চৈতন্য চরিতামৃত থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক

 চৈতন্য চরিতামৃত থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক






  • শ্লোক: 1

    'সাধুসঙ্গ', 'সাধুসঙ্গ' - সর্বশাস্ত্রে কয় ।
    লবমাত্র সাধুসঙ্গে সর্বসিদ্ধি হয় ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ২২/৫৪)
  • অনুবাদঃ- সমস্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গ যদি মুহূর্তের জন্যও লাভ করা যায়, তা হলেই সর্বসিদ্ধি লাভ হয়।

  • শ্লোক: 2

    কৃষ্ণভক্ত- নিষ্কাম, অতএব 'শান্ত' ।
    ভুক্তি-মুক্তি-সিদ্ধি-কামী-- সকলি 'অশান্ত' ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ১৯/১৪৯)
  • অনুবাদঃ- কৃষ্ণভক্ত নিষ্কাম বলেই শান্ত। সকাম কর্মীরা জড় ভোগ কামনা করেন, জ্ঞানীরা মুক্তি কামনা করেন, আর যোগীরা জড়-জাগতিক সিদ্ধি কামনা করেন। তাই এরা সকলেই কামার্ত ও অশান্ত।

  • শ্লোক: 3

    যাঁর চিত্তে কৃষ্ণপ্রেমা করয়ে উদয়।
    তাঁর বাক্য, ক্রিয়া, মুদ্রা বিজ্ঞেহ না বুঝয় ।।
    চৈঃ চঃ মধ্য ২৩/৩৯)
  • অনুবাদঃ- যাঁর চিত্তে কৃষ্ণপ্রেমের উদয় হয়, তাঁর কথাবার্তা, কার্যকলাপ এবং আচার-আচরণ বিজ্ঞেরাও বুঝতে পারেন না।

  • শ্লোক: 4

    'শ্রদ্ধা'-শব্দে- বিশ্বাস কহে সুদৃঢ় নিশ্চয় ।
    কৃষ্ণে ভক্তি কৈলে সর্বকর্ম কৃত হয় ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ২২/৬২)
  • অনুবাদঃ- কৃষ্ণভক্তি সম্পাদিত হলে অন্য সমস্ত কর্ম আপনা থেকেই সম্পাদিত হয়ে যায়। এই সুদৃঢ় বিশ্বাসকে বলা হয় শ্রদ্ধা।

  • শ্লোক: 5

    কিবা বিপ্র, কিবা ন্যাসী, শূদ্র কেনে নয় ।
    যেই কৃষ্ণতত্ত্ববেত্তা, সেই 'গুরু' হয় ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ৮/১২৮)
  • অনুবাদঃ- যিনি কৃষ্ণ-তত্ত্ববেত্তা তিনিই গুরু, তা তিনি ব্রাহ্মণ হোন, কিংবা সন্ন্যাসীই হোন অথবা শূদ্রই হোন, তাতে কিছুই যায় আসে না।

  • শ্লোক: 6

    'কে আমি', 'কেনে আমায় জারে তাপত্রয়' ।
    ইহা নাহি জানি-- 'কেমনে হিত হয়' ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ২০/১০২)
  • অনুবাদঃ- আমি কে? কেন জড় জগতের তিনটি তাপ আমাকে নিরন্তর দুঃখ দেয়? আমি যদি তা না জানি, তা হলে কিভাবে আমার যথার্থ মঙ্গল সাধিত হবে?

  • শ্লোক: 7

    ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমিতে কোন ভাগ্যবান জীব ।
    গুরু-কৃষ্ণ প্রসাদে পায় ভক্তিলতা-বীজ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ১৯/১৫১)
  • অনুবাদঃ- জীব তার কর্ম অনুসারে ব্রহ্মাণ্ডে ভ্রমণ করে। কখনও সে উচ্চতর লোকে উন্নীত হয় এবং কখনও নিম্নতর লোকে অধঃপতিত হয়। এভাবেই ভ্রমণরত অসংখ্য জীবের মধ্যে কদাচিৎ কোন একটি জীব তার অসীম সৌভাগ্যের ফলে, শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় সদগুরুর সান্নিধ্য লাভ করে। এভাবেই গুরু ও কৃষ্ণ, উভয়ের কৃপার প্রভাবে জীব ভক্তিলতার বীজ প্রাপ্ত হয়।

