শ্রীমদ্ভাগবত সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক
শ্লোক: 1
ইদং ভাগবতং নাম পুরাণং ব্রহ্মসম্মিতম্ ।
উত্তমশ্লোকচরিতং চকার ভগবানৃষিঃ ।।
নিঃশ্রেয়সায় লোকস্য ধন্যং স্বস্ত্যয়নং মহৎ ।।
(ভাগবত ১/৩/৪০)
অনুবাদঃ- এই শ্রীমদ্ভাগবত হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের বাঙ্ময় বিগ্রহ এবং তা সংকলন করেছেন ভগবানের অবতার শ্রীল ব্যসদেব। তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে সমস্ত মানুষের পরম মঙ্গল সাধন করা এবং এটি সর্বতোভাবে সার্থক, পূর্ণ আনন্দময় এবং সর্বতোভাবে পরিপূর্ণ।
শ্লোক: 2
অনর্থোপশমং সাক্ষাদ্ভক্তিযোগমধোক্ষজে ।
লোকস্যাজানতো বিদ্বাংশ্চক্রে সাত্বতসংহিতাম্ ।।
(ভাগবত ১/৭/৬)
অনুবাদঃ- জীবের জাগতিক দুঃখ-দুর্দশা, যা হচ্ছে তার কাছে অনর্থ, ভক্তিযোগের মাধ্যমে অচিরেই তার উপশম হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা জানে না এবং তাই মহাজ্ঞানী ব্যাসদেব পরমতত্ত্ব সমন্বিত এই সাত্বত সংহিতা সংকলন করেছেন।
শ্লোক: 3
ধর্মঃ স্বনুষ্ঠিতঃ পুংসাং বিষ্বকসেনকথাসু যঃ ।
নোৎপাদয়েদযদি রতিং শ্রম এব হি কেবলম্ ।।
(ভাগবত ১/২/৮)
অনুবাদঃ- মানুষের উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত বর্ণাশ্রম-ধর্ম যদি কৃষ্ণকথায় রতি উৎপাদন না করে, তা হলে সেই ধর্মও শ্রম মাত্র।
শ্লোক: 4
নিগমকল্পতরোর্গলিতং ফলং
শুকমুখাদমৃতদ্রবসংযুতম্ ।
পিবত ভাগবতং রসমালয়ং
মুহুরহো রসিকা ভুবি ভাবুকাঃ ।।
(ভাগবত ১/১/৩)
অনুবাদঃ- হে বিচক্ষণ এবং চিন্তাশীল মানুষ, কল্পবৃক্ষরূপী বৈদিক শাস্ত্রের অত্যন্ত সুপক্ব ফল শ্রীমদ্ভাগবত আস্বাদন করুন। তা শ্রীল শুকদেব গোস্বামীর শ্রীমুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল। তাই ফলটি আরও অধিক উপাদেয় হয়েছে, যদিও এই অমৃতময় রস মুক্ত পুরুষেরা পর্যন্ত আস্বাদন করে থাকেন।
শ্লোক: 5
নষ্টপ্রায়েষ্বভদ্রেষু নিত্যং ভাগবতসেবয়া ।
ভগবত্যুত্তমশ্লোকে ভক্তির্ভবতি নৈষ্ঠিকী ।।
(ভাগবত ১/২/১৮)
অনুবাদঃ- নিয়মিতভাবে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করলে এবং ভগবানের শুদ্ধ ভক্তের সেবা করলে হৃদয়ের সমস্ত কলুষ সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয় এবং তখন উত্তমশ্লোকের দ্বারা বন্দিত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমময়ী ভক্তি সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
শ্লোক: 6
তস্মাৎ সঙ্কীর্তনং বিষ্ণোর্জগন্মঙ্গলমংহসাম্।
মহতামপি কৌরব্য বিদ্ধ্যৈকান্তিকনিষ্কৃতম্।।
(ভাগবত ৬/৩/৩১)
অনুবাদঃ-- হে কুরুরাজ, হরিনাম সংকীর্তন এমন কি মহাপাপের ফলকেও নির্মূল করতে পারে। তাই হরিনাম সংকীর্তনই হচ্ছে জগতের সবচেয়ে মঙ্গলময় অনুষ্ঠান। অনুগ্রহ করে তা হৃদয়ঙ্গম করুন যাতে অন্যেরাও তা নিষ্ঠাভরে গ্রহণ করে।
শ্লোক: 7
ধর্মস্য হ্যাপবর্গ্যস্য নার্থোহর্থায়োপকল্পতে ।
নার্থস্য ধর্মৈকান্তস্য কামো লাভায় হি স্মৃতঃ ।। (ভাগবত ১/২/৯)
অনুবাদঃ-- সমস্ত ধর্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে চরম মুক্তি লাভ করা। তা কখনও জড় বিষয় লাভের আশায় অনুষ্ঠান করা উচিত নয় । অধিকন্তু, তত্ত্বদ্রষ্টা মহর্ষিরা নির্দেশ দিয়ে গেছেন যে, যাঁরা পরম ধর্ম অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়েছেন, তাঁরা যেন কখনই ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের উদ্দেশ্যে জড়-জাগতিক লাভের প্রত্যাশী না হন। (সূত গোস্বামী)
শ্লোক: 8
নৈষাং মতিস্তাবদুরুক্রমাঙ্ঘ্রিং
স্পৃশত্যনর্থাপগমো যদর্থঃ ।
মহীয়সাং পাদরজোহভিষেকং
নিষ্কিঞ্চনানাং ন বৃণীত যাবৎ ।।
(ভাগবত ৭/৫/৩২)
অনুবাদঃ- মানুষের মতি যতক্ষণ নিষ্কিঞ্চন ভগবদ্ভক্তদের শ্রীপাদপদ্মের ধূলির দ্বারা অভিসিক্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা অনর্থ নাশক কৃষ্ণ-পাদপদ্ম স্পর্শ করতে পারে না। (প্রহ্লাদ মহারাজ)
শ্লোক: 9
সতাং প্রসঙ্গান্মম বীর্যসংবিদো
ভবন্তি হৃৎকর্ণরসায়নাঃ কথাঃ।
তজ্জোষণাদাশ্বপবর্গবর্ত্মনি
শ্রদ্ধা রতির্ভক্তিরনুক্রমিষ্যতি।।
(ভাগবত ৩/২৫/২৫)
অনুবাদঃ- পারমার্থিক মহিমামণ্ডিত ভগবানের কথা ভক্তসঙ্গেই কেবল যথাযথভাবে আলোচনা করা যায় এবং সেই কথা শ্রবণে হৃদয় ও শ্রবণেন্দ্রিয় তৃপ্ত হয়। ভক্তসঙ্গে সেই বাণী প্রীতিপূর্বক শ্রবণ করতে করতে শীঘ্র মুক্তির বর্ত্মস্বরূপ আমার প্রতি প্রথমে শ্রদ্ধা, পরে রতি এবং অবশেষে প্রেমভক্তি ক্রমে ক্রমে উদিত হয়।
শ্লোক: 10
তুলয়াম লবেনাপি ন স্বর্গং নাপুনর্ভবম্ ।
ভগবৎসঙ্গিসঙ্গস্য মর্ত্যানাং কিমুতাশিষঃ ।।
(ভাগবত ১/১৮/১৩)
অনুবাদঃ- ভগবৎ সঙ্গীর নিমেষ মাত্র সঙ্গ দ্বারা জীবের যে অসীম মঙ্গল সাধিত হয়, তার সঙ্গে স্বর্গসুখ ভোগের বা মুক্তি লাভের কিছুমাত্র তুলনা করা যায় না, তখন মরণশীল মানুষের জাগতিক সমৃদ্ধির কথা আর কি বলার আছে ।
শ্লোক: 11
বিপদঃ সন্তু তাঃ শশ্বত্তত্র তত্র জগদ্ গুরুো ।
ভবতো দর্শনং যৎ স্যাদপুনর্ভবদর্শনম্ ।।
(ভাগবত ১/৮/২৫)
অনুবাদঃ- হে জগদীশ্বর ! আমি কামনা করি যেন সেই সমস্ত সঙ্কট বারে বারে উপস্থিত হয়, যাতে বারে বারে আমরা তোমাকে দর্শন করতে পারি। কারণ, তোমাকে দর্শন করলেই আমাদের আর জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে হবে না বা এই সংসার চক্র দর্শন করতে হবে না। (শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কুন্তীদেবী)
শ্লোক: 12
তিতিক্ষবঃ কারুণিকাঃ সুহৃদঃ সর্বদেহিনাম্ ।
অজাতশত্রবঃ শান্তাঃ সাধবঃ সাধুভূষণাঃ ।।
(ভাগবত ৩/২৫/২১)
অনুবাদঃ- ভগবদ্ভক্ত সর্বদাই সহিষ্ণু, অত্যন্ত কৃপা পরায়ণ, সর্বজীবের সুহৃদ, শাস্ত্রানুগ, অজাতশত্রু, শান্ত - এই সকল গুণাবলী সাধুর ভূষণস্বরূপ।
শ্লোক: 13
যৎপাদসংশ্রয়াঃ সূত মুনয়ঃ প্রশমায়নাঃ ।
সদ্যঃ পুনন্ত্ত্যপস্পৃষ্টাঃ স্বর্ধুন্যাপহনুসেবয়া ।।
(ভাগবত ১/১/১৫)
অনুবাদঃ- হে সূত গোস্বামী ! যে সমস্ত মহর্ষিরা সর্বতোভাবে পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, তাঁদের সঙ্গ প্রভাবে অর্থাৎ দর্শন মাত্রই জীব পবিত্র হয়, কিন্তু সুরধনী গঙ্গার জল সাক্ষাৎ সেবা অর্থাৎ স্পর্শন, অবগাহন আদি করার পরেই কেবল মানুষকে পবিত্র করে।
শ্লোক: 14
বয়ং তু ন বিতৃপ্যাম উত্তমঃশ্লোকবিক্রমে।
যচ্ছৃণ্বতাং রসজ্ঞানাং স্বাদু স্বাদু পদে পদে ।।
(ভাগবত ১/১/১৯)
অনুবাদঃ- উত্তম শ্লোকের দ্বারা বন্দিত হন যে পরমেশ্বর ভগবান, তাঁর অপ্রাকৃত লীলাকথা যতই আমরা শ্রবণ করি না কেন, আমাদের তৃপ্তি হবে না। যাঁরা তাঁর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে অপ্রাকৃত রস আস্বাদন করেছেন, তাঁরা নিরন্তর তাঁর লীলাবিলাসের রস আস্বাদন করেন।
শ্লোক: 15
যথা তরোর্মূলনিষেচনেন
তৃপ্যন্তি তৎস্কন্ধভুজোপশাখাঃ ।
প্রাণোপহারাচ্চ যথেন্দ্রিয়াণাং
তথৈব সর্বার্হণমচ্যুতেজ্যা ।।
(ভাগবত ৪/৩১/১৪)
অনুবাদঃ- গাছের মূলে জল সেচন করলে যেমন সেই গাছের কাণ্ড, ডাল, উপশাখা প্রভৃতি সকলেই তৃপ্তিলাভ করে এবং উদরে আহার্যদ্রব্য প্রদানের দ্বারা যেমন ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি হয়, তেমনই শ্রীকৃষ্ণের পূজা করলে সমস্ত দেবতাদের পূজা হয়ে যায়।।শ্লোক: 16
দেবর্ষিভূতাপ্তনৃণাং পিতৃণাং
ন কিঙ্করো নায়মৃণী চ রাজন্ ।
সর্বাত্মনা যঃ শরণং শরণ্যং
গতো মুকুন্দং পরিহৃত্য কর্তম্ ।।
(ভাগবত ১১/৫/৪১)
অনুবাদঃ- যিনি সমস্ত জাগতিক কর্তব্য পরিত্যাগ করে, সকলের আশ্রয় পরমেশ্বর ভগবানের শরণাগত হন, তখন আর তিনি দেবতাদের কাছে এবং পিতৃপুরুষদের কাছে ঋণী থাকেন না।
শ্লোক: 17
তদা রজস্তমোভাবাঃ কামলোভাদয়শ্চ যে ।
চেত এতৈরনাবিদ্ধং স্থিতং সত্ত্বে প্রসীদতি ।।
(ভাগবত ১/২/১৯)
অনুবাদঃ- যখন হৃদয়ে নৈষ্ঠিকী ভক্তির উদয় হয়, তখন রজ ও তমোগুণের প্রভাবজাত কাম, ক্রোধ, লোভ আদি রিপুসমূহ হৃদয় থেকে বিদূরিত হয়ে যায়। তখন ভক্ত সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হয়ে সম্পূর্ণরূপে প্রসন্ন হন।
শ্লোক: 18
এবং প্রসন্নমনসো ভগবদ্ভক্তিযোগতঃ ।
ভগবত্তত্ত্ববিজ্ঞানং মুক্তসঙ্গস্য জায়তে ।।
(ভাগবত ১/২/২০)
অনুবাদঃ- এভাবেই শুদ্ধ সত্ত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে ভক্তিযোগে যুক্ত হওয়ার ফলে যাঁর চিত্ত প্রসন্ন হয়েছে, তিনি সব রকম জড় বন্ধন মুক্ত হয়ে ভগবৎ-তত্ত্ব বিজ্ঞান উপলব্ধি করেন।
শ্লোক: 19
মুক্তিং দদাতি কর্হিচিৎ স্ম ন ভক্তিযোগম্
(ভাগবত ৫/৬/১৮)
অনুবাদঃ- যারা ভগবানের কৃপা অভিলাষী, ভগবান অতি সহজেই তাদেরকে মুক্তি দান করেন, কিন্তু তাঁর প্রতি ভক্তিমূলক সেবা সম্পাদনের সুযোগ তিনি খুব সহজে কাউকে দেন না।
শ্লোক: 20
যৎকীর্তনং যৎস্মরণং যদীক্ষণং
যদ্বন্দনং যচ্ছ্রবনং যদর্হণম্ ।
লোকস্য সদ্যো বিধুনোতি কল্মষং
তস্মৈ সুভদ্রশ্রবসে নমো নমঃ ।।
(ভাগবত ২/৪/১৫)
অনুবাদঃ- আমি সেই সর্ব মঙ্গলময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি; যাঁর যশগাথা কীর্তন, স্মরণ, দর্শন, বন্দন, শ্রবণ ও পূজনের ফলে সমস্ত পাপরাশি অচিরেই ধৌত হয়।
শ্লোক: 21
বাসুদেবে ভগবতি ভক্তিযোগঃ প্রয়োজিতঃ ।
জনয়ত্যাশু বৈরাগ্যং জ্ঞানং চ যদহৈতুকম্ ।।
(ভাগবত ১/২/৭)
অনুবাদঃ- ভক্তি সহকারে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা হলে অচিরেই শুদ্ধ জ্ঞানের উদয় হয় এবং জড়-জাগতিক বিষয়ের প্রতি অনাসক্তি আসে ।
শ্লোক: 22
বাসুদেবে ভগবতি ভক্তিযোগঃ প্রয়োজিতঃ ।
জনয়ত্যাশু বৈরাগ্যং জ্ঞানং চ যদহৈতুকম্ ।।
(ভাগবত ১/২/৭)
অনুবাদঃ- ভক্তি সহকারে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা হলে অচিরেই শুদ্ধ জ্ঞানের উদয় হয় এবং জড়-জাগতিক বিষয়ের প্রতি অনাসক্তি আসে ।
শ্লোক: 23
ভক্তিঃ পরেশানুভবো বিরক্তি-
রন্যত্র চৈষ ত্রিক এককালঃ ।
প্রপদ্যমানস্য যথাশ্নতঃ স্যু
স্ত্তষ্টিঃ পুষ্টিঃ ক্ষুদপায়োহনুঘাসম্ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪২)
