শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত অন্ত্য ১৬, শ্রীকৃষ্ণের অধরামৃত

 শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত অন্ত্য ১৬, শ্রীকৃষ্ণের অধরামৃত





  • শ্লোক: 1
    বন্দে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যং কৃষ্ণভাবামৃতং হি যঃ ।
    আস্বাদ্যাস্বাদয়ন্ ভক্তান্ প্রেমদীক্ষামশিক্ষয়ৎ ।। ১ ।।

  • অনুবাদঃ- যিনি কৃষ্ণপ্রেমামৃত স্বয়ং আস্বাদন করে এবং ভক্তদের আস্বাদন করিয়ে, প্রেম দীক্ষা বিষয়ক দিব্য জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলেন, সেই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুকে আমি বন্দনা করি।

  • শ্লোক: 2
    জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় নিত্যানন্দ ।
    জয়াদ্বৈতচন্দ্র জয় গৌরভক্তবৃন্দ ।। ২ ।।

  • শ্লোকার্থ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জয় ! শ্রীমন্নিত্যানন্দ প্রভুর জয় ! শ্রীঅদ্বৈত আচার্য প্রভুর জয় ! এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সমস্ত ভক্তবৃন্দের জয় !

  • শ্লোক: 3
    এইমত মহাপ্রভু রহেন নীলাচলে ।
    ভক্তগণ-সঙ্গে সদা প্রেম-বিহ্বলে ।। ৩ ।।

  • অনুবাদঃ- এইভাবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সর্বদা ভগবৎ-প্রেমে বিহ্বল হয়ে ভক্তদের সঙ্গে নীলাচলে অবস্থান করছিলেন ।

  • শ্লোক: 4
    বর্ষান্তরে আইলা সব গৌড়ের ভক্তগণ ।
    পূর্ববৎ আসি’ কৈল প্রভুর মিলন ।। ৪।।

  • অনুবাদঃ- পরের বছর, যথারীতি, গৌড়ের সমস্ত ভক্তরা জগন্নাথপুরীতে এলেন, এবং পূর্ববৎ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে তাঁদের মিলন হল ।

  • শ্লোক: 5
    তাঁ-সবার সঙ্গে আইল কালিদাস নাম ।
    কৃষ্ণনাম বিনা তেঁহো নাহি কহে আন ।। ৫ ।।

  • অনুবাদঃ- তাঁদের সঙ্গে কালিদাস নামক একজন ভক্ত এসেছিলেন। কৃষ্ণনাম ব্যতীত তাঁর মুখে আর অন্য কোন বাণী ছিল না।
  • শ্লোক: 1
    বন্দে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যং কৃষ্ণভাবামৃতং হি যঃ ।
    আস্বাদ্যাস্বাদয়ন্ ভক্তান্ প্রেমদীক্ষামশিক্ষয়ৎ ।। ১ ।।

  • অনুবাদঃ- যিনি কৃষ্ণপ্রেমামৃত স্বয়ং আস্বাদন করে এবং ভক্তদের আস্বাদন করিয়ে, প্রেম দীক্ষা বিষয়ক দিব্য জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলেন, সেই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুকে আমি বন্দনা করি।

  • শ্লোক: 2
    জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় নিত্যানন্দ ।
    জয়াদ্বৈতচন্দ্র জয় গৌরভক্তবৃন্দ ।। ২ ।।

  • শ্লোকার্থ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জয় ! শ্রীমন্নিত্যানন্দ প্রভুর জয় ! শ্রীঅদ্বৈত আচার্য প্রভুর জয় ! এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সমস্ত ভক্তবৃন্দের জয় !

  • শ্লোক: 3
    এইমত মহাপ্রভু রহেন নীলাচলে ।
    ভক্তগণ-সঙ্গে সদা প্রেম-বিহ্বলে ।। ৩ ।।

  • অনুবাদঃ- এইভাবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সর্বদা ভগবৎ-প্রেমে বিহ্বল হয়ে ভক্তদের সঙ্গে নীলাচলে অবস্থান করছিলেন ।

  • শ্লোক: 4
    বর্ষান্তরে আইলা সব গৌড়ের ভক্তগণ ।
    পূর্ববৎ আসি’ কৈল প্রভুর মিলন ।। ৪।।

  • অনুবাদঃ- পরের বছর, যথারীতি, গৌড়ের সমস্ত ভক্তরা জগন্নাথপুরীতে এলেন, এবং পূর্ববৎ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে তাঁদের মিলন হল ।

  • শ্লোক: 5
    তাঁ-সবার সঙ্গে আইল কালিদাস নাম ।
    কৃষ্ণনাম বিনা তেঁহো নাহি কহে আন ।। ৫ ।।

  • অনুবাদঃ- তাঁদের সঙ্গে কালিদাস নামক একজন ভক্ত এসেছিলেন। কৃষ্ণনাম ব্যতীত তাঁর মুখে আর অন্য কোন বাণী ছিল না।

  • শ্লোক: 6
    মহাভাগবত তেঁহো সরল উদার।
    কৃষ্ণনাম-‘সঙ্কেতে’ চালায় ব্যবহার ।। ৬ ।।

  • অনুবাদঃ- কালিদাস ছিলেন মহাভাগবত, এবং তাঁর ব্যবহার ছিল অত্যন্ত সরল এবং উদার। তিনি তাঁর ব্যবহারিক কার্যকলাপ কৃষ্ণনাম করতে করতে সম্পাদন করতেন।

  • শ্লোক: 7
    কৌতুকেতে তেঁহো যদি পাশক খেলায় ।
    ‘হরে কৃষ্ণ’ ‘কৃষ্ণ’ করি’ পাশক চালায় ।। ৭ ।।

  • অনুবাদঃ- কৌতুক ছলে তিনি যদি কখনও পাশা খেলতেন, তখন ‘হরেকৃষ্ণ’ ‘কৃষ্ণ’ বলে পাশা চালাতেন।

