ভক্তিমূলক সেবা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
শ্লোক: 1
যথা তরোর্মূলনিষেচনেন
তৃপ্যন্তি তৎস্কন্ধভুজোপশাখাঃ ।
প্রাণোপহারাচ্চ যথেন্দ্রিয়াণাং
তথৈব সর্বার্হণমচ্যুতেজ্যা ।।
(ভাগবত ৪/৩১/১৪)অনুবাদঃ- গাছের মূলে জল সেচন করলে যেমন সেই গাছের কাণ্ড, ডাল, উপশাখা প্রভৃতি সকলেই তৃপ্তিলাভ করে এবং উদরে আহার্যদ্রব্য প্রদানের দ্বারা যেমন ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি হয়, তেমনই শ্রীকৃষ্ণের পূজা করলে সমস্ত দেবতাদের পূজা হয়ে যায়।।
শ্লোক: 2
মা চ যোহব্যভিচারেণ ভক্তিযোগেন সেবতে।
স গুণান্ সমতীত্যৈতান্ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে ॥
(গীতা ১৪/২৬)অনুবাদঃ- যিনি ঐকান্তিক ভক্তিযোগ সহকারে আমার সেবা করেন, তিনি প্রকৃতির সমস্ত গুণকে অতিক্রম করে ব্রহ্মভূত স্তরে উন্নীত হন।
শ্লোক: 3
দেবর্ষিভূতাপ্তনৃণাং পিতৃণাং
ন কিঙ্করো নায়মৃণী চ রাজন্ ।
সর্বাত্মনা যঃ শরণং শরণ্যং
গতো মুকুন্দং পরিহৃত্য কর্তম্ ।।
(ভাগবত ১১/৫/৪১)অনুবাদঃ- যিনি সমস্ত জাগতিক কর্তব্য পরিত্যাগ করে, সকলের আশ্রয় পরমেশ্বর ভগবানের শরণাগত হন, তখন আর তিনি দেবতাদের কাছে এবং পিতৃপুরুষদের কাছে ঋণী থাকেন না।
শ্লোক: 4
তদা রজস্তমোভাবাঃ কামলোভাদয়শ্চ যে ।
চেত এতৈরনাবিদ্ধং স্থিতং সত্ত্বে প্রসীদতি ।।
(ভাগবত ১/২/১৯)অনুবাদঃ- যখন হৃদয়ে নৈষ্ঠিকী ভক্তির উদয় হয়, তখন রজ ও তমোগুণের প্রভাবজাত কাম, ক্রোধ, লোভ আদি রিপুসমূহ হৃদয় থেকে বিদূরিত হয়ে যায়। তখন ভক্ত সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হয়ে সম্পূর্ণরূপে প্রসন্ন হন।
শ্লোক: 5
এবং প্রসন্নমনসো ভগবদ্ভক্তিযোগতঃ ।
ভগবত্তত্ত্ববিজ্ঞানং মুক্তসঙ্গস্য জায়তে ।।
(ভাগবত ১/২/২০)অনুবাদঃ- এভাবেই শুদ্ধ সত্ত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে ভক্তিযোগে যুক্ত হওয়ার ফলে যাঁর চিত্ত প্রসন্ন হয়েছে, তিনি সব রকম জড় বন্ধন মুক্ত হয়ে ভগবৎ-তত্ত্ব বিজ্ঞান উপলব্ধি করেন।
শ্লোক: 6
মুক্তিং দদাতি কর্হিচিৎ স্ম ন ভক্তিযোগম্
(ভাগবত ৫/৬/১৮)অনুবাদঃ- যারা ভগবানের কৃপা অভিলাষী, ভগবান অতি সহজেই তাদেরকে মুক্তি দান করেন, কিন্তু তাঁর প্রতি ভক্তিমূলক সেবা সম্পাদনের সুযোগ তিনি খুব সহজে কাউকে দেন না।
শ্লোক: 7
যৎকীর্তনং যৎস্মরণং যদীক্ষণং
যদ্বন্দনং যচ্ছ্রবনং যদর্হণম্ ।
লোকস্য সদ্যো বিধুনোতি কল্মষং
তস্মৈ সুভদ্রশ্রবসে নমো নমঃ ।।
(ভাগবত ২/৪/১৫)অনুবাদঃ- আমি সেই সর্ব মঙ্গলময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি; যাঁর যশগাথা কীর্তন, স্মরণ, দর্শন, বন্দন, শ্রবণ ও পূজনের ফলে সমস্ত পাপরাশি অচিরেই ধৌত হয়।
শ্লোক: 8
ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলোকমহেশ্বরম্ ।
সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি ॥
(গীতা ৫/২৯)অনুবাদঃ- আমাকে সমস্ত যজ্ঞ ও তপস্যার পরম ভোক্তা, সর্বলোকের মহেশ্বর এবং সমস্ত জীবের সুহৃদরূপে জেনে যোগীরা জড় জগতের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করেন।
শ্লোক: 9
ঈহা যস্য হরের্দাস্যে কর্মণা মনসা গিরা ।
নিখিলাস্বপ্যবস্থাসু জীবন্মুক্ত স উচ্যতে ।।
(ভঃ রঃ সিঃ ১/২/১৮৭)অনুবাদঃ- যিনি তাঁর দেহ, মন ও বাক্য দিয়ে ভগবান শ্রীহরির দিব্য সেবায় নিযুক্ত আছেন, তিনি এই জড় জগতে থাকা কালেও সর্ব অবস্থাতেই মুক্ত থাকেন। তাঁকে জীবন্মুক্ত বলা হয়।
শ্লোক: 10
ভক্ত্যা ত্বনন্যয়া শক্য অহমেবংবিধোহর্জুন ।
জ্ঞাতুং দ্রষ্টুং চ তত্ত্বেন প্রবেষ্টুং চ পরন্তপ ॥
(গীতা ১১/৫৪)অনুবাদঃ- হে অর্জুন ! হে পরন্তপ ! অনন্য ভক্তির দ্বারাই কিন্তু এই প্রকার আমাকে তত্ত্বত জানতে, প্রত্যক্ষ করতে এবং আমার চিন্ময় ধামে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়।