অনুবাদঃ- আহার গ্রহণে নিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি গ্রাস অন্ন গ্রহণে যেমন তুষ্টি, পুষ্টি ও ক্ষুন্নিবৃত্তি যুগপৎ ও বর্ধনশীলভাবে লাভ হয়, তেমনই যিনি পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীচরণে প্রপত্তি করেছেন, তাঁর ক্ষেত্রেও ভক্তি, পরমেশ্বর ভগবানের প্রত্যক্ষ অনুভব এবং কৃষ্ণেতর বিষয়ে বিরক্তি- এই তিনটি ফল যুগপৎ লাভ হয়ে থাকে।
শ্লোক: 24
তস্মাদ্ভারত সর্বাত্মা ভগবানীশ্বরো হরিঃ ।
শ্রোতব্যঃ কীর্তিতব্যশ্চ স্মর্তব্যশ্চেচ্ছতাভয়ম্ ।।
(ভাগবত ২/১/৫)
অনুবাদঃ- হে ভারত! সমস্ত দুঃখ-দুঃর্দশা থেকে যে মুক্ত হওয়ার বাসনা করে, তাকে অবশ্যই পরমাত্মা, পরম নিয়ন্তা এবং সমস্ত দুঃখ হরণকারী পরমেশ্বর ভগবানের কথা শ্রবণ, কীর্তন ও স্মরণ করতে হবে।
শ্লোক: 25
স বৈ মনঃ কৃষ্ণপদারবিন্দয়ো-
র্বচাংসি বৈকুণ্ঠগুণানুবর্ণনে ।
করৌ হরের্মন্দিরমার্জনাদিষু
শ্রুতিং চকারাচ্যুতসৎকথোদয়ে ।।
(ভাগবত ৯/৪/১৮)
অনুবাদঃ- মহারাজ অম্বরীষ সর্বদা তাঁর মনকে কৃষ্ণের পাদপদ্মে, তাঁর বাক্যকে পরমেশ্বর ভগবানের গুণ বর্ণনায়, তাঁর হস্তাদি হরিমন্দির মার্জনাদিতে, তাঁর কর্ণকে কৃষ্ণকথা শ্রবণে নিযুক্ত করেছিলেন।
শ্লোক: 26
মুকুন্দলিঙ্গালয়দর্শনে দৃশৌ
তদ্ভৃত্যগাত্রস্পর্শেহঙ্গসঙ্গমম্ ।
ঘ্রাণং চ তৎপাদসরোজসৌরভে
শ্রীমত্তুলস্যা রসনাং তদর্পিতে ।।
(ভাগবত ৯/৪/১৯)
অনুবাদঃ- তিনি (মহারাজ অম্বরীষ) তাঁর চক্ষুদ্বয়কে মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের শ্রীবিগ্রহ দর্শনে, তাঁর স্পর্শেন্দ্রিয় বৈষ্ণবদের শ্রীপাদপদ্মে স্পর্শ এবং আলিঙ্গন করায়, তাঁর ঘ্রাণেন্দ্রিয় শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মে নিবেদিত তুলসীর ঘ্রাণ গ্রহণে, তাঁর জিহ্বাকে শ্রীকৃষ্ণে নিবেদিত প্রসাদ আস্বাদনে নিযুক্ত করেছিলেন ।
শ্লোক: 27
পাদৌ হরেঃ ক্ষেত্রপদানুসর্পণে
শিরো হৃষীকেশপদাভিবন্দনে ।
কামং চ দাস্যে ন তু কামকাম্যয়া
যথোত্তমশ্লোকজনাশ্রয়া রতিঃ ।।
(ভাগবত ৯/৪/২০)
অনুবাদঃ- তিনি (মহারাজ অম্বরীষ) তাঁর পদদ্বয়কে ভগবানের লীলাভূমি বৃন্দাবন, মথুরা আদি তীর্থে অথবা ভগবানের মন্দিরে গমনে, তাঁর মস্তককে ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে প্রণতি নিবেদনে এবং কামরহিত দাস্যে কাম এমনভাবে নিযুক্ত করেছিলেন যে, তাঁর হৃদয়ে শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি জাগ্রত হয়েছিল।
শ্লোক: 28
স বৈ পুংসাং পরো ধর্মো যতো ভক্তিরধোক্ষজে ।
অহৈতুক্যপ্রতিহতা যয়াত্মা সুপ্রসীদতি।।
(ভাগবত ১/২/৬)
অনুবাদঃ- সমস্ত মানুষের পরম ধর্ম হচ্ছে সেই ধর্ম যার দ্বারা ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞানের অতীত শ্রীকৃষ্ণে অহৈতুকী ও অপ্রতিহতা ভক্তি লাভ কারা যায়। সেই ভক্তি-বলে অনর্থ নিবৃত্তি হয়ে আত্মা যথার্থ প্রসন্নতা লাভ করে।
শ্লোক: 29
শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনম্ ।
অর্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্ ।।
ইতি পুংসার্পিতা বিষ্ণৌ ভক্তিশ্চেন্নবলক্ষণা ।
ক্রিয়েত ভগবত্যদ্ধা তন্মন্যেহধীতমুত্তমম্ ।।
(ভাগবত ৭/৫/২৩-২৪)
অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণের শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, পাদসেবন, অর্চন, বন্দন, দাস্য, সখ্য, আত্মনিবেদন- এই নব লক্ষণ-সম্পন্ন ভক্তি শ্রীকৃষ্ণে অর্পিত হয়ে সাধিত হলে সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। এটিই শাস্ত্রের নির্দেশ।
শ্লোক: 30
গুরুর্ন স স্যাৎ স্বজনো ন স স্যাৎ
পিতা ন স স্যাজ্জননী ন সা স্যাৎ ।
দৈবং ন তৎস্যান্ন পতিশ্চ স স্যা-
ন্ন মোচয়েদ্ যঃ সমুপেতমৃত্যুম্ ।।
(ভাগবত ৫/৫/১৮)
অনুবাদঃ- যিনি তাঁর আশ্রিত জনকে সমুপস্থিত মৃত্যুরূপ সংসার মার্গ থেকে উদ্ধার করতে না পারেন, তাঁর গুরু, পিতা, পতি, জননী অথবা পূজ্য দেবতা হওয়া উচিত নয়।শ্লোক: 31
ন তে বিদুঃ স্বার্থগতিং হি বিষ্ণুং
দুরাশয়া যে বহিরর্থমানিনঃ ।
অন্ধাঃ যথান্ধৈরুপনীয়মানা-
স্তেহপীশতন্ত্র্যামুরুদাম্নি বদ্ধাঃ ।।
(ভাগবত ৭/৫/৩১)
অনুবাদঃ- যারা জড় জগৎকে ভোগ করার বাসনার দ্বারা আবদ্ধ এবং তাই যারা তাদেরই মত বিষয়াসক্ত অন্ধ ব্যক্তিকে তাদের নেতা বা গুরুরূপে বরণ করেছে, তারা বুঝতে পারে না যে, জীবনের প্রকৃ্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবৎ-ধামে ফিরে যাওয়া এবং ভগবান শ্রীবিষ্ণুর সেবায় যুক্ত হওয়া। অন্ধের দ্বারা পরিচালিত হয়ে অন্ধরা যেমন প্রকৃ্ত পথের সন্ধান না জেনে অন্ধকূপে পতিত হয়, তেমনই জড় বিষয়াসক্ত ব্যক্তিরা অন্য বিষয়াসক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে সকাম কর্মরূপ অত্যন্ত দৃঢ় রজ্জুর বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং সংসারচক্রে বারবার আবর্তিত হয়ে ত্রিতাপ দুঃখ ভোগ করতে থাকে।
শ্লোক: 32
অশিতিং চতুরশ্চৈব লক্ষাংস্তাঞ্জীব জাতিষু
ভমদ্ভিঃ পুরুষৈঃ প্রাপ্যং মানুষ্যং জন্মপর্যায়াৎ ।
তদপ্যভলতাং জাতঃ তেষামাত্মাভিমানিনাম্
বরাকাণামনাশ্রিত্য গোবিন্দচরণদ্বয়ম্ ।।
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ)
অনুবাদঃ- ক্রমবিকাশের ক্রমিক পর্যায়ে চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমণ করার পর জীব মনুষ্য-দেহ লাভ করে। এত দুর্লভ এই মনুষ্য জন্ম পেয়েও গণ্ডমূর্খ ব্যক্তিরা শ্রীগোবিন্দের চরণকমল যুগলের আশ্রয় গ্রহণ না করে তা হেলায় নষ্ট করে।
শ্লোক: 33
লব্ধা সুদুর্লভমিদং বহুসম্ভবান্তে
মানুষ্যমর্থদমনিত্যমপীহ ধীরঃ ।
তূর্ণং যতেত ন পতেদনুমৃত্যু যাব-
ন্নিঃশ্রেয়সায় বিষয়ঃ খলু সর্বতঃ স্যাৎ ।।
(ভাগবত ১১/৯/২৯)
অনুবাদঃ- বহু জন্ম-মৃত্যুর পর জীব এই মনুষ্যদেহ লাভ করে, যা অনিত্য হওয়া সত্ত্বেও জীবকে পূর্ণসিদ্ধি লাভের সুযোগ প্রদান করে। অতএব ধীর ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে অবিলম্বে এই পূর্ণসিদ্ধি লাভের জন্য প্রযত্ন করা এবং কখনই জন্ম-মৃত্যুর চক্রে পতিত হওয়া উচিত নয়। ইন্দ্রিয় ভোগের বিষয় তো জঘন্যতম প্রজাতিদের মধ্যেও সুলভ, পক্ষান্তরে কৃষ্ণভাবনামৃত শুধু মানব-জীবনেই লাভ করা সম্ভব।
শ্লোক: 34
নৃ্দেহমাদ্যং সুলভং সুদুর্লভং
প্লবং সুকল্পং শুরুকর্ণধারম্ ।
ময়ানুকূলেন নভস্বতেরিতং
পুমান্ ভবাব্ধিং ন তরেৎ স আত্মহা।।
(ভাগবত ১১/২০/১৭)
অনুবাদঃ- সমস্ত প্রকার সুফলের মূলস্বরূপ সুদুর্লভ এই মনুষ্যজন্ম প্রকৃ্তির নিয়মে সুলভে লাভ করা যায়। এই মনুষ্যদেহ এক সুপরিকল্পিত নৌকার মতো, গুরুদেব হচ্ছেন সুদক্ষ কর্ণধার এবং পরমেশ্বরের বাণী হচ্ছে অনুকূল বায়ু। এত সুযোগ সত্ত্বেও যে মানুষ এই মনুষ্য-জন্মের সদ্ব্যবহার করে না সে আত্মঘাতী।
শ্লোক: 35
কামস্য নেন্দ্রিয়প্রীতির্লাভো জীবেত যাবতা ।
জীবস্য তত্ত্বজিজ্ঞাসা নার্থো যশ্চেহ কর্মভিঃ ।।
(ভাগবত ১/২/১০)
অনুবাদঃ- ইন্দ্রিয়সুখ ভোগকে কখনই জীবনের উদ্দেশ্য বলে গ্রহণ করা উচিত নয়। সুস্থ জীবন যাপন করা অথবা আত্মাকে নির্মল রাখার বাসনাই কেবল করা উচিত, কেন না মানব-জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরমতত্ত্ব সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা। এ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কর্ম করা উচিত নয়।
শ্লোক: 36
প্রায়েণাল্পায়ুষঃ সভ্য কলাবস্মিন্ যুগে জনাঃ ।
মন্দাঃ সুমন্দমতয়ো মন্দভাগ্যা হ্যুপদ্রুতাঃ ।।
(ভাগবত ১/১/১০)
অনুবাদঃ- হে মহাজ্ঞানী! এই কলিযুগের মানুষেরা প্রায় সকলেই অল্পায়ু। তারা কলহপ্রিয়, অলস, মন্দ মতি, ভাগ্যহীন এবং সর্বোপরি তারা নিরন্তর রোগাদির দ্বারা উপদ্রুত।
শ্লোক: 37
ততশ্চানুদিনং ধর্মং সত্যং শৌচ্যং ক্ষমা দয়া।
কালেন বলিনা রাজন্নঙ্ক্ষ্যত্যায়ুর্বলং স্মৃতিঃ ।।
(ভাগবত ১২/২/১)
অনুবাদঃ- হে রাজন্ ! তারপর কলির প্রবল প্রভাবে দিনে দিনে ধর্ম, সত্য, শুচিতা, সহিষ্ণুতা, দয়া, আয়ু, দৈহিক বল ও স্মৃতি ক্রমে ক্রমে হ্রাস পাবে।
শ্লোক: 38
বিত্তমেব কলৌ নৃণাং জন্মাচারগুণোদয়ঃ ।
ধর্মন্যায়ব্যবস্থায়াং কারণং বলমেব হি।।
(ভাগবত ১২/২/২)
অনুবাদঃ- কলিযুগে শুধুমাত্র বিত্তকেই মানুষদের বংশাভিজাত্য, সদাচার ও সদগুণাবলীর লক্ষণ বলে গণ্য করা হবে। শুধুমাত্র ক্ষমতার ভিত্তিতেই ধর্ম ও ন্যায় প্রযুক্ত হবে।
শ্লোক: 39
দাম্পত্যেহভিরুচির্হেতুর্মায়ৈব ব্যাবহারিকে।
স্ত্রীত্বে পুংস্ত্বে চ হি রতির্বিপ্রত্বে সূত্রমেব হি।।
(ভাগবত ১২/২/৩)
অনুবাদঃ- নারী ও পুরুষ শুধুমাত্র বাহ্য আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে একত্রে বসবাস করবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সাফল্য নির্ভর করবে প্রতারণার উপর । যৌন দক্ষতার ভিত্তিতেই পুরুষত্ব ও নারীত্বের বিচার হবে এবং শুধুমাত্র পৈতা ধারণের মাধ্যমেই কোন ব্যক্তি ব্রাহ্মণ বলে পরিচিতি লাভ করবেন ।
শ্লোক: 40
লিংমেবাশ্রমখ্যাতাবন্যোন্যাপত্তিকারণম্ ।
অবৃত্ত্যা ন্যায়দৌর্বল্যং পাণ্ডিত্যে চাপলং বচঃ ।।
(ভাগবত ১২/২/৪)
অনুবাদঃ- বাহ্য প্রতীকের ভিত্তিতে কোন ব্যক্তির আশ্রম নির্ধারিত হবে এবং এই একই ভিত্তিতে এক আশ্রমস্থিত ব্যক্তি পরবর্তী আশ্রমে প্রবেশ করবে। যে মানুষ ভাল রোজগার করতে পারবে না তার ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করা হবে। যিনি বাক্চাতুর্যে দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারবেন, তিনিই বিজ্ঞ পণ্ডিত বলে পরিচিত হবেন।
শ্লোক: 41
অনাঢ়্যতৈবাসাধুত্বে সাধুত্বে দম্ভ এব তু ।
স্বীকার এব চোদ্বাহে স্নানমেব প্রসাধনম্ ।।
(ভাগবত ১২/২/৫)
অনুবাদঃ- কোন মানুষ যদি দরিদ্র হয়, তা হলে তাকে অসাধু বলে গণ্য করা হবে এবং দম্ভ ও কপটতাকেই গুণ বলে স্বীকার করা হবে। মৌখিক স্বীকৃ্তির ভিত্তিতে বিবাহ অনুষ্ঠিত হবে এবং শুধুমাত্র স্নান করলেই (তিলক, চন্দন আদি ধারণ না করেই) মানুষ নিজেকে জনগণের মধ্যে প্রবেশের যোগ্য বলে মনে করবে।
শ্লোক: 42
দূরে বার্যয়নং তীর্থং লাবণ্যং কেশধারণম্ ।
উদরম্ভরতা স্বার্থঃ সত্যত্বে ধার্ষ্ট্যমেব হি ।
দাক্ষ্যং কুটুম্বভরণং যশোহর্থে ধর্মসেবনম্ ।।
(ভাগবত ১২/২/৬)
অনুবাদঃ- দূরে অবস্থিত জলাশয়কে তীর্থ বলে গণ্য করা হবে। কেশ ধারণের ভিত্তিতে সৌন্দর্য নিরূপিত হবে। উদরপূর্তিই হবে জীবনের লক্ষ্য । ধৃষ্ট ব্যক্তিকে সত্যনিষ্ঠ বলে গণ্য করা হবে। কুটুম্বভরণে সমর্থ ব্যক্তিকে দক্ষ বলে গণ্য করা হবে এবং শুধুমাত্র যশ লাভের জন্যই ধর্ম-কর্ম অনুষ্ঠান করা হবে।
