গৌরপূর্ণিমা উপলক্ষে শ্রীল জয়পতাকা স্বামী গুরুমহারাজের বিশেষ প্রবচন। ২৮/০৩/২০২১‚ মায়াপুর‚ ভারত।

 গৌরপূর্ণিমা উপলক্ষে শ্রীল জয়পতাকা স্বামী গুরুমহারাজের বিশেষ প্রবচন। ২৮/০৩/২০২১‚ মায়াপুর‚ ভারত।


আজকে একটা পবিত্র দিন। এই শ্লোকটি আমাদেরেকে দেখায় যে আমরা কত ভাগ্যবান। কৃষ্ণ এসেছেন কৃষ্ণপ্রেম বিলি করতে। পূর্বে বা আগেকার দিনে কৃষ্ণের কৃপা পেতে গেলে কৃষ্ণের শরণাপন্ন হতে হতো। কিন্তু এখন ভগবান চৈতন্যদেব তিনি কৃষ্ণপ্রেম বিলি করছেন। কি মহান একটা সুযোগ! এই সুবিধা না নিলে বোকামি ছাড়া আর কি বলব! ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তিনি এসেছেন, তিনি এসে নৃত্য করেছেন, কীর্তন করেছেন। তিনি সবাইকে আলিঙ্গন করে কৃষ্ণপ্রেম বিতরণ করলেন। সার্বভৌম ভট্টাচার্য তিনি একজন মায়াবাদী ছিলেন। কিন্তু ভগবান চৈতন্যদেব অত্যন্ত সুদক্ষতার সাথে তাঁর ভক্তি উৎকর্ষ করেছেন। এক সপ্তাহের মধ্যে বা সেরকম কিছু সময়ের মধ্যে তিনি সার্বভৌম ভট্টাচার্যকে তিনি শুদ্ধভক্তে পরিণত করেছেন। এমনকি তিনি তাঁর কক্ষে গিয়েছেন মঙ্গলারতির পরে। তিনি তাঁকে কিছু মহাপ্রসাদ দিয়েছেন। সার্বভৌম ভট্টাচার্য তিনি হাত-মুখ না ধুয়েই শয্যায় বসেই তিনি সেই প্রসাদ গ্রহণ করেছেন। তখন মহাপ্রভু তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি তোমার স্মার্ত ব্রাহ্মণসুলভ যে নিয়ম আছে সেগুলো পালন করলে না তো? তারপরে সার্বভৌম ভট্টাচার্য তিনি একটি শ্লোক উদ্ধৃতি করলেন যে‚ “প্রসাদ প্রাপ্তমাত্রেন ভুক্তব্যম্”। এইভাবে তাঁর আমূল পরিবর্তন হয়েছে এবং তিনি ভক্ত হয়ে গেছেন।


   এই তিথিতে যখন চন্দ্রগ্রহণ হয় তখন তিনি এসেছেন। সেই চন্দ্রগ্রহণের সময় সমস্ত হিন্দুরা নদীর তীরে পবিত্র নাম জপ কীর্তন করছেন। কিন্তু নিয়ম ছিল তখনকার দিনে পবিত্র নাম জোরে উচ্চারণ করা উচিত নয়। কিন্তু কেউ যদি গঙ্গাজলে থাকেন তাহলে তখন সেটা করা যেতে পারে। যখন ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভু জগতে অবতীর্ণ হয়েছেন সকলে সর্বত্রই ভগবানের পবিত্র নাম জপ কীর্তন করছেন। এমনকি নবদ্বীপে যাঁরা অহিন্দু তারাও পর্যন্ত ঠাট্টার ছলে‚ ‘দেখ দেখ এরা কেমন হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ করছে, হা হা হা হা; হরে কৃষ্ণ করছে সব।’ 


