পুরুষোত্তম নামের মহিমা:-

পুরুষোত্তম নামের মহিমা:-





 পুরুষোত্তম মাস কি?|| পুরুষোত্তম মাসের আগমনের কারণ কি?|| কেন এ মাস এতো মহিমান্বিত?|| পুরুষোত্তম নামের মহিমা || পুরুষোত্তম মাসের লীলা বর্ণনা || পুরুষোত্তম মাস বা অধিক মাস কি? || পুরুষোত্তম মাসের/ব্রতের মহিমা || দ্রোপদীর দুঃখের কারণ || পুরুষোত্তম মাসে করণীয় || প্রয়োজনীয় মন্ত্রাবলী ||তুলসীকাঠের প্রদীপের মাহাত্ম্য এবং কিভাবে বানাবেন || শ্রী শ্রী চৌরাগ্রগণ্যপুরুষাষ্টকম্ || পুরুষোত্তম ব্রত উৎযাপনের সুফল 🌸


☀আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ খৃষ্টাব্দ ০১ আশ্বিন ১৪২৭ রোজ শুক্রবার থেকে পুরুষোত্তম মাস শুরু।তাই আসুন জেনে নেই 👇


🌿 পুরুষোত্তম নামের মহিমা:-


পুরুষোত্তম পরমেশ্বর ভগবান শ্রী কৃষ্ণের একটি নাম। ‘পুরুষ’ অর্থাৎ ভোক্তা বা ভগবান; উত্তম মানে আধ্যাত্মিক। পুরুষোত্তম মানে ‘আধ্যাত্মিক পরম ভগবান’। ভগবদগীতার ১৫তম অধ্যায়কেও পুরুষোত্তম যোগ বলা হয়।


🌿 পুরুষোত্তম মাসের লীলা বর্ণনা:-


পান্ডবেরা শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করতেন ভক্ত হয়েও কেন জীবদ্দশায় তাদেরকে বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হয়েছিল। একটি পুরাণে বর্ণনা করা হয়েছে যেহেতু তারা যথাযথভাবে পুরুষোত্তম মাস পালন করেননি সে অপরাধের কারণে তাদেরকে এত দুদর্শা ভোগ করতে হয়েছিল। এবং আমদের পূর্বকৃত অপরাধ এড়াতে বা খন্ডন করতে কৃষ্ণও এই অতি শীঘ্রই আসন্ন পুরুষোত্তম মাস পালনের প্রস্তাব করেছেন। এভাবে পুরুষোত্তম মাসের পূর্বে কোন নাম ছিল না, এটি ছিল একটি অতিরিক্ত মাস, সংস্কৃতে যাকে বলা হয় অধিক মাস।

তার কিছু না থাকার কারণে তিনি খুবই হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। অন্যান্য সকল মাসেরই বিভিন্ন অবতারের প্রতি, রাধারাণীর প্রতি বা অন্য কোন বিশেষ নিবেদন ছিল। কিন্তু এটি একটি অতিরিক্ত মাস হওয়াতে এমাসে কিছু সংঘটিত হত না। দু’টি বিশেষ একাদশী থাকা সত্ত্বেও কিছু ব্যক্তি একে অমঙ্গলজনক মাস হিসেবে গণ্য করত। তাই তার সমস্যা সমাধনের জন্য তিনি বিষ্ণুর নিকট প্রার্থনা করলেন এবং বিষ্ণু তাকে গোলক বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের নিকট নিয়ে গেলেন। তিনি অত্যন্ত দুঃখিত ছিলেন কেননা তার জীবনে কোন লক্ষ্য ছিলনা, কোন উদ্দেশ্য ছিলনা; তিনি কাঁদছিলেন। গোলক বৃন্দাবনে, শ্রীকৃষ্ণের পরম আলয়ে, কৃষ্ণ তাকে বললেন, “তুমি এখানে কেন কাঁদছ? এটি চিন্ময় জগৎ, এখানে কেউ কাঁদে না, এখানে কোন দুর্দশা নেই” কিন্তু তার জীবনে কোন লক্ষ্য ছিলনা, তিনি কেবল তাঁর পদকমলকেই আশ্রয় করতে চেয়েছিলেন।

সুতরাং কৃষ্ণ তাকে তাঁর আশ্রয়ে নিলেন এবং তাকে পুরুষোত্তম নামে আখ্যা দিলেন। এমাসে যে কর্মই করা হোক না কেন, আধ্যাত্মিক বা ভক্তিমূলক, সবকিছুই হাজার গুণ বা ততোধিক ফল লাভ করে। এটি অত্যন্ত বিশেষ, এবং (কৃষ্ণ বলেছেন), “এই মাস আমার থেকে অভিন্ন”। একারণে যে ব্যক্তি এ মাস পালন করেন না, তিনি জীবনে বিভিন্ন বাঁধার সম্মুখীন হতে পারেন। যে সকল ভক্তরা নিয়মিত জপ করেন, নিয়মগুলো পালন করেন এবং ভক্তিমূলক সেবা করেন, তাদের কোন সমস্যা হবে না; কিন্তু যারা এখনো প্রারম্ভিক স্তরেই রয়েছেন, বা এখনো নিয়মিত নন, এটি তাদের জন্য নিয়মিত ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে?


🌿 পুরুষোত্তম মাস বা অধিক মাস কি? 