শ্লোক: 43
কলের্দোষনিধে রাজন্নস্তি হ্যেকো মহান্ গুণঃ ।
কীর্তনাদেব কৃষ্ণস্য মুক্তসঙ্গঃ পরং ব্রজেৎ ।।
(ভাগবত ১২/৩/৫১)
অনুবাদঃ- হে রাজন! দোষের নিধি এই কলিযুগে একটি মহৎ গুণ আছে। কলিযুগে ভগবানের নাম কীর্তনের প্রভাবেই জীব জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করেন।
শ্লোক: 44
কৃ্তে যদ্ধ্যায়তো বিষ্ণুং ত্রেতায়াং যজতো মখৈঃ ।
দ্বাপরে পরিচর্যায়াং কলৌ তদ্ধরিকীর্তনাৎ ।।
(ভাগবত ১২/৩/৫২)
অনুবাদঃ- সত্যযুগে বিষ্ণুকে ধ্যান করে, ত্রেতাযুগে যজ্ঞের মাধ্যমে যজন করে এবং দ্বাপরযুগে অর্চন আদি করে যে ফল লাভ হত, কলিকালে 'হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র' কীর্তনে সেই সকল ফল লাভ হয়।
শ্লোক: 45
কলিং সভাজয়ন্ত্যার্যা গুণজ্ঞাঃ সারভাগিণঃ ।
যত্র সঙ্কীর্তনেনৈব সর্বস্বার্থোহভিলভ্যতে ।।
(ভাগবত ১১/৫/৩৬)
অনুবাদঃ- গুণজ্ঞ সারগ্রাহী মহাত্মারা কলিযুগকে এই জন্য ধন্য বলেন, কেন না কলিযুগে কেবল হরিনাম সংকীর্তনের ফলেই সর্ব স্বার্থ লাভ হয়।শ্লোক: 46
শ্রেয়ঃসৃ্তিং ভক্তিমুদস্য তে বিভো
ক্লিশ্যন্তি যে কেবলবোধলব্ধয়ে ।
তেষামসৌ ক্লেশল এব শিষ্যতে
নান্যদ্ যথা স্থূলতুষাবঘাতিনাম্ ।।
(ভাগবত ১০/১৪/৪)
অনুবাদঃ- হে ভগবান! তোমাকে ভক্তি করাই সর্বশ্রেষ্ঠ পথ, তা পরিত্যাগ করে যারা কেবল জ্ঞান লাভের জন্য অর্থাৎ 'আমি ব্রহ্ম'
শ্লোক: 47
অথাপি তে দেব পদাম্বুজদ্বয়-
প্রসাদলেশানুগৃহীত এব হি ।
জানাতি তত্ত্বং ভগবন্মহিম্নো
ন চান্য একোহপি চিরং বিচিন্বন ।।
(ভাগবত ১০/১৪/২৯)
অনুবাদঃ- হে ভগবান ! কেউ যদি আপনার শ্রীপাদপদ্ম যুগলের কৃপার লেশমাত্রও লাভ করে থাকেন, তা হলে তিনি আপনার মহিমা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। কিন্তু যারা আপনার মহিমা সম্বন্ধে জল্পনা-কল্পনা করে, তারা দীর্ঘকাল বেদ অধ্যয়ন করেও আপনাকে জানতে পারে না।
শ্লোক: 48
ইদং হি পুংসস্তপসঃ শ্রুতস্য বা
স্বিষ্টস্য সূক্তস্য চ বুদ্ধিদত্তয়োঃ ।
অবিচ্যুতোহর্থঃ কবিভির্নিরূপিতো
যদুত্তমশ্লোকগুণানুবর্ণনম্ ।।
(ভাগবত ১/৫/২২)
অনুবাদঃ- তত্ত্বদ্রষ্টা মহর্ষিরা যথাযথভাবে সিদ্ধান্ত করেছেন যে, তপশ্চর্যা, বেদপাঠ, যজ্ঞ, মন্ত্রোচ্চারণ ও দান আদির একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে উত্তমশ্লোক ভগবানের অপ্রাকৃত লীলাবিলাসের বর্ণনা করা।
শ্লোক: 49
শব্দব্রহ্মণি নিষ্ণাতো ন নিষ্ণায়াৎ পরে যদি।
শ্রমস্তস্য শ্রম ফলো হ্যধেনুমিব রক্ষতঃ ।।
(ভাগবত ১১/১১/১৮)
অনুবাদঃ- কেউ হয়তো সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রে পারদর্শী হতে পারেন, কিন্তু তিনি যদি পরমেশ্বরকে (শ্রীকৃষ্ণকে) উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন, তা হলে তাঁর শাস্ত্রজ্ঞান দুগ্ধদানে অক্ষম গাভীর মতোই অর্থহীন। ভারবাহী পশুর মতোই শাস্ত্রের বোঝা বহন করেন তিনি।
শ্লোক: 50
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়
জন্মাদাস্য যতোহন্বয়াদিতরশ্চার্থেষ্বভিজ্ঞঃ স্বরাট্
তেনে ব্রহ্ম হৃদা য আদিকবয়ে মুহ্যন্তি যৎ সূরয়ঃ ।
তেজোবারিমৃদাং যথা বিনিময়ো যত্র ত্রিসর্গোহমৃষা
ধাম্না স্বেন সদা নিরস্তকুহকং সত্যং পরং ধীমহি ।।
(ভাগবত ১/১/১)
অনুবাদঃ- হে বসুদেব তনয় শ্রীকৃষ্ণ! হে সর্বব্যাপ্ত পরমেশ্বর ভগবান! আমি আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। আমি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করি, কেন না তিনি হচ্ছেন প্রকাশিত ব্রহ্মাণ্ডসমূহের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের পরম কারণ। তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সব কিছু সম্বন্ধে অবগত এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন, কেন না তাঁর অতীত আর কোন কারণ নেই। তিনিই আদি কবি ব্রহ্মার হৃদয়ে সর্বপ্রথম বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। তাঁর দ্বারা মহান ঋষিরা এবং স্বর্গের দেবতারাও মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, ঠিক যেভাবে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে আগুনে জল দর্শন হয়, অথবা জলে মাটি দর্শন হয়। তাঁরই প্রভাবে জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের মাধ্যমে জড় জগৎ সাময়িকভাবে প্রকাশিত হয় এবং তা অলীক হলেও সত্যবৎ প্রতিভাত হয়। তাই আমি সেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করি, যিনি জড় জগতের মোহ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত থেকে তাঁর ধামে নিত্যকাল বিরাজ করেন। আমি তাঁর ধ্যান করি, কেন না তিনিই হচ্ছেন পরম সত্য।
শ্লোক: 51
বাসুদেবপরা বেদা বাসুদেবপরা মখাঃ।
বাসুদেবপরা যোগা বাসুদেবপরাঃ ক্রিয়াঃ।।
বাসুদেবপরং জ্ঞানং বাসুদেবপরং তপঃ।
বাসুদেবপরো ধর্মো বাসুদেবপরা গতিঃ।।
(ভাগবত ১/২/২৮-২৯)
অনুবাদঃ- বৈদিক শাস্ত্রে জ্ঞানের পরম উদ্দেশ্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। যজ্ঞ সম্পাদনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবানের প্রীতিবিধান এবং যোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁকে জানা। সমস্ত সকাম কর্মের চরম ফল তিনিই দান করেন। পরম জ্ঞান ও সমস্ত তপশ্চর্যার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁকে জানা এবং তাঁর প্রতি প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত হওয়াই হচ্ছে ধর্মের উদ্দেশ্য। তিনি হচ্ছেন জীবনের পরম উদ্দেশ্য।
শ্লোক: 52
অহমেবাসমেবাগ্রে নান্যদ্ যৎ সদসৎ পরম্ ।
পশ্চাদহং যদেতচ্চ যোহবশিষ্যেত সোহস্ম্যহম্ ।।
(ভাগবত ২/৯/৩৩)
অনুবাদঃ- হে ব্রহ্মা ! সৃষ্টির পূর্বে কেবল আমি ছিলাম এবং সৎ, অসৎ ও অনির্বচনীয় নির্বিশেষ ব্রহ্ম পর্যন্ত কোনকিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। সৃষ্টির পরে এই সমুদয় স্বরূপে আমিই বিরাজ করি এবং প্রলয়ের পর কেবল আমিই অবশিষ্ট থাকব।
শ্লোক: 53
ততঃ কলৌ সম্প্রবৃত্তে সম্মোহায় সুরদ্বিষাম্ ।
বুদ্ধো নাম্নাঞ্জনসুতঃ কীকটেষু ভবিষ্যতি ।।
(ভাগবত ১/৩/২৪)
অনুবাদঃ- তারপর কলিযুগের প্রারম্ভে ভগবান ভগবৎ-বিদ্বেষী নাস্তিকদের সম্মোহিত করার জন্য বুদ্ধদেব নামে গয়া প্রদেশে অঞ্জনার পুত্ররূপে আবির্ভূত হবেন।
শ্লোক: 54
অবতারা হ্যসংখ্যেয়া হরেঃ সত্ত্বনিধের্দ্ধিজাঃ ।
যথাবিদাসিনঃ কুল্যাঃ সরসঃ স্যুঃ সহস্রশঃ ।।
(ভাগবত ১/৩/২৬)
অনুবাদঃ- হে ব্রাহ্মণগণ! বিশাল জলাশয় থেকে যেমন অসংখ্য নদী প্রবাহিত হয়, ঠিক তেমনই ভগবানের থেকে অসংখ্য অবতার প্রকাশিত হন ।
শ্লোক: 55
এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্ ।
ইন্দ্ররিব্যাকুলং লোকং মৃড়য়ন্তি যুগে যুগে ।।
(ভাগবত ১/৩/২৮)
অনুবাদঃ- ভগবানের এই সমস্ত অবতারেরা পুরুষাবতারদের অংস অথবা কলা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান। যখন নাস্তিকদের অত্যাচার বেড়ে যায়, তখন আস্তিকদের রক্ষা করবার জন্য ভগবান এই ধরাধামে অবতির্ণ হন।
শ্লোক: 56
নমস্যে পুরুষং ত্বাদ্যমীশ্বরং প্রকৃতেঃ পরম্
অলক্ষ্যং সর্বভূতানামন্তর্বহিরবস্থিতম্ ।।
(ভাগবত ১/৮/১৮)
অনুবাদঃ- হে কৃষ্ণ ! আমি তোমাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। কারণ তুমি আদি পুরুষ এবং জড়া প্রকৃতির সমস্ত গুণের অতীত। তুমি সকলের অন্তরে ও বাইরে অবস্থিত, তবু তোমাকে কেউ দেখতে পায় না।
শ্লোক: 57
নমস্যে পুরুষং ত্বাদ্যমীশ্বরং প্রকৃতেঃ পরম্
অলক্ষ্যং সর্বভূতানামন্তর্বহিরবস্থিতম্ ।।
(ভাগবত ১/৮/১৮)
অনুবাদঃ- হে কৃষ্ণ ! আমি তোমাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। কারণ তুমি আদি পুরুষ এবং জড়া প্রকৃতির সমস্ত গুণের অতীত। তুমি সকলের অন্তরে ও বাইরে অবস্থিত, তবু তোমাকে কেউ দেখতে পায় না।
শ্লোক: 58
মায়াজবনিকাচ্ছন্নমজ্ঞাধোক্ষজমব্যয়ম্ ।
ন লক্ষ্যসে মূঢ়দৃশা নটো নাট্যধরো যথা ।।
অনুবাদঃ- তুমি ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের অতীত, তুমি মায়ারূপা যবনিকার দ্বারা আচ্ছাদিত, অব্যক্ত ও অচ্যুত। মূঢ় দ্রষ্টা যেমন অভিনেতার সাজে সজ্জিত শিল্পীকে দেখে সাধারণত চিনতে পারে না, তেমনই অজ্ঞ ব্যক্তিরা তোমাকে দেখতে পায় না।
শ্লোক: 59
ইদং হি বিশ্বং ভগবানিবেতরো
যতো জগৎস্থাননিরোধসম্ভবাঃ ।
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং এই বিশ্ব, তবুও তিনি তাঁর অতীত। তাঁর থেকেই এই জগৎ প্রকাশিত হয়েছে, তাঁকে আশ্রয় করেই এই জগৎ বর্তমান এবং প্রলয়ের পর তাঁর মধ্যেই তা লীন হয়ে যায়।
শ্লোক: 60
অহো বকী যং স্তনকালকূটং
জিঘাংসয়াপায়য়দপ্যসাধ্বী ।
লেভে গতিং ধাক্র্যচিতাং ততোহন্যং
কং বা দয়ালুং শরণং ব্রজেম ।।
(ভাগবত ৩/২/২৩)
অনুবাদঃ- আহা, কি আশ্চর্য! বকাসুরের ভগ্নী পুতনা কৃষ্ণকে বধ করার জন্য তার স্তনে কালকূট মাখিয়ে তা কৃষ্ণকে পান করিয়েছিল। কিন্তু তবুও, কৃষ্ণ তাকে তাঁর মাতারূপে গ্রহণ করেছিলেন এবং তাকে মাতার উপযুক্ত গতি দান করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আমি আর কোন্ দয়ালুর শরণাপন্ন হতে পারি ?শ্লোক: 61
লোকে ব্যবায়ামিষমদ্যসেবা
নিত্যা হি জন্তোর্ন হি তত্র চোদনা ।
ব্যবস্থিতিস্তেষু বিবাহযজ্ঞ
সুরাগ্রহৈরাসু নিবৃত্তিরিষ্টা ।।
(ভাগবত ১১/৫/১১)
অনুবাদঃ- এই জড় জগতে বদ্ধ জীবেরা সর্বদাই কাম উপভোগ, মাংসাহার ও মদ্যপানের প্রবণতা-সম্পন্ন। সুতরাং ধর্মীয় শাস্ত্র কখনও এগুলিকে উৎসাহ দেয় না। যদিও শাস্ত্রে বিবাহ যজ্ঞের মাধ্যমে কামভোগ, পশুযজ্ঞের মাধ্যমে মাংসাহার এবং সুরাগ্রহ যজ্ঞের মাধ্যমে মদ্যপানের নির্দেশ রয়েছে- কিন্তু এই সমস্ত যজ্ঞের পরম উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐ সমস্ত ভোগ থেকে নিবৃত্তি লাভ করা।
শ্লোক: 62
কর্মণা দৈবনেত্রেণ জন্তুর্দেহোপপত্তয়ে।
স্ত্রীয়াঃ প্রবিষ্ট উদরং পুংসো রেতঃকণাশ্রয়ঃ।।
