১৯৯০সালে শ্রীল প্রভুপাদের নিকট গুরুমহারাজের লিখিত পত্র

 ১৯৯০সালে শ্রীল প্রভুপাদের নিকট গুরুমহারাজের লিখিত পত্র





১৫ আগস্ট ১৯৯০

প্রিয় শ্রীল প্রভুপাদ,

আপনার শ্রীপাদপদ্মে আমার বিনীত প্রণতি গ্রহণ করুন। আপনার দিব্য করুণার মাহাত্ম্য সর্বজয়যুক্ত হােক।


আপনার প্রতি আমার ভালবাসার উপরেই আমার পারমার্থিক জীবন

সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। আপনার প্রতি আমার ভালবাসা যখন অবিমিশ্র ও পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে শুধুমাত্র তখনই আমি কৃষ্ণালোকে প্রত্যাবর্তন করতে পারব। কখনও কখনও আমি ভাবি আপনার প্রতি আমার ভালবাসা কি বৃদ্ধি পাচ্ছে না কি হ্রাস পাচ্ছে। প্রথম যখন আপনার গ্রন্থ অধ্যয়ন শুরু করেছিলাম, আপনার প্রতি আমি এক সুগভীর ভালবাসা অনুভব

করেছিলাম। ভক্তবৃন্দের মুখে আপনার অপ্রাকৃত লীলা-মহিমা শ্রবণ করে যখন ইসকনে যােগদান করেছিলাম আপনার প্রতি আমার ভালবাসা আরও প্রগাঢ় হয়েছিল। কুম্ভ মেলায় আপনাকে যখন প্রার্থনারত অবস্থায় প্রথম দর্শন করেছিলাম প্রকৃত ভালবাসা বলতে কি বুঝায় তা জীবনে প্রথমবারের মত অনুধাবন করেছিলাম।


মায়াপুরে আপনি যখন আমাকে আপনার সচিব হওয়ার ও আপনার পাশের কক্ষে চলে আসার জন্য বলেছিলেন, আমি অনুভব করেছিলাম যে সেটাই ছিল আমার অস্তিত্বের পরিপূর্ণতা। আমার অগনন ভুল-ত্রুটির জন্য আপনি যখন আমাকে তিরস্কার করতেন আনন্দাশ্রুতে আমি প্লাবিত হতাম। আপনার অতি নগণ্য যেটুকু সেবা করতাম তার জন্য আপনি যখন প্রশংসা

করতেন (আপনার প্রতি) সম্রম উদ্রেককারী আনুগত্যবােধে আমার হৃদয় বিগলিত হত এবং আমার নয়নাশ্রু দিয়ে আপনার চরণযুগল ধৌত করে দেওয়ার আকাঙ্খা হত।


বৃন্দাবনের সেই দিনগুলােতে আপনাকে কেন্দ্র করেই আমাদের জীবনধারা আবর্তিত হত। আপনার দিব্য শক্তির প্রভাবে আমাদের উষ্ণ হৃদয়েও আপনি

ভালবাসার ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছিলেন আর আপনার জন্য আমাদের জীবন উৎসর্গ করতেও আমরা সদা প্রস্তুত ছিলাম। চিন্ময়লােকে প্রত্যাবর্তন করার

জন্য আপনি যখন প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন অনেক ভক্তই নীরবে কৃষ্ণের নিকটে প্রার্থনা করছিল যেন তাদের জীবনের বিনিময়ে হলেও আপনাকে এজগতে অবস্থান করার সুযােগ দান করা হয়। কিন্তু আপনার সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে কৃষ্ণ এত বেশি আপনার অভাববােধ করছিলেন যে আমাদের সকল প্রার্থনা সত্ত্বেও তিনি আপনাকে চিন্ময়লােকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।


 আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক দামােদর প্রসাদ শাস্ত্রী যিনি আপনার চিকিৎসা তা করছিলেন আমাকে কাঁদতে বারণ করলেন। তিনি বললেন “শ্রীল প্রভুপাদ এখন কৃষ্ণের নিকটে প্রত্যাবর্তন করছেন, তােমরা যদি এখন কাঁদ তবে তােমাদের অশ্রুধারা তার ভগবদ্ধামে প্রত্যাবর্তনের যাত্রাকে কঠিন করে তুলবে।” আমাদের পিসীমা আপনার ভগিনী আপনার শয্যাপাশেই বসেছিলেন এবং তার নয়ন বেয়ে ঝর্নার স্রোতধারারমত এত অনর্গল অশ্রু ঝরে পড়ছিল মনে হচ্ছিল যেন  তার হৃদয় বিদীর্ন হয়ে গিয়েছিল।


মনােহর প্রভু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন এবং আমি দামােদর প্রসাদের এ কথারই পুনরাবৃত্তি করলাম “অনুগ্রহ করে কাঁদবেন না, শ্রীল প্রভুপাদ এখন কৃষ্ণের নিকটে প্রত্যাবর্তন করছেন আমাদের নয়নাশ্রু দিয়ে তার চিন্ময়লােকে যাত্রাকে বাধাগ্রস্থ করতে পারিনা।” তখন আমি আরও বললাম, তার জন্য কাঁদার আমাদের সারা জীবনই পড়ে রয়েছে।”  