শ্লোক: 11
নেহাভিক্রমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে ।
স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ ॥
(গীতা ২/৪০)অনুবাদঃ- ভক্তিযোগের অনুশীলন কখনও ব্যর্থ হয় না এবং তার কোনও ক্ষয় নেই। তার সল্প অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠাতাকে সংসাররূপ মহাভয় থেকে পরিত্রাণ করে।
শ্লোক: 12
ভক্ত্যা মামভিজানাতি যাবান্ যশ্চাস্মি তত্ত্বতঃ ।
ততো মাং তত্ত্বতো জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্ ॥
(গীতা ১৮/৫৫)অনুবাদঃ- ভক্তির দ্বারা কেবল স্বরূপত আমি যে রকম হই, সেরূপে আমাকে কেউ তত্ত্বত জানতে পারেন৷ এই প্রকার ভক্তির দ্বারা আমাকে তত্ত্বত জেনে, তার পরে তিনি আমার ধামে প্রবেশ করতে পারেন।
শ্লোক: 13
বাসুদেবে ভগবতি ভক্তিযোগঃ প্রয়োজিতঃ ।
জনয়ত্যাশু বৈরাগ্যং জ্ঞানং চ যদহৈতুকম্ ।।
(ভাগবত ১/২/৭)অনুবাদঃ- ভক্তি সহকারে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা হলে অচিরেই শুদ্ধ জ্ঞানের উদয় হয় এবং জড়-জাগতিক বিষয়ের প্রতি অনাসক্তি আসে ।
শ্লোক: 14
জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ ।
ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন ।।
(গীতা ৪/৯)অনুবাদঃ- হে অর্জুন ! যিনি আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম যথাযথভাবে জানেন, তাঁকে আর দেহত্যাগ করার পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি আমার নিত্য ধাম লাভ করেন।
শ্লোক: 15
বীতরাগভয়ক্রোধা মন্ময়া মামুপাশ্রিতাঃ ।
বহবো জ্ঞানতপসা পূতা মদ্ভাবমাগতাঃ ।।
(গীতা ৪/১০)অনুবাদঃ- আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ থেকে মুক্ত হয়ে, সম্পূর্ণরূপে আমাতে মগ্ন হয়ে, একান্তভাবে আমার আশ্রিত হয়ে, পূর্বে বহু বহু ব্যক্তি আমার জ্ঞান লাভ করে পবিত্র হয়েছে- এবং এভাবেই সকলেই আমার অপ্র্রাকৃত প্রীতি লাভ করেছে।
শ্লোক: 16
ভক্তিঃ পরেশানুভবো বিরক্তি-
রন্যত্র চৈষ ত্রিক এককালঃ ।
প্রপদ্যমানস্য যথাশ্নতঃ স্যু
স্ত্তষ্টিঃ পুষ্টিঃ ক্ষুদপায়োহনুঘাসম্ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪২)অনুবাদঃ- আহার গ্রহণে নিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি গ্রাস অন্ন গ্রহণে যেমন তুষ্টি, পুষ্টি ও ক্ষুন্নিবৃত্তি যুগপৎ ও বর্ধনশীলভাবে লাভ হয়, তেমনই যিনি পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীচরণে প্রপত্তি করেছেন, তাঁর ক্ষেত্রেও ভক্তি, পরমেশ্বর ভগবানের প্রত্যক্ষ অনুভব এবং কৃষ্ণেতর বিষয়ে বিরক্তি- এই তিনটি ফল যুগপৎ লাভ হয়ে থাকে।শ্লোক: 17
মহাপ্রসাদে গোবিন্দে নামব্রহ্মণি বৈষ্ণবে ।
স্বল্পপুণ্যবতাং রাজন্ বিশ্বাসো নৈব জায়তে ।।
(মহাভারত এবং স্কন্দ পূরাণ)অনুবাদঃ- হে রাজন্ ! স্বল্প পুণ্যবান ব্যক্তিদের কখনও মহাপ্রসাদে, শ্রীগোবিন্দে, হরিনাম-রূপ শব্দব্রহ্মে ও বৈষ্ণবে বিশ্বাস উৎপন্ন হয় না।
শ্লোক: 18
'শ্রদ্ধা'-শব্দে- বিশ্বাস কহে সুদৃঢ় নিশ্চয় ।
কৃষ্ণে ভক্তি কৈলে সর্বকর্ম কৃত হয় ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ২২/৬২)অনুবাদঃ- কৃষ্ণভক্তি সম্পাদিত হলে অন্য সমস্ত কর্ম আপনা থেকেই সম্পাদিত হয়ে যায়। এই সুদৃঢ় বিশ্বাসকে বলা হয় শ্রদ্ধা।
শ্লোক: 19
যস্য দেবে পরা ভক্তির্যথা দেবে তথা গুরৌ।
তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ ।।
(শ্বেতাশ্বতর উপঃ ৬/৩৮)অনুবাদঃ- সেই সব মহাত্মাগণ, যাঁদের গুরু ও ভগবানে পরা ভক্তি রয়েছে, কেবল তাঁদের কাছেই বৈদিক জ্ঞানের সমস্ত তাৎপর্য স্বতঃই প্রকাশিত হয়।
শ্লোক: 20
অশ্রদ্দধানাঃ পুরুষাঃ ধর্মস্যাস্য পরন্তপ ।
অপ্রাপ্য মাং নিবর্তন্তে মৃত্যুসংসারবর্ত্মনি ॥