(ভাগবত ৩/৩১/১)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বরের অধ্যক্ষতায় জীবাত্মা তার পূর্বকৃ্ত কর্মের ফল অনুসারে, বিশেষ প্রকার শরীর ধারণের জন্য, পুরুষের রেতকণা আশ্রয় করে স্ত্রীর গর্ভে প্রবেশ করে।
শ্লোক: 63
নূনং প্রমত্তঃ কুরুতে বিকর্ম
যদিন্দ্রিয়প্রীতয় আপৃণোতি।
ন সাধু মন্যে যত আত্মনোহয়-
মসন্নপি ক্লেশদ আস দেহঃ ।।
(ভাগবত ৫/৫/৪)
অনুবাদঃ- যখন কোন ব্যক্তি ইন্দ্রিয়সুখ ভোগকেই জীবনের লক্ষ্য বলে গণ্য করে, সে নিঃসন্দেহে জড়বাদী জীবনধারায় প্রমত্ত হয়ে ওঠে এবং সমস্ত প্রকার পাপকর্মে লিপ্ত হয়। সে জানে না যে, তার অতীত পাপকর্মের ফলে সে ইতিমধ্যেই একটি দেহ পেয়েছে, যা ক্ষণস্থায়ী হওয়া সত্ত্বেও তার দুঃখের কারণ। আসলে এই জড় গ্রহণ করা জীবের উচিত হয়নি, কিন্তু ইন্দ্রিয়-ভোগের জন্যই জীবকে এই জড় দেহ প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং আমি মনে করি এভাবেই পুনরায় ইন্দ্রিয়ভোগে লিপ্ত হয়ে একের পর এক জড় দেহ লাভ করা বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে উপযুক্ত নয়।
শ্লোক: 64
পরাভবস্তাবদবোধজাতো
যাবন্ন জিজ্ঞাসত আত্মতত্ত্বম্ ।
যাবৎ ক্রিয়াস্তাবদিদং মনো বৈ
কর্মাত্মকং যেন শরীরবন্ধঃ ।।
(ভাগবত ৫/৫/৫)
অনুবাদঃ- যতদিন পর্যন্ত জীব আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা না করে, ততদিন পর্যন্তই সে জড় প্রকৃতির প্রভাবে পরাস্ত হয়ে অবিদ্যাজাত দুঃখ-কষ্টের শিকার হয়। পাপই হোক আর পুণ্যই হোক- কর্ম মাত্রই ফল উৎপাদন করে। কোন না কোন কর্মে রুচি থাকলেই মন কর্মাত্মক হয়, অর্থাৎ সকাম কর্মের দ্বারা তার মন কলুষিত থাকে। মন যতদিন কলুষিত থাকে, চেতনাও ততদিন আচ্ছাদিত থাকে এবং যতদিন পর্যন্ত কোন ব্যক্তি সকাম কর্মে মগ্ন থাকে, ততদিন তাকে জড় দেহ গ্রহণ করতেই হবে।
শ্লোক: 65
ঋতেহর্থং যৎ প্রতীয়েত ন প্রতীয়েত চাত্মনি ।
তদ্বিদ্যাদাত্মনো মায়াং যথাভাসো যথা তমঃ ।।
(ভাগবত ২/৯/৩৪)
অনুবাদঃ- আমি ব্যতীত যা সত্য বলে প্রতীয়মান হয়, তা হচ্ছে আমার মায়াশক্তি, কেন না আমি ব্যতীত কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এটি ঠিক প্রতীয়মান প্রকৃত আলোকের প্রতিফলনের মতো, কেন না আলোকে ছায়াও নেই, প্রতিবিম্বও নেই।
শ্লোক: 66
ভক্তিযোগেন মনসি সম্যক্ প্রণিহিতেহমলে ।
অপশ্যৎপুরুষং পূর্ণং মায়াং চ তদপাশ্রয়ম্ ।।
(ভাগবত ১/৭/৪)
অনুবাদঃ- এভাবেই তাঁর মনকে একাগ্র করে জড় কলুষ থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত হয়ে তিনি যখন পূর্ণরূপে ভক্তিযোগে যুক্ত হয়েছিলেন, তখন তিনি পরমেশ্বর ভগবানকে তাঁর মায়াশক্তি সহ দর্শন করেছিলেন, যে মায়া পূর্ণরূপে তাঁর বশীভূত ছিল।
শ্লোক: 67
যয়া সম্মোহিতো জীব আত্মানং ত্রিগুণাত্মকম্ ।
পরোহপি মনুতেহনর্থং তৎকৃতং চাভিপদ্যতে ।।
(ভাগবত ১/৭/৫)
অনুবাদঃ- এই বহিরঙ্গা শক্তির প্রভাবে জীব প্রকৃতির তিনটি গুণের অতীত হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে জড়া প্রকৃতি সম্ভূত বলে মনে করে এবং তার ফলে জড় জগতের দুঃখ-ভোগ করে।
শ্লোক: 68
তস্যৈব হেতোঃ প্রয়তেত কোবিদো
ন লভ্যতে যদ্ভ্রমতামুপর্যধঃ ।
তল্লভ্যতে দুঃখবদন্যতঃ সুখং
কালেন সর্বত্র গভীররংহসা ।।
(ভাগবত ১/৫/১৮)
অনুবাদঃ- যে সমস্ত মানুষ যথার্থই বুদ্ধিমান এবং পরমার্থ বিষয়ে উৎসাহী, তাদের কর্তব্য হচ্ছে সেই চরম লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য প্রয়াস করা, যা এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ লোক (ব্রহ্মলোক) থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন লোক (পাতাল লোক) পর্যন্ত ভ্রমণ করেও লাভ করা যায় না । ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে লব্ধ যে জড় সুখ, তা কালের প্রভাবে আপনা থেকেই লাভ হয়, ঠিক যেমন আকাঙ্ক্ষা না করলেও কালক্রমে আমরা দুঃখভোগ করে থাকি।
শ্লোক: 69
কেশাগ্রশতভাগস্য শতাংশসদৃশাত্মকঃ ।
জীবঃ সূক্ষ্মস্বরূপোহয়ং সংখ্যাতীতো হি চিৎকণঃ ।।
(ভাগবত ১০/৮৭/৩১)
অনুবাদঃ- কেশের অগ্রভাগকে শত ভাগ করলে তার শত শতাংশ-সদৃশ স্বরূপই জীবের সূক্ষ্ম স্বরূপ; জীব-চিৎকণ ও সংখ্যাতীত।
শ্লোক: 70
ইদং ভাগবতং নাম পুরাণং ব্রহ্মসম্মিতম্ ।
উত্তমশ্লোকচরিতং চকার ভগবানৃষিঃ ।।
নিঃশ্রেয়সায় লোকস্য ধন্যং স্বস্ত্যয়নং মহৎ ।।
(ভাগবত ১/৩/৪০)
অনুবাদঃ- এই শ্রীমদ্ভাগবত হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের বাঙ্ময় বিগ্রহ এবং তা সংকলন করেছেন ভগবানের অবতার শ্রীল ব্যসদেব। তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে সমস্ত মানুষের পরম মঙ্গল সাধন করা এবং এটি সর্বতোভাবে সার্থক, পূর্ণ আনন্দময় এবং সর্বতোভাবে পরিপূর্ণ।
শ্লোক: 71
অনর্থোপশমং সাক্ষাদ্ভক্তিযোগমধোক্ষজে ।
লোকস্যাজানতো বিদ্বাংশ্চক্রে সাত্বতসংহিতাম্ ।।
(ভাগবত ১/৭/৬)
অনুবাদঃ- জীবের জাগতিক দুঃখ-দুর্দশা, যা হচ্ছে তার কাছে অনর্থ, ভক্তিযোগের মাধ্যমে অচিরেই তার উপশম হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা জানে না এবং তাই মহাজ্ঞানী ব্যাসদেব পরমতত্ত্ব সমন্বিত এই সাত্বত সংহিতা সংকলন করেছেন।
শ্লোক: 72
ধর্মঃ স্বনুষ্ঠিতঃ পুংসাং বিষ্বকসেনকথাসু যঃ ।
নোৎপাদয়েদযদি রতিং শ্রম এব হি কেবলম্ ।।
(ভাগবত ১/২/৮)
অনুবাদঃ- মানুষের উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত বর্ণাশ্রম-ধর্ম যদি কৃষ্ণকথায় রতি উৎপাদন না করে, তা হলে সেই ধর্মও শ্রম মাত্র।
শ্লোক: 73
নিগমকল্পতরোর্গলিতং ফলং
শুকমুখাদমৃতদ্রবসংযুতম্ ।
পিবত ভাগবতং রসমালয়ং
মুহুরহো রসিকা ভুবি ভাবুকাঃ ।।
(ভাগবত ১/১/৩)
অনুবাদঃ- হে বিচক্ষণ এবং চিন্তাশীল মানুষ, কল্পবৃক্ষরূপী বৈদিক শাস্ত্রের অত্যন্ত সুপক্ব ফল শ্রীমদ্ভাগবত আস্বাদন করুন। তা শ্রীল শুকদেব গোস্বামীর শ্রীমুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল। তাই ফলটি আরও অধিক উপাদেয় হয়েছে, যদিও এই অমৃতময় রস মুক্ত পুরুষেরা পর্যন্ত আস্বাদন করে থাকেন।
শ্লোক: 74
নষ্টপ্রায়েষ্বভদ্রেষু নিত্যং ভাগবতসেবয়া ।
ভগবত্যুত্তমশ্লোকে ভক্তির্ভবতি নৈষ্ঠিকী ।।
(ভাগবত ১/২/১৮)
অনুবাদঃ- নিয়মিতভাবে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করলে এবং ভগবানের শুদ্ধ ভক্তের সেবা করলে হৃদয়ের সমস্ত কলুষ সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয় এবং তখন উত্তমশ্লোকের দ্বারা বন্দিত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমময়ী ভক্তি সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
শ্লোক:75
যং ব্রহ্মাবরুণেন্দ্ররুদ্রমরুতঃ স্তুন্বন্তি দিব্যৈইঃ স্তবৈ-
র্বেদ্যৈইঃ সাঙ্গপদক্রমোপনিষদৈর্গায়ন্তি যং সামগাঃ
ধ্যানাবস্থিত-তদ্ গতেন মনসা পশ্যন্তি যং যোগিনো
যস্যান্তং ন বিদুঃ সুরগণা দেবায় তস্মৈ নমঃ ॥
(ভাগবত ১২/১৩/১)
অনুবাদঃ- ব্রহ্মা, বরুণ, ইন্দ্র, রুদ্র, ও মরুৎগণ দিব্য স্তবদ্বারা যাঁকে স্তুতি করেন, সামবেদগায়কগণ অঙ্গ, পদক্রম ও উপনিষদসহ সমগ্র বেদদ্বারা যাঁর স্তুতিগান করেন, যোগিগণ ধ্যানাবস্থিত তদ্ গতচিত্তে যাঁকে দর্শন করেন, দেবতা ও অসুরগণ যাঁর শেষ জানেন না, সেই দেবতাকে নমস্কার ॥৯॥শ্লোক: 76
যন্নামধেয়শ্রবণানুকীর্তনাদ্
যৎপ্রহ্বণাদ্ যৎস্মরণাদপি ক্বচিৎ ।
শ্বাদোহপি সদ্যঃ সবনায় কল্পতে
কুতঃ পুনস্তে ভগবন্নু দর্শনাৎ ।।
(ভাগবত ৩/৩৩/৬)
অনুবাদঃ- হে ভগবন্ যাঁর নাম শ্রবণ, অনুকীর্তন, প্রণাম ও স্মরণ করা মাত্র চণ্ডাল ও যবন কুলোদ্ভূত ব্যক্তিও তৎক্ষণাৎ বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠানের যোগ্য হয়ে উঠে, এমন যে প্রভু তুমি, তোমার দর্শনের প্রভাবে কি না হয়?
শ্লোক: 77
অহো বত শ্বপচোহতো গরীয়ান্
যজ্জিহ্বাগ্রে বর্ততে নাম তুভ্যম্ ।
তেপুস্তপস্তে জুহুবুঃ সস্নুরার্যা
ব্রহ্মানূচুর্নাম গৃণন্তি যে তে ।।
(ভাগবত ৩/৩৩/৭)
অনুবাদঃ- হে ভগবান ! যাঁদের জিহ্বায় আপনার নাম বিরাজ করে, তাঁরা যদি অত্যন্ত নীচকুলেও জন্মগ্রহণ করেন, তা হলেও তাঁরা শ্রেষ্ঠ। যাঁরা আপনার নাম কীর্তন করেন, তাঁরা সব রকম তপস্যা করেছেন, সমস্ত যজ্ঞ করেছেন, সর্বতীর্থে স্নান করেছেন এবং সমস্ত বেদ পাঠ করেছেন, সুতরাং তাঁরা আর্য মধ্যে পরিগণিত।
শ্লোক: 78
শৃণ্বন্তি গায়ন্তি গৃণন্ত্যভীক্ষ্নশঃ
স্মরন্তি নন্দন্তি তবেহিতং জনাঃ ।
ত এব পশ্যন্তচিরেণ তাবকং
ভবপ্রবাহোপরমং পদাম্বুজম্ ।।
(ভাগবত ১/৮/৩৬)
অনুবাদঃ- হে শ্রীকৃষ্ণ ! যাঁরা তোমার অপ্রাকৃত চরিত-কথা নিরন্তর শ্রবণ করেন, কীর্তন করেন, স্মরণ করেন এবং অবিরাম উচ্চারণ করেন, অথবা অন্যে তা করলে আনন্দিত হন, তাঁরা অবশ্যই তোমার শ্রীপাদপদ্ম অচিরেই দর্শন করতে পারেন, যা একমাত্র জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহকে নিবৃত করতে পারে।
শ্লোক: 79
জ্ঞানে প্রয়াসমুদপাস্য নমন্ত এব
জীবন্তি সন্মুখরিতাং ভবদীয়বার্তাম্ ।
স্থানে স্থিতাঃ শ্রুতিগতাং তনুবাঙ্মনোভি-
র্যে প্রায়শোহজিত জিতোহপ্যসি তৈস্ত্রিলোক্যাম্ ।।
(ভাগবত ১০/১৪/৩)
অনুবাদঃ- যাঁরা তাঁদের সামাজিক পদে স্থিত হয়েও মনোধর্মী জল্পনা-কল্পনামূলক জ্ঞানকে দূরে নিক্ষেপ করেন, দেহ, মন ও বাক্য দিয়ে শ্রদ্ধা সহকারে আপনার লীলাকথা শ্রবণ করেন এবং আপনি ও আপনার শুদ্ধ ভক্তদের মুখনিঃসৃত হরিকথা শ্রবণ করে জীবন ধারণ করেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে আপনাকে জয় ক্রেন্ম, যদিও ত্রিলোকের কোনও ব্যক্তি অন্য কোন উপায়ে আপনাকে জয় করতে পারে না।
শ্লোক: 80
নিবৃত্ততর্ষৈরুপগীয়মানাদ্
ভবৌষধাচ্ছ্রোত্রমনোহভিরামাৎ
ক উত্তমশ্লোকগুণানুবাদাৎ
পুমান্ বিরজ্যেত বিনা পশুঘ্নাৎ ।।
(ভাগবত ১০/১/৪)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবানের মহিমা কীর্তিত হয় গুরু-পরম্পরার ধারা অনুসারে। এই জড় জগতের ক্ষণস্থায়ী মিথ্যা গুণকীর্তনে যাঁরা আদৌ আগ্রহী নয়, তাঁরাই ভগবানের মহিমা কীর্তনে আনন্দ লাভ করেন। ভগরোগের অধীনে যারা জন্মমৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হচ্ছে, সেই সব দেহবদ্ধ জীবদের পক্ষে ভগবানের মহিমা শ্রবণ-কীর্তন হল যথার্থ ঔষধ। তাই, পশুঘাতক বা আত্মঘাতী ছাড়া ভগবৎ-কথা শ্রবণ-কীর্তনে আর কে-ই বা বিরত হবে?