  • শ্লোক: 8
    রঘুনাথ-দাসের তেঁহো হয় জ্ঞাতি-খুড়া ।
    বৈষ্ণবের উচ্ছিষ্ট খাইতে তেঁহো হৈল বুড়া ।। ৮ ।।

  • অনুবাদঃ- কালিদাস ছিলেন রঘুনাথ দাস গোস্বামীর জ্ঞাতি-খুড়া। তিনি সারাজীবন, এমনকি বৃদ্ধ বয়সেও, বৈষ্ণবের উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করার চেষ্টা করতেন।

  • শ্লোক: 9
    গৌড়দেশে হয় যত বৈষ্ণবের গণ।
    সবার উচ্ছিষ্ট তেঁহো করিল ভোজন ।। ৯ ।।
  • অনুবাদঃ- তিনি বঙ্গদেশের সমস্ত বৈষ্ণবদের উচ্ছিষ্ট ভোজন করেছিলেন।

  • শ্লোক: 10
    ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব যত-ছোট, বড় হয় ।
    উত্তম-বস্তু ভেট লঞা তাঁর ঠাঞি যায় ।। ১০ ।।
  • অনুবাদঃ- ছোট, বড় যত ব্রাহ্মণ এবং বৈষ্ণব ছিলেন, অতি উত্তম সমস্ত উপহার নিয়ে তিনি তাঁদের কাছে যেতেন।

  • শ্লোক: 11
    তাঁর ঠাঞি শেশ-পাত্র লয়েন মাগিয়া ।
    কাঁহা না পায়, তবে রহে লুকাঞা ।। ১১।।
  • অনুবাদঃ- তারপর তাঁদের খাইয়ে তিনি তাঁদের উচ্ছিষ্ট ভিক্ষা করতেন, এবং কেউ যদি তাঁকে উচ্ছিষ্ট দিতে অস্বীকার করতেন, তিনি তখন লুকিয়ে থাকতেন।

  • শ্লোক: 12
    ভোজন করিলে পাত্র ফেলাঞা যায়া ।
    লুকাঞা সেই পাত্র আনি’ চাটি’ খায় ।। ১২ ।।
  • অনুবাদঃ- সেই বৈষ্ণব যখন ভোজনের পর তাঁর পাত্র ফেলে দিয়ে যেতেন, তখন কালিদাস লুকিয়ে সেই পাত্র এসে চেটে উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করতেন।

  • শ্লোক: 13
    শূদ্র-বৈষ্ণবের ঘরে যায় ভেট লঞা ।
    এইমত তাঁর উচ্ছিষ্ট খায় লুকাঞা ।। ১৩ ।।
  • অনুবাদঃ- কালিদাস শূদ্র-কুলোদ্ভূত বৈষ্ণবদের গৃহে উপহার নিয়ে যেতেন, এবং এইভাবে লুকিয়ে তাঁদের উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করতেন।

  • শ্লোক: 14
    ভুঁইমালি-জাতি, ‘বৈষ্ণব’—‘ঝড়ু’ তাঁর নাম।
    আম্রফল লঞা তেঁহো গেলা তাঁর স্থান ।। ১৪ ।।
  • অনুবাদঃ- ঝড়ু ঠাকুর নামক এক মহান বৈষ্ণব ছিলেন, যিনি ‘ভুঁইমালি’ কুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কালিদাস আম নিয়ে তাঁর কাছে গেলেন।

  • শ্লোক: 15
    আম্র ভেট দিয়া তাঁর চরণ বন্দিলা ।
    তাঁর পত্নীরে তবে নমস্কার কৈলা ।। ১৫।।
  • অনুবাদঃ- কালিদাস ঝড়ু ঠাকুরকে সেই আম উপহার দিয়ে তাঁর চরণ বন্দনা করলেন, এবং তারপর তাঁর পত্নীকে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন।

  • শ্লোক: 16
    পত্নী-সহিত তেঁহো আছেন বসিয়া ।
    বহু সম্মান কৈলা কালিদাসেরে দেখিয়া ।। ১৬।।
  • অনুবাদঃ- ঝড়ু ঠাকুর তখন তাঁর পত্নীর সঙ্গে বসে ছিলেন, কালিদাসকে দেখে তিনি তাঁর বহু সম্মান করলেন।

  • শ্লোক: 17 & 18
    ইষ্টগোষ্ঠী কতক্ষণ করি’ তাঁর সনে ।
    ঝড়ু-ঠাকুর কহে তাঁরে মধুর বচনে ।। ১৭।।
    “আমি—নীচজাতি, তুমি—অতিথি সর্বোত্তম ।
    কোন্ প্রকারে করিমু আমি তোমার সেবন ? ১৮।।
  • অনুবাদঃ- কালিদাসের সঙ্গে কিছুক্ষণ কৃষ্ণকথা আলোচনা করার পর, ঝড়ু ঠাকুর তাঁকে মধুর বচনে বললেন, “আমি অত্যন্ত নীচ কুলোদ্ভূত, আর আপনি সর্বোত্তম অতিথি। কিভাবে আমি আপনার সেবা করতে পারি ?”

