ভক্ত ও ভক্ত সম্বন্ধীয়ঃ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
শ্লোক: 1
বাঞ্ছাকল্পতরুভ্যশ্চ কৃপাসিন্ধুভ্য এব চ৷
পতিতানাং পাবনেভ্যোঃ বৈষ্ণবেভ্যো নমো নমঃ৷৷অনুবাদঃ- আমি সমস্ত বৈষ্ণবগণকে পুনঃপুনঃ আমার সশ্রদ্ধ দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদন করি। তাঁরা ঠিক কল্পতরুর মতো সকলের বাঞ্ছা পূর্ণ করতে পারেন এবং তাঁরা সমস্ত পতিত জীবদের প্রতি পূর্ণরূপে দয়াশীল ।
শ্লোক: 2
যে মে ভক্তজনাঃ পার্থ ন মে ভক্ত্যাশ্চ তে জনাঃ ।
মদ্ভক্তানাং চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমাঃ মতাঃ ।।
(আদি পুরাণ)অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, "হে পার্থ! যারা কেবল আমারই ভক্ত, তাঁরা বস্তুত আমার ভক্ত নয়। কিন্তু যারা আমার ভক্তের ভক্ত তাদেরই উত্তম ভক্ত বলে জানবে।"
শ্লোক: 3
নৈষাং মতিস্তাবদুরুক্রমাঙ্ঘ্রিং
স্পৃশত্যনর্থাপগমো যদর্থঃ ।
মহীয়সাং পাদরজোহভিষেকং
নিষ্কিঞ্চনানাং ন বৃণীত যাবৎ ।।
(ভাগবত ৭/৫/৩২)অনুবাদঃ- মানুষের মতি যতক্ষণ নিষ্কিঞ্চন ভগবদ্ভক্তদের শ্রীপাদপদ্মের ধূলির দ্বারা অভিসিক্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা অনর্থ নাশক কৃষ্ণ-পাদপদ্ম স্পর্শ করতে পারে না। (প্রহ্লাদ মহারাজ)
শ্লোক: 4
সতাং প্রসঙ্গান্মম বীর্যসংবিদো
ভবন্তি হৃৎকর্ণরসায়নাঃ কথাঃ।
তজ্জোষণাদাশ্বপবর্গবর্ত্মনি
শ্রদ্ধা রতির্ভক্তিরনুক্রমিষ্যতি।।
(ভাগবত ৩/২৫/২৫)অনুবাদঃ- পারমার্থিক মহিমামণ্ডিত ভগবানের কথা ভক্তসঙ্গেই কেবল যথাযথভাবে আলোচনা করা যায় এবং সেই কথা শ্রবণে হৃদয় ও শ্রবণেন্দ্রিয় তৃপ্ত হয়। ভক্তসঙ্গে সেই বাণী প্রীতিপূর্বক শ্রবণ করতে করতে শীঘ্র মুক্তির বর্ত্মস্বরূপ আমার প্রতি প্রথমে শ্রদ্ধা, পরে রতি এবং অবশেষে প্রেমভক্তি ক্রমে ক্রমে উদিত হয়।
শ্লোক: 5
তুলয়াম লবেনাপি ন স্বর্গং নাপুনর্ভবম্ ।
ভগবৎসঙ্গিসঙ্গস্য মর্ত্যানাং কিমুতাশিষঃ ।।
(ভাগবত ১/১৮/১৩)অনুবাদঃ- ভগবৎ সঙ্গীর নিমেষ মাত্র সঙ্গ দ্বারা জীবের যে অসীম মঙ্গল সাধিত হয়, তার সঙ্গে স্বর্গসুখ ভোগের বা মুক্তি লাভের কিছুমাত্র তুলনা করা যায় না, তখন মরণশীল মানুষের জাগতিক সমৃদ্ধির কথা আর কি বলার আছে ।
শ্লোক: 6
'সাধুসঙ্গ', 'সাধুসঙ্গ' - সর্বশাস্ত্রে কয় ।
লবমাত্র সাধুসঙ্গে সর্বসিদ্ধি হয় ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ২২/৫৪)অনুবাদঃ- সমস্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গ যদি মুহূর্তের জন্যও লাভ করা যায়, তা হলেই সর্বসিদ্ধি লাভ হয়।
শ্লোক: 7
তর্কোহপ্রতিষ্ঠঃ শ্রুতয়ো বিভিন্না
নাসাবৃষির্যস্য মতং ন ভিন্নম্ ।
ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং
মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ ।।
(মহাভারত, বনপর্ব ৩১৩/১১৭)অনুবাদঃ- তর্কের দ্বারা প্রকৃত সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করা যায় না। পক্ষান্তরে, তার ফলে শ্রুতিসমূহ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় এবং যাঁর মত ভিন্ন নয়, তিনি ঋষি হতে পারেন না। তাই ধর্মতত্ত্ব গূঢ়রূপে আচ্ছাদিত হয়ে আছে, অর্থাৎ শাস্ত্র আদি পাঠ করে ধর্মতত্ত্ব পাওয়া কঠিন । সুতরাং যাঁকে মহাজন বলে সাধুরা স্থির করেছেন, তিনি যে পন্থাকে শাস্ত্রপন্থা বলেছেন, সেই পথেই সকলের অনুগমন করা উচিত। (যুধিষ্ঠির মহারাজ)
শ্লোক: 8
দুর্জনঃ পরিহর্তব্যো বিদ্যয়ালঙ্কৃতোহপি সন।
মণিনা ভূষিতঃ সর্পঃ কিমসৌ ন ভয়ঙ্করঃ ।।
( চাণক্য পণ্ডিত)অনুবাদঃ- বিদ্যার দ্বারা অলঙ্কৃত হলেও দুর্জন ব্যক্তিকে পরিহার করা কর্তব্য। সে ঠিক একটি মণিভূষিত বিষাক্ত সর্পের মতো। সেই রকম সাপ কি ভয়ঙ্কর নয়?