(গীতা ৯/৩)অনুবাদঃ- হে পরন্তপ ! এই ভগবদ্ভক্তিতে যাদের শ্রদ্ধা উদিত হয়নি, তারা আমাকে লাভ করতে পারে না ৷ তাই তারা এই জড় জগতে জন্ম-মৃত্যুর পথে ফিরে আসে।
শ্লোক: 21
আদৌ শ্রদ্ধা ততঃ সাধুসঙ্গোহথ ভজনক্রিয়া।
ততোহনর্থনিবৃত্তিঃ স্যাৎ ততো নিষ্ঠা রুচিস্ততঃ ।।
অথাসক্তিস্ততো ভাবস্ততঃ প্রেমাভ্যুদঞ্চতি ।
সাধকানাময়ং প্রেমণঃ প্রাদুর্ভাবে ভবেৎ ক্রমঃ ।।
(ভঃ রঃ সিঃ ১/৪/১৫-১৬)অনুবাদঃ- প্রথমে শ্রদ্ধা, তা থেকে সাধুসঙ্গ, তা থেকে ভজনক্রিয়া, তা থেকে অনর্থ নিবৃত্তি, পরে নিষ্ঠা, তা থেকে রুচি ও আসক্তি- এই পর্যন্ত সাধন ভক্তি। তা থেকে ক্রমশ ভাব এবং অবশেষে প্রেম উদিত হয়। সাধকদের প্রেমোদয়ের এটিই ক্রম।
শ্লোক: 22
যদবধি মম চেতঃ কৃষ্ণপদারবিন্দে
নবনবরসধামন্যুদ্যতং রন্তমাসীৎ ।
তদবধি বত নারীসঙ্গমে স্মর্যমানে
ভবতি মুখবিকারঃ সুষ্ঠু নিষ্ঠীবনং চ ।।
(ভক্তিরসামৃতসিন্ধু)অনুবাদঃ- যেদিন থেকে আমার মন শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দিব্য ভক্তিমূলক সেবায় নিযুক্ত হয়েছে এবং তাঁর মধ্যে নব নব রস আস্বাদন করতে শুরু করেছে, সেদিন থেকেই যখনই আমি জঘন্য যৌন সুখের কথা ভাবি, তখনই বিরক্তিতে আমার মুখ বিকৃত হয় এবং সেই জঘন্য চিন্তার উদ্দেশ্যে আমি থুথু ফেলি।
শ্লোক: 23
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্ ॥
(গীতা ৯/২২)অনুবাদঃ- অনন্য চিত্তে আমার চিন্তায় মগ্ন হয়ে, পরিপূর্ণ ভক্তি সহকারে যাঁরা সর্বদাই আমার উপাসনা করেন, তাঁদের সমস্ত অপ্রাপ্ত বস্তু আমি বহন করি এবং তাঁদের প্রাপ্ত বস্তুর সংরক্ষণ করি।
শ্লোক: 24
ওঁ অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতোহপি বা।
যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ ।।
(গরুড় পুরাণ)অনুবাদঃ- অপবিত্র হোক বা পবিত্র হোক, জড়-জাগতিক জীবনের সকল অবস্থা অতিক্রম করেও কেউ যদি কমললোচন শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করেন, তা হলে অন্তরে ও বাইরে শুচিতা লাভ করেন।
শ্লোক: 25
অনন্যচেতাঃ সততং যো মাং স্মরতি নিত্যশঃ ।
তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যোগিনঃ ॥
(গীতা ৮/১৪)অনুবাদঃ- হে পার্থ ! যিনি একাগ্রচিত্তে কেবল আমাকেই নিরন্তর স্মরণ করেন, আমি সেই নিত্যযুক্ত ভক্তযোগীর কাছে সুলভ হই।
শ্লোক: 26
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্ যাজী মাং নমস্কুরু ।
মামেবৈষ্যসি যুক্ত্বৈবমাত্মানং মৎপরায়ণঃ ॥
(গীতা ৯/৩৪)অনুবাদঃ- তোমার মনকে আমার ভাবনায় নিযুক্ত কর, আমার ভক্ত হও, আমাকে প্রণাম কর এবং আমার পূজা কর। এভাবেই মৎপরায়্ণ হয়ে সম্পূর্ণরূপে আমাতে অভিনিবিষ্ট হলে, নিঃসন্দেহে তুমি আমাকে লাভ করবে।
শ্লোক: 27
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্ যাজী মাং নমস্কুরু ।
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে ॥
(গীতা ১৮/৬৫)
অনুবাদঃ- তুমি আমাতে চিত্ত অর্পণ কর, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তা হলে তুমি আমাকে অবশ্যই প্রাপ্ত হবে ৷এই জন্য আমি তোমার কাছে সত্যই প্রতিজ্ঞা করছি, যেহেতু তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়।
শ্লোক: 28
তস্মাদ্ভারত সর্বাত্মা ভগবানীশ্বরো হরিঃ ।
শ্রোতব্যঃ কীর্তিতব্যশ্চ স্মর্তব্যশ্চেচ্ছতাভয়ম্ ।।
(ভাগবত ২/১/৫)অনুবাদঃ- হে ভারত! সমস্ত দুঃখ-দুঃর্দশা থেকে যে মুক্ত হওয়ার বাসনা করে, তাকে অবশ্যই পরমাত্মা, পরম নিয়ন্তা এবং সমস্ত দুঃখ হরণকারী পরমেশ্বর ভগবানের কথা শ্রবণ, কীর্তন ও স্মরণ করতে হবে।
শ্লোক: 29
শ্রীবিষ্ণোঃ শ্রবণে পরীক্ষিদভবদ্বৈয়াসকিঃ কীর্তনে
প্রহ্লাদঃ স্মরণে তদঙ্ঘ্রিভজনে লক্ষ্মীঃ পৃথুঃ পূজনে।
অক্রুরস্ত্বভিবন্দনে কপিপতির্দাস্যেহথ সখ্যেহর্জুনঃ