প্রাচীন জ্যোতিষ গ্রন্হাবলিতে অধিক মাস সম্পর্কে অনেক তথ্য রয়েছে। আমরা যে গৌরাব্দ পঞ্জিকা ব্যবহার করি এটি সরাসরি চান্দ্রীয় বর্ষগননা পদ্ধতি নয়। আসলে চান্দ্র ও সৌরবর্ষের একটি মিশ্রণ। এ বিষয়ে জানতে হলে প্রথমে সৌর ও চান্দ্রমাসের সম্পর্ক সম্বন্ধে জানতে হবে।

সৌর ও চান্দ্রমাস: 'রাশিসংক্রমণাৎ সৌর'রাশিচক্রে যে বিন্দু হতে গ্রহসমূহের অবস্থান নির্ণয় করা হয়, তাকে আদিবিন্দু বলে। গৃহীত স্থির আদিবিন্দু হতে ত্রিশ অংশ অন্তরে সূর্যকেন্দ্র আসলে তাকে সংক্রান্তি বলা হয়। এক সংক্রান্তি থেকে অপর সংক্রান্তি পর্যন্ত সৌরমাস গননা করা হয়।গরে প্রতি সৌরমাসের দৈর্ঘ্য ৩০ দিন, ১০ ঘন্টা, ৩০ মিনিট, ৪৬ সেকেন্ড। ১ সৌরবর্ষে মোট ৩৬৫.২৫৮৭ দিন। আবার, ‘দর্শান্তশ্চান্দ্রমাসক':- কোনো সৌরমাসে যে আমাবস্যা হয়,তার পরবর্তী দিন থেকে যে মুখ্য চান্দ্রমাস ধরা হয়, তার নাম ঐ সৌরমাসের নামে নামাঙ্কিত করা হয়।গরে প্রতি চান্দ্রমাস ২৯ দিন, ১২ ঘন্টা, ৪৪ মিনিট, ৩ সেকেন্ডে পূর্ণ হয়।চান্দ্র বছরে মোট ৩৬০ টি তিথি থাকে। লক্ষণীয় চান্দ্রমাস ও সৌরমাসের দৈর্ঘ্যের পার্থক্যের কারনে প্রতি মাসে ১৯ থেকে ২৬ ঘন্টা ( গরে ২৩ ঘন্টা, ৩৭ মিনিট ও ২৮ সেকেন্ড) একটি ব্যবধান থেকে যায়। অর্থাৎ চান্দ্রবর্ষের ৩৬০ টি তিথিতে ৩৫৪.৩৬ সৌরদিন লাগে।ফলে প্রতি বছর চান্দ্র ও সৌরমাসের মধ্যে ১০ দিন,২১ ঘন্টা, ৩৫ মিনিটের পার্থক্য হয়। এই অতিরিক্ত ১০ দিন,২১ ঘন্টা (২৯.৫৩*১০.৬৩)গরে ২.৭১ বছর বা ৩২.৫ মাসে সমন্বয় করা হয়। ৩২ টি সৌরমাসের জন্য ৩৩ টি চান্দ্রমাস মোটকথা, চান্দ্র ও সৌর বর্ষে মধ্যে সমন্বয় রাখার জন্য তিনটি সৌর বছরের মধ্যে একটি অতিরিক্ত মাস সমন্বয় করতে হয়, সাধারণত, প্রতি ১৯ বছরে ৭ টি অধিকমাস পরে। এটি নির্ভর করে গ্রহসঞারের সময়ের ওপর ভিত্তি করে কখনো সেটি ২৮ মাস, কখনো ৩১,৩২,৩৩, বা ৩৫ মাস হতে পারে। এজন্য মহাভারতে পাঁচ বছরে দুইটি অতিরিক্ত মাসের কথা বলা হয়েছে। 

কেননা প্রতি তিনবছর পর পর এমনি সময় আসে যখন সূর্যের একটি রাশিতে ভ্রমণের সময়ে বা একটি সৌরমাসে দুটি অমাবস্যা বা তিনটি প্রতিপদ চলে আসে। প্রথমে প্রতিপদের পর থেকে অধিক মাস শুরু হয়।দ্বিতীয় অমাবস্যা পরবর্তী প্রতিপদ থেকে প্রকৃত সৌরমাস হিসাব করা হয়। অধিক মাসে সৌর সংক্রান্তি হয় না। অধিক মাসকে সৌরবছরের কোনো মাসের সাথে সংযুক্ত করে নামকরন করা হয়। যে চান্দ্র মাস সূর্য একটি রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন করে না, বরং মাসজুড়ে একটি নির্দিষ্ট রাশিতেই অবস্থাান করে, তাহলে সেই মাসটির নাম পরবর্তী মাসের নাম অনুসারে হয় এবং এর সাথে অধিক শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়। কার্তিক ও মাঘ মাসে কখনো অধিক মাস হয় না।

উদাহরণ হিসেবে, যদি কোনো মাসে সূর্য মেষ রাশিতে গমন না করে পরনর্তী রাশিতেই স্থিত থাকে। তবে ঐ মাসটির নাম হবে অধিক চৈত্র মাস। পরবর্তী মাসে সূর্য অন্য রাশিতে গমন করে, তাই সেই পরবর্তী মাসটি শুধু চৈত্র নামে পরিচিত হয়।

এই অধিমাস সংযোজন কৃক্রিম নয়, বরং স্বাভাবিক। উপরন্তু বৈদিক শাস্ত্রের অভ্রান্ততার একটি নিদর্শন। অতিরিক্ত মাসের সমন্বয় না করা হতো তবে কি হতো? তখন আমরা বিভিন্ন ঋতুতে পালনীয় ভগবানের ব্রত উৎসবাদি উদযাপন করতে পারতাম না। তখন বৈশাখ মাসের গ্রীষ্মের দাবদাহের সময় পালিত চন্দযাত্রা মহোৎসব কখনো কখনো চলে যেত মাঘ মাসের হাড় কাপানো শীতের সময়। এই গরমিল দূর করার লক্ষ্যেই অধিমাসের সংযোজন।


বাংলা বর্ষপঞ্জিতে মোটামুটি দুই থেকে তিন বছর পরপর একটি অধিক মাস দেখা যায়। চান্দ্র ও সৌরবর্ষের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য অতিরিক্ত একটি মাস হিসাব করা হয়। এই অতিরিক্ত মাসটিকেই পুরুষোত্তম মাস বলা হয়। এটি অনেকটা ইংরেজি অধিবর্ষের মতো।