শ্লোক: 9
তীর্থযাত্রা পরিশ্রম কেবল মনের ভ্রম
সর্বসিদ্ধি গোবিন্দচরণ।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর, প্রার্থনা )অনুবাদঃ- পরিশ্রম করে তীর্থভ্রমণ কেবল মনের ভ্রম মাত্র, কেন না পারমার্থিক প্রগতির জন্য গোবিন্দচরণকে আশ্রয় করলেই সর্বসিদ্ধি লাভ হবে ।
শ্লোক: 10
মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ ।
আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত ॥
(গীতা ২/১৪)অনুবাদঃ- হে কৌন্তেয় ! ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগের ফলে অনিত্য সুখ ও দুঃখের অনুভব হয় ৷ সেগুলি ঠিক যেন শীত এবং গ্রীষ্ম ঋতুর গমনাগমনের মতো । হে ভরতকুল-প্রদীপ ! সেই ইন্দ্রিয়্জাত অনুভূতির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সেগুলি সহ্য করার চেষ্টা কর।
শ্লোক: 11
যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ ।
সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে ॥
(গীতা ২/১৫)অনুবাদঃ- হে পুরুষশ্রেষ্ঠ (অর্জুন) ! যে জ্ঞানী ব্যক্তি সুখ ও দুঃখকে স মান জ্ঞান ক রেন এবং শীত ও উষ্ণ আদি দ্বন্দ্বে বিচলিত হন না, তিনিই মুক্তি লাভের প্রকৃত অধিকারী।
শ্লোক: 12
বিপদঃ সন্তু তাঃ শশ্বত্তত্র তত্র জগদ্ গুরুো ।
ভবতো দর্শনং যৎ স্যাদপুনর্ভবদর্শনম্ ।।
(ভাগবত ১/৮/২৫)অনুবাদঃ- হে জগদীশ্বর ! আমি কামনা করি যেন সেই সমস্ত সঙ্কট বারে বারে উপস্থিত হয়, যাতে বারে বারে আমরা তোমাকে দর্শন করতে পারি। কারণ, তোমাকে দর্শন করলেই আমাদের আর জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে হবে না বা এই সংসার চক্র দর্শন করতে হবে না। (শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কুন্তীদেবী)
শ্লোক: 13
যং লব্ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ
যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে ॥
(গীতা ৬/২২)অনুবাদঃ- পারমার্থিক চেতনায় অবস্থিত হলে যোগী আর আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান থেকে বিচলিত হন না এবং তখন আর অন্য কোন কিছু লাভই এর থেকে অধিক বলে মনে হয় না।
শ্লোক: 14
উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ ৷
আত্মৈব হ্যত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ ॥৫॥
(গীতা ৬/৫)অনুবাদঃ- মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা, মনের দ্বারা আত্মাকে অধঃপতিত করা কখনই উচিত নয়। মনই জীবের অবস্থা ভেদে বন্ধু ও শত্রু হয়ে থাকে ।
শ্লোক: 15
চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্ ৷
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্ ॥৩৪॥
(গীতা ৬/৩৪)অনুবাদঃ- হে কৃষ্ণ ! মন অত্যন্ত চঞ্চল, শরীর ও ইন্দ্রিয় আদির বিক্ষেপ উৎপাদক, দুর্দমনীয় এবং অত্যন্ত বলবান, তাই তাকে নিগ্রহ করা বায়ুকে বশীভূত করার থেকেও অধিকতর কঠিন বলে আমি মনে করি৷
শ্লোক: 16
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্ ৷
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে ॥৩৫॥
(গীতা ৬/৩৫)অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে মহাবাহো ! মন যে দুর্দমনীয় ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয় ! ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে বশীভূত করা যায়।
শ্লোক: 17
মন এব মনুষ্যাণাং কারণং বন্ধমোক্ষয়োঃ ।
বন্ধায় বিষয়াসঙ্গো মুক্ত্যৈ নির্বিষয়ং মনঃ ।।
(অমৃতবিন্দু উপনিষদ-২)অনুবাদঃ- মনই মানুষের বন্ধন ও মুক্তির কারণ। বিষয়ে আসক্ত মনই বন্ধনের কারণ এবং বিষয়ে অনাসক্ত মনই মুক্তির কারণ। অতএব যে মন সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত, তা পরম মুক্তির কারণ।
শ্লোক: 18
যঃ ইদং পরমং গুহ্যং মদ্ভক্তেষ্বভিধাস্যতি ।
ভক্তিং ময়ি পরাং কৃত্বা মামেবৈষ্যত্যসংশয়ঃ ॥
(গীতা ১৮/৬৮)অনুবাদঃ- যিনি আমার ভক্তদের মধ্যে এই পরম গোপনীয় গীতাবাক্য উপদেশ করেন, তিনি অবশ্যই পরা ভক্তি লাভ করে নিঃসংশয়ে আমার কাছে ফিরে আসবেন।শ্লোক: 19
ন চ তস্মান্মনুষ্যেষু কশ্চিন্মে প্রিয়কৃত্তমঃ ।
ভবিতা ন চ মে তস্মাদন্যঃ প্রিয়তরো ভুবি ।
(গীতা ১৮/৬৯)
অনুবাদঃ- এই পৃথিবীতে মানুষদের মধ্যে তাঁর থেকে অধিক প্রিয়কারী আমার কেউ নেই এবং তাঁর থেকে অন্য কেউ আমার প্রিয়্তর হবে না।
শ্লোক: 20
মৎচ্চিত্তা মদ্ গতপ্রাণা বোধয়ন্তঃ পরস্পরম্ ।
কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ ॥
(গীতা ১0/৯)
অনুবাদঃ- যাঁদের চিত্ত ও প্র্রাণ সম্পূর্ণরূপে আমাতে সমর্পিত, তাঁরা পরস্পরের মধ্যে আমার কথা সর্বদাই আলাচনা করে এবং আমার সম্বন্ধে পরস্পরকে বুঝিয়ে পরম সন্তোষ ও অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করেন।
শ্লোক: 21
তিতিক্ষবঃ কারুণিকাঃ সুহৃদঃ সর্বদেহিনাম্ ।
অজাতশত্রবঃ শান্তাঃ সাধবঃ সাধুভূষণাঃ ।।
(ভাগবত ৩/২৫/২১)
অনুবাদঃ- ভগবদ্ভক্ত সর্বদাই সহিষ্ণু, অত্যন্ত কৃপা পরায়ণ, সর্বজীবের সুহৃদ, শাস্ত্রানুগ, অজাতশত্রু, শান্ত - এই সকল গুণাবলী সাধুর ভূষণস্বরূপ।
শ্লোক: 22
মৎচ্চিত্তা মদ্ গতপ্রাণা বোধয়ন্তঃ পরস্পরম্ ।
কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ (গীতা ১০/৯)
অনুবাদঃ- যাঁদের চিত্ত ও প্র্রাণ সম্পূর্ণরূপে আমাতে সমর্পিত, তাঁরা পরস্পরের মধ্যে আমার কথা সর্বদাই আলাচনা করে এবং আমার সম্বন্ধে পরস্পরকে বুঝিয়ে পরম সন্তোষ ও অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করেন।
শ্লোক: 23
চতুর্বিধা ভজন্তে মাং জনাঃ সুকৃতিনোহর্জুন ।
আর্তো জিজ্ঞাসুরর্থার্থী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ ।।