শ্লোক: 81
শৃণ্বতাং স্বকথা কৃষ্ণঃ পুণ্যশ্রবণকীর্তনঃ ।
হৃদ্যন্তঃস্থো হ্যভদ্রাণি বিধুনোতি সুহৃৎ সতাম্ ।।
(ভাগবত ১/২/১৭)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি পরমাত্মারূপে সকলের হৃদয়েই বিরাজ করেন এবং তিনি হচ্ছেন সাধুদের সুহৃদ, তিনি তাঁর পবিত্র কথা শ্রবণ ও কীর্তনে রতিযুক্ত ভক্তদের হৃদয়ের সমস্ত ভোগবাসনা বিনাশ করেন।
শ্লোক: 82
এতন্নির্বিদ্যমানানামিচ্ছতামকুতভয়ম্ ।
যোগিনাং নৃপ নির্ণীতং হরের্নামানুকীর্তনম্ ।।
(ভাগবত ২/১/১১)
অনুবাদঃ- হে রাজন্ ! মহান আচার্যদের প্রদর্শিত পন্থা অনুসরণ করে নিরন্তর ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা সকলের জন্য সিদ্ধি লাভের নিশ্চিত তথা নির্ভীক মার্গ। এমন কি যাঁরা সমস্ত জড় কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হয়েছেন, যাঁরা সব রকম জড়-জাগতিক সুখভোগের প্রতি আসক্ত এবং যাঁরা দিব্যজ্ঞান লাভ করার ফলে আত্মতৃপ্ত হয়েছেন, তাঁদের সকলের পক্ষে এটিই হচ্ছে সিদ্ধি লাভের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।
শ্লোক: 83
আপন্নঃ সংসৃতিং ঘোরাং যন্নাম বিবশো গৃণন্ ।
ততঃ সদ্যো বিমুচ্যেত যদ্বিভেতি স্বয়ং ভয়ম্ ।।
(ভাগবত ১/১/১৪)
অনুবাদঃ- জন্ম-মৃত্যুর ভয়ঙ্কর আবর্তে আবদ্ধ মানুষ বিবশ হয়েও পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্যনাম উচ্চারণ করতে করতে অচিরেই সেই সংসারচক্র থেকে মুক্ত হয়, সেই নামে স্বয়ং মহাকালও ভীত হন।
শ্লোক: 84
এবংব্রতঃ স্বপ্রিয়নামকীর্ত্যা
জাতানুরাগো দ্রুতচিত্ত উচ্চৈঃ ।
হসত্যথো রোদিতি রৌতি গায়-
ত্যুন্মাদবন্ নৃত্যতি লোকবাহ্যঃ।।
(ভাগবত ১১/২/৪০)
অনুবাদঃ- কেউ যখন ভক্তিমার্গে যথার্থ উন্নতি সাধন করে এবং তার অতি প্রিয় ভগবানের দিব্যনাম কীর্তন করে আনন্দমগ্ন হন, তখন তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে ভগবানের নাম কীর্তন করেন। তিনি কখনও হাসেন, কখনও কাঁদেন এবং কখনও উন্মাদের মতো নৃত্য করেন। বাইরের লোকেরা কে কি বলে সেই সম্বন্ধে তাঁর কোন জ্ঞান থাকে না।
শ্লোক: 85
তত্তেহনুকম্পাং সুসমীক্ষমাণো
ভুঞ্জান এবাত্মকৃতং বিপাকম্ ।
হৃদ্বাগ্বপুর্ভির্বিদধন্নমন্তে
জীবেত যো মুক্তিপদে স দায়ভাক্ ।।
(ভাগবত ১০/১৪/৮)
অনুবাদঃ- যিনি আপনার কৃপা লাভের আশায় সকর্মের মন্দ ফল ভোগ করতে করতে মন, বাক্য ও শরীরের দ্বারা আপনার প্রতি ভক্তি বিধান করে জীবন যাপন করেন, তিনি মুক্তিপদে দায়ভাক্ অর্থাৎ তিনি আপনার ঐকান্তিকী শুদ্ধ ভক্ত হবার উপযুক্ত প্রার্থী। (ব্রহ্মা)
শ্লোক: 86
মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা নাবিবিক্তাসনো ভবেৎ ।
বলবানিন্দ্রিয়গ্রামো বিদ্বাংসমপি কর্ষতি ।।
(ভাগবত ৯/১৯/১৭)
অনুবাদঃ- মায়ের সঙ্গে, বোনের সঙ্গে এবং কন্যার সঙ্গে নির্জন স্থানে উপবেশন করা উচিত নয়, কেন না বলবান ইন্দ্রিয়সমূহ বিদ্বান ব্যক্তিরও মন আকর্ষণ করতে পারে। (দেবযানির প্রতি মহারাজ যযাতি)
শ্লোক: 87
পুংসঃ স্ত্রিয়া মিথুনীভাবমেতং
তয়োর্মিথো হৃদয়গ্রন্থিমাহুঃ ।
অতো গৃহক্ষেত্রসুতাপ্তবিত্তৈ-
র্জনস্য মোহোহয়মহং মমেতি ।।
(ভাগবত ৫/৫/৮)
অনুবাদঃ- স্ত্রী ও পুরুষের প্রতি আকর্ষণ জড়-জাগতিক জীবনের ভিত্তি। এই ভ্রান্ত আসক্তিই স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের হৃদয়গ্রন্থি-স্বরূপ এবং তার ফলেই জীবের দেহ, গৃহ, সম্পত্তি, সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও ধন-সম্পদ আদিতে “আমি ও আমার” বুদ্ধিরূপ মোহ উৎপন্ন হয়।
শ্লোক: 88
যন্মৈথুনাদি গৃহমেধিসুখং হি তুচ্ছং
কণ্ডূয়নেন করয়োরিব দুঃখদুঃখম্ ।
তৃপ্যন্তি নেহ কৃপণা বহুদুঃখভাজঃ
কণ্ডূতিবন্মনসিজং বিষহতে ধীরঃ ।।
(ভাগবত ৭/৯/৪৫)
অনুবাদঃ- চুলকানি কমানোর উদ্দেশ্যে দুহাতের ঘর্ষণের সঙ্গে যৌনজীবনের তুলনা করা হয়। গৃহমেধি বা তথাকথিত গৃহস্থদের কোন পারমার্থিক জ্ঞান নেই। তাই তারা মনে করে যে, এই চুলকানিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সুখের স্তর, যদিও বাস্তবে তা শুধু দুঃখেরই উৎস। ব্রাহ্মণদের বিপরীতধর্মী কৃপণগণ পুনঃ পুনঃ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করেও কখনও তৃপ্ত হয় না। কিন্তু যাঁরা ধীর এবং যাঁরা এই চুলকানি সহ্য করেন, তাঁদেরকে কখনও গণ্ডমূর্খদের প্রাপ্য দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয় না।
শ্লোক: 89
তপসা ব্রহ্মচর্যেণ শমেন চ দমেন চ ।
ত্যাগেন সত্যশৌচাভ্যাং যমেন নিয়মেন বা ।।
(ভাগবত ৬/১১/১৩)
অনুবাদঃ- মনকে সংযত করতে হলে অবশ্যই ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে এবং পতিত হওয়া চলবে না। স্বেচ্ছায় ইন্দ্রিয়ভোগ ত্যাগরূপ তপস্যা বরণ করতে হবে। এভাবেই মন ও ইন্দ্রিয়কে অবশ্যই সংযত করতে হবে । দান করতে হবে, সত্যনিষ্ঠ হতে হবে, নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং নিয়মিতভাবে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন এবং জপ করতে হবে।
শ্লোক: 90
প্রায়েণ দেব মুনয়ঃ স্ববিমুক্তিকামা
মৌনং চরন্তি বিজনে ন পরার্থনিষ্ঠাঃ ।
নৈতান্ বিহায় কৃপণান্ বিমুমুক্ষ একো
নান্যং ত্বদস্য শরণং ভ্রমতোহনুপশ্যে ।।
(ভাগবত ৭/৯/৪৪)
অনুবাদঃ- হে নৃসিংহদেব! বাস্তবিকই আমি কতো মুনি-ঋষিদের দেখি, যাঁরা শুধুমাত্র তাঁদের নিজেদের মুক্তির ব্যাপারেই আগ্রহী। বড় বড় শহর ও নগরের কথা বিবেচনা না করে, তাঁরা হিমালয়ে কিংবা নির্জন বনে মৌনব্রত অবলম্বন করে ধ্যান করে থাকেন। অন্যদের মুক্ত করার ব্যাপারে তাঁদের কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু আমি এই সমস্ত কৃপণদের পরিত্যাগ করে একা মুক্তি পেতে চাই না। আমি জানি কৃষ্ণভাবনামৃত ছাড়া, আপনার চরণ-কমলের আশ্রয় গ্রহণ না করে কেউ সুখী হতে পারে না। তাই তাদেরকেও আপনার চরণ-কমলের আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আমি পোষণ করি। (ভগবান নৃসিংহদেবের প্রতি প্রহ্লাদ মহারাজ)শ্লোক: 91
নৈবোদ্বিজে পরদুরত্যয়বৈতরণ্যা-
স্ত্বদ্বীর্যগায়নমহামৃতমগ্নচিত্তঃ ।
শোচে ততো বিমুখচেতস ইন্দ্রিয়ার্থ
মায়াসুখায় ভরমুদ্বহতো বিমূঢ়ান্ ।।
(ভাগবত ৭/৯/৪৩)
অনুবাদঃ- হে পরম পুরষ! আমি জড়-জাগতিক অস্তিত্ব তথা বৈতরণীকে ভয় করি না, কেন না যেখানেই আমি থাকি না কেন, সব সময় আমি আপনার মহিমান্বিত লীলা চিন্তনে মগ্ন আছি। আমি শুধু সেই সব মূর্খদের কথাই ভাবছি, যারা জড়-জাগতিক সুখের জন্য এবং তাদের পরিবার, সমাজ ও দেশের পরিচালনার জন্য বিপুল পরিকল্পনা করে চলেছে। অনুকম্পাবশত আমি শুধু তাদের কথাই ভাবছি।
শ্লোক: 92
মহদ্বিচলনং নৃণাং গৃহিণাং দীনচেতসাম্ ।
(ভাগবত ১০/৮/৪)
অনুবাদঃ- হে প্রভু! আপনার মতো মহৎ ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ইতস্তত পর্যটন করেন না, বরং দীনচেতা গৃহীদের উদ্ধারের জন্যই তাদের গৃহে গমন করেন। (গর্গমুনির প্রতি নন্দ মহারাজ)
শ্লোক: 93
সর্বভূতেষু যঃ পশ্যেদ্ভগবদ্ভাবমাত্মনঃ ।
ভূতানি ভগবত্যাত্মন্যেষ ভাগবতোত্তমঃ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪৫)
অনুবাদঃ- যিনি ভাগবতোত্তম, তিনি সর্বভূতে আত্মার আত্মাস্বরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেই দেখেন এবং আত্মার আত্মাস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণে সমস্ত জীবকে দেখেন।
শ্লোক: 94
ঈশ্বরে তদধীনেষু বালিশেষু দ্বিষৎসু চ ।
প্রেমমৈত্রীকৃপোপেক্ষা যঃ করোতি স মধ্যমঃ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪৬)
অনুবাদঃ- যে ভক্ত ঈশ্বরে প্রেম, ভক্তে মৈত্রী, অজ্ঞান ব্যক্তিদের কৃপা এবং বিদ্বেষীদের প্রতি উপেক্ষা করেন, তিনি মধ্যম ভক্ত।
শ্লোক: 95
অর্চায়ামেব হরয়ে পূজাং যঃ শ্রদ্ধয়েহতে ।
ন তদ্ভক্তেষু চান্যেষু স ভক্তঃ প্রাকৃতঃ স্মৃতঃ ।।
(ভাগবত ১১/২/৪৭)
অনুবাদঃ- যিনি লৌকিক ও পারিবারিক প্রথাক্রমে পরম্পরাগত শ্রদ্ধার সঙ্গে অর্চা মূর্তিতে হরিকে পূজা করেন, অথচ শাস্ত্র অনুশীলনের দ্বারা শুদ্ধ ভক্তিতত্ত্ব অবগত না হওয়ায় হরিভক্তদের পূজা করেন না। তিনি প্রাকৃত ভক্ত, অর্থাৎ ভক্তিপর্ব আরম্ভ করেছেন মাত্র। তাকে ভক্তপ্রায় বা বৈষ্ণবাভাষ বলা হয়।
শ্লোক: 96
সাধবো হৃদয়ং মহ্যং সাধূনাং হৃদয়ং ত্বহম্ ।
মদন্যৎ তে ন জ্ঞানন্তি নাহং তেভ্যো মনাগপি ।।
(ভাগবত ৯/৪/৬৮)
অনুবাদঃ- সাধু-মহাত্মারা আমার হৃদয় এবং আমিও তাদের হৃদয়। তারা আমাকে ছাড়া অন্য কিছু জানে না এবং আমিও তাদের ছাড়া অন্য কাউকে আমার বলে জানি না।
শ্লোক: 97
মুক্তানামপি সিদ্ধানাং নারায়ণপরায়ণঃ ।
সুদুর্লভঃ প্রশান্তাত্মা কোটিষ্বপি মহামুনে ।।
(ভাগবত ৬/১৪/৫)
অনুবাদঃ- হে মহর্ষি! কোটি কোটি মুক্ত ও সিদ্ধদের মধ্যে নারায়ণ পরায়ণ প্রশান্তাত্মা পুরুষ অত্যন্ত দুর্লভ।
শ্লোক: 98
ভবদ্বিধা ভাগবতাস্তীর্থভূতাঃ স্বয়ং বিভো । তীর্থীকুর্বন্তি তীর্থানি স্বান্তঃস্থেন গদাভৃতা ।।
(ভাগবত ১/১৩/১০)
অনুবাদঃ- আপনার মতো ভাগবতেরা নিজেরাই তীর্থস্বরূপ। তাঁরা স্বীয় অন্তকরণস্থিত গদাধারী ভগবানের পবিত্রতা বলে পাপীগণের পাপ দ্বারা মলিন তীর্থস্থানগুলিকে পবিত্র করেন। (বিদুরের প্রতি মহারাজ যুধিষ্ঠির)
শ্লোক: 99
যস্যাস্তি ভক্তির্ভগবত্যকিঞ্চনা
সর্বৈর্গুণৈস্তত্র সমাসতে সুরাঃ ।
হরাবভক্তস্য কুতো মহদ্ গুণা
মনোরথেনাসতি ধাবতো বহিঃ ।।
(ভাগবত ৫/১৮/১২)
অনুবাদঃ- যিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনন্য ভক্তিসম্পন্ন, তাঁর মধ্যে দেবতাদের সমস্ত সদ্ গুণগুলি প্রকাশিত হয়। কিন্তু যিনি হরিভক্তি-বিহীন তার মধ্যে কোন সদ্ গুণই নেই, কেন না তিনি মনোরথের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের বহিরঙ্গা শক্তি জড় জগতের প্রতি নিরন্তর ধাবিত হচ্ছেন। (প্রহ্লাদ মহারাজ ও হরিবর্ষবাসীরা)
শ্লোক: 100
ইত্থং সতাং ব্রহ্মসুখানুভূত্যা
দাস্যং গতানাং পরদৈবতেন ।
মায়াশ্রিতানাং নরদারকেণ
সাকং বিজহ্রুঃ কৃতপুণ্যপুঞ্জাঃ ।।
(ভাগবত ১০/১২/১১)
অনুবাদঃ- নির্বিশেষবাদীরা জ্ঞানীরা যাঁকে ব্রহ্মসুখরূপে উপলব্ধি করেন, দাস্য রসের ভক্তরা যাঁকে পর-দেবতারূপে দর্শন করেন এবং মায়াশ্রিত সাধারণ মানুষেরা যাঁকে একটি মানব-শিশুরূপে দর্শন করেন, সেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বৃন্দাবনের গোপ-বালকেরা জন্ম-জন্মান্তরের পুঞ্জীভূত পুণ্যকর্মের ফলে, সখারূপে খেলা করছেন। (শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 101
সত্ত্বং বিশুদ্ধং বসুদেবশব্দিতং
যদিয়তে তত্র পুমানপাবৃতঃ ।
সত্ত্বে চ তস্মিন্ ভগবান্ বাসুদেবো ।
হ্যধোক্ষজো মে মনসা বিধীয়তে ।।
(ভাগবত ৪/৩/২৩)
অনুবাদঃ- যে শুদ্ধ সত্ত্বে পরমেশ্বর ভগবান অনাবৃতভাবে বিরাজ করেন, তাকে বলা হয় বসুদেব স্তর। সেই শুদ্ধ সত্ত্বে অবস্থিত জড় ইন্দ্রিয়ানুভূতির অতীত পরমেশ্বর ভগবান বাসুদেব নামে পরিচিত। আমার মনের দ্বারা আমি তাঁকে উপলব্ধি করতে পারি । (সতীর প্রতি শিব)
শ্লোক: 102
বদন্তি তত্তত্ত্ববিদস্তত্ত্বং যজ্জ্ঞানমদ্বয়ম্ ।
ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দ্যতে ।।
(ভাগবত ১/২/১১)
অনুবাদঃ- যা অদ্বয় জ্ঞান, অর্থাৎ এক এবং অদ্বিতীয় বাস্তব বস্তু, তত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরা তাকেই পরমার্থ বলেন, এই তত্ত্ববস্তু ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান—এই তিন নামে অভিহিত হন । (সূত গোস্বামী)
শ্লোক: 103
ভক্ত্যাহমেকয়া গ্রাহ্যঃ শ্রদ্ধয়াত্মা প্রিয়ঃ সতাম্ ।