সর্বস্বাত্মনিবেদনে বলিরভূৎ কৃষ্ণাপ্তিরেষাং পরা ।।
(ভঃ রঃ সিঃ ১/২/২৬৫)অনুবাদঃ- শ্রীবিষ্ণুর কথা শ্রবণে মহারাজ পরীক্ষিৎ, কীর্তনে শুকদেব গোস্বামী, স্মরণে প্রহ্লাদ মহারাজ, তাঁর শ্রীপাদপদ্মের সেবায় লক্ষ্মীদেবী, তাঁর পূজনে পৃথু মহারাজ, তাঁর অভিবন্দনে অক্রুর, তাঁর দাস্যে কপিপতি হনুমান, তাঁর সখ্যে অর্জুন, তাঁর কাছে আত্মনিবেদন করার মাধ্যমে বলি মহারাজ, এভাবেই এঁরা সকলে শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় লাভ করেছিলেন।
শ্লোক: 30
যেন তেন প্রকারেণ মনঃ কৃষ্ণে নিবেশয়েৎ ।
সর্বে বিধিনিষেধাস্যুরেতয়োরেব কিঙ্করাঃ ।।
(রূপ গোস্বামী)অনুবাদঃ- যে কোনভাবে হোক মনকে শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে নিবিষ্ট করা উচিত। শাস্ত্রের সমস্ত বিধি-নিষেধ এর অনুগত।শ্লোক: 31
স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়ো-
র্বচাংসি বৈকুণ্ঠগুণানুবর্ণনে ।
করৌ হরের্মন্দিরমার্জনাদিষু
শ্রুতিং চকারাচ্যুতসৎকথোদয়ে ।।
(ভাগবত ৯/৪/১৮)অনুবাদঃ- মহারাজ অম্বরীষ সর্বদা তাঁর মনকে কৃষ্ণের পাদপদ্মে, তাঁর বাক্যকে পরমেশ্বর ভগবানের গুণ বর্ণনায়, তাঁর হস্তাদি হরিমন্দির মার্জনাদিতে, তাঁর কর্ণকে কৃষ্ণকথা শ্রবণে নিযুক্ত করেছিলেন।
শ্লোক: 32
মুকুন্দলিঙ্গালয়দর্শনে দৃশৌ
তদ্ভৃত্যগাত্রস্পর্শেহঙ্গসঙ্গমম্ ।
ঘ্রাণং চ তৎপাদসরোজসৌরভে
শ্রীমত্তুলস্যা রসনাং তদর্পিতে ।।
(ভাগবত ৯/৪/১৯)অনুবাদঃ- তিনি (মহারাজ অম্বরীষ) তাঁর চক্ষুদ্বয়কে মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের শ্রীবিগ্রহ দর্শনে, তাঁর স্পর্শেন্দ্রিয় বৈষ্ণবদের শ্রীপাদপদ্মে স্পর্শ এবং আলিঙ্গন করায়, তাঁর ঘ্রাণেন্দ্রিয় শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মে নিবেদিত তুলসীর ঘ্রাণ গ্রহণে, তাঁর জিহ্বাকে শ্রীকৃষ্ণে নিবেদিত প্রসাদ আস্বাদনে নিযুক্ত করেছিলেন ।
শ্লোক: 33
পাদৌ হরেঃ ক্ষেত্রপদানুসর্পণে
শিরো হৃষীকেশপদাভিবন্দনে ।
কামং চ দাস্যে ন তু কামকাম্যয়া
যথোত্তমশ্লোকজনাশ্রয়া রতিঃ ।।
(ভাগবত ৯/৪/২০)অনুবাদঃ- তিনি (মহারাজ অম্বরীষ) তাঁর পদদ্বয়কে ভগবানের লীলাভূমি বৃন্দাবন, মথুরা আদি তীর্থে অথবা ভগবানের মন্দিরে গমনে, তাঁর মস্তককে ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে প্রণতি নিবেদনে এবং কামরহিত দাস্যে কাম এমনভাবে নিযুক্ত করেছিলেন যে, তাঁর হৃদয়ে শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি জাগ্রত হয়েছিল।
শ্লোক: 34
স বৈ পুংসাং পরো ধর্মো যতো ভক্তিরধোক্ষজে ।
অহৈতুক্যপ্রতিহতা যয়াত্মা সুপ্রসীদতি।।
(ভাগবত ১/২/৬)অনুবাদঃ- সমস্ত মানুষের পরম ধর্ম হচ্ছে সেই ধর্ম যার দ্বারা ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞানের অতীত শ্রীকৃষ্ণে অহৈতুকী ও অপ্রতিহতা ভক্তি লাভ কারা যায়। সেই ভক্তি-বলে অনর্থ নিবৃত্তি হয়ে আত্মা যথার্থ প্রসন্নতা লাভ করে।
শ্লোক: 35
শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনম্ ।
অর্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্ ।।
ইতি পুংসার্পিতা বিষ্ণৌ ভক্তিশ্চেন্নবলক্ষণা ।
ক্রিয়েত ভগবত্যদ্ধা তন্মন্যেহধীতমুত্তমম্ ।।
(ভাগবত ৭/৫/২৩-২৪)অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণের শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, পাদসেবন, অর্চন, বন্দন, দাস্য, সখ্য, আত্মনিবেদন- এই নব লক্ষণ-সম্পন্ন ভক্তি শ্রীকৃষ্ণে অর্পিত হয়ে সাধিত হলে সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। এটিই শাস্ত্রের নির্দেশ।
শ্লোক: 36
যেষাং ত্বন্তগতং পাপং জনানাং পুণ্যকর্মণাম্ ।
তে দ্বন্দ্বমোহনির্মুক্তা ভজন্তে মাং দৃঢ়ব্রতাঃ ॥
