চক্রব্যূহ (বর্তমান হিন্দুদের করুন পরিস্থিতি)



স্মৃতি শাস্ত্র মহাভারতে উল্লেখ আছে কিভাবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনের পুত্র অভিমূণ্যের মৃত্যু হয়। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে প্রতিদিন কিছু ব্যূহ রচনা করে। তার মধ্যে একটি বূহ্য হলো চক্রব্যূহ।
চক্রাকারে দুর্ভেদ্য সেনা সমাবেশের কারণে এর নাম চক্রব্যূহ। দ্রোণাচার্য এই ব্যূহ রচনায় পারদর্শী ছিলেন।  এইরূপ সেনা-সমাবেশ ভেদ করতে একমাত্র অর্জুন সক্ষম ছিলেন।  অর্জুন পুত্র অভিমন্যু এই সেনা-সমাবেশে প্রবেশ করে ধ্বংস করার বিদ্যা অর্জন করেছিলেন, কিন্তু বেরিয়ে আসার বিদ্যা জানতেন না।  কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অভিমন্যু এই চক্রে ঢুকে বহু শত্রুসৈন্য বিনাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।  কিন্তু  দ্রোণ,  কৃপ,  কর্ণ,  অশ্বত্থামা,  বৃহদ্বল ও কৃতবর্মা, দূর্যোধন, দুঃশাসন ও শকুনি  এরা কৌরবপক্ষীয় যোদ্ধা  অভিমন্যুকে বেষ্টন করে, অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিল। আর অভিমূণ্যের করুণ মৃত্যু হয়।
উপরোক্ত  কাহিনীটি আমরা কম বেশি সকলেই জানি। কিন্তু বাস্তব জীবনে আমাদের সনাতন  ধর্মের হিন্দুদের অবস্থা এই অভিমূণ্যের মতো। এখানে অভিমূণ্যকে রূপক হিসেবে  হিন্দুদের বর্তমান অবস্থার সাথে তুলনা করা হয়েছে।
বর্তমান  হিন্দুরা এক চক্রব্যূহের মধ্যে আছে যেখান থেকে বের হতে পারছে না। আর সেই  চক্রবূহ্য রচনা করা হয় ৭০০ বছর আগ থেকে। ৪০০ বছর মুসলিম শাসন আর ২০০ বছর  ইংরেজ শাসনোতো আছে। এরা এই চক্রব্যূহের মতো এক অদৃশ্য বহ্যূ রচনা করা হয়েছে  যেখানে ঢুকে হিন্দুরা খালি আহত হচ্ছে। ঠিক যেমন চক্রব্যূহের ভিতরে  অভিমূন্যকে আহত করে একসাথে ৭ মহারথি। তেমনি হিন্দুরাও আহত হয়ে আসছে  বিভিন্নভাবে। হিন্দুদের মধ্যে গুরু বাদ,  বর্ণবাদ, ব্রাহ্মন্যবাদ, মনের  সংকীর্ণতা, অনৈক্য, বৈদিক শাস্ত্র পড়ার প্রতি অনিহা, সনাতক ঐতিহ্যকে হারিয়ে  ফেলা, অর্থনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি আর তাছাড়া আছে নানা মুনির নানা মত। এভাবেই  একের পর এক তীর এসে আহত করছে হিন্দুদের। এভাবে আঘাত খেতে খেতে হিন্দুরা আজ  এই পর্যায় এসে পরেছে। এই সমস্যার ঘায়েল হওয়া হিন্দুরা না পারছে উঠে  দাঁড়াতে না পারছে এই চক্রব্যূহ থেকে বের হতে।
তাই  আমাদের এখন সময় হয়েছে উঠে দাঁড়াবার। এই চক্রব্যূহ থেকে বের হওয়ার উপায়  আমাদের বের করতে হবে। তার জন্যে প্রথমে আমি একটা গল্প বলব -
একজন  মালিকের একটি পোষা কুকুর ছিল। কুকুর এত বিশ্বস্ততা ছিল মালিকের উপর। তাই  মালিক এই কুকুরের সামনে যে রূপেই আসুক না কেন কুকুর কিন্তু ঠিকই মালিককে  চিনে ফেলত। সেই মালিক একবার শাড়ি পরে মেয়ে সেজে কুকুরের সামনে এসেছে আর  কুকুর ঠিকই তার মালিককে চিনে ফেলেছে। তাই আমাদের হিন্দুদের প্রধান সমস্যা  আমরা আমাদের মালিক পরমেশ্বর ভগবানকে আমরা চিনতে পারি না। তিনি আমাদের সামনে  অনেক রূপে অনেকভাবে আসেন কিন্তু আমরা তাকে চিনতে পারি না। ভগবদগীতা  অনুযায়ী এই পৃথিবীর সকল জীব হচ্ছে আত্মা আর আমাদের হৃদয়ে পরমাত্নারূপে  ঈশ্বর বাস করেন। আর সেই ঈশ্বর হচ্ছেন আমাদের সকলের পিতা আর আমরা হচ্ছি তার  সন্তান। তাই আমাদের প্রথমেই সেই পরমেশ্বরের কাছে শরনাগত হতে হবে। তাহলে  আমাদের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। একজন পিতা থাকতে যেমন পুত্রদের কোন  চিন্তা থাকে না তেমনি আমরা যদি সেই পরমেশ্বরের শরণাগত হই তাহলে আমাদের কোন  সমস্যা আর থাকবে না। কারন আমরা সকলেই তার প্রকৃতির অধীনে আছি। আমরা যদি সেই  পরমেশ্বরের শরনাগত হতে পারি তাহলে আমাদের হিন্দুদের সকল সমস্যা মিটে যাবে  যা আমরা বিভিন্ন বৈদিক শাস্ত্রে দেখি।