    এইভাবে আমরা ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভুর লীলা স্মরণ করি এবং সেই লীলার উপরে আমরা ধ্যান করি। কেননা তাঁর লীলা, তাঁর নাম, তাঁর রূপ সব এক। যখন কেউ তাঁর নাম এবং গুণাবলির চিন্তা করেন, অথবা লীলা তখন তাঁরা এইভাবে ভগবানের উপর ধ্যান করে থাকেন। এইজন্য আমরা ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভুর বিষয় প্রত্যেকদিন আলোচনা করি। কারণ তাঁর লীলা ইত্যাদি আলোচনা করার মাধ্যমে আমরা তাঁর ধ্যান করে থাকি। যখন চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব হয়েছে তখন প্রতিবেশী মহিলারা সব এসেছেন এবং তাঁরা এসে দেখেছেন যে শচীমাতার গৌরবর্ণের একটি বালক হয়েছে। এমনকি অন্যান্য উর্ধ্বলোকের দেবীগণ তাঁরা ব্রাহ্মণীর রূপ ধারণ করে তাঁরা এসেছেন দেখতে। ভগবান পারমার্থিক জগৎ থেকে এই জগতে অবতরণ করেছিলেন। 

    নবদ্বীপে যে স্থানে আবির্ভূত হয়েছিলেন সেই স্থানকে বলা হয় যোগপীঠ অর্থাৎ এই জগতের সাথে তাঁর যেখানে যোগ হয়েছিল। অন্যান্য যুগে ভগবান পরম পুরুষোত্তম ভগবানরূপে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। এই কারনেই তাঁর একটি নাম হচ্ছে ত্রিযুগ। কিন্তু এই কলিযুগে আচ্ছন্ন বা ছন্ন অবতার রূপে তিনি অবতীর্ণ হন। ভক্তরূপে ওনি এসেছেন। এটা আমাদের পক্ষে একটি অত্যন্ত বিরল সুযোগ পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গলাভ করার। যখন ভাগী মহারাজ গঙ্গাকে স্বর্গলোক থেকে নিম্নে আনয়ন করছিলেন সেইসময় গঙ্গা নদী জহ্নুমুনির আশ্রমকে প্লাবিত করছিল। জহ্নুমুনি পুরো গঙ্গা নদীকে গণ্ডুষে পান করে নিলেন। ভাগী মহারাজ একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন যে, গঙ্গা গেল কোথায়? নবদ্বীপের নয়টি দ্বীপ এর অন্যতম একটি দ্বীপ হচ্ছে জহ্নুদ্বীপ। তারপর উনি উপলব্ধি করলেন যে এই জহ্নুমুনি গঙ্গাকে গিলে ফেলেছেন। তিনি জহ্নুমুনির কাছে প্রার্থনা করলেন যে, দয়া করে গঙ্গাদেবীকে  আবার পুনর্বহাল করুন। আমি তাঁকে আপনার আশ্রম থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাব। তিনি বললেন, আমি দুঃখিত আমি তাঁকে হজম করে ফেলেছি। ভাগী মহারাজ বললেন, আপনার যদি গঙ্গাকে পান করার ক্ষমতা হয় তাহলে আপনি গঙ্গাকে পুনর্জন্মও দিতে পারেন। তখন জহ্নুমুনি গঙ্গাকে পুনর্জন্ম দিলেন তাঁর জানু থেকে বা হাঁটু থেকে। সেইজন্য তাঁর অপর নাম হচ্ছে জাহ্নবী। ঠিক চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থানের অনতিদূরে তিনি থেমে গেলেন। ভাগী মহারাজ তিনি কত রকমের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। তিনি প্রার্থনা করলেন পুনরায়, “আপনি কেন থেমে গেলেন?” তখন তিনি বললেন যে, এখন প্রায় চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথি আসছে তাই ঐ তিথির জন্য আমি এখানে থাকব। এবং সেইজন্য যদি কেউ এই তিথিতে গঙ্গায় স্নান করেন তাহলে তাঁরা কৃষ্ণপ্রেম লাভ করে থাকেন। যদি তাঁরা গৌরাঙ্গের জন্মস্থানের নিকটবর্তী গঙ্গাতে যদি স্নান করেন। আজকে কিছু সমস্যাও রয়েছে গঙ্গায় স্নান করার কারণ আজকের দিনে হোলি খেলা হয়ে থাকে। অতএব আপনারা যদি গঙ্গায় স্নান করতে যান তাহলে হয়তো আপনাদেরকে রং মাখিয়ে দেবে। কমপক্ষে দুপুরবেলা পর্যন্ত তো এরকম হয়। আমরা দেখি যে গঙ্গার সাথে চৈতন্য মহাপ্রভুর বিশেষ কিছু লীলা রয়েছে। তিনি প্রতিদিন গঙ্গার জলে গিয়ে স্নান করতেন। এবং যখন তিনি শ্রীবাস ঠাকুরের গৃহে কীর্তন করতেন শ্রীবাস ঠাকুরের সেবিকা দুঃখিনী কলসি কলসি করে গঙ্গাজল নিয়ে আসতেন। সেই গঙ্গাজল দিয়ে তাঁরা মহাপ্রভুর অভিষেক করতেন। তখন চৈতন্য মহাপ্রভু বললেন, তাঁর নাম দুঃখিনী হওয়া উচিত নয় তাঁর নাম হওয়া উচিত সুখিনী। 