(গীতা ৭/১৬)
অনুবাদঃ- হে ভরতশ্রেষ্ঠ অর্জুন ! আর্ত, অর্থাথী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানী- এই চার প্রকার পুণ্যকর্মা ব্যক্তিগণ আমার ভজনা করেন।
শ্লোক: 24
কৃষ্ণভক্ত- নিষ্কাম, অতএব 'শান্ত' ।
ভুক্তি-মুক্তি-সিদ্ধি-কামী-- সকলি 'অশান্ত' ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ১৯/১৪৯)
অনুবাদঃ- কৃষ্ণভক্ত নিষ্কাম বলেই শান্ত। সকাম কর্মীরা জড় ভোগ কামনা করেন, জ্ঞানীরা মুক্তি কামনা করেন, আর যোগীরা জড়-জাগতিক সিদ্ধি কামনা করেন। তাই এরা সকলেই কামার্ত ও অশান্ত।
শ্লোক: 25
যৎপাদসংশ্রয়াঃ সূত মুনয়ঃ প্রশমায়নাঃ ।
সদ্যঃ পুনন্ত্ত্যপস্পৃষ্টাঃ স্বর্ধুন্যাপহনুসেবয়া ।।
(ভাগবত ১/১/১৫)
অনুবাদঃ- হে সূত গোস্বামী ! যে সমস্ত মহর্ষিরা সর্বতোভাবে পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, তাঁদের সঙ্গ প্রভাবে অর্থাৎ দর্শন মাত্রই জীব পবিত্র হয়, কিন্তু সুরধনী গঙ্গার জল সাক্ষাৎ সেবা অর্থাৎ স্পর্শন, অবগাহন আদি করার পরেই কেবল মানুষকে পবিত্র করে।
শ্লোক: 26
ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং
কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে ।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে
ভবতাদ্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি ।।
(শিক্ষাষ্টক ৪)
অনুবাদঃ- হে জগদীশ ! আমি ধন, জন, সুন্দরী স্ত্রী অথবা সকাম কর্ম কামনা করি না। আমি কেবল এই কামনা করি যে, জন্ম-জন্মান্তরে যেন আমি তোমার প্রতি অহৈতুকী ভক্তি লাভ করতে পারি।
শ্লোক: 27
ক্ষান্তিরব্যর্থকালত্বং বিরক্তির্মানশূন্যতা।
আশাবন্ধঃ সমুৎকণ্ঠা নামগানে সদা রূচিঃ ।।
আসক্তিস্তদ্ গুণাখ্যানে প্রীতিস্তদ্বসতিস্থলে।
ইত্যাদয়োহনুভাবাঃ স্যুর্জাতভাবাঙ্কুরে জনে।।
ভক্তিরসামৃতসিন্ধু ১/৩/২৫-২৬)
অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভাবের অঙ্কুর যাঁর বিকশিত হয়েছে, তাঁর ব্যবহারে নিম্নোক্ত নয়টি লক্ষণ প্রকাশ পায়- ক্ষমাশীলতা, সময় যাতে বৃথা না যায় সেই চিন্তা, ভোগে বিরক্তি, মিথ্যা অহংকার শূন্যতা, আশাবন্ধন, উৎকণ্ঠা, ভগবানের পবিত্র নামগানে রূচি, ভগবানের দিব্য গুণ আখ্যানে আসক্তি এবং ভগবানের বসতিস্থলে অর্থাৎ মন্দির বা বৃন্দাবনাদি তীর্থে প্রীতি। এগুলিকে অনুভাব বলা হয়, অর্থাৎ এগুলি হচ্ছে ভাবের অধীনস্থ লক্ষণ। যে ব্যক্তির হৃদয়ে ভাবের অঙ্কুর জাত হয়েছে, এই সমস্ত লক্ষণগুলি তাঁর মধ্যে প্রকাশিত হয়।
শ্লোক: 28
যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম ॥৭৮॥
(গীতা ১৮/৭৮)
অনুবাদঃ- যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই নিশ্চিতভাবে শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি বর্তমান থাকে৷ সেটিই আমার অভিমত।
শ্লোক: 29
বয়ং তু ন বিতৃপ্যাম উত্তমঃশ্লোকবিক্রমে।
যচ্ছৃণ্বতাং রসজ্ঞানাং স্বাদু স্বাদু পদে পদে ।।
(ভাগবত ১/১/১৯)
অনুবাদঃ- উত্তম শ্লোকের দ্বারা বন্দিত হন যে পরমেশ্বর ভগবান, তাঁর অপ্রাকৃত লীলাকথা যতই আমরা শ্রবণ করি না কেন, আমাদের তৃপ্তি হবে না। যাঁরা তাঁর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে অপ্রাকৃত রস আস্বাদন করেছেন, তাঁরা নিরন্তর তাঁর লীলাবিলাসের রস আস্বাদন করেন।
শ্লোক: 30
যাঁর চিত্তে কৃষ্ণপ্রেমা করয়ে উদয়।
তাঁর বাক্য, ক্রিয়া, মুদ্রা বিজ্ঞেহ না বুঝয় ।।
চৈঃ চঃ মধ্য ২৩/৩৯)
অনুবাদঃ- যাঁর চিত্তে কৃষ্ণপ্রেমের উদয় হয়, তাঁর কথাবার্তা, কার্যকলাপ এবং আচার-আচরণ বিজ্ঞেরাও বুঝতে পারেন না।
শ্লোক: 31
যুগায়িতং নিমেষেন চক্ষুষা প্রাবৃষায়িতম্ ।
শূন্যায়িতং জগৎ সর্বং গোবিন্দবিরহেণ মে।।
(শিক্ষাষ্টকম- ৭)
অনুবাদঃ- হে গোবিন্দ! তোমার অদর্শনে আমার এক নিমেষকে এক যুগ বলে মনে হচ্ছে। চক্ষু থেকে বর্ষার ধারার মতো অশ্রুধারা ঝরে পড়ছে এবং সমস্ত জগৎ শূন্য বলে মনে হচ্ছে।
শ্লোক: 32
আশ্লিষ্য বা পাদরতাং পিনষ্টু মা-
মদর্শনান্মর্মহতাং করোতু বা।
যথা তথা বা বিদধাতু লম্পটো
মৎ প্রাণনাথস্তু স এব নাপরঃ ।।
(শিক্ষাষ্টকম-৮)
অনুবাদঃ- এই পাদরতা দাসীকে কৃষ্ণ আলিঙ্গনপূর্বক পেষণ করুক অথবা দেখা না দিয়ে মর্মাহতই করুক, সেই লম্পট পুরুষ আমার প্রতি যেমনই আচরণ করুক না কেন, সে অন্য কেউ নয়, আমারই প্রাণনাথ।
শ্লোক: 33
বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি ।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ ॥
(গীতা ৫/১৮)
অনুবাদঃ- জ্ঞানবান পণ্ডিতেরা বিদ্যা-বিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গাভী, হস্তী, কুকুর ও চণ্ডাল সকলের প্রতি সমদর্শী হন।
শ্লোক: 34
ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি ।
সমঃ সর্বেষু ভূতেষু মদ্ভক্তিং লভতে পরাম্ ॥
(গীতা ১৮/৫৪)
অনুবাদঃ- ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত প্রসন্নচিত্ত ব্যক্তি কোন কিছুর জন্য শোক করেন না বা আকাঙ্ক্ষা করেন না৷ তিনি সমস্ত প্রাণীর প্রতি সমদর্শী হয়ে আমার পরা ভক্তি লাভ করেন।
শ্লোক: 35
সুখমাত্যন্তিকং যত্তদ্ বুদ্ধি গ্রাহ্যমতীন্দ্রিয়ম্ ৷
বেত্তি যত্র ন চৈবায়ং স্থিতশ্চলতি তত্ত্বতঃ ॥
(গীতা ৬/২১)
অনুবাদঃ- এই অবস্থায় শুদ্ধ অন্তঃকরণ দ্বারা আত্মাকে উপলব্ধি করে যোগী আত্মাতেই পরম আনন্দ আস্বাদন করেন। সেই আনন্দময় অবস্থায় অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অপ্রাকৃত সুখ অনুভূত হয়। এই পারমার্থিক চেতনায় অবস্থিত হলে যোগী আর আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান থেকে বিচলিত হন না।