  • শ্লোক: 8

    কলিকালে নামরূপে কৃষ্ণ-অবতার ।
    নাম হৈতে হয় সর্বজগতৎ-নিস্তার ।।
    (চৈঃ চঃ আদি ১৭/২২)
  • অনুবাদঃ- এই কলিযুগে ভগবানের দিব্যনাম 'হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র' হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের অবতার। কেবলমাত্র এই দিব্যনাম গ্রহণ করার ফলে, যে কোন মানুষ সরাসরিভাবে ভগবানের সঙ্গ লাভ করতে পারেন। যিনি তা করেন, তিনি অবশ্যই উদ্ধার লাভ করেন। এই নামের প্রভাবেই কেবল সমস্ত জগৎ নিস্তার পেতে পারে।

  • শ্লোক: 9

    একলে ঈশ্বর কৃষ্ণ, আর সব ভৃত্য ।
    যারে যৈছে নাচায়, সে তৈছে করে নৃত্য ।।
    (চৈঃ চঃ আদি ৫/১৪২)
  • অনুবাদঃ- একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম ঈশ্বর এবং অন্য সকলেই তাঁর সেবক। তিনি যেভাবে নির্দেশ দেন, তাঁরা সেভাবেই নৃত্য করেন ।

  • শ্লোক: 10

    কৃষ্ণ- সূর্যসম; মায়া হয় অন্ধকার ।
    যাহাঁ কৃষ্ণ, তাহাঁ নাহি মায়ার অধিকার ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ২২/৩১)
  • অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং মায়াকে অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সূর্য-কিরণের প্রকাশ হলে যেমন আর সেখানে অন্ধকার থাকতে পারে না, তেমনই কেউ যদি কৃষ্ণভক্তির পন্থা অবলম্বন করেন, তখন মায়ার অন্ধকার তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে দূর হয়ে যায়।

  • শ্লোক: 11

    কৃষ্ণ ভুলি' সেই জীব অনাদি- বহির্মুখ ।
    অতএব মায়া তারে দেয় সংসার-দুঃখ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ২০/১১৭)
  • অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে জীব অনাদিকাল ধরে জড়া প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে রয়েছে। তাই মায়া তাকে এই জড় জগতে নানা প্রকার দুঃখ প্রদান করছে ।

  • শ্লোক: 12

    আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি-বাঞ্ছা- -তারে বলি, 'কাম' ।
    কৃষ্ণেন্দ্রিয়প্রীতি-ইচ্ছা ধরে 'প্রেম' নাম ।।
    (চৈঃ চঃ আদি ৪/১৬৫)
  • অনুবাদঃ- নিজের ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির বাসনাকে বলা হয় কাম, আর শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয়ের প্রীতি সাধনের ইচ্ছাকে বলা হয় প্রেম ।

  • শ্লোক: 13

    জীবের 'স্বরূপ' হয়- কৃষ্ণের 'নিত্যদাস' ।
    কৃষ্ণের 'তটস্থা-শক্তি,' 'ভেদাভেদ-প্রকাশ' ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ২০/১০৮)
  • অনুবাদঃ- জীব তার স্বরূপে শ্রীকৃষ্ণের নিত্যদাস। সে শ্রীকৃষ্ণের তটস্থা শক্তি, তাই সে যুগপৎ শ্রীকৃষ্ণের ভেদ ও অভেদ প্রকাশ।

  • শ্লোক: 14

    গ্রাম্যকথা না শুনিবে, গ্রাম্যবার্তা না কহিবে ।
    ভাল না খাইবে আর ভাল না পরিবে ।।
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৬/২৩৬)
  • অনুবাদঃ- জড়-জাগতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে না এবং সেই সমস্ত বিষয়ে শ্রবণ করবে না। ভাল খাবার খাবে না এবং ভাল কাপড় পরবে না। (রঘুনাথ দাস গোস্বামীর প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উপদেশ)

  • শ্লোক: 15

    মালী হঞা করে সেই বীজ আরোপণ ।
    শ্রবণ-কীর্তণ-জলে করয়ে সেচন ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ১৯/১৫২)
  • অনুবাদঃ- সেই বীজ লাভ করার পর, মালী হয়ে সেই বীজটিকে হৃদয়ে রোপণ করতে হয় এবং শ্রবণ, কীর্তণরূপ জল তাতে সিঞ্চন করতে হয়।

    (শ্রীল রূপ গোস্বামীর প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)