যেহেতু অধিমাসে কোন পালনীয় তিথি বিদ্যমান থাকে না, তাই কোনো বৈদিক কর্মকাণ্ড এই মাসে পালিত হয় না। সেজন্য স্মার্ত পণ্ডিতেরা অধিমাসকে 'মলমাস' বা 'মলিনমাস' বলে ঘৃণা করেন। কিন্তু পরমার্থ-শাস্ত্র এ অধিমাসটিকে সর্বোপরি শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছে। যেহেতু এ মাসটি সকল প্রকার সকাম কর্মশূণ্য, তাই সেটি হরিভজনের জন্য অধিক উপযোগী। স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরম পবিত্র বৈশাখ, কার্তিক, মাঘ মাস অপেক্ষা এই অধিমাসকে অধিক মহিমা প্রদান করেছেন এবং একে নিজ নাম ‘পুরুষোত্তম দ্বারা অলংকৃত করেছেন।


🌿 পুরুষোত্তম মাসের/ব্রতের মহিমাঃ-


বছরে বারোটি মাসের আধিপত্য দেখে, অধিকমাস বৈকুণ্ঠাধিপতি শ্রীনারায়ণকে নিজ দুঃখ জ্ঞাপন করেছিলেন। তিনি কৃপাপূর্বক অধিমাসকে সঙ্গে নিয়ে গোলকে শ্রীকৃষ্ণের কাছে উপনীত হলেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন বললেন -

“হে রমাপতি! আমি যেরূপ এ জগতে পুরুষোত্তম নামে বিখ্যাত -এই অধিমাস ও তদ্রুপ ত্রিলোকে পুরুষোত্তম বলে বিখ্যাত হবে। আমাতে যে সমস্ত গুণ আছে, সে সব আমি এই মাসে অর্পণ করলাম। আমার সদৃশ হয়ে এই অধিমাস অন্য সকল মাসের অধিপতি হবে। এই মাস জগৎপূজ্য ও জগৎবন্দ্য। অন্য সকল মাস সকাম, এই মাসটি নিষ্কাম। যিনি সকল প্রকার কামনাশূণ্য বা কামনা যুক্ত হয়েও এই মাসের পূজা করেন, তিনি সকল কর্ম ভস্মসাৎ করে আমাকে প্রাপ্ত হন। যদিও আমার ভক্তদের কদাচিৎ অপরাধ হয়, কিন্তু এই পুরুষোত্তম মাসে ভক্তদের কখনই অপরাধ হবে না। 

যে সকল মহামূঢ় এই অধিমাসে জপ-দানাদি বর্জিত ও সৎকর্ম-স্নানাদি রহিত থাকে এবং দেব, তীর্থ ও দ্বিজগণের প্রতি বিদ্বেষ করে, সেই সকল দুষ্ট দুর্ভাগা পরভাগ্যোপজীবী হয়ে স্বপ্নেও কোনো সুখ পায় না। এই পুরুষোত্তম মাসে যিনি আমাকে ভক্তিপূর্বক অর্চন করেন, তিনি ধন-পুত্রাদি লাভে সুখ ভোগ করে অবশেষে গোলোকবাসী হন।”

নারদ মুনিকে ভগবান শ্রীনারায়ণ পুরুষোত্তম ব্রতের মহিমা সম্পর্কে বললেন- “এটি শুধু জাগতিক সুখই প্রদান করে না, ভগবদ্ধামে ফিরে যাবার যোগ্যতা প্রদান করবে।”

ভগবান নারায়ণের নিকটে এই পুরুষোত্তম মাসের মহিমা শ্রবণ করে নারদ মুনি অত্যন্ত প্রীত হলেন । তিনি বারবার দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদন করে বলতে লাগলেন,“এই পুরুষোত্তম মাস সকল মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এমনকি যদি কেউ ভক্তিভরে কেবল এই ব্রত মাহাত্ম্য শ্রবণও করে, সে অচিরেই ভগবত সেবা লাভ করেন এবং সকল পাপ কর্ম ফল থেকে মুক্ত হন । পুরুষোত্তম ব্রত প্রভাবে অচিরেই সকল সৌভাগ্য লাভ করে গোলক বৃন্দাবনে গমন করেন।”


🌿 ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদীর দিকে করুণাদৃষ্টি নিক্ষেপ করে অর্জুনকে বলতে লাগলেন,“হে পুরুষব্যাঘ্র, তোমরা কি তোমাদের দুঃখের কারণ জানো ? তোমরা আমার প্রিয় ও অত্যন্ত দুর্লভ পুরুষোত্তম ব্রত পালন করনি। এজন্য তোমরা দুঃখ পাচ্ছ। তোমরা ব্যাসদেবের উপদেশে সমস্ত বর্ণাশ্রমোচিত আচার পালন করেছ। কিন্তু পুরুষোত্তম মাসের পূজা না করা পর্যন্ত আমাতে শুদ্ধভক্তি লাভ করতে পারবে না।”

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলতে লাগলেন, “আমি এখন দ্রৌপদীর পূর্বজন্ম বৃত্তান্ত বলব। পূর্বজন্মে দ্রৌপদী মেধা ঋষির কন্যা ছিলেন। শৈশবেই তার মাতৃবিয়োগ হলে তিনি পিতার তত্ত্বাবধানে পালিত হন। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন তার পিতৃবিয়োগ হলো। তখন তার অবস্থা আরও শোচনীয় হলো। সৌভাগ্যক্রমে একদিন দুর্বাসা মুনি সেখানে আগমন করলেন। দুর্বাসা মুনিকে তিনি তার সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার কথা বর্ণনা করেন।

দুর্বাসা মুনি বললেন, “পুত্রী, আগামী তিন মাসের মধ্যে পরমপবিত্র পুরুষোত্তম মাস শুরু হবে। এই পবিত্র মাসটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট সবথেকে প্রিয়। দয়া করে আসন্ন পুরুষোত্তম মাসকে যত্ন সহকারে পূজা করতে ভুলো না।”

দুর্ভাগ্যবশত সেই ব্রাহ্মণকন্যা তাঁর কথায় বিশ্বাস করলেন না। বরং ক্রোধান্বিতা হয়ে নিন্দাপূর্ণ বাক্য বলতে লাগল,“হে মহামুনি, আপনি মিথ্যা বলছেন। কীভাবে এই অতিরিক্ত মাসটি, যাকে মলমাস বলা হয়, তা অন্য সকল মাস এমনকি, কার্তিক বা মাঘ বা বৈশাখ হতেও শ্রেষ্ঠ হবে ?