শ্লোক: 36
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি ৷
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি ॥
(গীতা ৬/৩০)
অনুবাদঃ- যিনি সর্বত্র আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতেই সমস্ত বস্তু দর্শন করেন, আমি কখনও তাঁর দৃষ্টির অগোচর হই না এবং তিনিও আমার দৃষ্টির অগোচর হন না ।শ্লোক: 37
মালী হঞা করে সেই বীজ আরোপণ ।
শ্রবণ-কীর্তণ-জলে করয়ে সেচন ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ১৯/১৫২)
অনুবাদঃ- সেই বীজ লাভ করার পর, মালী হয়ে সেই বীজটিকে হৃদয়ে রোপণ করতে হয় এবং শ্রবণ, কীর্তণরূপ জল তাতে সিঞ্চন করতে হয়।
(শ্রীল রূপ গোস্বামীর প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)শ্লোক: 38
নিত্যসিদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম ‘সাধ্য’ কভু নয় ।
শ্রবণাদি-শুদ্ধচিত্তে করয়ে উদয় ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ২২/১০৭)
অনুবাদঃ- কৃষ্ণপ্রেম নিত্যসিদ্ধ বস্তু, তা কখনও (শুদ্ধ ভক্তি ব্যতীত অন্য কোন অভিধেয়ের) সাধ্য নয়। কেবলমাত্র শ্রবণাদি দ্বারা বিশোধিত চিত্তে তার উদয় সম্ভব।
(শ্রীল সনাতন গোস্বামীর প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)শ্লোক: 39
যন্নামধেয়শ্রবণানুকীর্তনাদ্
যৎপ্রহ্বণাদ্ যৎস্মরণাদপি ক্বচিৎ ।
শ্বাদোহপি সদ্যঃ সবনায় কল্পতে
কুতঃ পুনস্তে ভগবন্নু দর্শনাৎ ।।
(ভাগবত ৩/৩৩/৬)
অনুবাদঃ- হে ভগবন্ যাঁর নাম শ্রবণ, অনুকীর্তন, প্রণাম ও স্মরণ করা মাত্র চণ্ডাল ও যবন কুলোদ্ভূত ব্যক্তিও তৎক্ষণাৎ বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠানের যোগ্য হয়ে উঠে, এমন যে প্রভু তুমি, তোমার দর্শনের প্রভাবে কি না হয়?শ্লোক: 40
অহো বত শ্বপচোহতো গরীয়ান্
যজ্জিহ্বাগ্রে বর্ততে নাম তুভ্যম্ ।
তেপুস্তপস্তে জুহুবুঃ সস্নুরার্যা
ব্রহ্মানূচুর্নাম গৃণন্তি যে তে ।।
(ভাগবত ৩/৩৩/৭)
অনুবাদঃ- হে ভগবান ! যাঁদের জিহ্বায় আপনার নাম বিরাজ করে, তাঁরা যদি অত্যন্ত নীচকুলেও জন্মগ্রহণ করেন, তা হলেও তাঁরা শ্রেষ্ঠ। যাঁরা আপনার নাম কীর্তন করেন, তাঁরা সব রকম তপস্যা করেছেন, সমস্ত যজ্ঞ করেছেন, সর্বতীর্থে স্নান করেছেন এবং সমস্ত বেদ পাঠ করেছেন, সুতরাং তাঁরা আর্য মধ্যে পরিগণিত।শ্লোক: 41
নাম চিন্তামণিঃ কৃষ্ণশ্চৈতন্যরসবিগ্রহঃ ।
পূর্ণ শুদ্ধো নিত্যমুক্তোহভিন্নত্বান্নামনামিনোঃ ।।
(পদ্ম পুরাণ)
অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণের নাম চিন্ময় চিন্তামণি বিশেষ, তা চৈতন্যরসের বিগ্রহস্বরূপ। তা পূর্ণ অর্থাৎ মায়িক বস্তুর মতো আবদ্ধ ও খণ্ড নয়; তা শুদ্ধ, অর্থাৎ মায়া-মিশ্য নয়; তা নিত্য মুক্ত অর্থাৎ সর্বদা চিন্ময়, কখনও জড় সম্বন্ধে আবদ্ধ হয় না, যেহেতু নাম ও নামীর স্বরূপে কোন ভেদ নেই।শ্লোক: 42
শৃণ্বন্তি গায়ন্তি গৃণন্ত্যভীক্ষ্নশঃ
স্মরন্তি নন্দন্তি তবেহিতং জনাঃ ।
ত এব পশ্যন্তচিরেণ তাবকং
ভবপ্রবাহোপরমং পদাম্বুজম্ ।।
(ভাগবত ১/৮/৩৬)
অনুবাদঃ- হে শ্রীকৃষ্ণ ! যাঁরা তোমার অপ্রাকৃত চরিত-কথা নিরন্তর শ্রবণ করেন, কীর্তন করেন, স্মরণ করেন এবং অবিরাম উচ্চারণ করেন, অথবা অন্যে তা করলে আনন্দিত হন, তাঁরা অবশ্যই তোমার শ্রীপাদপদ্ম অচিরেই দর্শন করতে পারেন, যা একমাত্র জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহকে নিবৃত করতে পারে।শ্লোক: 43
গোলোকের প্রেমধন, হরিনাম সংকীর্তন,
রতি না জন্মিলে কেনে তায় ।
সংসার-বিষানলে দিবানিশি হিয়ে জ্বলে,
জুড়াইতে না কৈনু উপায় ।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর-ইষ্টদেবে বিজ্ঞপ্তি-২, প্রার্থনা থেকে)
অনুবাদঃ- হরিনাম সংকীর্তনরূপে ভগবৎপ্রেম গোলোক বৃন্দাবন থেকে এই জগতে অবতরণ করেছে। কেন আমার তাতে রতি হল না? দিন ও রাত ধরে সংসার বিষের অনলে আমার হৃদয় জ্বলছে। কিন্তু তবুও তাকে প্রশমিত করার কোন উপায় আমি গ্রহণ করছি না।শ্লোক: 44
জ্ঞানে প্রয়াসমুদপাস্য নমন্ত এব
জীবন্তি সন্মুখরিতাং ভবদীয়বার্তাম্ ।
স্থানে স্থিতাঃ শ্রুতিগতাং তনুবাঙ্মনোভি-
র্যে প্রায়শোহজিত জিতোহপ্যসি তৈস্ত্রিলোক্যাম্ ।।
(ভাগবত ১০/১৪/৩)
অনুবাদঃ- যাঁরা তাঁদের সামাজিক পদে স্থিত হয়েও মনোধর্মী জল্পনা-কল্পনামূলক জ্ঞানকে দূরে নিক্ষেপ করেন, দেহ, মন ও বাক্য দিয়ে শ্রদ্ধা সহকারে আপনার লীলাকথা শ্রবণ করেন এবং আপনি ও আপনার শুদ্ধ ভক্তদের মুখনিঃসৃত হরিকথা শ্রবণ করে জীবন ধারণ করেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে আপনাকে জয় ক্রেন্ম, যদিও ত্রিলোকের কোনও ব্যক্তি অন্য কোন উপায়ে আপনাকে জয় করতে পারে না।শ্লোক: 45
নিবৃত্ততর্ষৈরুপগীয়মানাদ্
ভবৌষধাচ্ছ্রোত্রমনোহভিরামাৎ
ক উত্তমশ্লোকগুণানুবাদাৎ
পুমান্ বিরজ্যেত বিনা পশুঘ্নাৎ ।।
(ভাগবত ১০/১/৪)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবানের মহিমা কীর্তিত হয় গুরু-পরম্পরার ধারা অনুসারে। এই জড় জগতের ক্ষণস্থায়ী মিথ্যা গুণকীর্তনে যাঁরা আদৌ আগ্রহী নয়, তাঁরাই ভগবানের মহিমা কীর্তনে আনন্দ লাভ করেন। ভগরোগের অধীনে যারা জন্মমৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হচ্ছে, সেই সব দেহবদ্ধ জীবদের পক্ষে ভগবানের মহিমা শ্রবণ-কীর্তন হল যথার্থ ঔষধ। তাই, পশুঘাতক বা আত্মঘাতী ছাড়া ভগবৎ-কথা শ্রবণ-কীর্তনে আর কে-ই বা বিরত হবে?শ্লোক: 46
শৃণ্বতাং স্বকথা কৃষ্ণঃ পুণ্যশ্রবণকীর্তনঃ ।
হৃদ্যন্তঃস্থো হ্যভদ্রাণি বিধুনোতি সুহৃৎ সতাম্ ।।
(ভাগবত ১/২/১৭)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি পরমাত্মারূপে সকলের হৃদয়েই বিরাজ করেন এবং তিনি হচ্ছেন সাধুদের সুহৃদ, তিনি তাঁর পবিত্র কথা শ্রবণ ও কীর্তনে রতিযুক্ত ভক্তদের হৃদয়ের সমস্ত ভোগবাসনা বিনাশ করেন।শ্লোক: 47