  • শ্লোক: 19
    আজ্ঞা দেহ’,-- ব্রাহ্মণ-ঘরে অন্ন লঞা দিয়ে ।
    তাঁহা তুমি প্রসাদ পাও, তবে আমি জীয়ে ।।” ১৯।।
  • অনুবাদঃ- “আপনি যদি আমাকে আদেশ দেন, তাহলে আমি কোন ব্রাহ্মণের গৃহে অন্ন পাঠিয়ে দেব, এবং সেখানে আপনি প্রসাদ পাবেন। আপনি যদি তা করেন, তাহলে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব।”

  • শ্লোক: 20
    কালিদাস কহে, --“ঠাকুর, কৃপা কর মোরে ।
    তোমার দর্শনে আইনু মুই পতিত পামরে ।। ২০।।
  • অনুবাদঃ- কালিদাস তার উত্তরে বললেন, “ঠাকুর, আমাকে আপনি কৃপা করুন। আমি অত্যন্ত অধঃপতিত পাপী, তথাপি আমি আপনাকে দর্শন করতে এসেছি।”

  • শ্লোক: 21
    পবিত্র হইনু মুই পাইনু দরশন ।
    কৃতার্থ হইনু, মোর সফল জীবন ।। ২১ ।।
  • অনুবাদঃ- “কেবল আপনাকে দর্শন করার ফলে আমি পবিত্র হয়েছি। আমি কৃতার্থ হলাম, এবং আমার জীবন সফল হল।”

  • শ্লোক: 22
    এক বাঞ্ছা হয়, --যদি কৃপা করি’ কর।
    পাদরজ দেহ’, পাদ মোর মাথে ধর ।।” ২২।।
  • অনুবাদঃ- “আমার একটি বাসনা রয়েছে। দয়া করে আমার প্রতি কৃপা পরবশ হয়ে আপনি আপনার পা আমার মাথায় রাখুন, যাতে আমি আপনার পদধূলি লাভ করতে পারি।”

  • শ্লোক: 23
    ঠাকুর কহে,-- “ঐছে বাত্ কহিতে না যুয়ায় ।
    আমি –নীচজাতি, তুমি –সুসজ্জন রায় ।।” ২৩।।
  • অনুবাদঃ- ঝড়ু ঠাকুর তার উত্তরে বললেন, “আপনার এইভাবে কথা বলা উচিত নয়। আমি অত্যন্ত নীচ-জাতি, আর আপনি অতি সম্ভ্রান্ত ধনী ব্যক্তি।”

  • শ্লোক: 24
    তবে কালিদাস শ্লোক পড়ি’ শুনাইল ।
    শুনি’ ঝড়ু-ঠাকুরের বড় সুখ হইল ।। ।২৪।।
  • অনুবাদঃ- তখন কালিদাস কয়েকটি শ্লোক পড়ে শোনালেন, এবং তা শুনে ঝড়ু-ঠাকুর অত্যন্ত আনন্দিত হলেন।

  • শ্লোক: 25
    ন মেহভক্তশ্চতুর্বেদী মদ্ভক্তঃ শ্বপচঃ প্রিয়ঃ ।
    তস্মৈ দেয়ং ততো গ্রাহ্যং স চ পূজ্যো যথা হ্যহম্ ।। ২৫।।
  • অনুবাদঃ- অনুবাদ “ চতুর্বেদ পাঠী অর্থাৎ চতুর্বেদী ব্রাহ্মণ হলেই এ যে ভক্ত হয়, এমন নয়। আমার ভক্ত চণ্ডাল কুলে জন্মগ্রহণ করলেও আমার অত্যন্ত প্রিয়। তাকেই দান করা উচিত; এবং তাঁর প্রসাদই গ্রহণ করা উচিত। আমার ভক্ত আমারই মতো পূজ্য। ” তাৎপর্য – হরিভক্তিবিলাসের এই শ্লোকটি পরমেশ্বর ভগবানের উক্তি ।
  • শ্লোক: 26
    বিপ্রাদ্ দ্বিষড়্ গুণযুতাদরবিন্দনাভ-
    পাদারবিন্দবিমুখাৎ শ্বপচং বরিষ্ঠম্ ।
    মন্যে তদর্পিতমনোবচনেহিতার্থ-
    প্রাণং পুনাতি স কুলং ন তু ভূরিমানঃ ।। ২৬।।
  • অনুবাদঃ- অনুবাদ- “যার মন, বচন, চেষ্টা, অর্থ ও প্রাণ শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মে অর্পিত হয়েছে, তিনি যদি চণ্ডাল কুলেও জন্মগ্রহণ করে থাকেন, তাহলেও তিনি কৃষ্ণপাদপদ্ম বিমুখ দ্বাদশ গুণ বিশিষ্ট ব্রাহ্মণের থেকেও শ্রেষ্ঠ বলে আমি মনে করি। কেননা, তিনি ( শ্বপচ কুলোদ্ভূত) স্বীয় কুল পবিত্র করেন। কিন্তু অতি গর্বিত অভক্ত ব্রাহ্মণ তা করতে পারেন না। ” তাৎপর্য- এই শ্লোকটি এবং পরবর্তী শ্লোকটি শ্রীমদ্ভাগবত (৭/৯/১০) এবং (৩/৩৩/৭) থেকে উদ্ধৃত।

  • শ্লোক: 27
    অহো বত শ্বপচোহতো গরীয়ান্
    যজ্জিহ্বাগ্রে বর্ততে নাম তুভ্যম্ ।
    তেপুস্তপস্তে জুহুবুঃ সস্নুরার্যাঃ
    ব্রহ্মানূচুর্নাম গৃহন্তি যে তে ।। ২৭।।
  • অনুবাদঃ- অনুবাদ- “ ‘হে ভগবান, যাঁদের জিহ্বায় আপনার নাম বিরাজ করে, তাঁরা যদি অত্যন্ত নীচকুলেও জন্মগ্রহণ করেন, তাহলেও তাঁরা শ্রেষ্ঠ। যাঁরা আপানার নাম কীর্তন করেন, তাঁরা সবরকম তপস্যা করেছেন, সমস্ত যজ্ঞ করেছেন, সর্বতীর্থে স্নান করেছেন, সমস্ত বেদ পাঠ করেছেন, সুতরাং তাঁরা আর্য মধ্যে পরিগণিত।’ ”