কিন্তু  প্রকৃত বর্তমান পরিস্থিতি হচ্ছে আমরা ঈশ্বরভাবনাময়ে নাই আমরা তার থেকে  অনেক দূরে আর দেওয়া আইনের বিরুদ্ধে আমরা চলছি যার কারনে হিন্দুদের এই  করুন অবস্থা।
আরেকটা  দিক হচ্ছে আমরা গোড়া থেকে আমাদের সন্তানদের বৈদিক কৃষ্টির সাথে পরিচয়  করিয়ে দিই না, তাদের বেদ গীতা পড়ার জন্য উৎসাহিত করি না, তাদের গুরুকূল  পাঠানোর জন্য উৎসাহিত না আমরা। আমাদের চিন্তা হচ্ছে আমাদের সন্তানকে গাদা  গাদা বইগুলো কিভাবে ওর মাথায় ঢুকাতে হবে। কিন্তু তাই বলে আমাদের জাগতিক  জ্ঞান লাগবে না তা নয়। ঈশোপনিষদ অনুসারে আমাদের জাগতিক ও পারমার্থিক জ্ঞান  দুটোই প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে জাগতিক জ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু  পারমার্থিক বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কোন ব্যবস্থা নাই। যার কারনে আমাদের  হিন্দুরা হচ্ছে এক পাওয়ালা পঙ্গু।
"শিব  পরিবার" থেকে আমাদের হিন্দুদের কিছু শিখা উচিত। শিবের পরিবারে দূর্গা,  শিব, কার্তিক, ঘনেশ এরা সবাই থাকে আর তার সাথে সাথে তাদের বাহন সিংহ, ষাড়,  মূয়র, ইদুর। ইকো সিস্টেম অনুযায়ী এই বাহনের পশু পাখিরা একজন আরেকজনের  খাদ্য। যেমন শিবের গলায় থাকে সাপ আর সাপের খাদ্য হচ্ছে ঘনেশের বাহন ইঁদুর।   আর মূয়রের খাদ্য হচ্ছে এই সাপ। ওদিকে সিংহের খাদ্য হচ্ছে ষাঁড়।  যাইহোক  যেহেতু শিব তাদের কেন্দ্রে আছে তাই তাদের মধ্যে কোন সমস্যা হয় না। তারা  সবাই একসাথে থাকে। আমাদের হিন্দুদের মধ্যে অনেক বাদ আছে, কেউ রামকৃষ্ণ  আশ্রম, কেউ সৎগুরু, কেউ রাম ঠাকুর, কেউ নিরাকার কেউ সাকার, শৈব, শাক্ত,  বৈষ্ণব থাকবে কিন্তু আমাদের পিতা হচ্ছে এক তাকে কেন্দ্র করে থাকলে আমাদের  মধ্যে কোন সমস্যা থাকবে না। তার জন্যে আমাদের সেক্রিফাইস মাইন্ডের হতে হবে।  ঠিক যেরকম শিব পরিবারে আছে।
আমাদের  নানা মুনি নানা মত থাকতে পারে কিন্তু এগুলা হচ্ছে দৈহিক পরিচয়, আর গীতা আর  বেদ এই দৈহিক পরিচয়কে সাপোর্ট করে না। আমাদের আত্মগত পরিচয়ে সমস্ত  হিন্দুদের এক হতে হবে। আর আমাদের হিন্দুদের মনে যে সংকীর্ণতা আছে সেটা দূর  করতে হবে।
উপরোক্ত  সমস্ত কার্যগুলো সনাতন সংগঠন করে আসছে। হিন্দুদের বর্তমান যে সমস্যা তার  সমাধানের জন্য এই সংগঠন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের এই সংগঠনের আদর্শ  ও উদ্দেশ্যগুলো হলো
১) হিন্দুদের কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা করা
২) মন্দিরভিত্তিক সনাতনী সমাজ ব্যবস্থা গঠন
৩) সনাতনী ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা
৪) অবিভক্ত সনাতনী সমাজ গঠন
৫) বৈদিক সনাতন ধর্মের গৌরব ফিরে পাওয়া
৬) সামাজিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করা
৭) ধর্ম, বিজ্ঞান ও প্রগতিশীল শিক্ষার বিস্তার
৮) মন্দিরগুলিকে শিক্ষার প্রাণ কেন্দ্র রূপে গড়ে তোলা
৯) সনাতনী সমাজের ক্ষতগুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলিকে দূর করার ব্যবস্থা করা
১০) নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা
১১) সবার আগে চাই সবার মৌলিক অধিকার পূরণ, তারপর নাম-কীর্তন
সনাতন সংগঠন চেষ্টা করছে অর্জুনের মতো হিন্দুদের এই চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসতে।

Post a Comment

0 Comments