এতন্নির্বিদ্যমানানামিচ্ছতামকুতভয়ম্ ।
যোগিনাং নৃপ নির্ণীতং হরের্নামানুকীর্তনম্ ।।
(ভাগবত ২/১/১১)
অনুবাদঃ- হে রাজন্ ! মহান আচার্যদের প্রদর্শিত পন্থা অনুসরণ করে নিরন্তর ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা সকলের জন্য সিদ্ধি লাভের নিশ্চিত তথা নির্ভীক মার্গ। এমন কি যাঁরা সমস্ত জড় কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হয়েছেন, যাঁরা সব রকম জড়-জাগতিক সুখভোগের প্রতি আসক্ত এবং যাঁরা দিব্যজ্ঞান লাভ করার ফলে আত্মতৃপ্ত হয়েছেন, তাঁদের সকলের পক্ষে এটিই হচ্ছে সিদ্ধি লাভের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।শ্লোক: 48
আপন্নঃ সংসৃতিং ঘোরাং যন্নাম বিবশো গৃণন্ ।
ততঃ সদ্যো বিমুচ্যেত যদ্বিভেতি স্বয়ং ভয়ম্ ।।
(ভাগবত ১/১/১৪)
অনুবাদঃ- জন্ম-মৃত্যুর ভয়ঙ্কর আবর্তে আবদ্ধ মানুষ বিবশ হয়েও পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্যনাম উচ্চারণ করতে করতে অচিরেই সেই সংসারচক্র থেকে মুক্ত হয়, সেই নামে স্বয়ং মহাকালও ভীত হন।শ্লোক: 49
এবংব্রতঃ স্বপ্রিয়নামকীর্ত্যা
জাতানুরাগো দ্রুতচিত্ত উচ্চৈঃ ।
হসত্যথো রোদিতি রৌতি গায়-
ত্যুন্মাদবন্ নৃত্যতি লোকবাহ্যঃ।।
(ভাগবত ১১/২/৪০)
অনুবাদঃ- কেউ যখন ভক্তিমার্গে যথার্থ উন্নতি সাধন করে এবং তার অতি প্রিয় ভগবানের দিব্যনাম কীর্তন করে আনন্দমগ্ন হন, তখন তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে ভগবানের নাম কীর্তন করেন। তিনি কখনও হাসেন, কখনও কাঁদেন এবং কখনও উন্মাদের মতো নৃত্য করেন। বাইরের লোকেরা কে কি বলে সেই সম্বন্ধে তাঁর কোন জ্ঞান থাকে না।শ্লোক: 50
যদি বৈষ্ণব-অপরাধ উঠে হাতী মাতা ।
উপাড়ে বা ছিণ্ডে, তার শুখি যায় পাতা ।।
অনুবাদঃ- ভগবদ্ভক্ত যদি এই জড় জগতে ভক্তিলতার সেবা করার সময় কোন বৈষ্ণবের চরণে অপরাধ করেন, তা হলে ভক্তিলতার পাতা শুকিয়ে যায়। এই প্রকার বৈষ্ণব অপরাধকে মত্ত হস্তীর আচরণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।শ্লোক: 51
অসৎসঙ্গত্যাগ, -- এই বৈষ্ণব-আচার ।
‘স্ত্রীসঙ্গী’—এক অসাধু, ‘কৃষ্ণাভক্ত’ আর ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ২২/৮৭)
অনুবাদঃ- বৈষ্ণবকে সর্বদাই অসৎসঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। স্ত্রীর প্রতি আসক্ত এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিহীন ব্যক্তিরাই অসাধু। এই অসৎসঙ্গ ত্যাগই বৈষ্ণব আচার।শ্লোক: 52
তত্তেহনুকম্পাং সুসমীক্ষমাণো
ভুঞ্জান এবাত্মকৃতং বিপাকম্ ।
হৃদ্বাগ্বপুর্ভির্বিদধন্নমন্তে
জীবেত যো মুক্তিপদে স দায়ভাক্ ।।
(ভাগবত ১০/১৪/৮)
অনুবাদঃ- যিনি আপনার কৃপা লাভের আশায় সকর্মের মন্দ ফল ভোগ করতে করতে মন, বাক্য ও শরীরের দ্বারা আপনার প্রতি ভক্তি বিধান করে জীবন যাপন করেন, তিনি মুক্তিপদে দায়ভাক্ অর্থাৎ তিনি আপনার ঐকান্তিকী শুদ্ধ ভক্ত হবার উপযুক্ত প্রার্থী। (ব্রহ্মা)শ্লোক: 53
নারীস্তনা ভারং নাভিদেশং
দৃষ্ট্বা মা গা মোহ বেশ্যাম্ ।
এতাং মাংস বাসাদি বিকারা
মনসি বিচিন্তায় ভারং ভারম্ ।
(শঙ্করাচার্য)
অনুবাদঃ- নারীদের স্তনভার ও সরু নাভিদেশের তথাকথিত সৌন্দর্য দর্শন করে মোহগ্রস্ত বা উত্তেজিত হয়ো না। কারণ, এই আকর্ষণীয় অঙ্গগুলি শুধু চর্বি, মাংস আদি জঘন্য বস্তুর সমন্বয় মাত্র। এই কথা মনে মনে গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করা উচিত।শ্লোক: 54
মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা নাবিবিক্তাসনো ভবেৎ ।
বলবানিন্দ্রিয়গ্রামো বিদ্বাংসমপি কর্ষতি ।।
(ভাগবত ৯/১৯/১৭)
অনুবাদঃ- মায়ের সঙ্গে, বোনের সঙ্গে এবং কন্যার সঙ্গে নির্জন স্থানে উপবেশন করা উচিত নয়, কেন না বলবান ইন্দ্রিয়সমূহ বিদ্বান ব্যক্তিরও মন আকর্ষণ করতে পারে। (দেবযানির প্রতি মহারাজ যযাতি)শ্লোক: 55
যুবতীনাং যথা যূনি যুনাং চ যুবতৌ যথা ।
মনোহভিরমতে তদ্বন্ মনো মে রমতাং ত্বয়ি ।।
(বিষ্ণু পুরাণ ১/২০/১৯)
অনুবাদঃ- যুবকদের দর্শনে যুবতীদের মন যেমন উৎফুল্ল হয় এবং যুবতীদের দর্শনে যুবকেরা যেমন উৎফুল্ল হয়, হে কৃষ্ণ! আমার মনও যেন শুধু তোমাতেই সেই রকম আনন্দ লাভ করে।শ্লোক: 56
পুংসঃ স্ত্রিয়া মিথুনীভাবমেতং
তয়োর্মিথো হৃদয়গ্রন্থিমাহুঃ ।
অতো গৃহক্ষেত্রসুতাপ্তবিত্তৈ-
র্জনস্য মোহোহয়মহং মমেতি ।।
(ভাগবত ৫/৫/৮)
অনুবাদঃ- স্ত্রী ও পুরুষের প্রতি আকর্ষণ জড়-জাগতিক জীবনের ভিত্তি। এই ভ্রান্ত আসক্তিই স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের হৃদয়গ্রন্থি-স্বরূপ এবং তার ফলেই জীবের দেহ, গৃহ, সম্পত্তি, সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও ধন-সম্পদ আদিতে “আমি ও আমার” বুদ্ধিরূপ মোহ উৎপন্ন হয়।শ্লোক: 57
যন্মৈথুনাদি গৃহমেধিসুখং হি তুচ্ছং
কণ্ডূয়নেন করয়োরিব দুঃখদুঃখম্ ।
তৃপ্যন্তি নেহ কৃপণা বহুদুঃখভাজঃ
কণ্ডূতিবন্মনসিজং বিষহতে ধীরঃ ।।
(ভাগবত ৭/৯/৪৫)
অনুবাদঃ- চুলকানি কমানোর উদ্দেশ্যে দুহাতের ঘর্ষণের সঙ্গে যৌনজীবনের তুলনা করা হয়। গৃহমেধি বা তথাকথিত গৃহস্থদের কোন পারমার্থিক জ্ঞান নেই। তাই তারা মনে করে যে, এই চুলকানিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সুখের স্তর, যদিও বাস্তবে তা শুধু দুঃখেরই উৎস। ব্রাহ্মণদের বিপরীতধর্মী কৃপণগণ পুনঃ পুনঃ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করেও কখনও তৃপ্ত হয় না। কিন্তু যাঁরা ধীর এবং যাঁরা এই চুলকানি সহ্য করেন, তাঁদেরকে কখনও গণ্ডমূর্খদের প্রাপ্য দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয় না।শ্লোক: 58