(গীতা ৭/২৮)অনুবাদঃ- যে সমস্ত পুণ্যবান ব্যক্তির পাপ সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়েছে এবং যাঁরা দ্বন্দ্বমোহ থেকে মুক্ত হয়েছেন, তাঁরা দৃঢ় নিষ্ঠার সঙ্গে আমার ভজনা করেন।
শ্লোক: 37
পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি ।
তদহং ভক্ত্যুপহৃতমশ্নামি প্রযতাত্মনঃ ॥
(গীতা ৯/২৬)অনুবাদঃ- যে বিশুদ্ধচিত্ত নিষ্কাম ভক্ত ভক্তি সহকারে আমাকে এমনকি পত্র, পুষ্প, ফল ও জলও অর্পণ করেন, আমি তাঁর সেই ভক্তিপ্লুত উপহার প্রীতি সহকারে গ্রহণ করি।
শ্লোক: 38
যৎকরোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ ।
যত্তপস্যসি কৌন্তেয় তৎকুরুষ্ব মদর্পণম্ ॥
(গীতা ৯/২৭)অনুবাদঃ- হে কৌন্তেয় ! তুমি যা অনুষ্ঠান কর, যা আহার কর, যা হোম কর, যা দান কর এবং যে তপস্যা কর, সেই সমস্তই আমাকে সমর্পণ কর।
শ্লোক: 39
চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠো হরিভক্তিপরায়ণঃ ।
হরিভক্তিবিহীনশ্চ দ্বিজোহপি শ্বপচাধমঃ ।।
(অজ্ঞাত উৎস, শাস্ত্র নির্দেশ)
অনুবাদঃ- চণ্ডালকুলে জন্ম হলেও, কোন ব্যক্তি যদি হরিভক্তি-পরায়ণ হন, তা হলে তিনিও শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণে পরিণত হন। কিন্তু হরিভক্তি-বিহীন ব্যক্তি যদি ব্রাহ্মণও হন, তিনি কুকুরভোজী চণ্ডাল থেকেও অধম।শ্লোক: 40
ভক্ত্যাহমেকয়া গ্রাহ্যঃ শ্রদ্ধয়াত্মা প্রিয়ঃ সতাম্ ।
ভক্তিঃ পুনাতি মন্নিষ্ঠা শ্বপাকানপি সম্ভবাৎ ।।
(ভাগবত ১১/১৪/২১)
অনুবাদঃ- সাধু এবং ভক্তদের অত্যন্ত প্রিয় আমি, ঐকান্তিক শ্রদ্ধাজনিত ভক্তির দ্বারাই আমি প্রাপ্ত হই। আমার প্রতি জীবের নিষ্ঠা বর্ধনকারী ভক্তি নীচ কুলোদ্ভূত মানুষদেরও জন্ম আদি দোষ থেকে পরিত্রাণ করে। অর্থাৎ, ভক্তিযোগের পন্থা অবলম্বন করার মাধ্যমে প্রত্যেকেই চিন্ময় স্তরে উন্নীত হতে পারে। (উদ্ধবের প্রতি শ্রীকৃষ্ণ)শ্লোক: 41
ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ ।
ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি দৃষ্ট এবাত্মনীশ্বরে ।।
(ভাগবত ১/২/২১)
অনুবাদঃ- আত্মার আত্মা পরমাত্মা ভগবানকে দর্শন হলে হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়, সমস্ত সংশয় দূর হয় এবং সমস্ত কর্মফল ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।শ্লোক: 42
কেচিৎ কেবলয়া ভক্ত্যা বাসুদেবপরায়ণাঃ ।
অঘং ধুন্বন্তি কার্ৎস্ন্যেন নিহারমিব ভাস্করঃ ।।
(ভাগবত ৬/১/১৫)
অনুবাদঃ- সেই সব বিরল শুদ্ধ ভক্তরা যাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অহৈতুকী ভক্তিমূলক সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন, কেবল তাঁরাই তাঁদের সমস্ত পাপ- বাসনাকে এমনভাবে নির্মূল করতে সক্ষম যে, তাদের আর পুনর্জাগরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। শুধুমাত্র ভক্তিমূলক সেবা সম্পাদনের মাধ্যমেই তিনি তা করতে পারেন, ঠিক যেমন সূর্য তার রশ্মিচ্ছটায় তৎক্ষণাৎ কুয়াশাকে দূর করতে পারে। (শুকদেব গোস্বামী)শ্লোক: 43
সমাশ্রিতা যে পদপল্লবপ্লবং
মহৎপদং পুণ্যযশো মুরারেঃ ।
ভবাম্বুধির্বৎসপদং পরং পদং
পদং পদং যদ্বিপদং ন তেষাম্ ।।
(ভাগবত ১০/১৪/৫৮)
অনুবাদঃ- মহৎ-তত্ত্বের আশ্রয় এবং মুরারি নামে খ্যাত শ্রীভগবানের পদ-পল্লবরূপ নৌকাকে যাঁরা আশ্রয় করেছেন, তাঁদের কাছে এই ভবসাগর গোষ্পদের মতো ক্ষুদ্র হয়ে যায়। পরম পদ বৈকুণ্ঠ লাভই তাঁদের লক্ষ্য। পদে পদে বিপদসঙ্কুল এই জড় জগৎ তাঁদের জন্য নয়। (শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)শ্লোক: 44
মুক্তিপ্রদাতা সর্বেষাং বিষ্ণুরেব ন সংশয়ঃ ।
(শিব)
অনুবাদঃ- ভগবান শ্রীবিষ্ণুই যে সকলের মুক্তি-প্রদাতা, এতে কোন সংশয় নেই।শ্লোক: 45
এতাং স আস্থায় পরাত্মনিষ্ঠা-
মধ্যাসিতাং পূর্বতমৈর্মহর্ষিভিঃ ।