ভক্তিঃ পুনাতি মন্নিষ্ঠা শ্বপাকানপি সম্ভবাৎ ।।
(ভাগবত ১১/১৪/২১)
অনুবাদঃ- সাধু এবং ভক্তদের অত্যন্ত প্রিয় আমি, ঐকান্তিক শ্রদ্ধাজনিত ভক্তির দ্বারাই আমি প্রাপ্ত হই। আমার প্রতি জীবের নিষ্ঠা বর্ধনকারী ভক্তি নীচ কুলোদ্ভূত মানুষদেরও জন্ম আদি দোষ থেকে পরিত্রাণ করে। অর্থাৎ, ভক্তিযোগের পন্থা অবলম্বন করার মাধ্যমে প্রত্যেকেই চিন্ময় স্তরে উন্নীত হতে পারে। (উদ্ধবের প্রতি শ্রীকৃষ্ণ)
শ্লোক: 104
ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ ।
ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি দৃষ্ট এবাত্মনীশ্বরে ।।
(ভাগবত ১/২/২১)
অনুবাদঃ- আত্মার আত্মা পরমাত্মা ভগবানকে দর্শন হলে হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়, সমস্ত সংশয় দূর হয় এবং সমস্ত কর্মফল ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
শ্লোক: 105
কেচিৎ কেবলয়া ভক্ত্যা বাসুদেবপরায়ণাঃ ।
অঘং ধুন্বন্তি কার্ৎস্ন্যেন নিহারমিব ভাস্করঃ ।।
(ভাগবত ৬/১/১৫)
অনুবাদঃ- সেই সব বিরল শুদ্ধ ভক্তরা যাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অহৈতুকী ভক্তিমূলক সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন, কেবল তাঁরাই তাঁদের সমস্ত পাপ- বাসনাকে এমনভাবে নির্মূল করতে সক্ষম যে, তাদের আর পুনর্জাগরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। শুধুমাত্র ভক্তিমূলক সেবা সম্পাদনের মাধ্যমেই তিনি তা করতে পারেন, ঠিক যেমন সূর্য তার রশ্মিচ্ছটায় তৎক্ষণাৎ কুয়াশাকে দূর করতে পারে। (শুকদেব গোস্বামী)শ্লোক: 106
সমাশ্রিতা যে পদপল্লবপ্লবং
মহৎপদং পুণ্যযশো মুরারেঃ ।
ভবাম্বুধির্বৎসপদং পরং পদং
পদং পদং যদ্বিপদং ন তেষাম্ ।।
(ভাগবত ১০/১৪/৫৮)
অনুবাদঃ- মহৎ-তত্ত্বের আশ্রয় এবং মুরারি নামে খ্যাত শ্রীভগবানের পদ-পল্লবরূপ নৌকাকে যাঁরা আশ্রয় করেছেন, তাঁদের কাছে এই ভবসাগর গোষ্পদের মতো ক্ষুদ্র হয়ে যায়। পরম পদ বৈকুণ্ঠ লাভই তাঁদের লক্ষ্য। পদে পদে বিপদসঙ্কুল এই জড় জগৎ তাঁদের জন্য নয়। (শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 107
এতাং স আস্থায় পরাত্মনিষ্ঠা-
মধ্যাসিতাং পূর্বতমৈর্মহর্ষিভিঃ ।
অহং তরিষ্যামি দুরন্তপারং
তমো মুকুন্দাঙ্ঘ্রিনিষেবয়ৈব ।।
(ভাগবত ১১/২৩/৫৭)
অনুবাদঃ- প্রাচীন মহাজনদের উপাসিত এই পরাত্মনিষ্ঠারূপ সন্ন্যাস-আশ্রম অবলম্বন করে, শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের সেবা করে, আমি এই দুস্তর সংসাররূপ অজ্ঞান-অন্ধকার অতিক্রম করব। (অবন্তীদেশীয় ব্রাহ্মণ)
শ্লোক: 108
মুক্তির্হিত্বান্যথারূপং স্বরূপেণ ব্যবস্থিতিঃ ।
(ভাগবত ২/১০/৬)
অনুবাদঃ- মায়িক স্থূল-সুক্ষ্ম রূপ পরিহার করে শুদ্ধ স্বরূপে অবস্থানের নাম মুক্তি । (শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 109
ভবেহস্মিন্ ক্লিশ্যমানানামাবিদ্যাকামকর্মভিঃ ।
শ্রবণস্মরণার্হাণি করিষ্যন্নিতি কেচন ।।
(ভাগবত ১/৮/৩৫)
অনুবাদঃ- আবার অন্য আরও অনেকে বলেন যে, অবিদ্যাজনিত কাম ও কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ জড়-জাগতিক দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত বদ্ধ জীবেরা যাতে ভক্তিযোগের সুযোগ নিয়ে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই শ্রবণ, স্মরণ, অর্চন আদি ভক্তিযোগের পন্থাসমূহ পুনঃপ্রবর্তনের জন্য তুমি অবতরণ করেছিলে । (শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কুন্তিদেবী)
শ্লোক: 110
বিক্রীড়িতং ব্রজবধূভিরিদং চ বিষ্ণোঃ
শ্রদ্ধান্বিতোহনুশৃণুয়াদথ বর্ণয়েদ্ যঃ ।
ভক্তিং পরাং ভগবতি প্রতিলভ্য কামং
হৃদরোগমাশ্বপহিনোত্যচিরেণ ধীরঃ ।।
(ভাগবত ১০/৩৩/৩৯)
অনুবাদঃ- যিনি অপ্রাকৃত শ্রদ্ধান্বিত হয়ে এই রাস পঞ্চাধ্যায়ে ব্রজবধূদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত ক্রীড়া বর্ণনা শ্রবণ করেন বা বর্ণন করেন, সেই ধীর পুরুষ ভগবানে যথেষ্ট পরা ভক্তি লাভ করে হৃদরোগরূপ জড় কামকে দূর করেন। (শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 111
অকামঃ সর্বকামো বা মোক্ষকাম উদারধীঃ ।
তীব্রেণ ভক্তিযোগেন যজেত পুরুষং পরম্ ।।
(ভাগবত ২/৩/১০)
অনুবাদঃ- সর্বপ্রকার কামনা যুক্ত হোন, অথবা সম্পূর্ণ নিষ্কাম হোন, অথবা মুক্তিকামীই হোন, সুবুদ্ধিমান মানুষ তীব্র শুদ্ধ ভক্তিযোগে পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করবেন।
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 112
কামদ্ দ্বেষাদ্ ভয়াৎ স্নেহাদ্ যথা ভক্তেশ্বরে মনঃ ।
আবেশ্য তদঘং হিত্বা বহবস্তদ্ গতিং গতাঃ ।।
(ভাগবত ৭/১/৩০)
অনুবাদঃ- ভগবানের প্রতি ভক্তির মাধ্যমে যেমন তাঁর ধাম প্রাপ্ত হওয়া যায়, তেমনই অনেকেই কাম, দ্বেষ, ভয় ও স্নেহের প্রভাবে তাঁর প্রতি মনকে আবিষ্ট করে, তাঁদের পাপ কর্ম থেকে মুক্ত হয়ে সেই গতি প্রাপ্ত হয়েছেন।
(মহারাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি নারদ মুনি)
শ্লোক: 113
কামং ক্রোধং ভয়ং স্নেহমৈক্যং সৌহৃদমেব চ ।
নিত্যং হরৌ বিদধতো যান্তি তন্ময়তাং হি তে ।।
(ভাগবত ১০/২৯/১৫)
অনুবাদঃ- যে সমস্ত ব্যক্তি অবিশ্রান্তভাবে তাঁদের কাম, ক্রোধ, ভয়, স্নেহ, নিরাকার ব্রহ্মের সঙ্গে ঐক্য অনুভব এবং সখ্যভাব আদি অনুভূতিকে ভগবান শ্রীহরির অভিমুখে চালিত করেন, বাস্তবিকই তাঁরা শ্রীহরির চিন্তায় তন্ময়তা লাভ করেন।
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 114
ন সাধয়তি মাং যোগো ন সাংখ্যং ধর্ম উদ্ধব ।
ন স্বাধ্যায়স্তপস্ত্যাগো যথা ভক্তির্মমোর্জিতা ।।
(ভাগবত ১১/১৪/২০)
অনুবাদঃ- [পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন--] “হে উদ্ধব, আমার প্রতি প্রবলা ভক্তি যেমন আমাকে বশীভূত করতে পারে, অষ্টাঙ্গ-যোগ, অভেদ ব্রহ্মবাদ-রূপ সাংখ্য-জ্ঞান, বেদ অধ্যয়ন, সব রকম তপস্যা ও ত্যাগরূপ সন্ন্যাস আদির দ্বারা আমি সেই রকম বশীভূত হই না ।”
(উদ্ধবের প্রতি শ্রীকৃষ্ণ)
শ্লোক: 115
ক্বচিন্নিবর্ততেহভদ্রাৎ ক্বচিচ্চরতি তৎ পুনঃ ।
প্রায়শ্চিত্তমথোহপার্থং মন্যে কুঞ্জরশৌচবৎ ।।
(ভাগবত ৬/১/১০)
অনুবাদঃ- পাপকর্ম না করার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ব্যক্তিও কখনও কখনও পুনরায় পাপকর্মে লিপ্ত হয়, তাই আমি এই প্রায়শ্চিত্তের পন্থাকে হস্তীস্নানের মতো নিরর্থক বলে মনে করি। কারণ হস্তী স্নান করার পর ডাঙ্গায় উঠে এসেই তার মাথায় ও গায়ে ধূলি নিক্ষেপ করে।
শ্লোক: 116
কর্মণা কর্মনির্হারো ন হ্যাত্যন্তিকঃ ইষ্যতে ।
অবিদ্বদধিকারিত্বাৎ প্রায়শ্চিত্তং বিমর্শনম্ ।।
(ভাগবত ৬/১/১১)
অনুবাদঃ- (বেদব্যাস-নন্দন শ্রীল শুকদেব গোস্বামী উত্তর দিলেন—) হে রাজন! যেহেতু পাপকর্মের ফল নিষ্ক্রিয় করার এই পন্থাটিও সকাম কর্ম, তাই তার দ্বারা কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। যারা প্রায়শ্চিত্তের বিধি অনুসরণ করে, তারা মোটেই বুদ্ধিমান নয়। প্রকৃতপক্ষে, তারা তমোগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তমোগুণের প্রভাব থেকে মুক্ত না হয়, ততক্ষণ একটি কর্মের দ্বারা অন্য কর্মের প্রতিকারের চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়, কেন না তার ফলে কর্মবাসনা সমূলে উৎপাটিত হয় না। আপাতদৃষ্টিতে সেই সমস্ত ব্যক্তিদের পুণ্যবান বলে মনে হলেও তারা পুনরায় পাপকর্মে লিপ্ত হবে, সেই সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। তাই প্রকৃত প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে বেদান্তের পূর্ণজ্ঞান লাভ করা, যার দ্বারা পরম সত্য পরমেশ্বর ভগবানকে হৃদয়ঙ্গম করা যায়।
শ্লোক: 117
ব্রহ্মচারী গুরুকুলে বসন্দান্তো গুরুর্হিতম্ ।
আচরন্ দাসবন্নীচো গুরৌ সুদৃঢ়সৌহৃদঃ ।।
(ভাগবত ৭/১২/১)
অনুবাদঃ- (নারদ মুনি বললেন--) বিদ্যার্থীর কর্তব্য পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়-সংযম করার অভ্যাস করা। তার কর্তব্য বিনীতভাবে শ্রীগুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধাসহকারে সৌহার্দ্য পরায়ণ হওয়া এবং দাসবৎ আরচণ করা। এভাবেই মহান ব্রত সহকারে, কেবলমাত্র শ্রীগুরুদেবের হিতসাধনের জন্য ব্রহ্মচারীর গুরুকুলে বাস করা উচিত।
(মহারাজ যুধিষ্ঠিরের নিকট নারদ মুনি)
শ্লোক: 118
এবং জনং নিপতিতং প্রভবাহিকূপে
কামাভিকামমনু যঃ প্রপতন্ প্রসঙ্গাৎ ।
কৃত্বাত্মসাৎ সুরর্ষিণা ভগবান্ গৃহীতঃ
সোহহং কথং নু বিসৃজে তব ভৃত্যসেবাম্ ।।
(ভাগবত ৭/৯/২৮)
অনুবাদঃ- হে ভগবান! একের পর এক জড় বাসনার সঙ্গ প্রভাবে আমি সাধারণ মানুষদের অনুসরণ করে সর্পপূর্ণ অন্ধকূপে পতিত হয়েছি। আপনার সেবক নারদ মুনি কৃপা করে আমাকে তাঁর শিষ্যরূপে গ্রহণ করেছেন এবং দিব্য স্থিতি প্রাপ্ত হওয়ার শিক্ষা প্রদান করেছেন। তাই আমার সর্বপ্রথম কর্তব্য তাঁর সেবা করা। তাঁর সেবা আমি কি করে পরিত্যাগ করতে পারি?
(ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের প্রতি প্রহ্লাদ মহারাজ)
শ্লোক: 119
তস্মাদ্ গুরুং প্রপদ্যেত জিজ্ঞাসুঃ শ্রেয় উত্তমম্ ।
শাব্দে পরে চ নিষ্ণাতং ব্রহ্মণ্যুপশমাশ্রয়ম্ ।।
(ভাগবত ১১/৩/২১)
অনুবাদঃ- অতএব কেউ যদি আন্তরিকভাবে প্রকৃত আনন্দ কামনা করেন, তাহলে তাঁকে দীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে একজন সদ্গুরুর আশ্রয় অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। সদ্গুরুর যোগ্যতা হচ্ছে যে, তিনি গভীরভাবে শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত উপলব্ধি করেছেন এবং অন্যদেরও সেই সব সিদ্ধান্ত বিষয়ে প্রত্যয় উৎপাদন করতে সক্ষম। যাঁরা জড় সুখ সুবিধাকে অগ্রাহ্য করে পরমেশ্বরের শরণ গ্রহণ করেছেন, সেই ধরনের মহান ব্যক্তিদেরই যথার্থ গুরু বলে বুঝতে হবে।
শ্লোক: 120
বেত্থ ত্বং সৌম্য তৎসর্বং তত্ত্বতস্তদনুগ্রহাৎ ।
ব্রূয়ুঃ স্নিগ্ধস্য শিষ্যস্য গুরবো গুহ্যমপ্যুত ।।
(ভাগবত ১/১/৮)
অনুবাদঃ- যেহেতু আপনি শ্রদ্ধাশীল ও বিনীত, তাই আপনার গুরুদেবেরা বিশেষভাবে অনুগ্রহ করেছেন। কারণ, স্নিগ্ধ স্বভাবসম্পন্ন অর্থাৎ প্রীতিশীল শিষ্যের কাছেই গুরুবর্গ অতি নিগূঢ় রহস্য ব্যক্ত করেন।
(সূত গোস্বামীর প্রতি মুনি-ঋষিরা)
শ্লোক: 121
আচার্যং মাং বিজানীয়ান্নাবমন্যেত কর্হিচিৎ ।
ন মর্ত্যবুদ্ধ্যাসূয়েত সর্বদেবময়ো গুরুঃ ।।
(ভাগবত ১১/১৭/২৭)
অনুবাদঃ- আচার্যকে আমার থেকে অভিন্ন বলে মনে করা উচিত এবং কখনও কোনভাবে তাঁকে অশ্রদ্ধা করা উচিত নয়। তাঁকে একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করে তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়া উচিত নয়, কেন না তাঁর মধ্যে সমস্ত দেবতার অধিষ্ঠান আছে।
শ্লোক: 122
ত্বং নঃ সন্দর্শিতো ধাত্রা দুস্তরং নিস্তিতীর্ষতাম্ ।
কলিং সত্ত্বহরং পুংসাং কর্ণধার ইবার্ণবম্ ।।
(ভাগবত ১/১/২২)
অনুবাদঃ- আমরা মানুষের সদ্ গুণ অপহরণকারী কলিকালরূপ দুর্লঙ্ঘ্য সমুদ্র উত্তীর্ণ হতে ইচ্ছুক। সমুদ্রের পরপারে গমন করতে ইচ্ছুক মানুষের কাছে কর্ণধার সদৃশ আপনাকে বিধাতাই আমাদের কাছে পাঠিয়ে আপনার দর্শন লাভ ঘটিয়েছেন ।
(সূত গোস্বামীর প্রতি মুনি-ঋষিরা)
শ্লোক: 123
তরবঃ কিং ন জীবন্তি ভস্ত্রাঃ কিং ন শ্বসন্ত্ত্যত ।
ন খাদন্তি ন মেহন্তি কিং গ্রামে পশবোহপরে ।।
(ভাগবত ২/৩/১৮)
অনুবাদঃ- বৃক্ষসমূহ কি বেঁচে থাকে না? কামারের হাপর কি শ্বাসগ্রহণ ও পরিত্যাগ করে না? আমাদের চতুর্দিকে পশুরা কি আহার ও স্ত্রীসম্ভোগ করে না?
