নদী শুকালে পার হব

 নদী শুকালে পার হব



এক ব্যক্তি অত্যন্ত 'ঘর-পাগলা' ছিল। সে কিছুতেই ঘর ছাড়িয়া অন্য কোন স্থানে যাইতে চাহিত না। একদিন তাহার এক বন্ধু তাহাকে বলি,—"চল কামিনীমােহন ! আমরা দুইজনে সাধু দর্শন করিয়া আসি। শ্রীধাম-মায়াপুরে একজন মহাপুরুষ আসিয়াছেন। তিনি পরম মঙ্গলের বিষয়ে উপদেশ দিতেছেন। সেই মহাত্মার নাম—শ্রীল জগন্নাথদাস বাবাজী মহারাজ। তাঁহার উপদেশ শ্রবণ করিলে মানব-জন্ম-সার্থক হইবে।"


কামিনীমােহন সাধুর উপদেশ শ্রবণ করিবার জন্য কিছুতেই গৃহের আরাম ছাড়িতে প্রস্তুত হইল না। তখন তাহার বন্ধু কামিনীমােহনকে এক প্রলােভন দেখাইয়া বলিল,—"কুলিয়ার চড়ায় আজ খুব বড় মেলা বসিয়াছে ; সেখানে খুব আমােদ-প্রমোদ হইতেছে, না হয়, তাহা দেখিয়া ফিরিয়া আসিও। চল, বেড়াইয়া আসি।" 


কামিনীমােহন তামাসা দেখিবার লােভে তাহার বন্ধুর সহিত কুলিয়ার চড়ায় যাইতে প্রস্তুত হইল। বন্ধুর উদ্দেশ্য—কামিনীমােহনকে কোন কৌশলে কুলিয়ার চড়ায় লইয়া যাইতে পারিলে গঙ্গা পার করিয়াই তাহাকে শ্রীধাম-মায়াপুরে লইয়া যাইতে পারিবে। 


কামিনীমােহন কুলিয়ার চড়ায় আসিয়া কিছুক্ষণ নানাপ্রকার তামাসা দেখিল। তারপর তাহার বন্ধু তাহাকে গঙ্গার তীরে লইয়া গেল এবং বলিল,—"নদী পার হইলেই শ্রীমায়াপুর ; চল, একবার শ্রীধাম দর্শন করিয়া আসি, সেস্থানে শ্ৰীমন্মহাপ্রভর জন্ম-ভিটা আছে, মহাপুরুষগণ আছেন, চাঁদকাজীর সমাধি আছে, বল্লালসেনের ভগ্ন প্রাসাদ, বল্লাল দীঘি প্রভৃতি অনেক কিছু দেখিবার জিনিষ আছে।"


কামিনীমােহন দেখিল, তাহার বন্ধু যেভাবে তাহাকে ধরিয়াছে, তাহাতে তাহার আর নিস্তার নাই। তখন সে মনে মনে এক বুদ্ধি স্থির করিয়া বন্ধুকে বলিল,—"ভাই, নদী পার হইতে আমার বড় ভয় করে। আমি নৌকাতে মােটেই চড়িতে পারি না, চড়িলেই বমি-বমি ভাব হয়, মাথা ঘুরে ও কোন্ সময়ে জলে ডুবিয়া প্রাণ হারাইব, বুক ধড়ফড়, করিতে থাকে। এখন বর্ষাকাল, শীতকাল আসিলে নদী যখন শুষ্ক হইয়া যাইবে, তখন নৌকাতে না চড়িয়া হাঁটিয়াই নদী পার হইতে পারিব। সে সময়ে তোমাকেই সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিব ও শ্রীমায়াপুরে যাইয়া সব দেখিয়া আসিব।" 


কামিনীমােহনের এই কথা শুনিয়া তাহার বন্ধু তাহাকে বলিল,—"দেখ হে, তুমি যে বলিতেছ,—নদী শুকাইলে পার হইবে, তাহা তােমার কপটতা। নদীও শুকাইবে না, কোন দিন পারও হইতে পারিবে না।"


শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গােস্বামী প্রভুপাদ এই গল্পটীর উল্লেখ করিয়া গৃহারামী ও আত্মমঙ্গলের বিষয়ে চিন্তাহীন ব্যক্তিগণকে সর্তক করিতেন। আমরা অনেকেই মনে করি,—সংসারের অভাব, অসুবিধা, নানাপ্রকার বাধা, বিঘ্ন, বিপত্তি, দেহের অসুখ, পুত্র-কন্যার শিক্ষা ও বিবাহ, পরিবারবর্গের ভরণ-পােষণ—এই সকল কাৰ্য্য সুসমাপ্ত করিয়া সাধুর কথা শ্রবণ করিতে যাইব। কিন্তু এই সকল বাধা-বিপত্তি ও অভাব অসুবিধা কোন দিনই যাইবে না, সুতরাং হরিভজনও করিতে পারিব না। জাগতিক অভাব অসুবিধা ত্রিতাপের অন্তর্গত তাপবিশেষ। এইগুলিকে বিতাড়িত করিয়া কেহই এপর্য্যন্ত হরিভজন করিতে পারে নাই। যাহারা কল্পনা করে,—সংসারের অভাব-অসুবিধা দূর হইলে পরে হরিভজন করিবে, তাহাদিগের হৃদয়ে কপটতা আছে। কবে নদী শুকাইবে, সেইজন্য বসিয়া থাকা আত্মবঞ্চনা, অর্থাৎ নদী পার না হইবারই অভিসন্ধি। অভাব, অসুবিধা প্রভৃতি দূর হইলে হরিভজন করিবার ইচ্ছা হরিভজন না করিবারই কপটতাপূর্ণ সঙ্কল্পবিশেষ। আমরা অনেক সময়ে মায়ায় মুগ্ধ হইয়া ইহা বুঝিতে না পারিলেও ঐরূপ বিচারের অন্তরালে হরিভজন না করিয়া নিশ্চিন্তভাবে জীবন-যাপন করিবারই পিপাসা আছে। বৃদ্ধ-বয়সে হরিভজন করিবার বিচারের মধ্যেও এই জাতীয় চিন্তাস্রোতঃ প্রবাহিত রহিয়াছে। 


জগদ্গুরু সচ্চিদানন্দ শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর গাহিয়াছেন,—

'জীবন-সমাপ্তি-কালে করবি ভজন,

এবে করি গৃহসুখ।'

কখন একথা নাহি বলে' বিজ্ঞ-জন,

এ দেহ পতনোন্মুখ॥

আজি বা শতেক বর্ষে অবশ্য মরণ, 

নিশ্চিন্ত না থাক ভাই।

যত শীঘ্র পার, ভজ শ্রীকৃষ্ণ-চরণ,

জীবনের ঠিক নাই॥     

সংসার নির্বাহ করি' যা'ব আমি বৃন্দাবন,

ঋণত্রয় শোধিবারে করিতেছি সুযতন॥

এ আশায় নাহি প্রয়োজন।

এমন দুরাশা-বশে, যা'বে প্রাণ অবশেষে,

না হইবে দীনবন্ধু-চরণ-সেবন॥

যদি সুমঙ্গল চাও, সদা কৃষ্ণনাম গাও,

গৃহে থাক, বনে থাক, ইথে তর্ক অকারণ॥

—কল্যাণকল্পতরু, প্রয়োজন-বিজ্ঞান-লক্ষণ-উপলব্ধি-৪


(#তথ্যসূত্রঃ মহামহোপদেশক শ্রীসুন্দরানন্দ বিদ্যাবিনোদ বিরচিত উপাখ্যান উপদেশ থেকে সংগৃহীত।)

Post a Comment

0 Comments