পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পরমব্রহ্ম। তাঁর থেকেই জগতে সমস্ত কিছু প্রকাশিত হয়েছে-অহং সর্বস্য প্রভবঃ মত্তঃ সর্বং পবর্ততে। (ভ.গী. 10.8)। ব্রহ্মসংহিতায় শ্রীকৃষ্ণকে অনাদির আদি বলে সম্বোধন করা হয়েছে। তিনি সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশ সমস্ত কিছুর মূল কারণ-জন্মাদ্যস্যযতঃ (ভা.১.১.১)। তাঁর শক্তিতেই বিষ্ণু পালন করেন, ব্রহ্মা সৃজন করেন ও শিব সংহার করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনন্ত শক্তির আধার। তবুও তাঁর শক্তিকে প্রধানত তিন ভাবে ভাগ করা হয়েছে- অন্তরঙ্গা শক্তি, বহিরঙ্গা শক্তি তটস্থা শক্তি। তটস্থা শক্তি হচ্ছে জীবশক্তি।
মনুষ্যাদি সকল জীব এই শক্তির অন্তর্গত। বহিরঙ্গা শক্তি হচ্ছে ভগবানের মায়া শক্তি, যাঁর মাধ্যমে এই জড়জগৎ পরিচালিত হচ্ছে। আর অন্তরঙ্গা শক্তিকে আবার সন্ধিনী, সম্বিৎ ও হ্লাদিনী-এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সচ্ছিদানন্দময়। সৎ চিৎ ও আনন্দ এই তিনটির মধ্যে সন্ধিনী হচ্ছে ভগবানের সৎ বিভব, যাঁর দ্বারা তিনি তাঁর নিত্য স্বরূপ ধারণ করে আছেন। শ্রীকৃষ্ণের ধাম, শয্যা, আসন ইত্যাদি সন্ধিনী শক্তির অন্তর্গত। সম্বিৎ শক্তি হচ্ছে চিৎ শক্তি বা জ্ঞান শক্তি। চিৎ শক্তির দ্বারা ভগবান নিজেকে জানেন ও অপরকে তাঁর সম্বন্ধে জানান। হ্লাদিনী শক্তি হচ্ছে ভগবানের আনন্দদায়িনী শক্তি। শ্রীমতি রাধারাণী হচ্ছেন এই হ্লাদিনী শক্তির মূর্ত প্রকাশ। শ্রীকৃষ্ণের লীলার পুষ্টিবিধানের নিমিত্ত রাধারাণী থেকেই বৃন্দাবনের গোপীগণ, দ্বারকার মহিষীগণ এবং বৈকুণ্ঠের লক্ষীগণ প্রকাশিত হয়েছেন। পদ্মপুরাণ, পাতালখন্ড অনুসারে, শ্রীশিব নারদকে বলছেন-
মনুষ্যাদি সকল জীব এই শক্তির অন্তর্গত। বহিরঙ্গা শক্তি হচ্ছে ভগবানের মায়া শক্তি, যাঁর মাধ্যমে এই জড়জগৎ পরিচালিত হচ্ছে। আর অন্তরঙ্গা শক্তিকে আবার সন্ধিনী, সম্বিৎ ও হ্লাদিনী-এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সচ্ছিদানন্দময়। সৎ চিৎ ও আনন্দ এই তিনটির মধ্যে সন্ধিনী হচ্ছে ভগবানের সৎ বিভব, যাঁর দ্বারা তিনি তাঁর নিত্য স্বরূপ ধারণ করে আছেন। শ্রীকৃষ্ণের ধাম, শয্যা, আসন ইত্যাদি সন্ধিনী শক্তির অন্তর্গত। সম্বিৎ শক্তি হচ্ছে চিৎ শক্তি বা জ্ঞান শক্তি। চিৎ শক্তির দ্বারা ভগবান নিজেকে জানেন ও অপরকে তাঁর সম্বন্ধে জানান। হ্লাদিনী শক্তি হচ্ছে ভগবানের আনন্দদায়িনী শক্তি। শ্রীমতি রাধারাণী হচ্ছেন এই হ্লাদিনী শক্তির মূর্ত প্রকাশ। শ্রীকৃষ্ণের লীলার পুষ্টিবিধানের নিমিত্ত রাধারাণী থেকেই বৃন্দাবনের গোপীগণ, দ্বারকার মহিষীগণ এবং বৈকুণ্ঠের লক্ষীগণ প্রকাশিত হয়েছেন। পদ্মপুরাণ, পাতালখন্ড অনুসারে, শ্রীশিব নারদকে বলছেন-