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলতে লাগলেন,“হে অনঘ ! দুর্বাসা মুনি চলে যাওয়ার সাথে সাথে ব্রাহ্মণকণ্যা তার সমস্ত ঐশ্বর্য হারালো। পুরুষোত্তম মাসের প্রতি অপরাধের ফলে সে কুৎসিত দেহ লাভ করল। তখন সে মহাদেব শিবের আরাধনা করতে মনস্থ করল।” ধ্যানে তার নয় হাজার বছর অতীত হলে শ্রীশিব তার সম্মুখে আবির্ভূত হলেন ও বর দিতে চাইলেন, তখন ব্রাহ্মণকন্যা বলতে লাগল,“হে দীনবন্ধু, আমাকে গুণবান স্বামী প্রদান করুন।”একথাটি সে পরপর পাঁচবার বলল। তখন শিব বললেন, “যেহেতু তুমি পাঁচবার এ কথাটি বলেছ, তাই তোমার পঞ্চস্বামী হবে।”

পরবর্তীতে ব্রাহ্মণকণ্যা দ্রুপদ রাজার কন্যা দ্রৌপদী হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন এবং ঘটনাক্রমে পঞ্চপাণ্ডবকে পতি হিসেবে লাভ করেন। অতঃপর ক্রমান্বয়ে বস্ত্রহরণ, বনবাস, পুত্রবিয়োগাদি নানা দুঃখসমুদ্রে পতিত হন। বনবাসের সময় তাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে এত দুঃখের কারণ এবং নিস্কৃতির উপায় জিজ্ঞেস করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্রৌপদীর পূর্বজন্মে পুরুষোত্তম ব্রতের অবজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এই ব্রত আচরণ করে, সকলে বনবাস দুঃখের পার প্রাপ্ত হন।


নৈমিষারণ্যে ঋষিগণ পরস্পর বলতে লাগলেন,“ওহ! এই পুরুষোত্তম মাস সব থেকে মহিমাপূর্ণ এবং এর ইতিহাস অতি প্রাচীন। এটি কল্পতরুর ন্যায় ভক্তদের সমস্ত বাসনা পূরণে সমর্থ। পুরুষোত্তম মাসের জয় হোক।”


🌿 পুরুষোত্তম মাসে করণীয়ঃ-


স্মার্তগণ পুরুষোত্তম মাস বা অধিমাসকে 'মলমাস' বলে এই মাসে সমস্ত শুভকার্য পরিত্যাগ করে থাকেন। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই মাসকে পারমার্থিক মঙ্গলের জন্য অন্য সকল মাস থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে নির্ণয় করেছেন । তিনি নিজের নাম অনুসারে এই মাসের নাম “পুরুষোত্তম” মাস রেখেছেন ।


শ্রীবাল্মিকী-দৃঢ়ধন্বা সংবাদে উক্ত আছে,

পুরুষোত্তম মাসস্য দৈবতং পুরুষোত্তমঃ।

তস্মাৎ সম্পজয়েদ্ভক্ত্যা শ্রদ্ধয়া পুরুষোত্তমম্ ॥


-হে দৃঢ়ধন্বা! পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণই পুরুষোত্তম মাসের অধিদেবতা। অতএব সেই মাসে প্রতিদিন ভক্তি-শ্রদ্ধাপূর্বক পুরুষোত্তম কৃষ্ণকে ষোড়শোপচারে পূজা করবে।

নৈমিষারণ্যক্ষেত্রে শ্রীসূত গোস্বামী সমবেত ঋষিদের বললেন-

“ভারতভূমিতে জন্মলাভ করে যে গৃহাসক্ত নরাধমগণ শ্রীপুরুষোত্তম ব্রতকথা শ্রবণ ও ব্রত পালন করে না, সেই দুর্ভাগাগণ জন্ম -মরণ এবং পুত্র-মিত্র, কলত্র ও নিজজন বিয়োগজনিত দুঃখভাগী হয়। 

হে দ্বিজবরগণ, এই পুরুষোত্তম মাসে বৃথা কাব্যালংকারাদি আলোচনা করবে না, পরশয্যায় শয়ন এবং অনিত্য বিষয়ালাপ করবে না; পরনিন্দা, পরান্নভোজন ও পরকার্য করবে না, বিত্তশাঠ্য পরিত্যাগপূর্বক ব্রাহ্মণকে দান করবে।

ধন থাকার পরেও বিত্তশাঠ্য করলে রৌরব গমনের কারণ হয়। 

প্রতিদিন বৈষ্ণব ব্রাহ্মণদিগকে উত্তম ভোজন দিবে। 

ব্রতী নিজে দিবসের অষ্টম ভাগে ভোজন করবে। ইন্দ্রদ্যুম্ন, যৌবনাশ্ব ও ভগীরথ প্রমুখ রাজাগণ শ্রীপুরুষোত্তমকে আরাধনা করে ভগবৎসামীপ্য লাভ করেছিলেন। সর্বপ্রকার যত্নের সাথে পুরুষোত্তমের সেবা করবে। এই সেবা সকল সাধন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং সর্বার্থ ফলপ্রদ। “গোবর্ধন ধরং” এই মন্ত্র জপ করে কৌণ্ডীন্য মুনি পুরুষোত্তমকে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। নবঘন-দ্বিভুজ মুরলীধর, পীতাম্বর শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীরাধার সাথে নিয়ত ধ্যান করতে হবে। যিনি পুরুষোত্তম মাসে ভক্তিপূর্বক এরূপ করেন তিনি সর্বাভীষ্ট লাভ করেন।”