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 124
নায়ং দেহো দেহভাজং নৃলোকে
কষ্টান্ কামানর্হতে বিড়্ ভুজাং যে।
তপো দিব্যং পুত্রকা যেন সত্ত্বং
শুদ্ধ্যেদ্ যস্মাদ্ ব্রহ্মসৌখ্যং ত্বনন্তম্ ।।
(ভাগবত ৫/৫/১)
অনুবাদঃ- হে পুত্রগণ ! এই জগতে দেহধারী প্রাণীদের মধ্যে এই নরদেহ লাভ করে, কেবল ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করা উচিত নয়। ওই প্রকার ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ বিষ্ঠাভোজী কুকুর এবং শূকরদেরও লাভ হয়ে থাকে। ভগবৎ সেবাপর অপ্রাকৃত তপস্যা করাই উচিত, কারণ তার ফলে হৃদয় নির্মল হয় এবং হৃদয় নির্মল হলে জড় সুখের অতীত অন্তহীন চিন্ময় আনন্দ লাভ হয়।
শ্লোক: 125
কৌমার আচরেৎ প্রাজ্ঞো ধর্মান্ ভাগবতানিহ ।
দুর্লভং মানুষং জন্ম তদপ্যধ্রুবমর্থদম্ ।।
(ভাগবত ৭/৬/১)
অনুবাদঃ- প্রাজ্ঞ ব্যক্তি মনুষ্যজন্ম লাভ করে জীবনের শুরু থেকেই, অর্থাৎ বাল্যকাল থেকেই অন্য সমস্ত প্রয়াস ত্যাগ করে ভাগবত-ধর্ম অনুষ্ঠান করবেন। মনুষ্যজন্ম অত্যন্ত দুর্লভ এবং অন্যান্য শরীরের মতো অনিত্য হলেও তা অত্যন্ত অর্থপূর্ণ, কারণ মনুষ্য-জীবনে ভগবানের সেবা সম্পাদন করা সম্ভব। নিষ্ঠাপূর্বক কিঞ্চিৎ মাত্র ভগবদ্ভক্তির অনুষ্ঠান করলেও মানুষ পূর্ণসিদ্ধি লাভ করতে পারে।
(প্রহ্লাদ মহারাজ)
শ্লোক: 126
তস্যারবিন্দনয়নস্য পদারবিন্দ-
কিঞ্জল্কমিশ্রিতুলসীমকরন্দবায়ুঃ ।
অন্তর্গতঃ স্ববিবরেণ চকার তেষাং
সংক্ষোভমক্ষরজুষামপি চিত্ততন্বোঃ ।।
(ভাগবত ৩/১৫/৪৩)
অনুবাদঃ- সেই অরবিন্দ নেত্র ভগবানের পদকমলের কিঞ্জল্ক মিশ্রিত তুলসীর মধুর সৌরভযুক্ত বায়ু নির্বিশেষ ব্রহ্মপরায়ণ চতুঃসনের নাসিকার রন্ধ্রযোগে অন্তর্গত হয়ে, তাঁদের চিত্ত ও তনুর ক্ষোভ উৎপন্ন করেছিল।
শ্লোক: 127
যেহন্যেহরবিন্দাক্ষ বিমুক্তমানিন-
স্ত্বয্যস্তভাবাদবিশুদ্ধবুদ্ধয়ঃ ।
আরুহ্য কৃচ্ছ্রেণ পরং পদং ততঃ
পতন্ত্যধোহনাদৃতযুষ্মদঙ্ঘ্রয়ঃ ।।
(ভাগবত ১০/২/৩২)
অনুবাদঃ- হে অরবিন্দাক্ষ ! যারা ‘বিমুক্ত হয়েছে’ বলে অভিমান করে, আপনার প্রতি ভক্তিবিহীন হওয়ায় তাদের বুদ্ধি অবিশুদ্ধ। তারা বহু কৃচ্ছ্রসাধন করে মায়াতীত পরমানন্দ ব্রহ্ম পর্যন্ত আরোহণ করে। ভগবদ্ভক্তির অনাদর করার ফলে তারা আবার অধঃপতিত হয়।
শ্লোক: 128
যথোল্মুকাদ্বিস্ফুলিঙ্গাদ্ধুমাদ্বাপি স্বসম্ভবাৎ ।
অপ্যাত্মত্বেনাভিমতাদযথাগ্নিঃ পৃথগুল্মুকাৎ ।।
(ভাগবত ৩/২৮/৪০)
অনুবাদঃ- জ্বলন্ত অগ্নি যেমন অগ্নিশিখা থেকে, স্ফুলিঙ্গ থেকে এবং ধুম থেকে ভিন্ন, যদিও তারা সকলেই জ্বলন্ত কাষ্ঠ থেকে উদ্ভূত হওয়ার ফলে, পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
শ্লোক: 129
এবং প্রজাভির্দুষ্টাভিরাকীর্ণে ক্ষিতিমণ্ডলে ।
ব্রহ্মবিটক্ষত্রশূদ্রাণাং যো বলী ভবিতা নৃপঃ ।।
(ভাগবত ১২/২/৭)
অনুবাদঃ- এভাবেই ভূমণ্ডল যখন দুষ্ট জনগণে পূর্ণ হবে, তখন ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, ক্ষত্রিয় ও শূদ্রদের মধ্যে যাদের জোর বেশি, তারাই রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করবে।
শ্লোক: 130
দস্যুপ্রায়েষু রাজসু
(ভাগবত ১২/২/১৩)
অনুবাদঃ- রাজাগণ প্রায় দস্যুর মতো হয়ে যাবেন।
(শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 131
প্রজা হি লুব্ধৈরাজন্যৈর্নিঘৃণৈর্দস্যুধর্মভিঃ ।
আচ্ছিন্নদারদ্রবিণা যাস্যন্তি গিরিকাননম্ ।।
(ভাগবত ১২/২/৮)
অনুবাদঃ- ঐ সকল দস্যুপ্রায় লোভী ও নির্মম রাজাদের হাতে তাদের সম্পত্তি, স্ত্রী প্রভৃতি হারিয়ে প্রজাগণ গিরিকাননে চলে যাবে।
শ্লোক: 132
শাকমূলামিষক্ষৌদ্রফলপুষ্পার্ষ্টিভোজনাঃ ।
অনাবৃষ্ট্যা বিনঙ্ক্ষ্যন্তি দুর্ভিক্ষকরপীড়িতাঃ ।।
(ভাগবত ১২/২/৯)
অনুবাদঃ- দুর্ভিক্ষ ও অত্যাধিক করের দ্বারা উৎপীড়িত হয়ে জনসাধারণ শাক, মূল, আমিষ, বনের মধু, ফল, ফুল ও বীজ ভক্ষণ করবে এবং অনাবৃষ্টির ফলে তারা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস-প্রাপ্ত হবে।
শ্লোক: 133
তচ্ছ্রদ্দধানা মুনয়ো জ্ঞানবৈরাগ্যযুক্তয়া ।
পশ্যন্ত্যাত্মনি চাত্মানং ভক্ত্যা শ্রুতগৃহীতয়া ।।
(ভাগবত ১/২/১২)
অনুবাদঃ- অপ্রাকৃত বস্তুতে সুদৃঢ় ও নিশ্চয় বিশ্বাসযুক্ত মুনিগণ জ্ঞান ও বৈরাগ্যযুক্ত হয়ে শাস্ত্র শ্রবণজনিত উপলব্ধি অনুসারে ভগবানের প্রতি প্রেমময়ী সেবার দ্বারা তাঁদের শুদ্ধ হৃদয়ে পরমাত্মারূপে সেই তত্ত্ববস্তুকে দর্শন করেন।
শ্লোক: 134
শ্রুতিঃ প্রত্যক্ষমৈতিহ্যমনুমানং চতুষ্টয়ম্ ।
প্রমাণেষ্বনবস্থানাদ্ বিকল্পাৎ স বিরজ্যতে ।।
(ভাগবত ১১/১৯/১৭)
অনুবাদঃ- শ্রুতি, প্রত্যক্ষ, ঐতিহ্য ও অনুমান—এই চার প্রকার প্রমাণের ভিত্তিতে মানুষ এই জড় জগতের অস্থায়ী অসারত্ব উপলব্ধি করতে পারে এবং এর দ্বারা সে এই জড় জগতের প্রতি বিরাগ বোধ করে।
(উদ্ধবের প্রতি শ্রীকৃষ্ণ)
শ্লোক: 135
বরীয়ানেষ তে প্রশ্নঃ কৃতো লোকহিতং নৃপ ।
আত্মবিৎসম্মতঃ পুংসাং শ্রোতব্যাদিষু যঃ পরঃ ।।
(ভাগবত ২/১/১)
অনুবাদঃ- হে রাজন্ ! আপনার প্রশ্ন যর্থার্থই মহিমান্বিত, কেন না তা সমস্ত মানুষের পরম হিতকর। এই বিষয়টি সমস্ত শ্রবণীয় বিষয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম এবং আত্মতত্ত্বজ্ঞ মুক্তকুল কর্তৃক অনুমোদিত।
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 136
মুনয়ঃ সাধু পৃষ্টোহহং ভবদ্ভির্লোকমঙ্গলম্ ।
যৎকৃতঃ কৃষ্ণসংপ্রশ্নো যেনাত্মা সুপ্রসীদতি ।।
(ভাগবত ১/২/৫)
অনুবাদঃ- হে ঋষিগণ ! আপনারা আমাকে যথার্থ প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করেছেন। আপনাদের প্রশ্নগুলি অতি উত্তম, কেন না সেগুলি কৃষ্ণ-বিষয়ক এবং তাই তা জগতের মঙ্গল সাধন করে। এই ধরনের পরিপ্রশ্নের দ্বারাই কেবল আত্মা সম্পূর্ণরূপে প্রসন্ন হয়।
(সূত গোস্বামী)
শ্লোক: 137
জ্ঞানং পরমগুহ্যং মে যদ্বিজ্ঞানসমন্বিতম্ ।
সরহস্যং তদঙ্গং চ গৃহাণ গদিতং ময়া ।।
(ভাগবত ২/৯/৩১)
অনুবাদঃ- শাস্ত্রে আমার সম্বন্ধে যে জ্ঞান বর্ণিত হয়েছে তা অত্যন্ত গোপনীয় এবং তা ভক্তি সহকারে উপলব্ধি করতে হয়। সেই পন্থার আনুষঙ্গিক অঙ্গসমূহ আমি বিশ্লেষণ করছি, তুমি তা যত্ন সহকারে গ্রহণ কর।
শ্লোক: 138
এতাবদেব জিজ্ঞাস্যং তত্ত্বজিজ্ঞাসুনাত্মনঃ ।
অন্বয়ব্যতিরেকাভ্যাং যৎ স্যাৎ সর্বত্র সর্বদা ।।
(ভাগবত ২/৯/৩৬)
অনুবাদঃ- তত্ত্বজ্ঞান লাভে আগ্রহী ব্যক্তিকে সেই জন্য সর্ব্ব্যাপ্ত সত্যকে জানার জন্য সর্বদা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনুসন্ধান করতে হবে।
(ব্রহ্মার প্রতি শ্রীকৃষ্ণ)
শ্লোক: 139
ন যদ্বচশ্চিত্রপদং হরের্যশো
জগৎপবিত্রং প্রগৃণীত কর্হিচিৎ ।
তদ্বায়সং তীর্থমুশন্তি মানসা
ন যত্র হংসা নিরমন্ত্ত্যশিক্ক্ষয়াঃ ।।
(ভাগবত ১/৫/১০)
অনুবাদঃ- যে বাণী জগৎ পবিত্রকারী ভগবানের মহিমা বর্ণনা করে না, তাকে সন্ত পুরুষেরা কাকেদের তীর্থ বলে বিবেচনা করেন। ভগবৎ-ধামে নিবাসকারী পরমহংসেরা সেখানে কোন রকম আনন্দ অনুভব করেন না।
শ্লোক: 140
তদ্বাগ্বিসর্গো জনতাঘবিপ্লবো
যস্মিন্ প্রতিশ্লোকমবদ্ধত্যপি ।
নামান্যনন্তস্য যশোহঙ্কিতানি যৎ
শৃন্বন্তি গায়ন্তি গৃণন্তি সাধবঃ ।।
(ভাগবত ১/৫/১১)
অনুবাদঃ- পক্ষান্তরে যে সাহিত্য অন্তহীন পরমেশ্বর ভগবানের নাম, রূপ, যশ, লীলা আদির বর্ণনায় পূর্ণ, তা দিব্য শব্দতরঙ্গে পরিপূর্ণ এক অপূর্ব সৃষ্টি, যা এই জগতের উদ্ভ্রান্ত জনসাধারণের পাপ-পঙ্কিল জীবনে এক বিপ্লবের সূচনা করে। এই অপ্রাকৃত সাহিত্য যদি নির্ভুলভাবে রচিত নাও হয়, তবুও তা সৎ ও নির্মল চিত্ত সাধুরা শ্রবণ করেন, কীর্তন করেন এবং গ্রহণ করেন।
শ্লোক: 141
যথা মানতি ভূতানি ভূতষূচ্চাবচেষ্বনু ।
প্রবিষ্টান্যপ্রবিষ্টানি তথা তেষু ন তেষ্বহম্ ।
(ভাগবত ২/৯/৩৫)
অনুবাদঃ- জড় জগতের উপাদান বা মহাভূতসমূহ যেমন সমস্ত প্রাণীর ভিতরে প্রবিষ্ট হয়েও বাহিরে অপ্রবিষ্টরূপে স্বতন্ত্র বর্তমান থাকে, তেমনই আমিও সমস্ত জড় সৃষ্টির মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েও তার মধ্যে অবস্থিত নই।
শ্লোক: 142
ন হ্যস্য কর্হিচিদ্রাজন্ পুমান্ বেদ বিধিৎসিতম্ ।
যদ্বিজিজ্ঞাসয়া যুক্তা মুহ্যন্তি কবয়োহপি হি ।।
(ভাগবত ১/৯/১৬)
অনুবাদঃ- হে রাজন্, পরমেশ্বরের (শ্রীকৃষ্ণের) পরিকল্পনা কেউই জানতে পারে না। এমন কি, মহান দার্শনিকেরাও বিশদ অনুসন্ধিৎসা সহকারে নিয়োজিত থেকেও কেবলই বিভ্রান্ত হন। (যুধিষ্ঠিরের প্রতি ভীষ্মদেবের উক্তি)
শ্লোক: 143
নায়ং সুখাপো ভগবান্ দেহিনাং গোপিকাসুতঃ ।
জ্ঞানিনাং চাত্মভূতানাং যথা ভক্তিমতামিহ ।।
(ভাগবত ১০/৯/২১)
অনুবাদঃ- যশোদা পুত্র পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাগানুগাভক্তি-পরায়ণ ভক্তদের কাছে যেমন সুলভ, মনোধর্মী জ্ঞানী, ব্রত ও তপস্যা-পরায়ণ আত্মারাম অথবা দেহাত্মবুদ্ধি পরায়ণ ব্যক্তিদের কাছে তেমন সুলভ নন।
(শ্রী শুকদেব গোস্বামী )
শ্লোক: 144
এতদীশনমীশস্য প্রকৃতিস্থোহপি তদগুণৈঃ ।
ন যুজ্যতে সদাত্মস্থৈর্যথা বুদ্ধিস্তদাশ্রয়া ।।
(ভাগবত ১/১১/৩৮)
অনুবাদঃ- জড়া প্রকৃতিতে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃতির গুণের বশীভূত না হওয়াই হচ্ছে ভগবানের ঐশ্বর্য। তেমনই, যাঁরা তাঁর শরণাগত হয়ে তাঁদের বুদ্ধিকে তাঁর মধ্যে স্থির করেন, তাঁরা কখনও প্রকৃতির গুণের দ্বারা প্রভাবিত হন না।
(সূত গোস্বামী)
শ্লোক: 145
হরির্হি নির্গুণঃ সাক্ষাৎ পুরুষঃ প্রকৃতেঃ পরঃ ।
স সর্বদৃগুপদ্রষ্টা তং ভজন্নির্গুণো ভবেৎ ।।
(ভাগবত ১০/৮৮/৫)
অনুবাদঃ- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি জড়া প্রকৃতির অতীত; তাই তিনি হচ্ছেন সাক্ষাৎ গুণাতীত পুরুষ। অন্তর ও বাইরের সমস্ত বিষয় তিনি দর্শন করতে পারেন। তাই তিনিই হচ্ছেন সমস্ত জীবের পরম অধ্যক্ষ। কেউ যদি তাঁর চরণকমলকে আশ্রয় করে তাঁর ভজনা করেন, তা হলে তিনিও সেই রকম গুণাতীত স্তর লাভ করতে পারেন।
শ্লোক: 146
আত্মারামাশ্চ মুনয়ো নির্গ্রন্থা অপ্যুরুক্রমে ।
কুর্বন্ত্যহৈতুকীং ভক্তিমিত্থম্ভূতগুণো হরিঃ ।।
(ভাগবত ১/৭/১০)
অনুবাদঃ- আত্মাতে যারা রমণ করেন, এরূপ বাসনা-গ্রন্থিশূন্য মুনিরাও অত্যদ্ভূত কার্য সম্পাদনকারী শ্রীকৃষ্ণে অহৈতুকী ভক্তি করেন, কেন না জগতে চিত্তহারী হরির এই রকম একটি গুণ আছে।
শ্লোক: 147
জয়তি জননিবাসো দেবকীজন্মবাদো
যদুবরপরিষৎ স্বৈর্দোর্ভিরস্যন্নধর্মম্ ।
স্থিরচরবৃজিনঘ্নঃ সুস্মিতশ্রীমুখেন
ব্রজপুরবনিতানাং বর্ধয়ন্ কামদেবম্ ।।
(ভাগবত ১০/৯০/৪৮)
অনুবাদঃ- সমস্ত জীবের আশ্রয়স্বরূপ, দেবকীপুত্ররূপে পরিচিত, যদুদের সভাপতি, নিজ বাহুর দ্বারা অধর্ম নাশকারী, স্থাবর-জঙ্গম সমস্ত জীবের অমঙ্গলহারী, মধুর হাস্য মুখের দ্বারা ব্রজবনিতাদের কামবর্ধনকারী শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র জয়যুক্ত হোন।
(শ্রীল শুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 148
স্বপাদমূলং ভজতঃ প্রিয়স্য
ত্যক্তান্যভাবস্য হরিঃ পরেশঃ ।
বিকর্ম যচ্চোৎপতিতং কথঞ্চিদ্
ধুনোতি সর্বং হৃদি সন্নিবিষ্টঃ ।।
(ভাগবত ১১/৫/৪২)
অনুবাদঃ- যিনি অন্য ভাব পরিত্যাগ করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মের পূর্ণ আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, তিনি শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয়। তিনি যদি ঘটনাক্রমে কোন পাপ করেও ফেলেন, পরমেশ্বর হৃদয়ে প্রবিষ্ট থেকে তাঁর পাপ বিনষ্ট করে দেন।
শ্লোক: 149
যস্যাহমনুগৃহ্নামি হরিষ্যে তদ্ধনং শনৈঃ ।
(ভাগবত ১০/৮৮/৮)
অনুবাদঃ- আমার ভক্তের প্রতি আমার প্রথম কৃপা হচ্ছে আমি তার সমস্ত জড়-জাগতিক ধনসম্পদ হরণ করি।
শ্লোক: 150
সত্যং দিশত্যর্থিতমর্থিতো নৃণাং
নৈবার্থদো যৎ পুনরর্থিতা যতঃ ।
স্বয়ং বিধত্তে ভজতামনিচ্ছতা-
মিচ্ছাপিধানং নিজপাদপল্লবম্ ।।
(ভাগবত ৫/১৯/২৭)
অনুবাদঃ- কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ যে তাঁর সেই প্রার্থনা পূর্ণ করেন, সেই কথা সত্য; কিন্তু যা থেকে পুনঃপুনঃ প্রার্থনার উদয় হয়, সেই প্রকার বস্তু তিনি দান করেন না। অন্য কামনাযুক্ত হয়ে কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করেন, তখন তিনি স্বয়ংই তাঁদের অন্য কামনা শান্তিকারী তাঁর শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় দান করেন।
(ভারতবাসীদের উদ্দেশ্যে দেবতাদের উক্তি)
শ্লোক: 151
বালস্য নেহ শরণং পিতরৌ নৃসিংহ
নার্তস্য চাগদমুদন্বতি মজ্জতো নৌঃ ।
তপ্তস্য তৎপ্রতিবিধির্য ইহাঞ্জসেষ্ট-
স্তাবদ্ বিভো তনুভৃতাং তদুপেক্ষিতানাম্ ।।
(ভাগবত ৭/৯/১৯)
অনুবাদঃ- হে নৃসিংহদেব! হে বিভো! জীবন সম্বন্ধে দেহ-চেতনাবশত যে সমস্ত দেহবদ্ধ জীবগণ আপনার দ্বারা উপেক্ষিত হয়েছে, তারা তাদের নিজেদের কল্যাণের জন্য কিছুই করতে পারে না। যে প্রতিবিধানই তারা গ্রহণ করুক না কেন, সেগুলি হয়ত সাময়িকভাবে উপকারী হতে পারে, কিন্তু নিশ্চিতরূপে সেগুলি ক্ষণস্থায়ী। দৃষ্টান্তস্বরূপ, পিতা-মাতা তাদের বালককে রক্ষা করতে পারে না, ওষুধ ও চিকিৎসক রোগীকে যন্ত্রণা থেকে রেহাই দিতে পারে না এবং একটি নৌকা সমুদ্রে নিমজ্জমান কোনও ব্যক্তিকে রক্ষা করতে পারে না।
শ্লোক: 152
নৈষ্কর্ম্যমপ্যচুতভাববর্জিতং
ন শোভতে জ্ঞানমলং নিরঞ্জনম্ ।
কুতঃ পুনঃ শশ্বদভদ্রমীশ্বরে
ন চার্পিত্নগ কর্ম যদপ্যকারণম্ ।।
(ভাগবত ১/৫/১২)
অনুবাদঃ- আত্ম-উপলব্ধির জ্ঞান সব রকমের জড় সংসর্গ-বিহীন হলেও তা যদি অচ্যুত ভগবানের মহিমা বর্ণনা না করে, তা হলে তা অর্থহীন। তেমনই, যে সকাম কর্ম শুরু থেকেই ক্লেশদায়ক ও অনিত্য, তা যদি পরমেশ্বর ভগবানের ভক্তিযুক্ত সেবার উদ্দেশ্যে সাধিত না হয়, তা হলে তার কি প্রয়োজন?