    চৈতন্য মহাপ্রভু ভবিষ্যৎবাণী দিয়েছিলেন,“পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম। সর্বত্র প্রচার হবে মোর নাম।।” শ্রীল প্রভুপাদ সেটা শুরু করেছিলেন। আমাদের সেটা পূর্ণ করা উচিত। আমাদের সেটা সম্পূর্ণ করা উচিত। মানুষেরা মহা পরীক্ষার মধ্যে অধঃপতিত হয়েছে এই অতিমারীর কারণে। এটাই হচ্ছে আমাদের সুযোগ সকলকেই হরিনাম জপ কীর্তনে নিযুক্ত করার জন্য। 


   আজকের দিনটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিন। ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভু এই জগতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ৫৩৫ বছর পূ্র্বে; অনুত্তম প্রভুর কথা অনুযায়ী। এবং এটা হচ্ছে শ্রীল প্রভুপাদের ১২৫ তম আবির্ভাব বর্ষ। এই বছর আমাদের শ্রীল প্রভুপাদ ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর যে পরিচিতি তা বৃদ্ধি করার জন্য আমাদের শুরু করা উচিত। শ্রীল প্রভুপাদের ইতিহাস এবং শ্রীল প্রভুপাদের বিষয়ে প্রচার করা হচ্ছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর গুণমহিমা প্রচার করা। কেননা শ্রীল প্রভুপাদের আবির্ভাব শ্রীচৈতন্যদেবের সেবার জন্য। ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভু সকলকে অনুরোধ করেছেন যে তারা যেন বৈরাগী হয় অথবা তারা যদি গৃহী হয় সকলেই যেন ভগবানের নাম কীর্তন করেন। শঙ্করাচার্য শিক্ষা দিয়েছেন যদি আপনি মুক্তি পেতে চান তবে আপনাকে সন্ন্যাসী হতে হবে। ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন‚ “গৃহে থাক, বনে থাক, সদা হরি বলে ডাক।” এবং আপনারা কৃষ্ণপ্রেম লাভ করতে পারেন যা হচ্ছে মুক্তির থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ স্তর। এই ছিল শ্রীল অভয়চরনারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ও শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রভুপাদ এর শিক্ষা। শ্রীল প্রভুপাদ চেয়েছিলেন শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের সমস্ত শিষ্যবৃন্দরা তাঁরা সকলেই একত্রিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চৈতন্য মহাপ্রভুর এই শিক্ষা প্রসার এবং প্রচার করবেন। যাইহোক এটাই হচ্ছে আমাদের নীতি এই ইসকনের মধ্যে।


    এই জন্য আমরা দেখি চৈতন্যদেব বলেছিলেন‚ “ভারত ভূমিতে হইল মনুষ্যজন্ম যার‚ জন্ম সার্থক করি কর পরোপকার।” আমরা এখন দেখে থাকি যে বিভিন্ন পাশ্চাত্য দেশের মধ্যে কত ভক্তরা এসেছেন তাঁরা সব ভারতবর্ষ থেকে। এটা তাদের কর্তব্য তাঁরা তাদের নিজের জীবন সার্থক করবে এবং চৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করবে। এখন সকাল ৮:০০ টা বাজে এখন দর্শন আরতির সময় হয়ে গিয়েছে। আজকে শ্রীধাম মায়াপুরের শ্রীবিগ্রহগণ সকলেই নূতন বস্ত্র পরিধান করবেন।

Post a Comment

0 Comments