পুরুষোত্তম মাসে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধানার্থে নানাবিধ ব্রতনিয়ম গ্রহণ করা যেতে পারে। কিভাবে সময়ের সর্বোচ্চ উপযোগ করে ভগবানের সেবা করা যায় সেটাই সংকল্প হওয়া উচিত। তবে সর্বাগ্রে এটা খেয়াল রাখা উচিত যে নিয়মগুলো (ব্রতের সংকল্প) যেন শুধু লোক দেখানো বা নিয়মাগ্রহ না হয়ে থাকে। ব্রত এর সময়সীমা পর্যন্ত যেন সেগুলো পালন করা যায় সেটাও বিবেচনা করতে হবে।


🌿 বিভিন্ন রকম নিয়ম গ্রহণ করা যেতে পারে। যথা -


১. ব্রাহ্মমুহূর্তের পূর্বে গাত্রোত্থান করে স্নান ও মঙ্গল আরতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত।

২. প্রতিদিন নির্ধারিত সংখ্যামালার অতিরিক্ত (২৪, ৩২,৩৩,৪৮,৬৪ বা তদুর্ধ্ব) জপ করা উচিত এবং যত বেশি সম্ভব হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তনে অংশগ্রহণ করা উচিত।

৩. প্রতিদিন চৌরাগ্রগণ্য পুরুষাষ্টকম, জগন্নাথাষ্টকম্, নন্দনন্দনাষ্টকম্, রাধা-কৃষ্ণ কৃপাকটাক্ষস্তোত্রম প্রভৃতি নিজাভীষ্ট স্তোত্রাবলি পাঠও পূর্বতন আচার্যকৃত ভজন কীর্তন করা উচিত।

৪. এ মাসে ৩৩ সংখ্যাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাধা-কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে ৩৩বার দন্ডবৎ প্রণাম, ৩৩ সংখ্যক প্রদীপ দান, ৩৩ সংখ্যক ফল ও পুষ্প প্রদান প্রভৃতি যেকোনো সেবায় ৩৩ সংখ্যার ব্যবহার। (পুরাণে বর্ণিত আছে, এই মাসে কৌশিক মুনি ও তারপুত্র মৈত্রেয় মুনি ব্রাহ্মণগণকে ৩৩ সংখ্যক আপূপ দান করেছিলেন।) আপূপ- আতপ চাল, শর্করা ও ঘৃত দ্বারা তৈরি পিষ্টক বিশেষ)

৫. পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টির জন্য প্রতি সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রদান করা কর্তব্য। সামর্থ্য থাকলে ঘৃত প্রদীপ নতুবা তিল-তৈল প্রদীপ দেওয়া উচিত।

৬. প্রতিদিন শ্রীমদ্ভাগবত ও অন্যান্য সদ্গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করা উচিত। বিশেষ করে শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্দে বর্ণিত ব্রহ্মস্তুতি ও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়।

৭. পুরুষোত্তম মাসে ভক্তিপূর্বক শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থ শ্রবণ করবে ।

৮. ভক্তগণ শ্রীশালগ্রাম শিলার অর্চন করবেন।

৯. পুরুষোত্তম ব্রতী হবিষ্যান্ন ভোজন করবেন । গম,আতপ চাল, মুগডাল, যব, তিল, মটর, কাঙ্গলী তণ্ডুল, উড়ি তন্ডুল, বেতোশাক, হেলেঞ্চা শাক, আদা, কালশাক, মুলক, কন্দমূল, কাঁকুড়, কলা, সৈন্ধব ও সামুদ্রিক লবণ, দধি, ঘৃত, অনুদ্বৃত দুগ্ধসার, কাঁঠাল, আম, হরিতকি, পিপ্পল, জিরা, শুঁঠ, তেঁতুল, ক্রমুক, আতা, আমলকি, ইক্ষুজাত চিনি, মিশ্র অতৈলপক্ব ব্যঞ্জনাদি দ্রব্য-এ সমস্তই হবিষ্যান্ন। ছোলা ডাল, তিল তৈল, কাঁকরযুক্ত অন্ন, ভাবদুষ্ট-ক্রিয়াদুষ্ট-শব্দদুষ্ট দ্রব্যসকল পরিত্যাগ করবে।

১০. পরান্ন ভোজন, পরদ্রোহ, পরদার গমন পরিত্যাগ করবে ।

১১. পুরুষোত্তম মাসে দেবতা, বেদ, গুরু, গো, ব্রতী, স্ত্রীলোক, রাজা ও মহাজনদের নিন্দা পরিত্যাগ করবে।

১২. ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ অমৈথুন, অধঃশয্যা, পত্রাবলীতে ভোজন পুরুষোত্তম মাসে প্রশস্ত।


🌿 প্রয়োজনীয় মন্ত্রাবলীঃ


অর্ঘ্য:

দেব দেব নমস্তুভ্যং পুরাণ পুরুষোত্তম।

গৃহাণার্ঘ্যং ময়া দত্তং রাধয়া সহিত হরে ॥


নীরাজন:

নীরাজয়ামি দেবেশমিন্দীবর-দলচ্ছবিম্।

রাধিকারমণং প্রেম্না কোটীকন্দর্প সুন্দরম্ ॥


ধ্যান:

অন্তর্জ্যোতিরত্ন রত্নরচিতে সিংহাসনে সংস্থিতম্।

বংশনাদ-বিমোহিত-ব্রজবধু-বৃন্দাবনে সুন্দরম্ ॥

ধ্যায়েদ্ রাধিকয়া সকৌস্তভমণি-প্রদ্যোতিতোরস্হলম্।

রাজেদ্ রত্নকীরিট-কুণ্ডলধরংপ্রত্যগ্রপীতাবম্বরম্ ॥


প্রণাম ও পুষ্পাঞ্জলি:

বন্দে নবঘনশ্যামং দ্বিভুজং মুরলীধরং।

পীতাম্বরধরং দেবং সরাধং পুরুষোত্তমম্ ॥

নৌমি নবঘনশ্যামং পীতবাসসমুচ্যতং।

শ্রীবৎসভাসিতোরস্কং রাধিকাসহিতং হরিম্ ॥


জপ:

গোবর্দ্ধনধরং বন্দে গোপাল গোপরূপিণম্।

গোকুলৎসবমীশানং গোবিন্দং গোপীকাপ্রিয়ম ॥


🌿 এই মহাপবিত্র মাসে রয়েছে একসাথে একলক্ষ প্রদীপ নিবেদনের সুযোগ!


