"হরিপ্রিয়া শ্ৰীমতী রাধারানীর জন্মলীলা রহস্য"


"হরিপ্রিয়া শ্ৰীমতী রাধারানীর জন্মলীলা রহস্য"





লীলা পুরুষােত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিমান পুরুষ। যেহেতু কৃষ্ণ শক্তিমান পুরুষ, তাই তাঁর থেকে অনন্ত শক্তি প্রকাশিত হয়েছে, যেমন—সৃষ্টিশক্তি, লীলাশক্তি, ইচ্ছাশক্তি, জীবশক্তি, মায়াশক্তি, বৈকুণ্ঠে ভূ, শ্রী, যােগমায়া আদি ষােড়শ শক্তি, তা ছাড়া অন্তরঙ্গা শক্তি ইত্যাদি। চিন্ময় জগৎ গােলােকের সমস্ত কার্যকলাপ শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তির দ্বারা সম্পন্ন হয়। এই অন্তরঙ্গা শক্তি তিন ভাগে বিভক্ত— সন্ধিনী, সম্বিৎ ও হ্লাদিনী। সন্ধিনী শক্তির সাহায্যে সমগ্র চিৎ-জগৎ প্রকাশিত হয়েছে। সম্বিৎ শক্তি বা জ্ঞান শক্তির দ্বারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে জানতে পারেন এবং কৃষ্ণভক্তেরা এই শক্তির সাহায্যে শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারেন। আর হ্লাদিনী শক্তির দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ দিব্য আনন্দ আস্বাদন করেন এবং ভক্তরা এই হ্লাদিনী শক্তির কৃপায় কৃষ্ণপ্রেমের সমুদ্রে অবগাহন করেন। এই হ্লাদিনী শক্তির প্রতিমূর্তি হচ্ছেন শ্রীমতী রাধাঠাকুরানী। 


🌿 ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে শ্রীমতী রাধারানীর জন্মলীলা সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে —


 অপ্রাকৃত বৃন্দাবন-ধামে মাধবীতলায় আসীন রত্ন-সিংহাসনে কৃষ্ণচন্দ্র একা বসে আছেন। তখন তিনি লীলাবিলাস করতে ইচ্ছা করায়, সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর বাম অঙ্গ থেকে হ্লাদিনী শক্তি শ্রীমতী রাধারানী প্রকটিত হন। শ্রীমতী রাধিকাই হচ্ছে আদি শক্তি। তাঁর গাত্রবর্ণ তপ্তসােনার মতাে এবং সমগ্র অঙ্গসৌষ্ঠব নানা রকম রত্ন-অলঙ্কারে বিভূষিতা। তিনি নানা লীলাবিলাসের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের সন্তোষ বিধান করছিলেন। আরও অধিকভাবে শ্রীকৃষ্ণের আনন্দ বিধানের জন্য তিনি নিজের অঙ্গ থেকে অসংখ্য গােপিকাদের প্রকাশ করেন। সেই সমস্ত ব্রজাঙ্গনারা রূপে-গুণে সর্বোত্তমা ছিলেন। সুতরাং শ্রীমতী রাধারানী ও তাঁর কায়ব্যূহ গােপিকাদের মায়াবদ্ধ জীবদের মতাে জন্মগ্রহণ করতে হয়নি। তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির প্রকাশ। তারা গােলােকে শাশ্বতকাল ধরে অবস্থান করছেন এবং শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে লীলাবিলাস করে কৃষ্ণপ্রেম আস্বাদন করছেন। ব্রহ্মার দিবসের মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন ভৌম বৃন্দাবনে বা এই জড় জগতের মধ্যে প্রকাশিত বৃন্দাবনে অবতরণ করেন, তখন তাঁর লীলায় অংশ গ্রহণ করবার জন্য তার হ্লাদিনী শক্তি শ্ৰীমতী রাধারানী ও তাঁর কায়ব্যূহ গােপিকারাও সেই সঙ্গে অবতরণ করেন।বৃন্দাবনে শ্রীমতী রাধিকা ও তাঁর কায়ব্যূহ সখীরা যদিও তাঁদের শাশ্বত চিন্ময় রূপ নিয়ে আবির্ভূত হন, তবুও আমাদের দৃষ্টিতে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা যেন জন্মলীলা প্রকট করেছেন। যেহেতু আমরা মায়াবদ্ধ জীব, তাই আমাদের কৃপা করবার জন্য তাঁরা আমাদের মতাে জন্মলীলা