  • শ্লোক: 16

    নিত্যসিদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম ‘সাধ্য’ কভু নয় ।
    শ্রবণাদি-শুদ্ধচিত্তে করয়ে উদয় ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ২২/১০৭)
  • অনুবাদঃ- কৃষ্ণপ্রেম নিত্যসিদ্ধ বস্তু, তা কখনও (শুদ্ধ ভক্তি ব্যতীত অন্য কোন অভিধেয়ের) সাধ্য নয়। কেবলমাত্র শ্রবণাদি দ্বারা বিশোধিত চিত্তে তার উদয় সম্ভব।

    (শ্রীল সনাতন গোস্বামীর প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)

  • শ্লোক: 17

    অসৎসঙ্গত্যাগ, -- এই বৈষ্ণব-আচার ।
    ‘স্ত্রীসঙ্গী’—এক অসাধু, ‘কৃষ্ণাভক্ত’ আর ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ২২/৮৭)
  • অনুবাদঃ- বৈষ্ণবকে সর্বদাই অসৎসঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। স্ত্রীর প্রতি আসক্ত এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিহীন ব্যক্তিরাই অসাধু। এই অসৎসঙ্গ ত্যাগই বৈষ্ণব আচার।

  • শ্লোক: 18

    আপনি করিমু ভক্তভাব অঙ্গীকারে ।
    আপনি আচরি’ ভক্তি শিখাইমু সবারে ।।
    (চৈঃ চঃ আদি ৩/২০)
  • অনুবাদঃ- আপনি নিজে ভক্তভাব অঙ্গীকার করে এবং ভক্তির আরচরণ করে সকলকে শিক্ষা দেব। (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)
  • শ্লোক: 19

    ভারত-ভূমিতে হৈল মনুষ্য-জন্ম যার ।
    জন্ম সার্থক করি’ কর পর-উপকার ।।
    (চৈঃ চঃ আদি ৯/৪১)
  • অনুবাদঃ- ভারতবর্ষে যিনি মনুষ্য দেহ পেয়েছেন, তিনি যেন নিজের জীবন সার্থক করে পরোপকার করেন।

  • শ্লোক: 20

    যারে দেখ, তারে কহ ‘কৃষ্ণ’-উপদেশ ।
    আমার আজ্ঞায় গুরু হঞা তার’ এই দেশ ।।

    (চৈঃ চঃ মধ্য ৭/১২৮)
  • অনুবাদঃ- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও ভাগবতে যেমনটি রয়েছে, অবিকৃতভাবে কৃষ্ণের সেই সব আদেশ সকলকে পালন করতে উপদেশ দাও। এভাবেই গুরু হয়ে আমার আজ্ঞায় এই দেশের প্রত্যেককে ত্রাণ কর।

  • শ্লোক: 21

    এইমত ভক্তভাব করি’ অঙ্গীকার ।
    আপনি আচরি’ ভক্তি করিল প্রচার ।।
    (চৈঃ চঃ আদি ৪/৪১)
  • অনুবাদঃ-

  • শ্লোক: 22

    কলিকালের ধর্ম—কৃষ্ণনাম-সঙ্কীর্তন ।
    কৃষ্ণ-শক্তি বিনা নহে তার প্রবর্তন ।।
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৭/১১)
  • অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণের নাম-সঙ্কীর্তনই কলিকালের মূল ধর্ম, শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা শক্ত্যাবিষ্ট না হলে এই সংকীর্তন আন্দোলন প্রচার করা যায় না।

  • শ্লোক: 23

    জগাই মাধাই হৈতে মুঞি সে পাপিষ্ঠ ।
    পুরীষের কীট হৈতে মুঞি সে লঘিষ্ঠ ।।
    (চৈঃ চঃ আদি ৫/২০৫)
  • অনুবাদঃ- আমি জগাই-মাধাই থেকেও পাপিষ্ঠ এবং এমন কি বিষ্ঠার কীট থেকেও অধম। (কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী)

  • শ্লোক: 24

    মোর নাম শুনে যেই তার পূণ্য ক্ষয় ।
    মোর নাম লয় যেই তার পাপ হয় ।।
    (চৈঃ চঃ আদি ৫/২০৬)
  • অনুবাদঃ- যিনি আমার নাম শুনেন, তাঁর পূণ্য ক্ষয় হয়ে যায়। যিনি আমার নাম উচ্চারণ করেন, তাঁর পাপ হয়। (কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী)