দেবী কৃষ্ণময়ী প্রোজ্বা রাধিকা পরদেবতা।
সর্বলক্ষ্মীস্বরূপা সা কৃষ্ণাহ্লাদস্বরূপিণী।।
ততঃ সা প্রোচ্যতে বিপ্র হ্লাদিনীতি মনীষিভিঃ।
তৎকলাকোটিকোট্যংশা দুর্গাদ্যাস্ত্রিগুণাত্মিকাঃ।।
সা তু সাক্ষান্মহালক্ষীঃ কৃষ্ণো নারায়ণো প্রভুঃ।
নৈতয়োর্বিদ্যতে ভেদঃ স্বল্পোহপি মুনসত্তম।।
(৫০/৫৩/৫৫)
দেবী রাধিকা, কৃষ্ণময়ী,পরদেবতা, সর্বলক্ষ্মীস্বরূপা; তিনি কৃষ্ণাহ্লাদস্বরূপিণী, এজন্য মনীষীগণ তাঁকে হ্লাদিনী বা আনন্দদায়িনী বলেন। ত্রিগুণময়ী দুর্গা প্রভৃতি শক্তিগণ তাঁরই কলার কোটি কোটি অংশের একাংশ। শ্রীরাধাই মহালক্ষ্মী, আর শ্রীকৃষ্ণই সাক্ষাৎ প্রভু নারায়ণ। হে মনিসত্তম, এঁদের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। অর্থাৎ, শ্রীমতি রাধারাণী যে শ্রীকৃষ্ণের অবিচ্ছেদ্য হ্লাদিনী শক্তি এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই। তাঁরা পরস্পর নিত্যসঙ্গী। গোলোক বৃন্দাবন ধামে তাঁরা নিত্য লীলা বিলাস করছেন।
শক্তি-শক্তিমান অভেদ
রাধারাণীর চিজ্জগতে প্রকাশ সম্বন্ধে নারদ পঞ্চরাত্রে (২/৩/২৬) বলা হয়েছে-
দ্বিভুজ সোহপি গোলোকে বভ্রাম রাসমন্ডলে।
গোপবেশশ্চ তরুণ জলদশ্যামসুন্দরঃ।।
এক ইশঃ প্রথমতো দ্বিধারূপো বভুব সঃ।
একা স্ত্রী বিষ্ণুমায়া যা পুমানেকঃ স্বয়ং বিভূঃ।।
নবমেঘের ন্যায় শ্যামসুন্দর ও গোপবেশধারী সেই দ্বিভুজ তরুণ বিভক্ত হলেন। তাঁর এক ভাগ স্ব্রী হলো, তাঁকে বিষ্ণুমায়া বলে এবং অপরভাগে তিনি স্বয়ং বিভু পুরুষরূপে রইলেন।
চৈতন্যচরিতামৃতে আদিলীলায় (৪/৯৭) বলা হয়েছে-
রাধা-পূর্ণশক্তি, কৃষ্ণ-পূর্ণশক্তিমান।
দুই বস্তু ভেদ নাই, শাস্ত্র-পরমাণ।।
মৃগমদ, তার গন্ধ-যৈছে অবিচ্ছেদ।
অগ্নিজ্বালাতে যৈছে নাহি কভু ভেদ।।
রাধাকৃষ্ণ তৈছে সদা একই স্বরূপ।
লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুইরূপ।।
শ্রীমতি রাধারাণী হলেন পূর্ণ শক্তি এবং শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণ শক্তিমান। তাই তাঁদের মধ্যে কোনো ভেদ নেই-একথা শাস্ত্রে প্রমাণিত। কস্তুরী থেকে তার গন্ধকে যেমন আলাদা করা যায় না, আগুন থেকে তার তাপকে যেমন আলাদা করা যায় না, তেমনি রাধাকৃষ্ণও কেবল লীলার নিমিত্তে দুইরূপে বিলাস করেছেন। তাই রাধাকৃষ্ণ দুই দেহে বিলাস করলেও স্বরূপত তাঁরা এক।
রাধা-কৃষ্ণের ভৌমলীলার কারণ