পরিগ্রহ করেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের জন্ম ও কর্ম সবই দিব্য বা অপ্রাকৃত।


🌿 পদ্ম পুরাণের উত্তর খণ্ডে শিব-পার্বতী সংবাদে ভৌম বৃন্দাবনে শ্রীমতী রাধারানীর জন্ম সম্বন্ধে আমরা জানতে পাই যে—


 বৃন্দাবনে বৃষভানু রাজা নামে এক পরম ভক্ত বাস করতেন। তাঁর কীর্তিদা সুন্দরী নামে এক পতিপ্রাণা স্ত্রী ছিল। তারই গর্ভে ভাদ্রমাসে শুক্লাষ্টমী তিথিতে মধ্যাহ্নে শুভক্ষণে শ্রীমতী রাধারানী জন্মগ্রহণ করেন। কন্যারত্ন দর্শনে সমগ্র বৃন্দাবন দিব্যানন্দে মগ্ন হলেন। কন্যার রূপে সকলে মুগ্ধ হলেও তাঁর চোখ নিমীলিত ছিল বলে,

সকলেই মনে করল কন্যাটি অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে।


🌿 রাধারানীর চোখ মুদ্রিত হয়ে থাকার কারণঃ 

—একদিন গােলােকে কৃষ্ণ রাধারানীকে জ্ঞাপন করলেন যে, তিনি অতি শীঘ্রই পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। সুতরাং রাধারানী যেন সেখানে অবতরণ করেন, কেন না সেখানে উভয়ের মধ্যে বিচিত্র মাধুর্য লীলাবিলাস হবে। কৃষ্ণের কথা শুনে রাধারানী বললেন যে, যদি তাঁকে পৃথিবীতে অবতরণ করতে হয়, তা হলে পর পুরুষের মুখ দর্শন করতে হবে। কিন্তু রাধারানী শ্রীকৃষ্ণের রূপমাধুরী ছাড়া অন্য কিছুই দর্শন করেন না। তাই তাঁর পক্ষে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করা কি করে সম্ভব? রাধারানীর যুক্তিসঙ্গত কথা শুনে কৃষ্ণ বললেন যে, সেই জন্য তাঁর চিন্তার কোনও কারণ নেই। রাধারানী সব সময় কৃষ্ণকেই দেখতে পাবেন।এভাবেই আশ্বস্ত হয়ে, তবেই হরিপ্রিয়া রাধারানী মর্ত্যলােকে অবতীর্ণ হতে রাজি হয়েছিলেন।


প্রকৃতপক্ষে ভৌম জগতের বৃন্দাবন-ধাম আর চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চলােক গােলােক বৃন্দাবনের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাতেই চিন্ময়

গােলােক বৃন্দাবন এই জড় জগতে প্রকাশিত হয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন এই জড় জগতে অবতরণ করতে চান, তখন তিনি তাঁর নিত্য পার্ষদবৃন্দ ও চিন্ময় ধামসহ

অবতরণ করেন।

মায়াবদ্ধ জীবেরা এই জড় জগতের অন্তর্গত বৃন্দাবন, নবদ্বীপ আদি ধামগুলি যে চিন্ময় তা উপলব্ধি করতে পারে না। তাদের কাছে এই চিন্ময় ধামণ্ডলি জড়

রাজ্যেরই অন্তর্গত এক-একটি অঞ্চল বলে মনে হয়। ধাম যেহেতু ভগবানের চিন্ময়


রাজ্য, তাই বদ্ধ জীব ধামকে কলুষিত করতে পারে না। যারা ধামে এসে পাপকর্ম চরিতার্থ করে, প্রকৃতপক্ষে তাদের কার্যকলা ধামের উপরে মায়া রচিত আবরণের

জালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সদ্গুরুর কৃপায় মায়ার আবরণ উন্মােচন হলে, তবেই ধামের চিন্ময় স্বরূপের দর্শন ও উপলব্ধি সম্ভব হয়।