  • শ্লোক: 25

    প্রেমের স্বভাব—যাঁহা প্রেমের সম্বন্ধ ।
    সেই মানে,-- ‘কৃষ্ণে মোর নাহি প্রেম-গন্ধ’ ।।
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ২০/২৮)
  • অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যদি কোনও ভক্তের প্রকৃত প্রেম জাগ্রত হয়, সেই প্রেমের স্বভাবই এই রকম যে, সেই ভক্ত নিজেকে ভক্ত বলেই গণ্য করেন না। বরং, তিনি সর্বদাই মনে করেন যে, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমের গন্ধমাত্রও আমার নেই। (কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী)

  • শ্লোক: 26

    ধর্মাচারি-মধ্যে বহুত ‘কর্মনিষ্ঠ’ ।
    কোটি-কর্মনিষ্ঠ-মধ্যে এক ‘জ্ঞানী’ শ্রেষ্ঠ ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ১৯/১৪৭)
  • অনুবাদঃ- বৈদিক জ্ঞানের অনুগামীদের মধ্যে অধিকাংশই সকাম কর্মের অনুষ্ঠান করছেন এবং ভাল ও মন্দ কর্মের পার্থক্য নিরূপণ করছেন। সেই রকম নিষ্ঠাবান কোটি সংখ্যক সকাম কর্মীর মধ্যে কদাচিৎ একজন জ্ঞানী ব্যক্তি থাকতে পারেন, যিনি সকাম কর্মীদের থেকে শ্রেষ্ঠ।

  • শ্লোক: 27

    কোটিজ্ঞানী-মধ্যে হয় একজন ‘মুক্ত’ ।
    কোটিমুক্ত-মধ্যে ‘দুর্লভ’ এক কৃষ্ণ-ভক্ত ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ১৯/১৪৮)
  • অনুবাদঃ- সেই রকম কোটি সংখ্যক জ্ঞানীর মধ্যে কদাচিৎ একজন বস্তুত মুক্তি লাভ করেন। সেই রকম কোটি সংখ্যক মুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একজন শুদ্ধ ভক্ত অত্যন্ত দুর্লভ।

  • শ্লোক: 28

    যেই ভজে সেই বড়, অভক্ত – হীন, ছার ।
    কৃষ্ণভজনে নাহি জাতি-কুলাদি-বিচার ।।
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৪/৬৭)
  • অনুবাদঃ- যিনি কৃষ্ণভক্তিমূলক সেবার পন্থা গ্রহণ করেছেন, তিনিই মহিমান্বিত। আর অভক্ত সর্বদাই নিন্দনীয় এবং জঘন্য গুণসম্পন্ন। এই জন্য কৃষ্ণভজনে জাতি ও কুলাদির বিচার করা হয় না। (সনাতন গোস্বামীর প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)

  • শ্লোক: 29

    স্থাবর-জঙ্গম দেখে, না দেখে তার মূর্তি ।
    সর্বত্র হয় নিজ ইষ্টদেব-স্ফূর্তি ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ৮/২৭৪)
  • অনুবাদঃ- মহাভাগবত স্থাবর-জঙ্গম দর্শন করেন, কিন্তু তিনি তাদের রূপ দর্শন করেন না। পক্ষান্তরে, তিনি সর্বত্র পরমেশ্বর ভগবানকে দর্শন করেন। (রায় রামানন্দের প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু)

  • শ্লোক: 30

    কৈবল্যং নরকায়তে ত্রিদশপুরাকাশপুষ্পায়তে
    দুর্দান্তেন্দ্রিয়কালসর্পপটলী প্রোৎখাতদংষ্ট্রায়তে ।
    বিশ্বং পূর্ণসুখায়তে বিধিমহেন্দ্রাদিশ্চ কীটায়তে
    যৎ কারুণ্যকটাক্ষবৈভববতাং তং গৌরমেব স্তুমঃ ।।
    (চৈতন্যচন্দ্রামৃত)
  • অনুবাদঃ- যাঁর করুণাকটাক্ষ রূপ সম্পদ প্রাপ্ত হলে নিরাকার ব্রহ্মসাযুজ্য মুক্তি নরকের মতো মনে হয়, স্বর্গকে আকাশকুসুম বলে মনে হয়; দুর্দান্ত ইন্দ্রিয়গুলি বিষদাঁত ভাঙা কালো সর্পের মতো নির্বিষ হয়ে যায়। সমস্ত বিশ্ব সুখময় হয়ে ওঠে এবং ব্রহ্ম ও ইন্দ্রের পদও কীটতুল্য তুচ্ছ মনে হয়, আমরা সেই শ্রীগৌরসুন্দরের স্তব করি। (প্রবোধানন্দ সরস্বতী)