  • শ্লোক: 28
    শুনি’ ঠাকুর কহে, -- “শাস্ত্র এই সত্য কয় ।
    সেই শ্রেষ্ঠ, ঐছে যাতে কৃষ্ণভক্তি হয় ।। ২৮।।
  • অনুবাদঃ- শ্রীমদ্ভাগবতের এই শ্লোকগুলি শুনে ঝড়ু ঠাকুর বললেন, “হ্যাঁ, এই শাস্ত্র-বাণী সত্য। কিন্তু, যিনি ঐ প্রকার কৃষ্ণভক্তি লাভ করেছেন তিনিই শ্রেষ্ঠ।

  • শ্লোক: 29
    আমি –নীচজাতি, আমার নাহি কৃষ্ণভক্তি ।
    অন্য ঐছে হয়, আমার নাহি ঐছে শক্তি ।।” ২৯।।
  • অনুবাদঃ- "“আমি নীচজাতি এবং আমি কৃষ্ণভক্তি লাভ করতে পারিনি। অন্য যাঁরা যথার্থ কৃষ্ণভক্ত তাঁদের বেলায়ই এই শ্লোক প্রযোজ্য, আমার সেরকম শক্তি নেই। ” তাৎপর্য- এখানে ঝড়ু ঠাকুর তাঁর নীচকুলে জন্মগ্রহণ করার এবং কৃষ্ণভক্তি লাভের অযোগ্যতার কথা বলেছেন। নীচকুলোদ্ভূত ব্যক্তিও বৈষ্ণবে পরিণত হলে সর্বোত্তম হন সেকথা তিনি স্বীকার করেছেন, কিন্তু তিনি অনুভব করেছিলেন যে শ্রীমদ্ভগবতের এই বর্ণনাগুলি অন্যদের বেলায় প্রযোজ্য, কিন্তু তাঁর বেলায় নয়। ঝড়ু ঠাকুরের এই মনোভাব আদর্শ বৈষ্ণবোচিত, কেননা, বৈষ্ণব অতি উত্তম হলেও, কখনও নিজেকে উত্তম বলে মনে না। তিনি সর্বদাই অত্যন্ত দীন ও বিনীত, এবং তিনি কখনও নিজেকে উত্তম ভক্ত বলে মনে না। তিনি অত্যন্ত দীনতা অবলম্বন করেন, কিন্তু অর্থ এই নয় যে তিনি অধঃপতিত। শ্রীল সনাতন গোস্বামী এক সময় বলেছিলেন যে তিনি অত্যন্ত নীচজাতি, কেননা ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হলেও তিনি রাজমন্ত্রীরূপে ম্লেচ্ছ এবং যবনদের সঙ্গ করেছিলেন। তেমনই, ঝড়ু ঠাকুরও নীচকুলোদ্ভূত বলে দীনতা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত বহু ব্যক্তির থেকে অনেক উন্নত। ২৬ এং ২৭ শ্লোকে শ্রীমদ্ভাগবত থেকে কালিদাসের উদ্ধৃত প্রমাণ ব্যতীত শাস্ত্রে আরও বহু প্রমাণ রয়েছে। যেমন, মহাভারতে (বনপর্ব, ১৭৭ পরিচ্ছেদের ২০ শ্লোকে) বর্ণনা করা হয়েছে—
    শূদ্রে তু যদ্ভবেল্লক্ষং দ্বিজে তচ্চ ন বিদ্যতে ।
    ন বৈ শূদ্রো ভবেচ্ছূদ্রো ব্রাহ্মণো ন চ ব্রাহ্মণঃ ।।
    “ব্রাহ্মণোচিত গুণাবলী যদি শূদ্রের মধ্যে দেখা যায় তাহলে তিনি শূদ্র নন; এবং ব্রাহ্মণোচিত গুণাবলী যদি কোন ব্রাহ্মণে না দেখা যায় তাহলে তিনি ব্রাহ্মণ নন।”

    তেমনই, বনপর্বের ২১১ পরিচ্ছেদের ১-১২ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে—
    শূদ্রযোনৌ হি জাতস্য সদ্ গুণানুপতিষ্ঠতঃ ।
    আর্জবে বর্তমানস্য ব্রাহ্মণ্যমভিজায়তে ।।
    “শূদ্রকুলে জাত ব্যক্তির মধ্যে যদি ব্রাহ্মণের গুণাবলী প্রকাশ হয়, যথা সত্য, শম (প্রশান্ততা), দম (ইন্দ্রিয় সংযম), এবং আর্জব (সরলতা), তাহলে তাঁকে ব্রাহ্মণ বলেই স্বীকার করতে হবে।”

    মহাভারতের অনুশাসন পর্বে, ১৬৩ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে—
    স্থিসো ব্রাহ্মণধর্মেণ ব্রাহ্মণ্যমুপজীবতি ।
    ক্ষত্রিয়ো বাথ বৈশ্যো বা ব্রহ্মভূয়ঃ স গচ্ছতি ।।
    এভিস্তু কর্মভির্দেবি শুভৈরাচরিতৈস্তথা ।
    শূদ্রো ব্রাহ্মণতাং যাতি বৈশ্যঃ ক্ষত্রিয়তাং ব্রজেৎ ।।
    ন যোনির্নাপি সংস্কারো ন শ্রুতং ন চ সন্ততিঃ ।
    কারণানি দ্বিজত্বস্য বৃত্তমেব তু কারণম্ ।।
    “কেউ যদি ব্রাহ্মণ ধর্মে স্থিত হন, তাহলে ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্য কুলে জন্ম হওয়া সত্ত্বেও তাকে ব্রাহ্মণ বলে বিবেচনা করতে হবে।
    “হে দেবি, শূদ্র যদি ব্রাহ্মণের মতো শুদ্ধ আচার-আচরণের যুক্ত হয় তাহলে তিনিও ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হন। তেমনই ক্ষত্রিয়োচিত গুণাবলী অর্জন করার মাধ্যমে বৈশ্য ক্ষত্রিয়ত্ব লাভ করতে পারেন।
    “তাই, জন্ম, সংস্কার অথবা বেদ পাঠের দ্বারা কেবল কেউ ব্রাহ্মণত্ব লাভ করে না। বৃত্তির দ্বারাই ব্রাহ্মণ চেনা যায় ।”