এদিকে রাধিকার শুভ জন্ম-মহােৎসব উপলক্ষ্যে আমন্ত্রিত হয়ে স্ত্রী ও পুত্রসহ নন্দ মহারাজ বৃষভানু রাজার রাজপুরীতে এসে উপস্থিত হন। তাঁরা পরস্পরে আনন্দে কোলাকুলি করছিলেন, তখন এক ফাকে কৃষ্ণ অন্তঃপুরে রাধার পালঙ্কের কাছে এসে তাঁর পদ্মহস্ত দ্বারা রাধার মুদ্রিত চক্ষু স্পর্শ করা মাত্রই রাধারানী তাঁর চোখ খুলে কৃষ্ণের দিকে তাকালেন। এভাবেই উভয়ে উভয়কে দর্শন করে দিব্য আনন্দে নিমগ্ন হন।

ইত্যবসরে বৃষভানু রাজা অন্তঃপুরে প্রবেশ করে দেখলেন, রাধিকা চোখ উন্মীলিত করে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে আছে, তখন তিনি আনন্দের আতিশয্যে উভয়কে কোলে তুলে নিলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, কৃষ্ণই রাধাকে চক্ষুদান করেছেন। রাধার চক্ষু উন্মীলনের খবর পাওয়া মাত্রই সমগ্র ব্রজবাসীরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়েছিলেন।


🌿 শ্রীল রূপ গােস্বামী বিরচিত শ্রীশ্রীললিতমাধব-নাটকম্ গ্রন্থে শ্রীরাধিকার জন্মলীলা সম্বন্ধে আমরা জানতে পারি যে—

কন্যা কামনা করে বিন্ধ্য পর্বত ব্রহ্মার তপস্যা করেছিলেন। তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাকে বর দিয়েছিলেন যে, সে তার মনের মতাে দুটি কন্যা লাভ করবে এবং তাদের পতি এমন একজন হবেন, যিনি দেবাদিদেব শঙ্করকে পর্যন্ত পরাজিত করে নিজের গুণমহিমায় জগৎকে বিস্মিত করবেন। পুত্র কামনা না করে বিন্ধ্য কন্যা কামনা করেছিল কেন? গৌরীপিতা হিমালয় তাঁর জামাতা শিবের সম্পর্কে অত্যন্ত গর্বিত ছিলেন, সেই হিমালয়ের প্রতি স্পর্ধা করেই বিন্ধ্য কন্যা প্রার্থনা করেছিলেন। রাক্ষসী পূতনাই রাধাকে গােকুলে নিয়ে এসেছিল। বৃন্দাবনে যে-সমস্ত অসাধারণ কুমারীরা জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁদেরকে অপহরণ করে নিয়ে আসার জন্য কংস পূতনাকে নিযুক্ত করেছিল, কারণ সে তাদের হত্যা করতে চেয়েছিল। কংসের এই প্রবৃত্তি হয়েছিল, কারণ দেবকীকন্যা দেবী অষ্টভুজা কংসকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন যে, সে যখন পূর্বজন্মে কালনেমি ছিল, তখন যিনি সুদর্শনচক্র দ্বারা তার মক্তক ছেদন করেছিলেন, যিনি দেবতাদের আরাধ্য এবং যিনি জগতের মূলস্বরূপ, তিনি আজ আনন্দামৃত সমুদ্ররাশি দ্বারা প্রণয়িজনের আনন্দকে উদ্বেলিত করে চন্দ্রোদয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। দেবকীকন্যা আরও বলেছিলেন যে, তাঁর থেকেও উত্তম মাধুর্যমণ্ডিতা অষ্ট মহাশক্তি—রাধা, চন্দ্রাবলী, ললিতা, বিশাখা, পদ্ম, শৈব্যা, শ্যামলা ও ভদ্রা কাল হােক বা পরশু হােক পৃথিবীতে আবির্ভূতা হবেন। আবার এই অষ্ট মহাশক্তির মধ্যে দুটি ভগিনী বিশেষ গুণবতী বলে খ্যাতিলাভ করবেন এবং তাঁরা যুথেশ্বরী হবেন। এই দুই ভগিনীকে যিনি বিবাহ করবেন, তিনি রাজশ্রেষ্ঠা হবেন এবং যুদ্ধে মহাদেবকে পরাজিত করতে পারবেন।