পদ্মপুরাণে বর্ণনা করা হয়েছে, যদি কেউ শুষ্ক তুলসী কাষ্ঠের মাধ‍্যমে ভগবানকে শ্রীকৃষ্ণকে প্রদীপ নিবেদন করে, তাহলে সাধারণ প্রদীপ নিবেদনের চেয়ে ভগবান এক্ষেত্রে লক্ষগুণ বেশি সন্তুষ্ট হন।

সহজভাবে বলা হলে, সাধারণ প্রদীপ ১ লক্ষ বার নিবেদন করা হলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যতটা সন্তুষ্ট হন, একটি তুলসীকাঠের প্রদীপ নিবেদন করা হলে ভগবান তার চেয়েও বেশি সন্তুষ্ট হন।

আগত পুরুষোত্তম মাসে শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে চৌরাগ্রগণ‍্যপুরুষাষ্টকম্ কীর্তনের সাথে সাথে প্রদীপ নিবেদন করা কর্তব‍্য।সেক্ষেত্রে সকলেই তুলসীকাঠের প্রদীপ নিবেদন করতে পারেন।


🌿 কীভাবে তৈরী করবেন তুলসীকাঠের প্রদীপ: 


১. প্রথমে শুকনো তুলসীবৃক্ষ খোঁজ করতে হবে।

অনেকেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে অনেকসময় তুলসীবৃক্ষ শুষ্ক হয়ে যায়, সব পাতা ঝরে যায়, তুলসী দেহত‍্যাগ করেন, সেই শুষ্ক বৃক্ষ জলে ভাসিয়ে বা মাটিতে পুতে দেয়া হয়। প্রদীপের জন‍্য এরকম শুষ্ক তুলসী সংগ্রহ করতে হবে। যদি তাজা বৃক্ষ থেকে কাঠ সংগ্রহ করা হয়, সেটাতে হিতে বিপরীত হবে!

২. শুকনো তুলসীর ডাল ধুয়ে শুঁকিয়ে নিতে পারেন।

৩. শুকনো ডাল গুলো ৬ বা ৭ ইঞ্চি করে কেটে নিতে হবে। (আরো বড় কাটা যেতে পারে, কিন্তু বেশি ছোট কাটা হলে প্রদীপের আগুনের আঁচ হাতে লাগতে পারে)

৪. এবার তুলা নিয়ে একেকটি ডালে সমানভাবে পেচাতে হবে। সবগুলো ডালে তুলো পেচিয়ে এভাবে সলিতা বানিয়ে রেখে দিতে পারেন।

৫. প্রদীপ নিবেদনের আগে তুলা পেচানো তুলসীর ডালের সলিতাগুলো ঘিয়ে ডুবিয়ে তারপর অতিরিক্ত ঘি সরিয়ে দিয়ে সলিতাগুলোর মাথায় কর্পূর লাগাতে হবে।

৬. এরপর কর্পূরে আগুন জ্বালালে আস্তে আস্তে পুরো সলিতাটিয় জ্বলে উঠবে, সেক্ষেত্রে আগুন জ্বালানোর শুরু থেকেই প্রদীপ নিবেদন শুরু করা উচিত।

৭. নতুনদের জন‍্য সতর্কতা হিসেবে পুরুষোত্তম-প্রদীপ-নিবেদনের আগেই একদিন সলিতা তৈরি করে প্রদীপ নিবেদন করে চেষ্টা করে দেখতে পারেন, সলিতার জন‍্য তুলসী কাঠ আরো বড় করে কাটা লাগবে কীনা, বা তুলা আরো বেশি পেচাতে হবে কীনা, ঘি আরো অধিক লাগবে কীনা ইত‍্যাদি। প্রয়োজনে প্রদীপের মধ‍্যেও তুলসীকাঠের সলিতাগুলো নিয়ে নিবেদন করতে পারেন। 

৮. আরতি নিবেদনের জন‍্য, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীনিতাইগৌর, শ্রীনৃসিংহদেব, শ্রীবিষ্ণুকে চরণে চারবার, উদরে দুইবার, মস্তকে তিনবার এবং সর্বাঙ্গে সাতবার প্রদীপ নিবেদন করতে হয়। আর, শ্রীমতী রাধারাণী, শ্রীলক্ষ্মীদেবী, শ্রীতুলসীদেবীকে সর্বাঙ্গে সাতবার প্রদীপ নিবেদন করা উচিত। শ্রীরাধাকৃষ্ণের পর শ্রীজগন্নাথ-বলদেব-সুভদ্রাকে (প্রত‍্যেককে সাতবার করে), এরপর শ্রীনৃসিংহদেব ও তারপর শ্রীনিতাইগৌরকে প্রদীপ নিবেদন করতে হয়। এরপর তুলসীদেবীকে নিবেদনের পর শ্রীগুরুপরম্পরাকে। গুরুপরম্পরায় প্রত‍্যেককে সাতবার বা পাঁচবার নিবেদন করতে হবে। তবে, যেহেতু প্রদীপ ইতোমধ্যে ভগবানকে নিবেদন করা হয়েছে, তাই এটি গুরুপরম্পরা, যেহেতু জীবতত্ত্ব তাই তাদের কেবল মুখমণ্ডলে প্রদীপ নিবেদনের জন‍্য আচার্যগণ বলে থাকেন। সকল আরতির ক্ষেত্রেই এই নিয়ম প্রযোজ্য। 