তপসা ব্রহ্মচর্যেণ শমেন চ দমেন চ ।
ত্যাগেন সত্যশৌচাভ্যাং যমেন নিয়মেন বা ।।
(ভাগবত ৬/১১/১৩)
অনুবাদঃ- মনকে সংযত করতে হলে অবশ্যই ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে এবং পতিত হওয়া চলবে না। স্বেচ্ছায় ইন্দ্রিয়ভোগ ত্যাগরূপ তপস্যা বরণ করতে হবে। এভাবেই মন ও ইন্দ্রিয়কে অবশ্যই সংযত করতে হবে । দান করতে হবে, সত্যনিষ্ঠ হতে হবে, নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং নিয়মিতভাবে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন এবং জপ করতে হবে।শ্লোক: 59
প্রায়েণ দেব মুনয়ঃ স্ববিমুক্তিকামা
মৌনং চরন্তি বিজনে ন পরার্থনিষ্ঠাঃ ।
নৈতান্ বিহায় কৃপণান্ বিমুমুক্ষ একো
নান্যং ত্বদস্য শরণং ভ্রমতোহনুপশ্যে ।।
(ভাগবত ৭/৯/৪৪)
অনুবাদঃ- হে নৃসিংহদেব! বাস্তবিকই আমি কতো মুনি-ঋষিদের দেখি, যাঁরা শুধুমাত্র তাঁদের নিজেদের মুক্তির ব্যাপারেই আগ্রহী। বড় বড় শহর ও নগরের কথা বিবেচনা না করে, তাঁরা হিমালয়ে কিংবা নির্জন বনে মৌনব্রত অবলম্বন করে ধ্যান করে থাকেন। অন্যদের মুক্ত করার ব্যাপারে তাঁদের কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু আমি এই সমস্ত কৃপণদের পরিত্যাগ করে একা মুক্তি পেতে চাই না। আমি জানি কৃষ্ণভাবনামৃত ছাড়া, আপনার চরণ-কমলের আশ্রয় গ্রহণ না করে কেউ সুখী হতে পারে না। তাই তাদেরকেও আপনার চরণ-কমলের আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আমি পোষণ করি। (ভগবান নৃসিংহদেবের প্রতি প্রহ্লাদ মহারাজ)শ্লোক: 60
নৈবোদ্বিজে পরদুরত্যয়বৈতরণ্যা-
স্ত্বদ্বীর্যগায়নমহামৃতমগ্নচিত্তঃ ।
শোচে ততো বিমুখচেতস ইন্দ্রিয়ার্থ
মায়াসুখায় ভরমুদ্বহতো বিমূঢ়ান্ ।।
(ভাগবত ৭/৯/৪৩)
অনুবাদঃ- হে পরম পুরষ! আমি জড়-জাগতিক অস্তিত্ব তথা বৈতরণীকে ভয় করি না, কেন না যেখানেই আমি থাকি না কেন, সব সময় আমি আপনার মহিমান্বিত লীলা চিন্তনে মগ্ন আছি। আমি শুধু সেই সব মূর্খদের কথাই ভাবছি, যারা জড়-জাগতিক সুখের জন্য এবং তাদের পরিবার, সমাজ ও দেশের পরিচালনার জন্য বিপুল পরিকল্পনা করে চলেছে। অনুকম্পাবশত আমি শুধু তাদের কথাই ভাবছি।শ্লোক: 61
মহদ্বিচলনং নৃণাং গৃহিণাং দীনচেতসাম্ ।
(ভাগবত ১০/৮/৪)
অনুবাদঃ- হে প্রভু! আপনার মতো মহৎ ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ইতস্তত পর্যটন করেন না, বরং দীনচেতা গৃহীদের উদ্ধারের জন্যই তাদের গৃহে গমন করেন। (গর্গমুনির প্রতি নন্দ মহারাজ)শ্লোক: 62
চৈঃ চঃ আপনি করিমু ভক্তভাব অঙ্গীকারে ।
আপনি আচরি’ ভক্তি শিখাইমু সবারে ।।
(চৈঃ চঃ আদি ৩/২০)
অনুবাদঃ- আপনি নিজে ভক্তভাব অঙ্গীকার করে এবং ভক্তির আরচরণ করে সকলকে শিক্ষা দেব। (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)শ্লোক: 63
ভারত-ভূমিতে হৈল মনুষ্য-জন্ম যার ।
জন্ম সার্থক করি’ কর পর-উপকার ।।
(চৈঃ চঃ আদি ৯/৪১)
অনুবাদঃ- ভারতবর্ষে যিনি মনুষ্য দেহ পেয়েছেন, তিনি যেন নিজের জীবন সার্থক করে পরোপকার করেন।শ্লোক: 64
যারে দেখ, তারে কহ ‘কৃষ্ণ’-উপদেশ ।
আমার আজ্ঞায় গুরু হঞা তার’ এই দেশ ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ৭/১২৮)
অনুবাদঃ- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও ভাগবতে যেমনটি রয়েছে, অবিকৃতভাবে কৃষ্ণের সেই সব আদেশ সকলকে পালন করতে উপদেশ দাও। এভাবেই গুরু হয়ে আমার আজ্ঞায় এই দেশের প্রত্যেককে ত্রাণ কর।শ্লোক: 65
এইমত ভক্তভাব করি’ অঙ্গীকার ।
আপনি আচরি’ ভক্তি করিল প্রচার ।।
(চৈঃ চঃ আদি ৪/৪১)
অনুবাদঃ- এইমত ভক্তভাব অঙ্গীকার করে, নিজে আচরণ করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জগতে ভক্তি প্রচার করলেন।শ্লোক: 66
কলিকালের ধর্ম—কৃষ্ণনাম-সঙ্কীর্তন ।
কৃষ্ণ-শক্তি বিনা নহে তার প্রবর্তন ।।
(চৈঃ চঃ অন্ত্য ৭/১১)
অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণের নাম-সঙ্কীর্তনই কলিকালের মূল ধর্ম, শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা শক্ত্যাবিষ্ট না হলে এই সংকীর্তন আন্দোলন প্রচার করা যায় না।শ্লোক: 67
সর্বভূতেষু যঃ পশ্যেদ্ভগবদ্ভাবমাত্মনঃ ।
ভূতানি ভগবত্যাত্মন্যেষ ভাগবতোত্তমঃ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪৫)
অনুবাদঃ- যিনি ভাগবতোত্তম, তিনি সর্বভূতে আত্মার আত্মাস্বরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেই দেখেন এবং আত্মার আত্মাস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণে সমস্ত জীবকে দেখেন।শ্লোক: 68
ঈশ্বরে তদধীনেষু বালিশেষু দ্বিষৎসু চ ।
প্রেমমৈত্রীকৃপোপেক্ষা যঃ করোতি স মধ্যমঃ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪৬)
অনুবাদঃ- যে ভক্ত ঈশ্বরে প্রেম, ভক্তে মৈত্রী, অজ্ঞান ব্যক্তিদের কৃপা এবং বিদ্বেষীদের প্রতি উপেক্ষা করেন, তিনি মধ্যম ভক্ত।শ্লোক: 69
অর্চায়ামেব হরয়ে পূজাং যঃ শ্রদ্ধয়েহতে ।
ন তদ্ভক্তেষু চান্যেষু স ভক্তঃ প্রাকৃতঃ স্মৃতঃ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪৭)
অনুবাদঃ- যিনি লৌকিক ও পারিবারিক প্রথাক্রমে পরম্পরাগত শ্রদ্ধার সঙ্গে অর্চা মূর্তিতে হরিকে পূজা করেন, অথচ শাস্ত্র অনুশীলনের দ্বারা শুদ্ধ ভক্তিতত্ত্ব অবগত না হওয়ায় হরিভক্তদের পূজা করেন না। তিনি প্রাকৃত ভক্ত, অর্থাৎ ভক্তিপর্ব আরম্ভ করেছেন মাত্র। তাকে ভক্তপ্রায় বা বৈষ্ণবাভাষ বলা হয়।শ্লোক: 70
শ্রুতিমপরে স্মৃতিমিতরে ভারতমন্যে ভজন্তু ভবভীতাঃ ।
অহমিহ নন্দং বন্দে যস্যালিন্দে পরং ব্রহ্ম ।।
(পদ্যাবলী ১২৬)