  🌿 ব্রহ্মার প্রার্থনা অনুসারে হরিমায়া চন্দ্রভানু ও বৃষভানুর পত্নীদ্বয়ের গর্ভদুটিকে আকর্ষণ করে ওই দুটি কন্যাকে বিন্ধ্যাগিরির পত্নীর গর্ভে স্থাপন করেন। পূতনা রাক্ষসী যখন ওই কন্যাদুটি অপহরণ করে পলায়ন করছিল, তখন বিন্ধ্যাচলের পুরােহিত রাক্ষসনাশক মন্ত্র পাঠ করলে পূতনা ভীতগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন তার হাত

থেকে প্রথমা ভগিনী চন্দ্রাবলী বিদর্ভদেশ প্রবাহিণী স্রোতে পতিত হয়। বিদর্ভরাজ ভীষ্মক তাঁকে পেয়েছিলেন। পৌর্ণমাসী পূতনা রাক্ষসীর কোল থেকে রাধা, ললিতা, ভদ্রা, শৈব্যা ও শ্যামা—এই পাঁচটি কন্যাকে পেয়েছিলেন। পরে তিনি এই অতুলনীয়া পাঁচটি কন্যাকে গােপীদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। বিশাখা যমুনার জলে ভেসে যাচ্ছিলেন, জটিলাই তাকে পেয়েছিলেন। অভিমন্যু, গােবর্ধন প্রভৃতি গােপগণের সঙ্গে রাধা, চন্দ্রাবলী প্রভৃতির বিবাহ মায়াই ঘটিয়েছেন। গােপগণ যে কুমারীদের পতি বলে মনে করেন তা কেবল মমতা মাত্র, কারণ এই সব কুমারীদের দর্শনও গােপদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব অর্থাৎ তাঁরা কখনও এই কন্যাদের স্ত্রীরূপে দেখতেও সমর্থ নন। তবে এই আটজন কুমারীর যে কৃষ্ণের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ।


তাও আশ্চর্য নয়। আট কন্যার কি কথা? গােকুলে এমন কোন মৃগনয়নী সুন্দরী আছে, যে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরাগবর্তী নয় ? গােকুলে ষােল হাজার একশ গােপকন্যাকে নিয়ে চন্দ্রাবলী প্রভৃতি কুমারী দেবী চণ্ডিকার অর্চনা করেন। তাদের জপের মন্ত্র ছিল, “হে কাত্যায়নী! হে মহামায়ে! হে মহাযােগিনী! হে অধিশ্বরী!

নন্দ মহারাজের পুত্রকে আমার পতি করে দিন,আপনাকে নমস্কার করি।”


🌿 শ্রীল কবিরাজ গােস্বামী শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে শ্রীমতী রাধারানীর স্বরূপতত্ত্ব বর্ণনা করে বলেছেন—


রাধিকা হয়েন কৃষ্ণের প্রণয়-বিকার ।

স্বরূপশক্তি-'হ্লাদিনী’ নাম যাঁহার ॥

হ্লাদিনী করায় কৃষে আনন্দাস্বাদন।

হাদিনীর দ্বারা করে ভক্তের পােষণ ॥

হ্লাদিনীর সার ‘প্রেম’, প্রেমসার ‘ভাব’ ।

ভাবের পরমকাষ্ঠা, নাম—মহাভাব’ ॥

মহাভাবস্বরূপা শ্রীরাধা-ঠাকুরাণী ।

সর্বগুণখনি কৃষ্ণকান্তাশিরােমণি ॥

কৃষ্ণপ্রেম-ভাবিত যাঁর চিত্তেন্দ্রিয়-কায় ।

কৃষ্ণ-নিজশক্তি রাধা ক্রীড়ার সহায় ॥

    (চৈঃ চঃ আদি ৪/৫৯,৬০,৬৮,৬৯,৭১)


🌿 উপরােক্ত শেষ শ্লোকের তাৎপর্যে কৃষকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ উল্লেখ করেছেন—