যদিও আমি ভেবেছিলাম যে সমগ্র জীবনভর আমি আপনার জন্য কাঁদব, কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে আমার মরুসদৃশ হৃদয় থেকে কোন অশ্রুই ঝরে পড়েনি। তারপর একদিন আমি যখন আপনার সমাধির সম্মুখে বসেছিলাম, যা তখন পর্যন্তও সাধারন কাঠের দরজাওয়ালা একটি ছােট্ট কক্ষ মাত্র ছিল, হঠাৎ করেই আমার এই অনুভব হল যে আপনার কোমড় জড়িয়ে ধরে আমি আর আপনাকে হাঁটাতে পারব না, আপনার জন্য রন্ধনকৃত প্ৰসাদ আপনি যখন আহার করবেন তখন আর আপনার সম্মুখে বসে থাকতে পারব না, বনমালী কবিরাজ অনেক যত্ন ও সতর্কতার  সাথে যথাযথভাবে আপনার জন্য ঔষধ-পথ্য প্রস্তুত করার যে শিক্ষা আমাকে প্রদান করেছিল, আমি আর আপনাকে সেই ঔষধ-পথ্য প্রদান করতে পারবনা। দীর্ঘক্ষণ ধরে পিঠে ভর দিয়ে একপাশে কাত হয়ে থাকার ফলে আপনি ব্যথা বােধ করলে আর আপনাকে পাশ ফিরিয়ে দিতে পারব না। তখন আমার মনে হল আমি যেন

একটি ভুল করেছি, আপনি যখন আপনার সমাধিতে প্রবেশ করেছিলেন আপনাকে সাহায্য করার জন্য আমিও সেখানে গিয়েছিলাম, আমার তখন আপনার সাথে সেখানেই থেকে যাওয়া উচিত ছিল । চিরকাল আপনার সেবা করার জন্য আমারও সেখানে থেকে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে আমার দুঃখ-ক্লেশে পরিপূর্ণ এই দেহটিকে প্রতিপালনের জন্য আমি ফিরে এসেছিলাম, আমি অনুধাবন করতে পারলাম যে আপনার সাথেই চিদাকাশে ফিরে যাবার সুবর্ণ সুযােগটিকে আমি হারিয়ে ফেলেছি।


হৃষিকেশ থেকে আপনি যখন বৃন্দাবনে ফিরে আসলেন, আপনি ভক্তদের জানালেন যে আপনি দেহত্যাগ করার জন্য ফিরে এসেছেন। সেকথা শুনে তারা কাঁদতে শুরু করেছিল। কিন্তু আপনি তাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে আত্মার কখনাে মৃত্যু হয়না। এখন আমি উপলব্ধি করতে পারছি যে আপনাকে শুধু আপনার ভৌত দেহে সীমাবদ্ধ বলে ভাবাটাই একটি ভ্রান্ত ধারনা। আমি এখন প্রত্যক্ষ করতে পারছি যে আপনি ইসকনের সর্বত্র, সবকিছুর মাঝে অবস্থান করছেন। আমার ভক্তিজীবনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ইসকন থেকে আপনি অভিন্ন, আপনার ইসকন আপনার থেকে অভিন্ন -তা উপলব্ধি না করেই, নবীন ভক্ত হিসেবে আমি আপনার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম। আপনার করুণায় আমি এখন অনুধাবন করতে পারছি যে ইসকন হচ্ছে আপনার দেহসদৃশ্য এবং আপনি হচ্ছেন তার আত্মা। ইসকন হচ্ছে মন্দির, আপনি হচ্ছেন তার শ্রীবিগ্রহ। যদিও আমাদের জড় দৃষ্টির সম্মুখ থেকে আপনার বপুদেহ অন্তরালে রয়েছে। আপনি আপনার ইসকনের মাধ্যমে আমাদের মাঝেই অবস্থান করছেন।


 চিন্ময়লােকের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার কৃষ্ণপ্রেম বিতরণ করার জন্য শ্রীকৃষ্ণই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সুতরাং তিনি মহাবদান্য অবতাররূপে পরিচিত। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি নগর ও গ্রামে সংকীর্তন আন্দোলন সম্প্রসারিত হবে। শ্রীল প্রভুপাদ এমনকি মহাবদান্য অবতারও তাঁর মহানতম অভিযাত্রা আপনার দ্বারা সম্পন্ন করার জন্য রেখে গিয়েছেন এবং সেই সুদুর্লভ করুণার মূর্তরূপ হচ্ছে ইসকন।


নবীনভক্ত হিসাবে আমি আপনার সাথে চিন্ময়লােকে প্রত্যাবর্তন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শ্রীল প্রভুপাদ, এখন আমি আমার কায়, মন ও বাক্য দ্বারা আপনার ইস্কনের সেবা করার জন্য জন্ম-জন্মান্তর ধরে এ জগতেই

অবস্থান করার অভিলাষী।


আপনার নিত্য সেবক

ভক্তিচারু স্বামী

Post a Comment

0 Comments