অনুবাদঃ- সংসার ভয়ে ভীত মানুষেরা কেউ শ্রুতিকে, কেউ স্মৃতিকে, কেউ বা মহাভারতকে ভজনা করুন; আমি কিন্তু কেবল শ্রীনন্দেরই বন্দনা করি – যাঁর অলিন্দে শ্রীকৃষ্ণ খেলা করেন। (রঘুপতি উপাধ্যায়/ রূপ গোস্বামী)শ্লোক: 71
সাধবো হৃদয়ং মহ্যং সাধূনাং হৃদয়ং ত্বহম্ ।
মদন্যৎ তে ন জ্ঞানন্তি নাহং তেভ্যো মনাগপি ।।
(ভাগবত ৯/৪/৬৮)
অনুবাদঃ- সাধু-মহাত্মারা আমার হৃদয় এবং আমিও তাদের হৃদয়। তারা আমাকে ছাড়া অন্য কিছু জানে না এবং আমিও তাদের ছাড়া অন্য কাউকে আমার বলে জানি না।শ্লোক: 72
জগাই মাধাই হৈতে মুঞি সে পাপিষ্ঠ ।
পুরীষের কীট হৈতে মুঞি সে লঘিষ্ঠ ।।
(চৈঃ চঃ আদি ৫/২০৫)
অনুবাদঃ- আমি জগাই-মাধাই থেকেও পাপিষ্ঠ এবং এমন কি বিষ্ঠার কীট থেকেও অধম। (কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী)শ্লোক: 73
মোর নাম শুনে যেই তার পূণ্য ক্ষয় ।
মোর নাম লয় যেই তার পাপ হয় ।।
(চৈঃ চঃ আদি ৫/২০৬)
অনুবাদঃ- যিনি আমার নাম শুনেন, তাঁর পূণ্য ক্ষয় হয়ে যায়। যিনি আমার নাম উচ্চারণ করেন, তাঁর পাপ হয়। (কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী)শ্লোক: 74
প্রেমের স্বভাব—যাঁহা প্রেমের সম্বন্ধ ।
সেই মানে,-- ‘কৃষ্ণে মোর নাহি প্রেম-গন্ধ’ ।।
(চৈঃ চঃ অন্ত্য ২০/২৮)
অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যদি কোনও ভক্তের প্রকৃত প্রেম জাগ্রত হয়, সেই প্রেমের স্বভাবই এই রকম যে, সেই ভক্ত নিজেকে ভক্ত বলেই গণ্য করেন না। বরং, তিনি সর্বদাই মনে করেন যে, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমের গন্ধমাত্রও আমার নেই। (কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী)শ্লোক: 75
তুমি ত ঠাকুর, তোমার কুক্কুর,
বলিয়া জানহ মোরে।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, শরণাগতি)
অনুবাদঃ- তুমি তো পরমেশ্বর ভগবান, অনুগ্রহ করে আমাকে তোমার পোষা কুকুর বলে গণ্য করবে।শ্লোক: 76
কীটজন্ম হউ যথা তুয়া দাস ।
বহির্মুখ ব্রহ্মজন্মে নাহি আশ ।।
(ভক্তিবিনোদ ঠাকুর, মানস দেহ গেহ ৫)
অনুবাদঃ- তোমার ভক্ত হয়ে, যেখানে তোমার ভক্তদের বাস, সেখানে কীটরূপে জন্ম নিতেও আমি প্রস্তুত। তবে তোমার প্রতি ভক্তিহীন হয়ে ব্রহ্মার জন্ম লাভ করার ইচ্ছাও আমার নেই।শ্লোক: 77
হা হা প্রভু নন্দসুত, বৃষভানুসুতাযুত,
করুণা করহ এইবার ।
নরোত্তমদাস কয়, না ঠেলিহ রাঙ্গা পায়,
তোমা বিনা কে আছে আমার।।
(নরোত্তম দাস ঠাকুর)
অনুবাদঃ- হে শ্রীকৃষ্ণ! হে নন্দসুত! হে বৃষভানুর কন্যা শ্রীমতি রাধার সঙ্গী! আমাকে এবার করুণা কর। অবশেষে আমি তোমার রাঙ্গাচরণ পেলাম। কৃপা করে আমাকে সেখান থেকে ঠেলে দিও না। তুমি ছাড়া আমার আশ্রয় আর কে আছে?শ্লোক: 78
ধর্মাচারি-মধ্যে বহুত ‘কর্মনিষ্ঠ’ ।
কোটি-কর্মনিষ্ঠ-মধ্যে এক ‘জ্ঞানী’ শ্রেষ্ঠ ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ১৯/১৪৭)
অনুবাদঃ- বৈদিক জ্ঞানের অনুগামীদের মধ্যে অধিকাংশই সকাম কর্মের অনুষ্ঠান করছেন এবং ভাল ও মন্দ কর্মের পার্থক্য নিরূপণ করছেন। সেই রকম নিষ্ঠাবান কোটি সংখ্যক সকাম কর্মীর মধ্যে কদাচিৎ একজন জ্ঞানী ব্যক্তি থাকতে পারেন, যিনি সকাম কর্মীদের থেকে শ্রেষ্ঠ।শ্লোক: 79
কোটিজ্ঞানী-মধ্যে হয় একজন ‘মুক্ত’ ।
কোটিমুক্ত-মধ্যে ‘দুর্লভ’ এক কৃষ্ণ-ভক্ত ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ১৯/১৪৮)
অনুবাদঃ- সেই রকম কোটি সংখ্যক জ্ঞানীর মধ্যে কদাচিৎ একজন বস্তুত মুক্তি লাভ করেন। সেই রকম কোটি সংখ্যক মুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একজন শুদ্ধ ভক্ত অত্যন্ত দুর্লভ।শ্লোক: 80
মুক্তানামপি সিদ্ধানাং নারায়ণপরায়ণঃ ।
সুদুর্লভঃ প্রশান্তাত্মা কোটিষ্বপি মহামুনে ।।
(ভাগবত ৬/১৪/৫)
অনুবাদঃ- হে মহর্ষি! কোটি কোটি মুক্ত ও সিদ্ধদের মধ্যে নারায়ণ পরায়ণ প্রশান্তাত্মা পুরুষ অত্যন্ত দুর্লভ।শ্লোক: 81
ভবদ্বিধা ভাগবতাস্তীর্থভূতাঃ স্বয়ং বিভো । তীর্থীকুর্বন্তি তীর্থানি স্বান্তঃস্থেন গদাভৃতা ।।
(ভাগবত ১/১৩/১০)
অনুবাদঃ- আপনার মতো ভাগবতেরা নিজেরাই তীর্থস্বরূপ। তাঁরা স্বীয় অন্তকরণস্থিত গদাধারী ভগবানের পবিত্রতা বলে পাপীগণের পাপ দ্বারা মলিন তীর্থস্থানগুলিকে পবিত্র করেন। (বিদুরের প্রতি মহারাজ যুধিষ্ঠির)শ্লোক: 82
যস্যাস্তি ভক্তির্ভগবত্যকিঞ্চনা
সর্বৈর্গুণৈস্তত্র সমাসতে সুরাঃ ।
হরাবভক্তস্য কুতো মহদ্ গুণা
মনোরথেনাসতি ধাবতো বহিঃ ।।
(ভাগবত ৫/১৮/১২)
অনুবাদঃ- যিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনন্য ভক্তিসম্পন্ন, তাঁর মধ্যে দেবতাদের সমস্ত সদ্ গুণগুলি প্রকাশিত হয়। কিন্তু যিনি হরিভক্তি-বিহীন তার মধ্যে কোন সদ্ গুণই নেই, কেন না তিনি মনোরথের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের বহিরঙ্গা শক্তি জড় জগতের প্রতি নিরন্তর ধাবিত হচ্ছেন। (প্রহ্লাদ মহারাজ ও হরিবর্ষবাসীরা)শ্লোক: 83
বিষ্ণু অস্য দেবতা ইতি বৈষ্ণবঃ ।
(অজ্ঞাত উৎস)
অনুবাদঃ- যিনি ভগবান বিষ্ণুকে তাঁর আরাধ্যদেব রূপে গ্রহণ করেছেন, তিনিই বৈষ্ণব ।শ্লোক: 84
যেই ভজে সেই বড়, অভক্ত – হীন, ছার ।
কৃষ্ণভজনে নাহি জাতি-কুলাদি-বিচার ।।
(চৈঃ চঃ অন্তঃ ৪/৬৭)
অনুবাদঃ- যিনি কৃষ্ণভক্তিমূলক সেবার পন্থা গ্রহণ করেছেন, তিনিই মহিমান্বিত। আর অভক্ত সর্বদাই নিন্দনীয় এবং জঘন্য গুণসম্পন্ন। এই জন্য কৃষ্ণভজনে জাতি ও কুলাদির বিচার করা হয় না। (সনাতন গোস্বামীর প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)শ্লোক: 85
ইত্থং সতাং ব্রহ্মসুখানুভূত্যা
দাস্যং গতানাং পরদৈবতেন ।
মায়াশ্রিতানাং নরদারকেণ
সাকং বিজহ্রুঃ কৃতপুণ্যপুঞ্জাঃ ।।
(ভাগবত ১০/১২/১১)