“শ্রীমতী রাধারানী শ্রীকৃষ্ণের মতাে পূর্ণ চিন্ময়ী। তাঁকে কখনও জড় জগতের মায়ার দ্বারা প্রভাবিত একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করা উচিত নয়। জড় জগতের বদ্ধ জীবের মতাে তাঁর জড় ইন্দ্রিয়ের জড় অনুভূতিপূর্ণ সূক্ষ্ম ও স্থূল জড় দেহ নেই। তিনি পূর্ণরূপে চিন্ময় এবং তাঁর দেহ ও চিত্ত উভয়ই চিন্ময়। যেহেতু তাঁর দেহ চিন্ময়, তাই তার ইন্দ্রিয়ও চিন্ময়। তাঁর দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়সমূহ কৃষ্ণপ্রেমে পরিপূর্ণ। তিনি হচ্ছেন ভগবানের আনন্দদায়িনী অন্তরঙ্গা শক্তির অন্তর্গত হ্লাদিনী শক্তির মূর্ত প্রকাশ এবং তাই শ্রীকৃষ্ণের আনন্দের একমাত্র উৎস।


 “অন্তরঙ্গে যা শ্রীকৃষ্ণ থেকে ভিন্ন, তা শ্রীকৃষ্ণ উপভােগ করতে পারেন না। তাই শ্ৰীমতী রাধারানী ও শ্রীকৃষ্ণ অভিন্ন। শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তির সন্ধিনী অংশের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের সর্বাকর্ষক চিন্ময় কলেবর প্রকাশিত হয়। সেই অন্তরঙ্গা শক্তির হ্লাদিনী শক্তি সর্বাকর্ষক শ্রীকৃষ্ণকে আকর্ষণকারী শ্ৰীমতী রাধারানীকে প্রকাশ করেন। শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলাবিলাসে কেউই শ্ৰীমতী রাধারানীর সমপর্যায়ভুক্ত নন।”


🌸 শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় সহচরীরা সকলেই শ্ৰীমতী রাধারাণীর কায়ব্যূহ, অংশ বা বিভৃতি।


🌿 শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গােস্বামী সেই সম্বন্ধে বলেছেন—

কৃষ্ণকান্তাগণ দেখি ত্রিবিধ প্রকার ।

এক লক্ষ্মীগণ, পুরে মহিষীগণ আর ॥

ব্রজাঙ্গনা-রূপ, আর কান্তাগণ-সার।

শ্রীরাধিকা হৈতে কান্তাগণের বিস্তার ॥


“শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় সহচরীরা তিনটি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত—লক্ষ্মীগণ, মহিষীগণ ব্রজগোপিকাগণ। ব্রজগােপিকারা হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠা। শ্রীমতী রাধারানী থেকে সমস্ত কান্তাদের বিস্তার হয়েছে।" (চৈঃ চঃ আদি ৪/৭৪-৭৫)


অবতার কৃষ্ণ যৈছে করে অবতার । 

অংশিনী রাধা হৈতে তিন গণের বিস্তার ॥


"অবতারী শ্রীকৃষ্ণ থেকে যেভাবে সমস্ত অবতারদের বিস্তার হয়, তেমনই রাধারানী থেকে সমস্ত লক্ষ্মী, মহিষী ও ব্রজদেবীরা প্রকাশিত হন।" (চৈঃ চঃ আদি ৪/৭৬)


বৈভবগণ যেন তার অঙ্গ-বিভূতি। 

বিম্ব-প্রতিবিম্ব রূপ মহিষীর ততি ॥


'বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীদেবীরা হচ্ছেন শ্রীমতী রাধারানীর অংশ-প্রকাশ এবং দ্বারকার মহিষীরা তাঁর ভাবমুর্তি।" (চৈঃ চঃ আদি ৪/৭৭)


বহু কান্তা বিনা নহে রসের উল্লাস।

 লীলার সদায় লাগি বহুত প্রকাশ।। 


"বহু কান্তা ব্যতীত রস আস্বাদনের আনন্দ উপভােগ করা যায় না। তাই ভগবানের লীলা বিলাসে সহায়তা করার জন্য শ্রীমতী রাধারানী বহুরূপে প্রকাশিত হন।" (চৈঃ চঃ আদি ৪/৮০)