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ইচ্ছাময়। তাঁর ইচ্ছাতেই সমস্ত সৃষ্টি পরিচালিত হচ্ছে। তিনি স্বধাম গোলোক বৃন্দাবনে নিত্য লীলা বিলাস করছেন। নিত্যলীলার পাশাপাশি এই জগতে আবির্ভূত হয়েও তিনি তাঁর লীলা বিস্তার করেন। ভগবদ্গীতার সিদ্ধান্ত অনুসারে যখনই ধর্মের গ্লানি হয় ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন ভগবান সাধুদের পরিত্রাণ ও দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এই জগতে আবির্ভূত হন। (ভ.গী. ৪,৮)। ভগবানের পুরুষাবতার বিষ্ণুর মাধ্যমেই তিনি এই ধর্ম সংস্থাপনের কাজ করতে পারেন। কিন্তু ব্রহ্মার একদিনে স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একবার এই জগতে অবতীর্ণ হন তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্তদের আনন্দ বিধানের নিমিত্তে।
তিনি যখন এ জগতে আসেন, তখন তিনি একা আসেন না; তিনি তাঁর শক্তি, ধাম ও পরিকরসহ অবতীর্ণ হন। আমরা যে কলিযুগে বাস করছি, তার অব্যবহিত পূর্বের দ্বাপরেই ভগবান স্বয়ং অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এই লীলাকে ভগবানের নরলীলা বলা হয়। তিনি সাধারণ মানুষের মতোই লীলা করেন। তাই প্রকৃত দৃষ্টিতে ভগবানের এই লীলাকে মনুষ্যবৎ জ্ঞান হবে। তবে নরলীলায়ও তাঁর ভগবত্তা প্রকাশের কমতি ছিল না। পূতনা বধ লীলা, যশোদা মাতাকে বিশ্বরূপ প্রদর্শন, দাবানল গ্রাস, কংস প্রেরিত অসুর সংহারসহ গোবর্ধনধারণের মতো বহু অলৌকিক লীলা তিনি এই ভৌমলীলায় প্রদর্শন করেছিলেন।
যা তাঁর ভগবত্তাকে পরিস্ফুষ্ট করে। সেই সাথে তিনি দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর-এই চার রসের ভক্তবৃন্দের সাথে লীলাভিনয় করেছিলেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বন্দাবনে নন্দ যশোদার পুত্ররূপে এবং শ্রীমতি রাধারাণী বৃষভানু ও কীর্তিদার কন্যারূপে লীলা করেন। শাস্ত্রে তাঁদের আবির্ভব ও বিভিন্ন লীলার প্রসঙ্গ বর্ণিত আছে। আমাদের এবারের আলোচ্য বিষয় লীলা নয়, বরং রাধাকৃষ্ণের সম্পর্কের মূল অনুসন্ধান।
আমরা ইতোমধ্যে জানতে পারলাম যে, সচ্চিদানন্দময় ভগবান তাঁর ভক্তদের আনন্দ বিধানের জন্য এই জগতে লীলাভিনয় করেন।‘১৮ সংখ্যায় এ প্রসঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ রয়েছে। তাই এখানে এর আলোচনা বিশদ করা হলো না। যাহোক, তাঁর সাথে আমরা কখনোই সাধারণ মানুষের তুলনা করতে পারি না, কেননা তিনি পুতনা বধ, কালীয় দমন ও গোবর্ধন ধারণের মতো অলৌকিক কার্যও সম্পাদন করেছেন।