    আমরা অনেক সময় দেখি যে ডাক্তারের পুত্র না হলেও এবং মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা না করলেও কখনও কখনও অনেকে চিকিৎসকের বৃত্তি গ্রহণ করতে সমর্থ হন। ব্যবহারিক ভাবে ঔষধ তৈরি করার বিদ্যা, বিভিন্ন রোগে ঔষধ দেওয়ার বিদ্যা এবং শল্য চিকিৎসা শিক্ষা লাভ করে ব্যবহারিকভাবে চিকিৎসক হওয়ার স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি চিকিৎসকের কার্য করতে পারেন এবং চিকিৎসক রূপে পরিচিত হন। শিক্ষিত চিকিৎসকেরা তাঁকে হাতুড়ে ডাক্তার বলে মনে করলেও, সরকার তার চিকিৎসার স্বীকৃতি দেন। বিশেষ করে ভারতবর্ষে এই রকম বহু ডাক্তার রয়েছেন যাঁরা অত্যন্ত সুদক্ষতার সঙ্গে চিকিৎসা করেন। সরকার পর্যন্ত তাঁদের স্বীকার করেন। তেমনই, কেউ যদি ব্রাহ্মণের বৃত্তি অনুশীলন করেন, নীচকুলে জন্ম হলেও তাঁকে ব্রাহ্মণ বলে স্বীকৃতি দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। সেইটিই সমস্ত শাস্ত্রের নির্দেশ। শ্রীমদ্ভাগবতে (৭/১১/৩৫) বলা হয়েছে—
    যস্য যল্লক্ষণং প্রোক্তং পুংসো বর্ণাভিব্যঞ্জকম্ ।
    যদন্যত্রাপি দৃশ্যেত তত্তেনৈব বিনির্দিশেৎ ।।
    এটি মহারাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি নারদ মুনির উক্তি। এখানে নারদ মুনি বলছেন যে শাস্ত্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের লক্ষণ বর্ণিত হয়েছে। তাই, কারোর মধ্যে যদি ব্রাহ্মণের গুণাবলী ও লক্ষণগুলি দেখা যায় এবং ব্রাহ্মণের বৃত্তিতে আচরণ করতে দেখা যায়, তাহলে ব্রাহ্মণ অথবা ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ না করলেও তাঁকে গুণ এবং কর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ বলে বিবেচনা করা উচিত।
    তেমনই পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে—
    ন শূদ্রা ভগবদ্ভক্তাস্তে তু ভাগবতা মতাঃ ।
    সর্ববর্ণেষু তে শূদ্রা যে ন ভক্তা জনার্দনে ।।
    “ভগবদ্ভক্ত বৈষ্ণবকে কখনও শূদ্র বলে মনে করা উচিত নয়। পরমেশ্বর ভগবানের সমস্ত ভক্তদের ‘ভাগবত’ বলে চেনা উচিত। যদি সে ভগবানের ভক্ত না হয়, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় অথাবা বৈশ্য কুলে জন্ম হলেও তাকে শূদ্র বলে বিবেচনা করতে হবে।”

    পদ্ম-পুরাণেও বলা হয়েছে—
    শ্বপাকমিব নেক্ষেত লোকে বিপ্রমবৈষ্ণবম্ ।
    বৈষ্ণবো বর্ণবাহ্যোহপি পুনাতি ভুবনত্রয়ম্ ।।
    “ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও কেউ যদি অবৈষ্ণব হয়, তাহলে তার মুখ দর্শন পর্যন্ত করা উচিত নয়, ঠিক যেভাবে কুকুর-ভোজী চণ্ডালের মুখ দর্শন করা উচিত নয়। কিন্তু ব্রাহ্মণোত্তর কুলে জাত বৈষ্ণব ত্রিভুবন পবিত্র করতে পারেন।”

    পদ্ম-পুরাণে আরও বলা হয়েছে –
    শূদ্রং বা ভগবদ্ভক্তং নিষাদং শ্বপচং তথা ।
    বীক্ষ্যতে জাতিসামান্যাৎ স যাতি নরকং ধ্রুবম্ ।।
    “শূদ্র, নিষাদ অথবা চণ্ডাল কুলজাত ভগবদ্ভক্ত বৈষ্ণবকে সেই সেই বর্ণ বলে যে মনে করে, সে অবশ্যই নরকগামী হয়।”

    ব্রাহ্মণকে অবশ্যই বৈষ্ণব এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত হতে হবে। তাই ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণকে পণ্ডিত বলে সম্বোধন করার প্রথা প্রচলিত আছে। ব্রহ্মজ্ঞান ব্যতীত পরমেশ্বর ভগবানকে জানা যায় না। তাই বৈষ্ণব অবশ্যই ব্রাহ্মণ, কিন্তু সব ব্রাহ্মণই বৈষ্ণব নন।
    গরুড় পুরাণে বলা হয়েছে—
    ভক্তিরষ্টবিধা হ্যেষা যস্মিন্ ম্লেচ্ছহপি বর্ততে ।
    স বিপ্রেন্দ্রো মুনিশ্রেষ্ঠঃ স জ্ঞানী স চ পণ্ডিতঃ ।।
    “ম্লেচ্ছও যদি ভগবদ্ভক্ত হন, তাহলে তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ এবং পণ্ডিত বলে স্বীকার করতে হবে।”
    তেমনই, তত্ত্বসাগরে বলা হয়েছে—
    যথা কাঞ্চনতাং যাতি কাংস্যং রসবিধানতঃ ।
    তথা দীক্ষাবিধানেন দ্বিজত্বং জায়তে নৃণাম্ ।।
    “পারদের মিশ্রণে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাঁসা যেমন সোনায় পরিণত হয়, তেমনই সদ্ গুরুর কাছ থেকে উপযুক্ত শিক্ষা এবং দীক্ষা লাভ করার মাধ্যমে মানুষ ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হন।” সমস্ত শাস্ত্রে প্রমাণিত হয়ে যে বেদের সিদ্ধান্ত অনুসারে বৈষ্ণবকে কখনও অব্রাহ্মণ বলে মনে করা উচিত নয়। ম্লেচ্ছ অথবা যবন কুলে জন্মগ্রহণ করলেও বৈষ্ণবকে কখনও নীচজাতি বলে মনে করা উচিত নয়। যেহেতু তিনি শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত হয়েছেন, তাই তিনি সম্পূর্ণভাবে পবিত্র হয়েছেন এবং ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন (দ্বিজত্বং জায়তে নৃণাম্ )।