তার মধ্যে ব্রজে নানা ভাব-রস-ভেদে । 

কৃষ্ণকে করায় রাসাদিক-লীলা স্বাদে ।


“ব্রজে বিভিন্ন যূথে বিভিন্ন ভাব ও রস অনুসারে গোপিকারা শ্রীকৃষ্ণকে রাসনৃত্য ও অন্যান্য লীলাবিলাসের রস আস্বাদন করান।" (চৈঃ চঃ আদি ৪/৮১)


গােবিন্দানন্দিনী, রাধা, গােবিন্দমােহিনী। 

গােবিন্দসর্বস্ব, সর্বকান্তা-শিরােমণি ॥


“শ্রীমতী রাধারানী হচ্ছেন শ্রীগােবিন্দের আনন্দদায়িনী এবং তিনি গােবিন্দমােহিনীও।তিনি গােবিন্দের সর্বস্ব এবং সমস্ত কান্তার শিরোমণি।” (চৈঃ চঃ আদি ৪/৮২)


কৃষ্ণবাঞ্ছা-পূর্তিরূপ করে আরাধনে ।

অতএব 'রাধিকা' নাম পুরাণে বাখানে ॥


“তার আরাধনা হচ্ছে কৃষ্ণ-বাঞ্ছাপূর্তি। তাই পুরাণে তাঁকে 'রাধিকা' বলে বর্ণনা করা হয়েছে। (চৈঃ চঃ ৪/৮৭)


কৃষ্ণ আরাধনায় রাধিকা যে সর্বশ্রেষ্ঠা, তা গােপিকাদের উক্তি থেকে বােঝা যায় - 

অনয়ারাধিতাে নূনং ভগবান হরিরীশ্বরঃ। 

যন্নো বিহায় গােবিন্দঃ প্রীতাে যামনয়দ্রহঃ ।


“ভগবান যথার্থই তাঁর দ্বারা আরাধিত হয়েছেন। তাই তিনি (গােবিন্দ) তাঁর প্রতি অত্যন্ত প্রীত হয়ে, আমাদের সকলকে পরিত্যাগ করে তাঁকে এক নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়েছেন।" (ভাগবত ১০/৩০/২৮) তাই, কবিরাজ গোস্বামী বলেছেন —


অতএব সর্বপূজ্যা, পরম-দেবতা ।

সর্বপালিকা, সর্ব-জগতের মাতা ॥


"তাই শ্রীমতী রাধারানী হচ্ছেন পরম দেবতা এবং তিনি সকলের পূজ্যা। তিনি সকলের পালিকা এবং সমস্ত জগতের মাতা।"

 পঞ্চতত্ত্বের অন্তর্গত শ্রীল গদাধর পণ্ডিত হচ্ছেন শ্রীমতী রাধারানীর অবতার। তিনি পাঁচশাে বছর পূর্বে অবতীর্ণ হয়ে শ্রীচৈতন্য লীলার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন। নিজের প্রেমরস-সুধা আস্বাদন করবার জন্য লীলা পুরুষােত্তম শ্রীকৃষ্ণ পাঁচশাে বছর পূর্বে শ্রীধাম মায়াপুরে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। শ্রীল কবিরাজ গোস্বামী সেই সম্বন্ধে বলেছেন—


শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা কীদৃশাে বানয়ৈবা-

 স্বাদ্যো যেনাদ্ভুতমধুরিমা কীদৃশো বা মদীয়ঃ।

সৌখ্যাঞ্চাস্যা মদনুভবতঃ কীদৃশং বেতি লোভা-

 ত্তদ্ভাবাঢ্যঃ সমজনি শচীগৰ্ভসিন্ধৌ হরীন্দুঃ।।

(চৈঃ চঃ আদি ১/৬) 