অহং তরিষ্যামি দুরন্তপারং
তমো মুকুন্দাঙ্ঘ্রিনিষেবয়ৈব ।।
(ভাগবত ১১/২৩/৫৭)
অনুবাদঃ- প্রাচীন মহাজনদের উপাসিত এই পরাত্মনিষ্ঠারূপ সন্ন্যাস-আশ্রম অবলম্বন করে, শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের সেবা করে, আমি এই দুস্তর সংসাররূপ অজ্ঞান-অন্ধকার অতিক্রম করব। (অবন্তীদেশীয় ব্রাহ্মণ)শ্লোক: 46
মুক্তির্হিত্বান্যথারূপং স্বরূপেণ ব্যবস্থিতিঃ ।
(ভাগবত ২/১০/৬)
অনুবাদঃ- মায়িক স্থূল-সুক্ষ্ম রূপ পরিহার করে শুদ্ধ স্বরূপে অবস্থানের নাম মুক্তি । (শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)শ্লোক: 47
যস্ত্বিন্দ্রগোপমথবেন্দ্রমহো স্বকর্ম-
বন্ধানুরূপফলভাজনমাতনোতি ।
কর্মণি নির্দহতি কিন্তু চ ভক্তিভাজাং
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৫৪)
অনুবাদঃ- যিনি ইন্দ্রগোপ কীট থেকে আরম্ভ করে দেবরাজ ইন্দ্র পর্যন্ত সমস্ত জীবদের কর্ম অনুসারে ফল ভোগ করান, কিন্তু যিনি তাঁর ভক্তদের সমস্ত কর্মই বিনাশ করেন, আহা! সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।শ্লোক: 48
ভবেহস্মিন্ ক্লিশ্যমানানামাবিদ্যাকামকর্মভিঃ ।
শ্রবণস্মরণার্হাণি করিষ্যন্নিতি কেচন ।।
(ভাগবত ১/৮/৩৫)
অনুবাদঃ- আবার অন্য আরও অনেকে বলেন যে, অবিদ্যাজনিত কাম ও কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ জড়-জাগতিক দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত বদ্ধ জীবেরা যাতে ভক্তিযোগের সুযোগ নিয়ে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই শ্রবণ, স্মরণ, অর্চন আদি ভক্তিযোগের পন্থাসমূহ পুনঃপ্রবর্তনের জন্য তুমি অবতরণ করেছিলে । (শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কুন্তিদেবী)শ্লোক: 49
প্রেমাঞ্জনচ্ছুরিতভক্তিবিলোচনেন
সন্তঃ সদৈব হৃদয়েষু বিলোকয়ন্তি ।
যং শ্যামসুন্দরমচিন্ত্যগুণস্বরূপং
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।
(ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩৮)
অনুবাদঃ- প্রেমাঞ্জন দ্বারা রঞ্জিত ভক্তিচক্ষু-বিশিষ্ট সাধুগণ যে অচিন্ত্য গুণবিশিষ্ট শ্যামসুন্দর কৃষ্ণকে হৃদয়েও অবলোকন করেন, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।শ্লোক: 50
বিক্রীড়িতং ব্রজবধূভিরিদং চ বিষ্ণোঃ
শ্রদ্ধান্বিতোহনুশৃণুয়াদথ বর্ণয়েদ্ যঃ ।
ভক্তিং পরাং ভগবতি প্রতিলভ্য কামং
হৃদরোগমাশ্বপহিনোত্যচিরেণ ধীরঃ ।।
(ভাগবত ১০/৩৩/৩৯)
অনুবাদঃ- যিনি অপ্রাকৃত শ্রদ্ধান্বিত হয়ে এই রাস পঞ্চাধ্যায়ে ব্রজবধূদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত ক্রীড়া বর্ণনা শ্রবণ করেন বা বর্ণন করেন, সেই ধীর পুরুষ ভগবানে যথেষ্ট পরা ভক্তি লাভ করে হৃদরোগরূপ জড় কামকে দূর করেন। (শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)শ্লোক: 51
ভক্তিস্ত্বয়ি স্থিরতরা ভগবন্ যদি স্যাদ্
দৈবেন নঃ ফলতি দিব্যকিশোরমূর্তিঃ ।
মুক্তি স্বয়ং মুকুলিতাঞ্জলি সেবতেহস্মান্
ধর্মার্থকামগতয়ঃ সময়প্রতীক্ষাঃ ।।
(কৃষ্ণকর্ণমৃত)
অনুবাদঃ- হে ভগবান! কেউ যদি স্থিরভাবে তোমার প্রতি শুদ্ধ ভক্তমূলক সেবা সম্পাদনে নিযুক্ত হন, তা হলে তুমি তাঁর কাছে তোমার দিব্য কিশোররূপে প্রকটিত হও। মুক্তিদেবী স্বয়ং অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে শুদ্ধ ভক্তের সেবা করার জন্য অপেক্ষা করেন। ধর্ম, অর্থ ও কাম তখন পৃথক চেষ্টা ছাড়াই স্বতস্ফূর্তভাবে লাভ করা যায়। (বিল্বমঙ্গল ঠাকুর)শ্লোক: 52
স্থানাভিলাষী তপসি স্থিতোহহং
ত্বাং প্রাপ্তবান্ দেবমুনীন্দ্রগুহ্যম্ ।
কাচং বিচিন্বন্নপি দিব্যরত্নং
স্বামিন্ কৃতার্থোহস্মি বরং ন যাচে ।।
(হরিভক্তিসুধোদয় ৭/২৮)