  • শ্লোক: 30
    তাঁরে নমস্করি’ কালিদাস বিদায় মাগিলা ।
    ঝড়ু –ঠাকুর তবে তাঁর অনুব্রজি’ আইলা ।। ৩০।।
  • অনুবাদঃ- তাঁকে পুনরায় নমস্কার করে কালিদাস তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলেন, এবং ঝড়ু ঠাকুর তখন তাঁর পিছনে পিছনে বাইরে এলেন।

  • শ্লোক: 31 -32
    তাঁরে বিদায় দিয়া ঠাকুর যদি ঘরে আইল ।
    তাঁর চরণ-চিহ্ন যেই ঠাঞি পড়িল ।।৩১।। সেই ধুলি লঞা কালিদাস সর্বাঙ্গে লেপিলা । তাঁর নিকট একস্থানে লুকাঞা রহিলা ।।৩২।।
  • অনুবাদঃ- কালিদাসকে বিদায় দিয়ে ঝড়ু ঠাকুর যখন তাঁর ঘরে ফিরে গেলেন, তখন যে যে স্থানে তাঁর চরণ চিহ্ন পড়েছিল, সেই স্থানের ধুলি নিয়ে কালিদাস তাঁর সর্বাঙ্গে লেপন করলেন, এবং তাঁর বাড়ির কাছেই একজায়গায় লুকিয়ে রইলেন।

  • শ্লোক: 33
    ঝড়ু –ঠাকুর ঘর যাই’ দেখি’ আম্রফল ।
    মানসেই কৃষ্ণচন্দ্রে অর্পিলা সকল ।।৩৩।।
  • অনুবাদঃ- ঘরে ফিরে গিয়ে সেই আমগুলি দেখে ঝড়ু ঠাকুর মানসে সেগুলি শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রকে অর্পণ করলেন।

  • শ্লোক: 34
    কলার পাটুয়া-খোলা হৈতে আম্র নিকাশিয়া ।
    তাঁর পত্নী তাঁরে দেন, খায়েন চুষিয়া ।।৩৪।।
  • অনুবাদঃ- ঝড়ু ঠাকুরের পত্নী তখন কলার পাতা এবং খোলার মোড়ক থেকে আম বার করে ঝড়ু ঠাকুরকে নিবেদন করলেন, এবং ঝড়ু ঠাকুর সেগুলি চুষে চুষে খেতে লাগলেন।

  • শ্লোক: 35
    চুষি’ চুষি চোষা আঁঠি ফেলিলা পাটুয়াতে ।
    তারে খাওয়াঞা তাঁর পত্নী খায় পশ্চাতে ।। ৩৫ ।।
  • অনুবাদঃ- আমগুলি খেয়ে সেই আমের আঁঠিগুলি তিনি কলার পাতায় ফেললেন, এবং তাঁকে প্রথমে খাইয়ে তারপার তাঁর স্ত্রী আম খেতে লাগলেন।
  • শ্লোক: 36
    আঁঠি-চোষা সেই পাটুয়া-খোলাতে ভরিয়া ।
    বাহিরে উচ্ছিষ্ট-গর্তে ফেলাইলা লঞা ।।৩৬।।
  • অনুবাদঃ- চোষা আঁঠিগুলি কলার পাতা এবং খোলায় ভরে তিনি বাইরে উচ্ছিষ্ট-গর্তে সেগুলি ফেলে দিলেন।

  • শ্লোক: 37
    সেই খোলা, আঁঠি, চোকলা চুষে কালিদাস ।
    চুষিতে চুষিতে হয় প্রেমেতে উল্লাস ।।৩৭।।
  • অনুবাদঃ- সেই কলার খোলা, আমের আঁঠি ও চোকলা কালিদাস উচ্ছিষ্ট-গর্ত থেকে তুলে নিয়ে এসে চুষতে লাগলেন, এবং চুষতে চুষতে তিনি কৃষ্ণপ্রেমানন্দে উল্লসিত হলেন।

  • শ্লোক: 38
    এইমত যত বৈষ্ণব বৈসে গৌড়দেশে ।
    কালিদাস ঐছে সবার নিলা অবশেষে ।।৩৮।।
  • অনুবাদঃ- এইভাবে কালিদাস গৌড়দেশের সমস্ত বৈষ্ণবদের উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করেছিলেন ।

  • শ্লোক: 39
    সেই কালিদাস যবে নীলাচলে আইলা ।
    মহাপ্রভু তাঁর উপর মহাকৃপা কৈলা ।। ৩৯ ।।
  • অনুবাদঃ- সেই কালিদাস যখন নীলাচলে এলেন তখন মহাপ্রভু তাঁকে বিশেষভাবে কৃপা করলেন।