"শ্রীরাধার প্রেমের মহিমা কি রকম। ওই প্রেমের দ্বারা শ্রীরাধা আমার যে অদ্ভুত মাধুর্য আস্বাদন করেন, সেই মাধুর্য বা কি রকম। আমার মাধুর্য আস্বাদন করে শ্রীরাধা যে সুখ অনুভব করেন, সেই সুখই বা কি রকম। এই সমস্ত বিষয়ে জানবার জন্য লােভ জন্মানাের ফলে শ্রীরাধার ভাবযুক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণরূপ চন্দ্র শচীগৰ্ভসিন্ধুতে আবির্ভূত হয়েছেন।"


শ্রীকৃষ্ণের বিরহে শ্রীমতী রাধারানীর প্রলাপ—


অনুন্যধন্যানি দিনান্তরাণি হরে ত্বদালােকনমন্তরেণ।

 অনাথবন্ধো করুণৈকসিন্ধো হা হন্ত হা হন্ত কথং নয়ামি।।


“হে হরে! হে অনাথবন্ধো! হে করুণৈক-সিন্ধো! আহা! আহা! তােমার দর্শনাভাবে আমি এই অধন্য দিবা-রাত্র কিরূপে যাপন করব? (কৃষ্ণকর্ণামৃত ৪১) 


শ্রীমতী রাধিকার দয়িত কৃষ্ণ দর্শনের আকাঙ্ক্ষা—


হে দেব হে দয়িত হে ভুবনৈবন্ধো

হে কৃষ্ণ হে চপল হে করুণৈকসিন্ধো।

 হে নাথ হে রমণ হে নয়নাভিরাম

হা হা কদা নু ভবিতাসি পদং দৃশাের্মে।।


“হে দেব! হে দয়িত! হে ভুবনৈকবন্ধো! হে কৃষ্ণ! হে চপল ! হে করুণৈকসিন্ধো! হে নাথ! হে রমণ! হে নয়নাভিরাম! আহা, তুমি কবে আমার দৃষ্টিগােচর হবে?”

(কৃষ্ণকর্ণামৃত ৪০) 


মহাভাগবত শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদ ছিলেন কৃষ্ণপ্রেম কল্পবৃক্ষের অঙ্গুর। তিনি অন্তিম সময়ে ভগবৎ-ধাম প্রাপ্ত হয়েছিলেন শ্রীরাধারানী-কৃত শ্লোক কীর্তন করতে করতে —

অয়ি দীনদয়ার্দ্রনাথ হে মথুরানাথ কদাবলােক্যসে ।

হৃদয়ং তৃদলােককাতরং দয়িত ভ্রাম্যতি কিং করােম্যহম।।

 "হে দীন-দয়ার্দ্রনাথ! হে মথুরানাথ! কবে আমি তােমাকে দর্শন করব! তােমার দর্শনে বঞ্চিত হয়ে আমার হৃদয় যে অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েছে! হে প্রিয়তম, এখন আমি কি করব ?” (পদ্যাবলী)


তপ্তকাঞ্চনগৌরাঙ্গি রাধে বৃন্দাবনেশ্বরী। 

বৃষভানুসুতে দেবি প্রণমামি হরিপ্রিয়ে।।


"যাঁর  অঙ্গকান্তি তপ্তকাঞ্চন মতাে গৌরবর্ণ, যিনি শ্রীধাম অধীশ্বরী, যিনি বৃন্দাবনের বৃষভানু মহারাজের কন্যা, সেই হরিপ্রিয়া শ্ৰীমতী রাধারানীকে শত-সহস্র কোটি প্রণাম নিবেদন করি।”


🌿 শ্রীমতি রাধারাণীর ভজন - 


“রাধে জয় জয় মাধব-দয়িতে।

গোকুলতরুণীমণ্ডল-মহিতে।।

দামোদর-রতিবর্ধন-বেশে।

হরি নিষ্কুট বৃন্দাবিপিনেশে।।

বৃষভানূদধি-নবশশিলেখে।

ললিতাসখি গুণরমিত বিশাখে।।

করুণাং কুরুময়ি করুণা-ভরিতে।

সনক-সনাতন বর্ণিত-চরিতে।।”


আগামী ২৬ আগস্ট বুধবার শ্রীমতি রাধারাণীর আবির্ভাব তিথি “রাধাষ্টমী”

দুপুর ১২ ঘটিকা পর্যন্ত উপবাস,,,

হরে কৃষ্ণ

Post a Comment

0 Comments