অনুবাদঃ- (ভগবান যখন ধ্রুব মহারাজকে বর দিচ্ছিলেন, তখন ধ্রুব মহারাজ বলেছিলেন--) “হে ভগবান, জড়-জাগতিক ঐশ্বর্য এবং পদের কামনা নিয়ে আমি কঠোর তপস্যায় স্থিত হয়েছিলাম। এখন আমি শ্রেষ্ঠ দেবতা এবং মুনিদেরও দুর্লভ আপনাকে লাভ করেছি। আমি এক টুকরো ভাঙ্গা কাঁচের অনুসন্ধান করছিলাম। আমি দিব্যরত্ন লাভ করেছি। তাই আমি এতই কৃতার্থ বোধ করছি যে, আপনার কাছে কোন বর আমি চাই না। ”শ্লোক: 53
কৈবল্যং নরকায়তে ত্রিদশপুরাকাশপুষ্পায়তে
দুর্দান্তেন্দ্রিয়কালসর্পপটলী প্রোৎখাতদংষ্ট্রায়তে ।
বিশ্বং পূর্ণসুখায়তে বিধিমহেন্দ্রাদিশ্চ কীটায়তে
যৎ কারুণ্যকটাক্ষবৈভববতাং তং গৌরমেব স্তুমঃ ।।
(চৈতন্যচন্দ্রামৃত)
অনুবাদঃ- যাঁর করুণাকটাক্ষ রূপ সম্পদ প্রাপ্ত হলে নিরাকার ব্রহ্মসাযুজ্য মুক্তি নরকের মতো মনে হয়, স্বর্গকে আকাশকুসুম বলে মনে হয়; দুর্দান্ত ইন্দ্রিয়গুলি বিষদাঁত ভাঙা কালো সর্পের মতো নির্বিষ হয়ে যায়। সমস্ত বিশ্ব সুখময় হয়ে ওঠে এবং ব্রহ্ম ও ইন্দ্রের পদও কীটতুল্য তুচ্ছ মনে হয়, আমরা সেই শ্রীগৌরসুন্দরের স্তব করি। (প্রবোধানন্দ সরস্বতী)শ্লোক: 54
ত্যক্ত্বা স্বধর্মং চরণাম্বুজং হরে-
র্ভজন্নপক্কোহথ পতেত্ততো যদি ।
যত্র ক্ব বাভদ্রমভূদমুষ্য কিং
কো বার্থ আপ্তোহভজতাং স্বধর্মতঃ ।।
(ভাগবত ১/৫/১৭)
অনুবাদঃ- ভগবানের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত হওয়ার জন্য যিনি জাগতিক কর্তব্য পরিত্যাগ করেছেন, অপক্ক অবস্থায় যদি কোন কারণে তাঁর পতনও হয়, তবুও বিফল হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না। পক্ষান্তরে, অভক্ত যদি সর্বতোভাবে নৈমিত্তিক ধর্ম-অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়, তবুও তাতে তার কোন লাভ হয় না।
(ব্যাসদেবের প্রতি নারদ মুনি)শ্লোক: 55
অকামঃ সর্বকামো বা মোক্ষকাম উদারধীঃ ।
তীব্রেণ ভক্তিযোগেন যজেত পুরুষং পরম্ ।।
(ভাগবত ২/৩/১০)
অনুবাদঃ- সর্বপ্রকার কামনা যুক্ত হোন, অথবা সম্পূর্ণ নিষ্কাম হোন, অথবা মুক্তিকামীই হোন, সুবুদ্ধিমান মানুষ তীব্র শুদ্ধ ভক্তিযোগে পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করবেন।
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)শ্লোক: 56
স্মর্তব্যঃ সততং বিষ্ণুর্বিস্মর্তব্যো ন জাতুচিৎ ।
সর্বে বিধিনিষেধাঃ স্যুরেতয়োরেব কিঙ্করাঃ ।।
(পদ্ম পুরাণ)
অনুবাদঃ- সর্বদা বিষ্ণুকে স্মরণ করা উচিত এবং কখনই তাঁকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। সমস্ত বিধি ও নিষেধ এই দুটি কথার অনুগত ।শ্লোক: 57
স হানিস্তন্ মহচ্ছিদ্রং স মোহঃ স চ বিভ্রমঃ ।
যন্মুহূর্তং ক্ষণং বাপি বাসুদেবং ন চিন্তয়েৎ ।।
(বিষ্ণু পুরাণ)
অনুবাদঃ- এক মুহূর্ত ক্ষণও যদি বাসুদেবকে স্মরণ না করে অতিক্রান্ত হয়, তা হলে সেই হানিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় হানি। সেটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় মোহ এবং সবচেয়ে বড় বিভ্রম।শ্লোক: 58
কামদ্ দ্বেষাদ্ ভয়াৎ স্নেহাদ্ যথা ভক্তেশ্বরে মনঃ ।
আবেশ্য তদঘং হিত্বা বহবস্তদ্ গতিং গতাঃ ।।
(ভাগবত ৭/১/৩০)
অনুবাদঃ- ভগবানের প্রতি ভক্তির মাধ্যমে যেমন তাঁর ধাম প্রাপ্ত হওয়া যায়, তেমনই অনেকেই কাম, দ্বেষ, ভয় ও স্নেহের প্রভাবে তাঁর প্রতি মনকে আবিষ্ট করে, তাঁদের পাপ কর্ম থেকে মুক্ত হয়ে সেই গতি প্রাপ্ত হয়েছেন।
(মহারাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি নারদ মুনি)শ্লোক: 59
কামং ক্রোধং ভয়ং স্নেহমৈক্যং সৌহৃদমেব চ ।
নিত্যং হরৌ বিদধতো যান্তি তন্ময়তাং হি তে ।।
(ভাগবত ১০/২৯/১৫)
অনুবাদঃ- যে সমস্ত ব্যক্তি অবিশ্রান্তভাবে তাঁদের কাম, ক্রোধ, ভয়, স্নেহ, নিরাকার ব্রহ্মের সঙ্গে ঐক্য অনুভব এবং সখ্যভাব আদি অনুভূতিকে ভগবান শ্রীহরির অভিমুখে চালিত করেন, বাস্তবিকই তাঁরা শ্রীহরির চিন্তায় তন্ময়তা লাভ করেন।