শ্লোক: 153
ভয়ং দ্বিতীয়াভিনিবেশতঃ স্যা-
দীশাদপেতস্য বিপর্যয়োহস্মৃতিঃ ।
তন্ময়য়াতো বুধ আভজেত্তং
ভক্ত্যৈকয়েশং শুরুদেবতাত্মা ।।
(ভাগবত ১১/২/৩৭)
অনুবাদঃ- জীব যখন শ্রীকৃষ্ণের বহিরঙ্গা শক্তি মায়ার দ্বারা আকৃষ্ট হয়, তখন তার ভয় উপস্থিত হয়। জড়া প্রকৃতির প্রভাবে পরমেশ্বর ভগবানের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ফলে তার স্মৃতি বিপর্যয় হয়। অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণের নিত্য দাস হওয়ার পরিবর্তে সে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিযোগী হয়। এই ভ্রান্তি সংশোধন করার জন্য পণ্ডিত ব্যক্তি পরমেশ্বর ভগবানকে গুরুদেবরূপে, অর্চ্চা-বিগ্রহরূপে ও পরমাত্মারূপে ভজনা করেন।
শ্লোক: 154
সুখমৈন্দ্রিয়কং দৈত্যা দেহযোগেন দেহিনাম্ ।
সর্বত্র লভ্যতে দৈবাদ্ যথা দুঃখমযত্নতঃ ।।
(ভাগবত ৭/৬/৩)
অনুবাদঃ- হে আমার দৈত্যবন্ধুগণ ! বিভিন্ন প্রকার দেহের মাধ্যমে যে ইন্দ্রিয়জাত সুখ, তা পূর্ব কর্মফল অনুসারে যে কোন জীবদেহেই লাভ করা যায়। বিনা চেষ্টাতেই সেই দেহসুখ লাভ করা যায়, ঠিক যেমন বিনা চেষ্টাতেই আমরা দুঃখ লাভ করি।
শ্লোক: 155
নেহ যৎকর্ম ধর্মায় ন বিরাগায় কল্পতে ।
ন তীর্থপদসেবায়ৈ জীবন্নপি মৃতো হি সঃ ।।
(ভাগবত ৩/২৩/৫৬)
অনুবাদঃ- যে ব্যক্তির কর্ম তাকে ধর্মাভিমুখী করে না, যার ধর্ম অনুষ্ঠান জড় বিষয়ের প্রতি বিরক্তি উৎপাদন করে না এবং যার বৈরাগ্য পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি প্রেমময়ী সেবায় পর্যবসিত হয় না, সেই ব্যক্তি জীবিত হলেও মৃত।
শ্লোক: 156
শ্রোতব্যাদীনি রাজেন্দ্র নৃণাং সন্তি সহস্রশঃ ।
অপশ্যতামাত্মতত্ত্বং গৃহেষু গৃহমেধিনাম্ ।।
(ভাগবত ২/১/২)
অনুবাদঃ- হে রাজশ্রেষ্ঠ ! আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান আলোচনায় উদাসীন, বিষয়াসক্ত গৃহমেধীদের অসংখ্য শ্রবণীয়, কীর্তনীয় ও স্মরণীয় বিষয়সমূহ আছে।
শ্লোক: 157
নিদ্রয়া হ্রিয়তে নক্তং ব্যবায়েন চ বা বয়ঃ ।
দিবা চার্থেহয়া রাজন্ কুটুম্বভরণেন বা ।।
(ভাগবত ২/১/৩)
অনুবাদঃ- এই প্রকার মাৎসর্য পরায়ণ গৃহমেধীরা নিদ্রামগ্ন হয়ে অথবা রতিক্রিয়ায় তাদের রাত্রি অতিবাহিত করে এবং আত্মীয়-স্বজনদের প্রতিপালনের জন্য অর্থ উপার্জনের চেষ্টায় দিবাভাগের অপচয় করে।
শ্লোক: 158
দেহাপত্যকলত্রাদিষ্বাত্মসৈন্যেষ্বসৎস্বপি ।
তেষাং প্রমত্তো নিধনং পশ্যন্নপি ন পশ্যতি ।।
(ভাগবত ২/১/৪)
অনুবাদঃ- আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান রহিত ব্যক্তিরা দেহ, পুত্র, পত্নী আদি অনিত্য সৈন্যদের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়ে জীবনের প্রকৃত সমস্যাগুলি সাধনের কোন চেষ্টা করে না। এই সমস্ত বিষয়ের অনিত্যতা সম্বন্ধে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তারা তাদের অবশ্যম্ভাবী বিনাশ দর্শন করে না।
শ্লোক: 159
শ্ববিড়্ বরাহোষ্ট্রখরৈঃ
সংস্তুতঃ পুরুষঃ পশুঃ ।
ন যৎ কর্ণ পথোপেতো
জাতু নাম গদাগ্রজঃ ।।
(ভাগবত ২/৩/১৯)
অনুবাদঃ- কুকুর, শূকর, উট ও গর্দভের মতো মানুষেরা তাদেরই প্রশংসা করে, যারা সমস্ত অশুভ থেকে উদ্ধারকারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্য লীলাসমূহ কখনও শ্রবণ করে না।
(শ্রীশুকদেব গোস্বামী)
শ্লোক: 160
বিলে বতোরুক্রমবিক্রমান্ যে
ন শৃণ্বতঃ কর্ণপুটে নরস্য ।
জিহ্বাসতী দার্দুরিকেব সূত
ন চোপগায়ত্যুরুগায়গাথাঃ ।।
(ভাগবত ২/৩/২০)
অনুবাদঃ- যে ব্যক্তি ভগানের শৌর্য ও অদ্ভূত কার্যকলাপের কথা শ্রবণ করেনি এবং ভগবানের গুণগাথা কীর্তন করেনি, তার কর্ণরন্ধ্র সর্পের গর্তের মতো এবং তার জিহ্বা ভেকের জিহ্বার মতো।
শ্লোক: 161
মতির্ন কৃষ্ণে পরতঃ স্বতো বা
মিথোহভিপদ্যেত গৃহব্রতানাম্ ।
অদান্তগোভির্বিশতাং তামিস্রং
পুনঃ পুনশ্চর্বিতচর্বণানাম্ ।।
(ভাগবত ৭/৫/৩০)
অনুবাদঃ- ইন্দ্রিয়গুলি অসংযত হওয়ার ফলে, জড় ভোগে অত্যধিক আসক্ত ব্যক্তিরা নারকীয় জীবনের পথে এগিয়ে যায় এবং পুনঃপুনঃ চর্বিত বস্তুর চর্বণ করে। অন্যের উপদেশে বা নিজের চেষ্টায়, কিংবা উভয় পক্ষের সংযুক্ত প্রচেষ্টায় – কোনভাবেই কখনও তাদের শ্রীকৃষ্ণে মতি হয় না।
শ্লোক: 162
স্বজনাখ্যদস্যুভিঃ
(ভাগবত ৮/২২/৯)
অনুবাদঃ- স্বজন নামে পরিচিত লোকগুলি আসলে দস্যুর মতো। দস্যুরা যেমন বলপূর্বক ধন হরণ করে, স্বজনেরাও দেহসুখ ভোগের জন্য অর্থব্যয় করে। যে ধন দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা যেত, তা তারা হরণ করে। এই স্বজনরূপ দস্যুর কি প্রয়োজন?
শ্লোক: 163
যস্যাত্মবুদ্ধিঃ কুপণে ত্রিধাতুকে
স্বধীঃ কলত্রাদিষু ভৌম ইজ্যধীঃ ।
যত্তীর্থবুদ্ধিঃ সলিলে ন কর্হিচিজ্
জনেষ্বভিজ্ঞেষু স এব গোখরঃ ।।
(ভাগবত ১০/৮৪/১৩)
অনুবাদঃ- যে ব্যক্তি কফ, পিত্ত ও বায়ু – এই ত্রিধাতু-বিশিষ্ট দেহরূপ থলিটিকে আত্মা বলে মনে করে, স্ত্রী-পুত্রাদিকে স্বজন বলে মনে করে, জন্মভূমিকে পূজ্য বলে মনে করে, তীর্থে গিয়ে তীর্থের জলকেই তীর্থ বলে মনে করে তাতে স্নান করে অথচ তীর্থবাসী অভিজ্জ সাধুদের সঙ্গ করে না, সে একটি গরু বা গাধা থেকে কোন অংশেই উৎকৃষ্ট নয়।
শ্লোক: 164
তৎ সাধু মন্যেহসুরবর্য দেহিনাং
সদা সমুদ্বিগ্নধিয়ামসদ্ গ্রহাৎ ।
হিত্বাত্মপাতং গৃহমন্ধকূপং
বনং গতো যদ্ধরিমাশ্রয়েত ।।
(ভাগবত ৭/৫/৫)
অনুবাদঃ- হে অসুরশ্রেষ্ঠ রাজা! আমি আমার গুরু থেকে যতদূর শিখেছি তা হচ্ছে এই যে, এই ক্ষণস্থায়ী দেহ ও গৃহজীবনকে যে ব্যক্তি আমি ও আমার বলে গ্রহণ করে, সে নিশ্চিতরূপে সর্বদা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় নিমগ্ন থাকে, কারণ সে একটি জলহীন অন্ধকূপে পতিত হয়েছে। তার এই আত্মপাতকারী গৃহ ছেড়ে বনে যাওয়া কর্তব্য। বিশেষত বৃন্দাবনে গিয়ে কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করে শ্রীহরির চরণকে আশ্রয় করাই তার কর্তব্য। (প্রহ্লাদ মহারাজ)শ্লোক: 165
যস্য যল্লক্ষণং প্রোক্তং পুংসো বর্ণাভিব্যঞ্জকম্ ।
যদন্যত্রাপি দৃশ্যেত তত্তেনৈব বিনির্দিশেৎ ।।
(ভাগবত ৭/১১/৩৫)
অনুবাদঃ- কোনও ব্যক্তি যদি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্রের উপরোক্ত লক্ষণগুলি প্রদর্শন করে, তা হলে সে যদি অন্য বর্ণেও জাত হয়, তবুও তাকে ওই সমস্ত লক্ষণ অনুসারেই বিশেষ বর্ণের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করতে হবে।
(মহারাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি নারদ মুনির উক্তি)
শ্লোক: 166
য এষাং পুরুষং সাক্ষাদাত্মপ্রভবমীশ্বরম্ ।
ন ভজন্ত্যবজানন্তি স্থানাদ্ ভ্রষ্টাঃ পতন্ত্যধঃ ।।
(ভাগবত ১১/৫/৩)
অনুবাদঃ- এই চার বর্ণাশ্রমের মধ্যে যারা তাদের প্রভু ভগবান বিষ্ণুর সাক্ষাৎ ভজন না করে, নিজের নিজের বর্ণ ও আশ্রমের অহংকারে তাঁর ভজনে অবজ্ঞা করে, তারা স্থান ভ্রষ্ট হয়ে অধঃ পতিত হয়।
শ্লোক: 167
ধর্মঃ স্বনুষ্ঠিতঃ পুংসাং বিষ্বক্ সেনকথাসু যঃ ।
নোৎপাদয়েদ্ যদি রতিং শ্রম এব হি কেবলম্ ।।
(ভাগবত ১/২/৮)
অনুবাদঃ- স্বীয় বৃত্তি অনুসারে বর্ণাশ্রম পালনরূপ স্বধর্ম অনুষ্ঠান করার ফলেও যদি পরমেশ্বর ভগবানের মহিমা শ্রবণ-কীর্তনে আসক্তির উদয় না হয়, তা হলে তা বৃথা শ্রম মাত্র।
(সূত গোস্বামী)
শ্লোক: 168
অতঃ পুম্ভির্দ্বিজশ্রেষ্ঠা বর্ণাশ্রমবিভাগশঃ ।
স্বনুষ্ঠিতস্য ধর্মস্য সংসিদ্ধির্হরিতোষণম্ ।।
(ভাগবত ১/২/১৩)
অনুবাদঃ- হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! তাই সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে, স্বীয় প্রবণতা অনুসারে বর্ণাশ্রম-ধর্ম পালন করার মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির সন্তুষ্টি-বিধান করাই হচ্ছে স্বধর্মের চরম ফল।
শ্লোক: 169
বিপ্রাদ্ দ্বিষড়্ গুণযুতাদরবিন্দনাভ-
পাদারবিন্দবিমুখাৎ শ্বপচং বরিষ্ঠম্ ।
মন্যে তদর্পিতমনোবচনেহিতার্থ-
প্রাণং পুনাতি স কুলং ন তু ভূরিমানঃ ।।
(ভাগবত ৭/৯/১০)
অনুবাদঃ- যাঁর মন, বচন, চেষ্টা, অর্থ ও প্রাণ শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মে অর্পিত হয়েছে, তিনি যদি চণ্ডাল কুলেও জন্মগ্রহণ করে থাকেন, তা হলেও তিনি কৃষ্ণ-পাদপদ্ম বিমুখ দ্বাদশ গুণবিশিষ্ট ব্রাহ্মণের থেকেও শ্রেষ্ঠ বলে আমি মনে করি, কেন না তিনি (শ্বপচ কুলোদ্ভূত) স্বীয় কুল পবিত্র করেন। কিন্তু অতি গর্বিত অভক্ত ব্রাহ্মণ তা করতে পারেন না।
শ্লোক: 170
কামং ববর্ষ পর্জন্যঃ সর্বকামদুঘা মহী ।
সিষিচুঃ স্ম ব্রজান্ গাবঃ পয়সোধস্বতীর্মুদা ।।
(ভাগবত ১/১০/৪)
অনুবাদঃ- মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাজত্বকালে মেঘরাজি মানুষের প্রয়োজন মতো যথেষ্ট বারি বর্ষণ করত এবং পৃথিবী মানুষের সমস্ত প্রয়োজনই পর্যাপ্তভাবে পূর্ণ করত। দুগ্ধবতী প্রফুল্লমনা গাভীদের স্ফীত স্তন থেকে ক্ষরিত দুগ্ধে গোচারণভূমি সিক্ত হত।
(সূত গোস্বামী)
শ্লোক: 171
ত্যক্ত্বা স্বধর্মং চরণাম্বুজং হরে-
র্ভজন্নপক্কোহথ পতেত্ততো যদি ।
যত্র ক্ব বাভদ্রমভূদমুষ্য কিং
কো বার্থ আপ্তোহভজতাং স্বধর্মতঃ ।।
(ভাগবত ১/৫/১৭)
অনুবাদঃ- ভগবানের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত হওয়ার জন্য যিনি জাগতিক কর্তব্য পরিত্যাগ করেছেন, অপক্ক অবস্থায় যদি কোন কারণে তাঁর পতনও হয়, তবুও বিফল হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না। পক্ষান্তরে, অভক্ত যদি সর্বতোভাবে নৈমিত্তিক ধর্ম-অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়, তবুও তাতে তার কোন লাভ হয় না।
(ব্যাসদেবের প্রতি নারদ মুনি)
0 Comments