অনুবাদঃ- নির্বিশেষবাদীরা জ্ঞানীরা যাঁকে ব্রহ্মসুখরূপে উপলব্ধি করেন, দাস্য রসের ভক্তরা যাঁকে পর-দেবতারূপে দর্শন করেন এবং মায়াশ্রিত সাধারণ মানুষেরা যাঁকে একটি মানব-শিশুরূপে দর্শন করেন, সেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বৃন্দাবনের গোপ-বালকেরা জন্ম-জন্মান্তরের পুঞ্জীভূত পুণ্যকর্মের ফলে, সখারূপে খেলা করছেন। (শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)শ্লোক: 86
নানাশাস্ত্র-বিচারণৈক-নিপুণৌ সদ্ধর্ম-সংস্থাপকৌ
লোকানাং হিতকারিণৌ ত্রিভুবনে মানৌ শরণ্যাকরৌ ।
রাধাকৃষ্ণ-পদারবিন্দভজনানন্দেন মত্তালিকৌ
বন্দে রূপ-সনাতনৌ রঘুযুগৌ শ্রীজীব-গোপালকৌ ।।
(শ্রীশ্রীষড়্ গোস্বামী-অষ্টক-২)
অনুবাদঃ- যাঁরা বিবিধ শাস্ত্র-বিচারে পরম নিপুণ, সৎ-ধর্মের স্থাপনকর্তা, মানবগণের পরম মঙ্গলকারী, ত্রিভুবন-পূজ্য, আশ্রয়দাতা ও শ্রীরাধা-গোবিন্দের পদারবিন্দ ভজনানন্দে প্রমত্ত মধুকর-সদৃশ আমি বারবার সেই শ্রীরূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ দাস ও শ্রীজীব গোস্বামীপাদগণের বন্দনা করি। (শ্রীনিবাস আচার্য)শ্লোক: 87
ত্যক্ত্বা তূর্ণমশেষ-মণ্ডলপতিশ্রেণীং সদা তুচ্ছবৎ
ভূত্বা দীনগণেশকৌ করুণয়া কৌপীন-কন্থাশ্রিতৌ ।
গোপীভাব-রসামৃতাব্ধিলহরী-কল্লোল-মগ্নৌমুহু-
র্বন্দে রূপ-সনাতনৌ রঘুযুগৌ শ্রীজীব-গোপালকৌ ।।
(শ্রীশ্রীষড়্ গোস্বামী-অষ্টক-৪)
অনুবাদঃ- যাঁরা অসংখ্য মণ্ডলপতিদের সহবাস ঝটিতি তুচ্ছবৎ পরিত্যাগ করে কৃপাপূর্বক দীনহীনগণের পতি হয়ে কৌপীনকন্থা অবলম্বন করেছিলেন এবং যাঁরা গোপীপ্রেম-রসামৃত-সিন্ধু-তরঙ্গে সদাই নিমগ্ন ছিলেন, আমি বারবার সেই শ্রীরূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ দাস ও শ্রীজীব গোস্বামীপাদগণের বন্দনা করি। (শ্রীনিবাস আচার্য)শ্লোক: 88
সংখ্যাপূর্বক-নাম-গান-নতিভিঃ কালাবসানীকৃতৌ
নিদ্রাহার-বিহারকাদি-বিজিতৌ চাতন্ত্যদীনৌ চ যৌ ।
রাধাকৃষ্ণ-গুণ-স্মৃতের্মধুরিমানন্দেন সম্মোহিতৌ
বন্দে রূপ-সনাতনৌ রঘুযুগৌ শ্রীজীব-গোপালকৌ ।।
(শ্রীশ্রীষড়্ গোস্বামী-অষ্টক-৬)
অনুবাদঃ- যাঁরা সংখ্যাপূর্বক নাম-জপ, কীর্তন ও প্রণাম করে সময় অতিবাহিত করতেন, যাঁরা আহার-বিহার-নিদ্রা আদি জয় করেছিলেন, যাঁরা অত্যন্ত দীন-হীনের মতো বিচরণ করতেন এবং যাঁরা শ্রীশ্রীরাধা-গোবিন্দের গুণ-মাধুর্য স্মরণ করে পরমানন্দে বিভোর হতেন, আমি বারবার সেই শ্রীরূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, গোপালভট্ট, রঘুনাথ দাস ও শ্রীজীব গোস্বামীপাদগণের বন্দনা করি। (শ্রীনিবাস আচার্য)শ্লোক: 89
হে রাধে ব্রজদেবিকে চ ললিতে হে নন্দসূনো কুতঃ
শ্রীগোবর্ধন-কল্পপাদপ-তলে কালিন্দী-বন্যে কুতঃ ।
ঘোষন্তাবিতি সর্বতো ব্রজপুরে খেদৈর্মহাবিহ্বলৌ
বন্দে রূপ-সনাতনৌ রঘুযুগৌ শ্রীজীব-গোপালকৌ ।।
(শ্রীশ্রীষড়্ গোস্বামী-অষ্টক-৮)
অনুবাদঃ- “হে ব্রজদেবী রাধে! তুমি কোথায়? হে ললিতে! তুমি কোথায়? হে কৃষ্ণ! তুমি কোথায়? তোমরা কি শ্রীগোবর্ধনের কল্পতরুতলে, না কালিন্দী-কূলস্থ বনমধ্যে,”- এভাবেই বলতে বলতে যাঁরা নিরতিশয় শোকাতুর হয়ে ব্রজভূমির সর্বত্র ব্যাকুলভাবে পরিভ্রমণ করতেন, আমি বার-বার সেই শ্রীরূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ দাস ও শ্রীজীব গোস্বামীপাদগণের বন্দনা করি। (শ্রীনিবাস আচার্য)শ্লোক: 90
সত্ত্বং বিশুদ্ধং বসুদেবশব্দিতং
যদিয়তে তত্র পুমানপাবৃতঃ ।
সত্ত্বে চ তস্মিন্ ভগবান্ বাসুদেবো ।
হ্যধোক্ষজো মে মনসা বিধীয়তে ।।
(ভাগবত ৪/৩/২৩)
অনুবাদঃ- যে শুদ্ধ সত্ত্বে পরমেশ্বর ভগবান অনাবৃতভাবে বিরাজ করেন, তাকে বলা হয় বসুদেব স্তর। সেই শুদ্ধ সত্ত্বে অবস্থিত জড় ইন্দ্রিয়ানুভূতির অতীত পরমেশ্বর ভগবান বাসুদেব নামে পরিচিত। আমার মনের দ্বারা আমি তাঁকে উপলব্ধি করতে পারি । (সতীর প্রতি শিব)শ্লোক: 91
যস্মিন্ সর্বাণি ভূতান্যাত্মৈবাভূদ্ বিজানতঃ ।
তত্র কো মোহঃ কঃ শোক একত্বমনুপশ্যতঃ ।।
(শ্রীঈশোপনিষদ ৭)
অনুবাদঃ- যিনি সর্বদা সমস্ত জীবকুলকে গুণগতভাবে শ্রীভগবানের সঙ্গে অভিন্ন, চিৎকণাস্বরূপ দর্শন করেন, তিনিই যথার্থ তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী। তাঁর শোকই বা কি? মোহই বা কি? তাঁর মোহ বা শোক থাকে না।শ্লোক: 92
স্থাবর-জঙ্গম দেখে, না দেখে তার মূর্তি ।
সর্বত্র হয় নিজ ইষ্টদেব-স্ফূর্তি ।।
(চৈঃ চঃ মধ্য ৮/২৭৪)
অনুবাদঃ- মহাভাগবত স্থাবর-জঙ্গম দর্শন করেন, কিন্তু তিনি তাদের রূপ দর্শন করেন না। পক্ষান্তরে, তিনি সর্বত্র পরমেশ্বর ভগবানকে দর্শন করেন। (রায় রামানন্দের প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)শ্লোক: 93
বদন্তি তত্তত্ত্ববিদস্তত্ত্বং যজ্জ্ঞানমদ্বয়ম্ ।
ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দ্যতে ।।
(ভাগবত ১/২/১১)
অনুবাদঃ- যা অদ্বয় জ্ঞান, অর্থাৎ এক এবং অদ্বিতীয় বাস্তব বস্তু, তত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরা তাকেই পরমার্থ বলেন, এই তত্ত্ববস্তু ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান—এই তিন নামে অভিহিত হন । (সূত গোস্বামী)শ্লোক: 94
নাহং বিপ্রো ন চ নরপতির্নাপি বৈশ্যো ন শূদ্রো
নাহং বর্ণী ন চ গৃহপতির্নো বনস্থো যতির্বা ।
কিন্তু প্রোদ্যন্নিখিলপরমানন্দপূর্ণামৃতাব্ধে-
র্গোপীভর্তুঃ পদকমলয়োর্দাসদাসানুদাসঃ ।।
(পদ্যাবলী ৭৪)
অনুবাদঃ- আমি ব্রাহ্মণ নই, ক্ষত্রিয় রাজা নই, বৈশ্য বা শূদ্র নই, ব্রহ্মচারী নই, গৃহস্থ নই, বাণপ্রস্থ নই, সন্ন্যাসীও নই। কিন্তু আমি নিত্য স্বতঃ প্রকাশমান নিখিল পরমানন্দপূর্ণ অমৃত-সমুদ্ররূপ শ্রীকৃষ্ণের পদকমলের দাসের অনুদাসের দাস। (রূপ গোস্বামী)
0 Comments