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)শ্লোক: 60
অত্যাহারঃ প্রয়াসশ্চ প্রজল্পো নিয়মাগ্রহঃ ।
জনসঙ্গশ্চ লৌল্যঞ্চ ষড়্ ভির্ভক্তির্বিনশ্যতি ।।
(উপদেশামৃত ২)
অনুবাদঃ- প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার গ্রহণ বা প্রয়োজনের অধিক অর্থ সঞ্চয়, পার্থিব সম্পদ লাভের জন্য অত্যধিক প্রচেষ্টা করা, কৃষ্ণবিহীন অনাবশ্যক গ্রাম্য-কথন, পারমার্থিক জীবনে উন্নতি লাভের জন্য প্রয়াস না করে শুধুমাত্র শাস্ত্রের নিয়ম-নীতিগুলি অনুসরণ করার জন্যই তাদের অনুশীলন করার প্রচেষ্টা, বা শাস্ত্রের নির্দেশ অমান্যপূর্বক ব্যক্তিগত খেয়াল বা ইচ্ছা অনুসারে কার্য সম্পাদন করার প্রচেষ্টা, কৃষ্ণ ভাবনাবিমুখ জড় বিষয়ী লোকের সঙ্গ করা, পার্থিব বিষয় লাভ করার বাসনায় ব্যাকুল হওয়া—কোন ব্যক্তি যখন উপরোক্ত ছয়টি দোষের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন তার পারমার্থিক জীবন বিনাশপ্রাপ্ত হয়।
(শ্রীল রূপ গোস্বামী)শ্লোক: 61
উৎসাহান্নিশ্চয়াদ্ধৈর্যাৎ তত্তৎকর্মপ্রবর্তনাৎ ।
সঙ্গত্যাগাৎ সতোবৃত্তেঃ ষড়্ ভির্ভক্তিঃ প্রসিধ্যতি ।।
(উপদেশামৃত ৩)
অনুবাদঃ- ভক্তিযোগে ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে সেবাকার্য সম্পাদন করার সময় অনুকূলে ছয়টি প্রধান নিয়ম বা বিধি বর্তমান আছে। যথা, সেবাকার্যে উৎসাহ, দৃঢ় বিশ্বাস বা সংকল্প, ধৈর্য ধারণ, নববিধা ভক্তির বিধি অনুসারে সেবাকার্য সম্পাদন, আসক্তি ও অসৎসঙ্গ ত্যাগ, পূর্বতন আচার্যবর্গের পদাঙ্ক অনুসরণ। এই ছয়টি বিধি অনুসারে পারমার্থিক জীবন যাপন করলে ভক্তিযোগে অবশ্যই সিদ্ধিলাভ করা যাবে।
(শ্রীল রুপ গোস্বামী)শ্লোক: 62
কৃষ্ণভক্তিরসভাবিতা মতিঃ
ক্রীয়তাং যদি কুতোহপি লভ্যতে ।
তত্র লৌল্যমপি মূল্যমেকলং
জন্মকোটিসুকৃতৈর্ন লভ্যতে ।।
(রূপগোস্বামী, পদ্যাবলী-১৪)
অনুবাদঃ- কোটি কোটি জন্ম-জন্মান্তরের সুকৃতির দ্বারাও যা পাওয়া যায় না, অথচ লোভরূপ একটি মূল্য দিয়ে যা পাওয়া যায়, সেই কৃষ্ণভক্তি রসভাবিতা মতি যেখানেই পাও, অবিলম্বে তা ক্রয় করে নাও।শ্লোক: 63
সর্বোপাধিবিনির্মুক্তং তৎপরত্বেন নির্মলম্ ।
হৃষীকেণ হৃষীকেশ-সেবনং ভক্তিরুচ্যতে ।।
(নারদ পঞ্চরাত্র)
অনুবাদঃ- সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ইন্দ্রিয়ের অধীশ্বর হৃষীকেশের সেবা করার নাম ভক্তি। এই সেবার দুটি ‘তটস্থ’ লক্ষণ—যথা, এই শুদ্ধ ভক্তি সমস্ত উপাধি থেকে মুক্ত এবং কেবল শ্রীকৃষ্ণের সেবায় যুক্ত হবার ফলে নির্মল ।শ্লোক: 64
অন্যাভিলাষিতাশূন্যং জ্ঞানকর্মাদ্যনাবৃতম্ ।
আনুকূল্যেন কৃষ্ণানুশীলনং ভক্তিরুত্তমা ।।
(ভঃ রঃ সিঃ ১/১/১১)
অনুবাদঃ- যখন উত্তমা ভক্তি জাগ্রত হয়, তখন ভক্তকে অবশ্যই সমস্ত জড় অভিলাষ, অদ্বৈত মায়াবাদ দর্শন এবং সকাম কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হবে। শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছার অনুকূলে ভক্তকে নিরন্তর সেবা অনুষ্ঠান করতে হবে।শ্লোক: 65
কৃষ্ণার্থে অখিল চেষ্টা
(ভঃ রঃ সিঃ)
অনুবাদঃ- শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করার জন্যই আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা নিয়োজিত হওয়া উচিত।শ্লোক: 66
ন সাধয়তি মাং যোগো ন সাংখ্যং ধর্ম উদ্ধব ।
ন স্বাধ্যায়স্তপস্ত্যাগো যথা ভক্তির্মমোর্জিতা ।।
(ভাগবত ১১/১৪/২০)
অনুবাদঃ- [পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন--] “হে উদ্ধব, আমার প্রতি প্রবলা ভক্তি যেমন আমাকে বশীভূত করতে পারে, অষ্টাঙ্গ-যোগ, অভেদ ব্রহ্মবাদ-রূপ সাংখ্য-জ্ঞান, বেদ অধ্যয়ন, সব রকম তপস্যা ও ত্যাগরূপ সন্ন্যাস আদির দ্বারা আমি সেই রকম বশীভূত হই না ।”
(উদ্ধবের প্রতি শ্রীকৃষ্ণ)
0 Comments