তাই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীমতি রাধারাণীর প্রেমকে সাধারণের সাথে তুলনা করার পূর্বে তাঁর পূর্বাপর অন্যান্য লীলারও তুলনা করতে হবে। শ্রীল প্রভুপাদ ভাগবতের (২.৭.৬) তাৎপর্যে লিখেছেন- “ময়রা কখনো মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হয় না। সর্বক্ষণ মিষ্টি তৈরি করছে যে ময়রা তার মিষ্টি খাওয়ার কোনো বাসনা থাকে না; তেমনই ভাগবান তাঁর হ্লাদিনী শক্তির প্রভাবে অসংখ্য চিন্ময় সুন্দরীদের সৃষ্টি করতে পারেন এবং তাই তাঁর জড় সৃষ্টির মায়িক সুন্দরীদের প্রতি লেশমাত্র আকর্ষণ নেই।
তিনি যখন এ জগতে আসেন, তখন তিনি একা আসেন না; তিনি তাঁর শক্তি, ধাম ও পরিকরসহ অবতীর্ণ হন। আমরা যে কলিযুগে বাস করছি, তার অব্যবহিত পূর্বের দ্বাপরেই ভগবান স্বয়ং অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এই লীলাকে ভগবানের নরলীলা বলা হয়। তিনি সাধারণ মানুষের মতোই লীলা করেন। তাই প্রকৃত দৃষ্টিতে ভগবানের এই লীলাকে মনুষ্যবৎ জ্ঞান হবে। তবে নরলীলায়ও তাঁর ভগবত্তা প্রকাশের কমতি ছিল না। পূতনা বধ লীলা, যশোদা মাতাকে বিশ্বরূপ প্রদর্শন, দাবানল গ্রাস, কংস প্রেরিত অসুর সংহারসহ গোবর্ধনধারণের মতো বহু অলৌকিক লীলা তিনি এই ভৌমলীলায় প্রদর্শন করেছিলেন।
যা তাঁর ভগবত্তাকে পরিস্ফুষ্ট করে। সেই সাথে তিনি দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর-এই চার রসের ভক্তবৃন্দের সাথে লীলাভিনয় করেছিলেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বন্দাবনে নন্দ যশোদার পুত্ররূপে এবং শ্রীমতি রাধারাণী বৃষভানু ও কীর্তিদার কন্যারূপে লীলা করেন। শাস্ত্রে তাঁদের আবির্ভব ও বিভিন্ন লীলার প্রসঙ্গ বর্ণিত আছে। আমাদের এবারের আলোচ্য বিষয় লীলা নয়, বরং রাধাকৃষ্ণের সম্পর্কের মূল অনুসন্ধান।
আমরা ইতোমধ্যে জানতে পারলাম যে, সচ্চিদানন্দময় ভগবান তাঁর ভক্তদের আনন্দ বিধানের জন্য এই জগতে লীলাভিনয় করেন।‘১৮ সংখ্যায় এ প্রসঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ রয়েছে। তাই এখানে এর আলোচনা বিশদ করা হলো না। যাহোক, তাঁর সাথে আমরা কখনোই সাধারণ মানুষের তুলনা করতে পারি না, কেননা তিনি পুতনা বধ, কালীয় দমন ও গোবর্ধন ধারণের মতো অলৌকিক কার্যও সম্পাদন করেছেন।
তাই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীমতি রাধারাণীর প্রেমকে সাধারণের সাথে তুলনা করার পূর্বে তাঁর পূর্বাপর অন্যান্য লীলারও তুলনা করতে হবে। শ্রীল প্রভুপাদ ভাগবতের (২.৭.৬) তাৎপর্যে লিখেছেন- “ময়রা কখনো মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হয় না। সর্বক্ষণ মিষ্টি তৈরি করছে যে ময়রা তার মিষ্টি খাওয়ার কোনো বাসনা থাকে না; তেমনই ভাগবান তাঁর হ্লাদিনী শক্তির প্রভাবে অসংখ্য চিন্ময় সুন্দরীদের সৃষ্টি করতে পারেন এবং তাই তাঁর জড় সৃষ্টির মায়িক সুন্দরীদের প্রতি লেশমাত্র আকর্ষণ নেই।
0 Comments