  • শ্লোক: 31

    নীচ জাতি, নীচ-সঙ্গী, পতিত অধম ।
    কুবিষয়-কূপে পড়ি’ গোঙাইনু জনম ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ২০/৯৯)
  • অনুবাদঃ- “অত্যন্ত নীচকুলে আমার জন্ম হয়েছিল, আমার সঙ্গীরা অত্যন্ত অধঃপতিত। পাপে পূর্ণ বিষয়রূপ কূপে পতিত হয়ে আমি আমার জীবন কাটিয়েছি।”

  • শ্লোক: 32

    আপনার হিতাহিত কিছুই না জানি ।
    গ্রাম্য-ব্যবহারে পণ্ডিত, তাই সত্য মানি ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ২০/১০০)
  • অনুবাদঃ- কি করলে যে আমার ভাল হবে এবং কি করলে আমার খারাপ হবে, সেই সম্বন্ধে কোন জ্ঞানই আমার নেই। কিন্তু তবুও, জাগতিক ব্যবহারে লোকেরা আমাকে পণ্ডিত বলে মনে করে এবং আমিও মনে করি যেন তা সত্যি ।

  • শ্লোক: 33

    প্রভু কহে—“মায়াবাদী কৃষ্ণে অপরাধী।”
    (চৈঃ চঃ মধ্য ১৭/১২৯)
  • অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বললেন, “মায়াবাদীরা শ্রীকৃষ্ণের চরণে অপরাধী।”

  • শ্লোক: 34

    মায়াবাদী ভাষ্য শুনিলে হয় সর্বনাশ ।।
    (চৈঃ চঃ মধ্য ৬/১৬৯)
  • অনুবাদঃ- কেউ যদি মায়াবাদী-ভাষ্য শোনে, তা হলে তার সর্বনাশ হয়।

  • শ্লোক: 35

    সিদ্ধান্ত বলিয়া চিত্তে না কর অলস ।
    ইহা হইতে কৃষ্ণে লাগে সুদৃঢ় মানস ।।
    (চৈঃ চঃ আদি ২/১১৭)
  • অনুবাদঃ- আলস্যবশত পাঠক যেন এই সমস্ত সিদ্ধান্তের আলোচনা শ্রবণ করার ব্যাপারে কখনও অবহেলা না করেন, কেন না এই সমস্ত আলোচনার মাধ্যমে মন সুদৃঢ়ভাবে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠে।

  • শ্লোক: 36

    ‘দ্বৈতে’ ভদ্রাভদ্র-জ্ঞান, সব—‘মনোধর্ম’ ।
    ‘এই ভাল, এই মন্দ’, -- এই সব ‘ভ্রম’ ।।
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৪/১৭৬)
  • অনুবাদঃ- জড় জগতে ভাল ও মন্দের ধারণা হচ্ছে মনোধর্ম-প্রসূত। তাই, ‘এটি ভাল এবং এটি মন্দ’ এই ধারণাটি ভ্রান্ত।
    (সনাতন গোস্বামীর প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উক্তি)
  • শ্লোক: 37

    বৈরাগী হঞা যেবা করে পরাপেক্ষা ।
    কার্যসিদ্ধি নহে, কৃষ্ণ করেন উপেক্ষা ।।
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৬/২২৪)
  • অনুবাদঃ- “বৈরাগী হয়ে যে পরের উপর নির্ভর করে, তার কার্যসিদ্ধি হয় না, এবং কৃষ্ণ তাকে উপেক্ষা করেন। ”
    (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উক্তি)

  • শ্লোক: 38

    বৈরাগী হঞা করে জিহ্বার লালস ।
    পরমার্থ যায়, আর হয় রসের বশ ।।
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৬/২২৫)
  • অনুবাদঃ- “বৈরাগী হয়ে কেউ যদি জিহ্বার লালসা করে, তাহলে তার পরমার্থ সাধন হয় না, এবং সে জিহ্বার রসের বশবর্তী হয়। ”
    (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উক্তি)

  • শ্লোক: 39

    বৈরাগীর কৃত্য—সদা নাম-সঙ্কীর্তন।
    শাক-পত্র-ফল-মূলে উদর-ভরণ।।
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৬/২২৬)
  • অনুবাদঃ- “বৈরাগীর কর্তব্য—সর্বদা নাম-সঙ্কীর্তন করা, এবং শাক-পাতা, ফল-মূল, যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে উদর-ভরণ করা। ”
    (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উক্তি)