  • শ্লোক: 40
    প্রতিদিন প্রভু যদি যা’ন দরশনে ।
    জল-করঙ্গ লঞা গোবিন্দ যায় প্রভু-সনে ।।৪০।।
  • অনুবাদঃ- প্রতিদিন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন মন্দিরে জগন্নাথদেবকে দর্শন করতে যেতেন, তখন গোবিন্দ তাঁর জলপাত্র নিয়ে তাঁর সঙ্গে যেতেন।

  • শ্লোক: 41
    সিংহদ্বারের উত্তরদিকে কপাটের আড়ে ।
    বাইশ ‘পাহাচ’-তলে আছে এক নিম্ন গাড়ে ।।৪১।।
  • অনুবাদঃ- সিংহদ্বারের উত্তর দিকে, দরজার পিছন দিকে, বাইশটি সিঁড়ির তলায় একটি ডোবা আছে।

  • শ্লোক: 42
    সেই গাড়ে করেন প্রভু পাদ-প্রক্ষালনে ।
    তবে করিবারে যায় ঈশ্বর-দরশনে ।।৪২।।
  • অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সেই ডোবায় পাদ-প্রক্ষালন করে, তারপর মন্দিরে শ্রীজগন্নাথদেবকে দর্শন করতে যেতেন।

  • শ্লোক: 43
    গোবিন্দেরে মহাপ্রভু কৈরাছে নিয়ম ।
    ‘মোর পাদজল যেন না লয় কোন জন’ ।।৪৩।।
  • অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু গোবিন্দকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “আমার পা ধোয়া জল যেন কেউ না নেয়।”

  • শ্লোক: 44
    প্রাণিমাত্র লইতে না পায় সেই জল ।
    অন্তরঙ্গ ভক্ত লয় করি’ কোন ছল ।।৪৪।।
  • অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কঠোর নির্দেশের ফলে কোন প্রাণী তাঁর সেই পা ধোয়া জল গ্রহণ করতে পারত না। তাঁর কোন কোন অন্তরঙ্গ ভক্তই কেবল কোন ছলে সেই জল গ্রহণ করতে পেরেছিলেন।

  • শ্লোক: 45
    একদিন প্রভু তাঁহা পাদ প্রক্ষালিতে ।
    কালিদাস আসি’ তাঁহা পাতিলেন হাতে ।। ৪৫ ।।
  • অনুবাদঃ- একদিন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন সেখানে তাঁর পাদ প্রক্ষালন করছিলেন, তখন কালিদাস বসে সেই জল ভিক্ষা করে হাত পাতলেন।

  • শ্লোক: 46 -47
    এক অঞ্জলি, দুই অঞ্জলি, তিন অঞ্জলি পিলা ।
    তবে মহাপ্রভু তাঁরে নিষেধ করিলা ।।৪৬।।
    “অতঃপর আর না করিহ পুনর্বার ।
    এতাবতা বাঞ্ছা-পূরণ করিলুঁ তোমার ।।” ৪৭।।
  • অনুবাদঃ- তিনি একে একে তিন অঞ্জলি ভরে সেই জল পান করলেন, এবং তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁকে নিষেধ করে বললেন, “আমি তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছি, আর কখনও এরকম কর না। ”

  • শ্লোক: 48
    সর্বজ্ঞ-শিরোমণি চৈতন্য ঈশ্বর ।
    বৈষ্ণবে তাঁহার বিশ্বাস, জানেন অন্তর ।। ৪৮।।
  • অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সর্বজ্ঞ-শিরোমণি পরমেশ্বর ভগবান, তাই তিনি জানতেন যে কালিদাস অন্তরে বৈষ্ণবদের প্রতি কত শ্রদ্ধা-পরায়ণ ছিলেন।

  • শ্লোক: 49
    সেইগুণ লঞা প্রভু তাঁরে তুষ্ট হইলা ।
    অন্যের দুর্লভ প্রসাদ তাঁহারে করিলা ।। ৪৯ ।।
  • অনুবাদঃ- তাঁর সেই গুণের ফলে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে, অন্য সকলের দুর্লভ প্রসাদ তাঁকে দান করেছিলেন।

  • শ্লোক: 50
    বাইশ ‘পাহাচ’-পাছে উপর দক্ষিণ-দিকে ।
    এক নৃসিংহ-মূর্তি আছেন উঠিতে বামভাগে ।। ৫০।।
  • অনুবাদঃ- দক্ষিণ দিকে, বাইশটি সিঁড়ির পশ্চাতে উপরিভাগে এবং মন্দিরে উঠাকালীন বাঁ দিকে নৃসিংহদেবের একটি শ্রীবিগ্রহ আছে।

  • শ্লোক: 51
    প্রতিদিন তাঁরে প্রভু করেন নমস্কার ।
    নমস্করি’ এই শ্লোক পড়েন বারবার ।। ৫১ ।।
  • অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রতিদিন সেই নৃসিংহদেবকে প্রণতি নিবেদন করে বারবার নিম্নলিখিত শ্লোক দুটি আবৃত্তি করতেন।

  • শ্লোক: 52
    নমস্তে নরসিংহায় প্রহ্লাদাহ্লাদদায়িনে ।
    হিরণ্যকশিপোর্বক্ষঃশিলাটঙ্ক-নখালয়ে ।।৫২।।
  • অনুবাদঃ- "“হে নৃসিংহদেব, আমি আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। আপনি প্রহ্লাদ মহারাজকে আনন্দ দান করেন, এবং পাথর কাটার ধারাল টঙ্কের মতো আপনার নখের দ্বারা আপনি হিরণ্যকশিপুর বক্ষ বিদীর্ণ করেছিলেন।” এই শ্লোকটি এবং পরবর্তী শ্লোকটি নৃসিংহ-পুরাণ থেকে উদ্ধৃত।

