে মাছ-মাংস আহার। তেমনই, মসুর ডাল ও কলাইয়ের ডালকেও আমিষ বলে গণনা করা হয়। এ দুই ডালে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে। মূল কথা হচ্ছে, বর্ষার এ চারমাসে ইন্দ্রিয়তৃপ্তিকর আহারাদি পরিত্যাগ করার অনুশীলন করতে হয়।”
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত (মধ্য ৪/১৬৯, তাৎপর্য)

“ভারতবর্ষে বর্ষাকালের চারটি মাস (শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক) কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের জন্য এক স্থান থেকে আর এক স্থানে ভ্রাম্যমান সাধুরা তাঁদের ভ্রমণ স্থগিত রেখে কোনো পুণ্যস্থানে অবস্থান করেন। এ সময় কতগুলো বিধিনিষেধ দৃঢ়তার সাথে পালন করা হয়। স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে যে, সেই সময়ে কেউ যদি অন্তত চারবার বিষ্ণুমন্দির প্রদক্ষিণ করেন, তাহলে বুঝতে হবে যে , তিনি সমস্ত ব্রহ্মা- ভ্রমণ করেছেন। এই ধরনের পরিক্রমার ফলে গঙ্গার জলের দ্বারা নিস্নাত সমস্ত পুণ্যতীর্থ দর্শন হয়ে যায় এবং অনায়াসে ভগবদ্ভক্তির স্তরে উন্নীত হওয়া যায়।”
শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধু, ৯ম অধ্যায় (ভক্তি অঙ্গগুলির বিশদ বিবেচনা)

“অনেক লোক আছেন যাঁরা উন্নততর জীবন অথবা স্বর্গারোহণ করবার জন্য চান্দ্রায়ণ, চাতুর্মাস্য আদি স্বেচ্ছামূলক তপশ্চর্যার অনুশীলন করেন। এ সমস্ত পন্থায় বিশেষ বিশেষ বিধি-নিষেধের মাধ্যমে জীবনযাত্রাকে পরিচালিত করার জন্য কঠোর ব্রত পালন করতে হয়। যেমন, চাতুর্মাস্য ব্রত পালনকারী চার মাস দাড়ি কামান না, নিষিদ্ধ জিনিস আহার করেন না, দিনে একবারের বেশি দুবার আহার করেন না অথবা কখনও গৃহ পরিত্যাগ করেন না। এভাবেই সাংসারিক সুখ পরিত্যাগ করাকে বলা হয় তপোময় যজ্ঞ।”
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (৪/২৮, তাৎপর্য)
🙏🙏🙏🙏

Post a Comment

0 Comments