সময়স্বল্পতা থাকলে (গৃহে বা মন্দিরে না থাকলে, বা কোনো প্রয়োজন থাকলে) কেবল শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ ও শ্রীগৌরনিতাইকে তথা অন‍্য ভগবৎবিগ্রহকে প্রদীপ নিবেদন করতে পারেন।


নিজে তুলসীকাঠের সলিতার প্রদীপ নিবেদনের মহিমা জেনে ভগবানকে নিবেদন করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধান করুন, অন‍্যকে জানিয়ে উৎসাহিত করে তার ও আপনার নিজের ভগবানকে আরো অধিক সন্তুষ্ট করার সুযোগ গ্রহণ করুন।


বিঃদ্রঃ-অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন তুলসীকাঠের প্রদীপ গুরুপরম্পরাকে নিবেদন ঠিক হবে কি না?

আসলে, যেকোনো আরতিই ভগবানকে নিবেদনের পর গুরুপরম্পরাকে ভগবানের প্রসাদরূপে দেখানো হয়। ধূপ, দীপ ইত‍্যাদি, পুষ্পব‍্যাতীত সকল আরতিই তুলসীযুক্ত জলে প্রৌক্ষণ করে ভগবানকে নিবেদন করা হয়, ঐ তুলসীযুক্ত আরতিই প্রসাদরূপে গুরুপরম্পরাকে নিবেদন করা হয়। তএমনি তুলসীযুক্ত ভগবৎমহাপ্রসাদও গুরুপরম্পরাকে দেওয়া হয়। এতে কোনো শাস্ত্রবিরুদ্ধ কাজ হয়না। কারণ তা প্রসাদরূপে নিবেদিত হয়। আর আরতিসমুহ এক্ষেত্রে গুরুপরম্পরাকে বক্ষ পর্যন্ত নিবেদিত হয়। তাই এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।]


🌿 এছাড়াও পুরুষোত্তম মাসে প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় তিল বা ঘৃত এর সহিত কর্পূর মিশ্রিত প্রদীপ ভগবানের চরণে ৪ বার, নাভিকমলে ২ বার, মুখমন্ডলে ৩ বার এবং সর্বাঙ্গে ৭ বার ঘড়ির কাটার ন্যায় ডানদিকে থেকে দেখাবেন এবং নিম্নোক্ত অষ্টকমটি কীর্তন করে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ঘৃত প্রদীপ নিবেদন করা উচিত।


🌿 শ্রী শ্রী চৌরাগ্রগণ্যপুরুষাষ্টকম্ঃ

-শ্রী বিল্বমঙ্গল ঠাকুর


ব্রজে প্রসিদ্ধং নবনীতচৌরং

গোপাঙ্গনানাং চ দুকূলচৌরম্।

অনেক জন্মার্জিত পাপচৌরং

চৌরাগ্রগণ্যং পুরুষং নমামি ॥১॥

অনুবাদ: যিনি ব্রজে নবনীত চোর ও গোপাঙ্গনাদের বসন চোর বলে প্রসিদ্ধ ও যিনি স্বীয় ভক্তদের অশেষ জন্মার্জিত পাপ সকল হরণ করেন, সেই চোর শিরোমণিকে আমি নমস্কার করি।


শ্রীরাধিকায়া হৃদয়স্য চৌরং

নবাম্বুদশ্যামলকান্তিচৌরং

পদাশ্রিতানাং চ সমস্ত চৌরং

চৌরাগ্রগণ্যং পুরুষং নমামি ॥২॥

অনুবাদ: যিনি রাধিকার চিত্ত চোর, যিনি নবজলধর মেঘের কান্তি চোর ও যিনি স্ব-চরণাশ্রিত ভক্তগণের সর্বস্ব হরণ করেন, সেই চোর শিরোমণিকে আমি প্রণাম করি।


অকিঞ্চনীকৃত্য পদাশ্রিতং যঃ

করোতি ভিক্ষুং পথি গেহহীনম্।

কেনাপ্যহো ভীষণচৌর ঈদৃগ্

দৃষ্টঃ শ্রুতো বা ন জগত্রয়েহপি ॥৩॥

অনুবাদ: যিনি স্ব-চরণাশ্রিত ভক্তদের অকিঞ্চন করে (তাদের স্ত্রী-পুত্র, ধনাদি সর্বস্ব হরণ করে) তাদেরকে গৃহহীন ও পথের ভিক্ষুক করেন, তাঁর ন্যায় ভীষণ চোর জগতে কেউ দেখেওনি বা শোনেনি ।


যদীয় নামাপি হরত্যশেষং

গিরি-প্রসারানপি পাপরাশিন্।

আশ্চর্যরূপঃ ননু চৌর ঈদৃগ্

দৃষ্টঃ শ্রুতো বা ন ময়া কদাপি ॥৪॥

অনুবাদ : যাঁর নাম মাত্রেই জীবের পর্বত প্রমাণ পাপরাশি নিঃশেষে হরণ করেন, এরূপ আশ্চর্য চোর আমি কখনও দেখিনি বা শুনিনি।


ধনং চ মানং চ তথেন্দ্রিয়াণি

প্রাণাংশ্চ হৃত্বা মম সর্বমেব।

পলায়সে কুত্র ধৃতোহদ্য চৌর

ত্বং ভক্তিদাম্নাসি ময়া নিরুদ্ধঃ ॥৫॥

অনুবাদ : হে চোর! তুমি আমার ধন, মান, ইন্দ্রিয় ও প্রাণ প্রভৃতি হরণ করে কোথায় পলায়ন করছ ? আমি তোমাকে ভক্তিরজ্জু দ্বারা বেঁধে রাখলাম। 