  • শ্লোক: 53
    ইতো নৃসিংহঃ পরতো নৃসিংহো
    যতো যতো যামি ততো নৃসিংহঃ ।
    বহির্নৃসিংহো হৃদয়ে নৃসিংহো
    নৃসিংহমাদিং শরণং প্রপদ্যে ।।৫৩।।
  • অনুবাদঃ- “নৃসিংহদেব এখানে রয়েছেন এবং তিনি অন্য দিকেও রয়েছেন। যেখানেই আমি যাই, সেখানেই আমি শ্রীনৃসিংহদেবকে দর্শন করি। তিনি আমার হৃদয়ে রয়েছেন এবং তিনি বাহিরেও রয়েছেন। তাই আমি আদিপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের শরণ গ্রহণ করি।”

  • শ্লোক: 54
    তবে প্রভু করিলা জগন্নাথ দরশন ।
    ঘরে আসি’ করিলা মধ্যাহ্ন ভোজন ।।৫৪।।
  • অনুবাদঃ- এইভাবে শ্রীনৃসিংহদেবকে বন্দনা করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জগন্নাথদেবকে দর্শন করলেন, এবং তারপর তাঁর ঘরে ফিরে গিয়ে তিনি মধ্যাহ্ন ভোজন করলেন।

  • শ্লোক: 55
    বহির্দ্বারে আছে কালিদাস প্রত্যাশা করিয়া ।
    গোবিন্দেরে ঠারে প্রভু কহেন জানিয়া ।।৫৫।।
  • অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রসাদ পাওয়ার প্রত্যাশায় কালিদাস দ্বারের বাহিরে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন। তা জেনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু গোবিন্দকে ইঙ্গিতে কিছু বললেন।

  • শ্লোক: 56
    মহাপ্রভুর ইঙ্গিত গোবিন্দ সব জানে ।
    কালিদাসেরে দিল প্রভুর শেষপাত্র-দানে ।।৫৬।।
  • অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ইঙ্গিত গোবিন্দ বুঝতে পারতেন, এবং তাই তিনি তৎক্ষণাৎ মহাপ্রভুর অবশিষ্ট পাত্র নিয়ে কালিদাসকে দিলেন।

  • শ্লোক: 57
    বৈষ্ণবের শেষ-ভক্ষণের এতেক মহিমা ।
    কালিদাসে পাওয়াইল প্রভুর কৃপা-সীমা ।।৫৭।।
  • অনুবাদঃ- বৈষ্ণবের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণের এমনই মহিমা যে তার ফলে কালিদাস শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পরম কৃপা লাভ করলেন।

  • শ্লোক: 58
    তাতে ‘বৈষ্ণবের ঝুটা’ খাও ছাড়ি’ ঘৃণা-লাজ ।
    যাহা হৈতে পাইবা নিজ বাঞ্ছিত সব কাজ ।।৫৮।।
  • অনুবাদঃ- তাই, সমস্ত ঘৃণা এবং লজ্জা পরিত্যাগ করে, বৈষ্ণবের উচ্ছিষ্ট গ্রহণ কর, তাহলে তোমার সমস্ত অভীষ্ট সিদ্ধ হবে।

  • শ্লোক: 59
    কৃষ্ণের উচ্ছিষ্ট হয় ‘মহাপ্রসাদ’ নাম ।
    ‘ভক্তশেষ’ হৈলে ‘মহা-মহাপ্রসাদাখ্যান’ ।।৫৯।।
  • অনুবাদঃ- শ্রীকৃষ্ণের উচ্ছিষ্টকে বলা হয় মহাপ্রসাদ, এবং তা যখন ভক্ত কর্তৃক আস্বাদিত হয় তখন তাকে বলা হয় মহা-মহাপ্রসাদ।

  • শ্লোক: 60
    ভক্তপদধূলি আর ভক্তপদ-জল ।
    ভক্তভুক্ত-অবশেষ, --তিনি মহাবল ।।৬০।।
  • অনুবাদঃ- ভক্তের পদধূলি, ভক্তের পা ধোয়া জল এবং ভক্তের ভুক্তাবশিষ্ট—এই তিনটি বস্তু মহাশক্তিশালী।

  • শ্লোক: 61
    এই তিন-সেবা হৈতে কৃষ্ণপ্রেমা হয় ।
    পুনঃ পুনঃ সর্বশাস্ত্রে ফুকারিয়া কয় ।।৬১।।
  • অনুবাদঃ- এই তিনের সেবার ফলে কৃষ্ণপ্রেম লাভ হয়। সমস্ত শাস্ত্রে বার বার সে কথা উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করা হয়েছে।

  • শ্লোক: 62
    তাতে বার বার কহি, -- শুন ভক্তগণ ।
    বিশ্বাস করিয়া কর এ-তিন সেবন ।।৬২।।
  • অনুবাদঃ- তাই, হে ভক্তগণ, বিশ্বাস সহকারে এই তিনের সেবা করুন।

  • শ্লোক: 63
    তিন হৈতে কৃষ্ণনাম-প্রেমের উল্লাস ।
    কৃষ্ণের প্রসাদ, তাতে ‘সাক্ষী’ কালিদাস ।।৬৩।।
  • অনুবাদঃ- এই তিনের প্রভাবে জীবনের পরম উদ্দেশ্য – কৃষ্ণ-প্রেম লাভ হয়। এইটিই শ্রীকৃষ্ণের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রসাদ। তার প্রমাণ কালিদাস স্বয়ং।

  • শ্লোক: 64
    নীলাচলে মহাপ্রভু রহে এইমতে ।
    কালিদাসে মহাকৃপা কৈলা অলক্ষিতে ।।৬৪।।
  • অনুবাদঃ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এইভাবে নীলাচলে অবস্থান করছিলেন, এবং অলক্ষিতে তিনি কালিদাসকে মহাকৃপা করলেন।

  • Post a Comment

    0 Comments