  • শ্লোক: 40

    জিহ্বার লালসে যেই ইতি-উতি ধায় ।
    শিশ্নোদরপরায়ণ কৃষ্ণ নাহি পায়।।
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৬/২২৭)
  • অনুবাদঃ- “জিহ্বার লালসে যে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায়, সেই শিশ্নোদর-পরায়ণ ব্যক্তি কখনও কৃষ্ণকে পায় না। ”
    (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উক্তি)

  • শ্লোক: 41

    কি মোর কর্তব্য, মুঞি না জানি উদ্দেশ ।
    আপনি শ্রীমুখে মোরে কর উপদেশ ।।
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৬/২৩২)
  • অনুবাদঃ- “আমার কি কর্তব্য, কি উদ্দেশ্য, তা আমি জানি না। আপনি আপনার শ্রীমুখে আমাকে সেই সম্বন্ধে উপদেশ দান করুন। ”
    (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উদ্দেশ্যে রঘুনাথ দাস গোস্বামীর উক্তি)

  • শ্লোক: 42

    হাসি’ মহাপ্রভু রঘুনাথেরে কহিল ।
    "তোমার উপদেষ্টা করি' স্বরূপেরে দিল ।।
    'সাধ্য'-'সাধন'-তত্ত্ব শিখ ইহাঁর স্থানে।
    আমি তত নাহি জানি, ইহোঁ যত জানে ।। (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৬/২৩৩-২৩৪)
  • অনুবাদঃ- হেসে তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রঘুনাথ দাসকে বললেন, "আমি ইতিমধ্যেই স্বরূপ দামোদর গোস্বামীকে তোমার উপদেষ্টা নিযুক্ত করেছি। তুমি তার কাছে সাধ্য সাধন তত্ত্ব শেখ। উনি যা জানেন আমি ততটা জানি না।
    (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উক্তি)

  • শ্লোক: 43

    তথাপি আমার আজ্ঞায় যদি শ্রদ্ধা হয় ।
    আমার এই বাক্যে তবে করিহ নিশ্চয়।।
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৬/২৩৫)
  • অনুবাদঃ- “তথাপি, আমার আজ্ঞায় যদি তোয়ার শ্রদ্ধা হয়, তাহলে আমার এই নির্দেশ নিশ্চিতভাবে পালন কর।”
    (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উক্তি)

  • শ্লোক: 44

    গ্রাম্যকথা না শুনিবে, গ্রাম্যবার্তা না কহিবে ।
    ভাল না খাইবে আর ভাল না পরিবে।।
    অমানী মানদ হঞা কৃষ্ণনাম সদা ল'বে।
    ব্রজে রাধাকৃষ্ণ-সেবা মানসে করিবে।।
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৬/২৩৬-২৩৭)
  • অনুবাদঃ- “জড়-জাগতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে না, এবং সেই সমস্ত বিষয়ে শ্রবণ করবে না। ভাল খাবার খাবে না এবং ভাল কাপড় পরবে না। নিজে কোন রকম সম্মানের প্রত্যাশা না করে অন্য সকলকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে সর্বদা কৃষ্ণনাম গ্রহণ করবে; এবং মানসে বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণের সেবা করবে। ”
    (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উক্তি)

  • শ্লোক: 45

    এই ত' সংক্ষেপে আমি কৈলুঁ উপদেশ।
    স্বরূপের ঠাঞি ইহার পাইবে বিশেষ।।
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৬/২৩৮)
  • অনুবাদঃ- “সংক্ষেপে আমি তোমাকে এই উপদেশ দিলাম। স্বরূপ দামোদর গোস্বামীর কাছে তুমি সেই সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে নির্দেশ পাবে। ”
    (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উক্তি)

  • শ্লোক: 46

    "তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা ।
    অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ ।।"
    (চৈঃ চঃ অন্ত্য ৬/২৩৫)
  • অনুবাদঃ- “যিনি নিজেকে সকলের পদদলিত তৃণের থেকেও ক্ষুদ্র বলে মনে করেন, যিনি বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু, যিনি নিজে মানশূন্য এবং অন্য সকলকে সম্মান প্রদর্শন করেন, তিনি সর্বক্ষণ ভগবানের দিব্যনাম কীর্তনের অধিকারী।”
    (শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উক্তি)
  • Post a Comment

    0 Comments