ছিনৎসি ঘোরং যমপাশবন্ধং

ভিনৎসি ভীমং ভবপাশবন্ধম্

ছিনৎসি সর্বস্য সমস্তবন্ধং

নৈবাত্ননো ভক্তকৃতং তু বন্ধম্ ॥৬॥

অনুবাদ: তুমি মনুষ্য মাত্রেরই ঘোর যমপাশ ছিন্ন করতে পার, তার ভয়ানক সংসার বন্ধনও ছিন্ন করতে পার এমনকি সকলের সবরকম বন্ধন ছিন্ন করতে পার; কিন্তু স্বভক্তকৃত নিজ বন্ধন ছিন্ন করতে পার না।


মন্মানসে তামসরাশিঘোরে

কারাগৃহে দুঃখময়ে নিবদ্ধঃ।

লভস্ব হে চৌর! হরে! চিরায়

স্বচৌর্যদোষোচিতমেব দণ্ডম্ ॥৭॥

অনুবাদ : হে চোর, তুমি ঘোর তমসাচ্ছন্ন দুঃখময় কারাগৃহরূপ আমার হৃদয়ে চিরকালের জন্য নিবদ্ধ হয়ে নিজের চৌর্যকার্যের উপযুক্ত দণ্ড গ্রহণ করো।


কারাগৃহে বস সদা হৃদয়ে মদীয়ে

মদ্ভক্তিপাশদৃঢ়বন্ধন-নিশ্চল সন্।

ত্বাং কৃষ্ণ হে! প্রলয়কোটিশতান্তরেহপি

সর্বস্বচৌর হৃদয়ান্নহি মোচয়ামি ॥৮॥

অনুবাদ : অতঃপর তুমি আমার হৃদয় কারাগারে আমার ভক্তিপাশ দ্বারা দৃঢ়রূপে বদ্ধ হয়ে সর্বদা নিশ্চলভাবে অবস্থান কর। হে কৃষ্ণ! হে আমার সর্বস্ব চোর! শতকোটি প্রলয়াবসানেও হৃদয় কারাগার হতে তোমাকে মুক্ত করব না।


🌿 পুরুষোত্তম ব্রত উৎযাপনের সুফলঃ


১. পৃথিবীর সমস্ত পবিত্র তীর্থ দেহে বিরাজ করে।

২. যে ব্যক্তি গভীর বিশ্বাস ও ভক্তি সহকারে পুরুষোত্তম মাস পালন করেন, তিনি জীবনের অন্তিমে প্রকৃত আলয় গোলক বৃন্দাবনে ফিরে গিয়ে রাধা-গোবিন্দের সেবাধিকার প্রাপ্ত হন।


🌿পদ্মপুরাণে পুরুষোত্তম মাস মাহাত্ম্যে নিম্নোক্ত সমস্ত ব্রতের উল্লেখ রয়েছে।

পুরুষোত্তম মাস মাহাত্ম্য (স্কন্ধপুরাণ ও পদ্মপুরাণ থেকে)


👉ভগবান শ্রীকৃষ্ণঃ

''পুরুষোত্তম ব্রত পালনকারী ব্যক্তি আমার সমস্ত আশির্বাদ প্রাপ্ত হন। যিনি পুরুষোত্তম ব্রত পালন করেন, তাঁর পূর্ব জন্মকৃত সমস্ত পাপকর্মের ফল বিনষ্ট হয়। পুরুষোত্তম ব্রত পালন ব্যতীত কেউ শুদ্ধভক্তি যাজন করতে পারে না। বেদোক্ত সমস্ত তপস্যাদি ও ধর্মীয় কার্যকলাপ থেকেও পুরুষোত্তম ব্রত পালন অধিক গুরুত্ববহ। যে ব্যক্তি পুরুষোত্তম ব্রত পালন করেন, তিনি তার জীবনের অন্তিমে আমার ধাম, গোলক বৃন্দাবনে প্রত্যাবর্তন করেন।''


👉দুর্বাসা মুনিঃ

''পুরুষোত্তম মাসে শুধুমাত্র কোন পবিত্র নদীতে স্নান করার মাধ্যমেই যে কেউ পাপমুক্ত হতে পারেন। অন্যান্য মাসসমূহের মহিমা পুরুষোত্তম মাসের মহিমার ষোল ভাগের এক ভাগের সমানও নয়। পুরুষোত্তম মাসে পবিত্র কোন স্থানে বাস করা, দান করা এবং শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র নাম জপ করার ফলে সমস্ত দুঃখের বিনাশ ঘটে। তিনি সর্বসিদ্ধি প্রাপ্ত হন এবং তাঁর সমস্ত বাঞ্ছা পূর্ণ হয়।''


👉বাল্মীকি মুনিঃ

''পুরুষোত্তম ব্রত পালনের মাধ্যমে একশত অশ্বমেধ যজ্ঞেরও অধিক সুফল লাভ করা যায়। সমস্ত পবিত্র স্থানসমূহ পুরুষোত্তম ব্রত পালনকারী ব্যক্তির দেহে বিরাজ করে। যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে পুরুষোত্তম ব্রত পালন করেন, তিনি গোলক বৃন্দাবন লাভ করবেন ''


👉নারদ মুনি:

''পুরুষোত্তম মাস সমস্ত মাস, ব্রত এবং তপস্যার মধ্যে সর্বোত্তম। শুধুমাত্র বিশ্বাস সহকারে পুরুষোত্তম মাসের মাহাত্ম্য শ্রবণের মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি কৃষ্ণভক্তি লাভ করতে পারেন এবং তৎক্ষণাৎ সমস্ত পাপকর্মের প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত হতে পারেন। যে ব্যক্তি যথাযথভাবে পুরুষোত্তম ব্রত পালন করেন, তিনি অসীম সুকৃতি লাভ করেন এবং চিন্ময় জগতে ফিরে যান।''


👉নৈমিষারণ্যের মুনিগণঃ

''পরম করুণাময় পুরুষোত্তম মাস ভক্তদের সমস্ত বাঞ্ছা পূরণার্থে কল্পতরুর ন্যায় কাজ করে।''

Post a Comment

0 Comments